বাসার গলিতে ভয়ালদর্শন দুটো কুকুর দেখছি এ পাড়ায় আসার পর থেকেই। গলিতে ঢুকতে গেলে আক্রমণাত্মকভাবে ছুটে এসে প্রায়ই ভয় পাইয়ে দিতো। করোনাকালের প্রথম দিকে সবাই যখন বাসায় আটকা, রাস্তার বেওয়ারিশ প্রাণীকুলের খাবারের ঘাটতি দেখা দেয়। এই কুকুর দুটি তখন করুণভাবে চিৎকার করতো, কান্নার মত, দিনে রাতের বিভিন্ন সময়ে। তারপর একসময় সে কান্না থেমে গেলো; যেনো বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছে কুকুর দুটি। যেনো বুঝে গেছে যে মনুষ্য প্রজাতির কেউ এখন আর খাবার দেবে না...
কিন্তু মানুষতো শুধু নিজের আকৃতির জন্য মানুষ নয়, বরং পৃথিবীর সকল প্রাণীর জন্য মায়া আর দায়িত্ববোধ নিয়েই সে মানুষ। আমার ব্যালকনি থেকে একদিন দেখি অবিন্যস্ত চুলের এক ছেলে পাত্রে খাবার নিয়ে ওই কুকুরগুলোকে দিচ্ছে। এরপরও দেখেছি অনেকদিন। কুকুরগুলোর সাথে তার একধরনের বন্ধুত্বও হয়েছে। যেহেতু ওই যুবক, জয়া আহসান বা সেলিব্রেটি কিসিমের কেউ নয়, সুতরাং কোনো ফটো সাংবাদিক তার ছবি তোলেনি, তার এই মমত্ববোধের সংবাদ ছাঁপা হয়নি কোনো পত্রিকায়। তার ছবি বা খবর আসুক পত্রিকায়, সেরকম সে চায় বলেও হাবভাবে মনে হয়নি।
আমি মনে মনে এক ধরনের শ্রদ্ধা বোধ করতে শুরু করলাম চেহারায় বিশেষত্বহীন এই ছেলেটির প্রতি।
হুমায়ূনের কোনো একটা গল্পে শফিক নামের একটি চরিত্র আছে। (গল্পের নামটা মনে আসছে না, সম্ভবত রাজীব নুর বলতে পারবেন, উনি প্রচুর পড়েন)। এই শফিক সাহেব প্রতিমাসে বেতনের সব টাকা খরচ করে গরীব দুঃখীদের চিকিৎসা করান। কর্মজীবনের শুরুর দিকে এ রকম এক বাচ্চার চিকিৎসা করাতে গিয়ে বাচ্চাটি মারা যায়। তারপর থেকে তাঁর মধ্যে এক ধরনের জেদ চেপে যায় এবং তিনি খুঁজে খুঁজে দরিদ্র, অসহায় মানুষের উপকার করার জন্য ছুটে বেড়ান। এদিকে নিজের পরিবারে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা!!
মধ্যবিত্ত বাঙালিমানস হুমায়ূন যত ভালোভাবে বুঝেছিলেন এবং আঁকতে পেরেছিলেন, নিঃসন্দেহে অন্য কেউ তা পারেনি। তেমনি, এই শফিক নামের চরিত্রের মত ঘরের খেয়ে পরের মোষ তাড়ানোর নেশা আমাদের অনেকের মধ্যেই আছে। হ্যাঁ, এটা এক ধরনের নেশাই বটে! এ এমনই এক নেশা, যেখানে ফটো তুলে বিখ্যাত হওয়ার কোনো বিষয় নেই, নিজের ব্যক্তিজীবন নিয়ে কোনো চিন্তা নেই, নেই নিজের ফ্যামিলির দিকে নজর দেয়ার সময়টুকুও। এখানে শুধু পরোপোকারটুকুই মূখ্য।
শীর্ষেন্দুর ‘যাও পাখি'তে এরকম একজন মানুষ, সোমেনের বাবা সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘ঘর জ্বালানী কিন্তু পর ভুলানি’। এই লাইনটা পড়ার পর আমি তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ আমি এই ভদ্রলোককে প্রত্যক্ষ করেছি। তিনি আমার নিজেরই বাবা। যাও পাখিতে সোমেনের বাবার চরিত্র আর আমার বাবার চরিত্র হুবহু এক। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় কিভাবে আমার বাবার চরিত্রকেই খুঁজে পেলেন সেটা ভেবে বেশ অবাক হয়েছিলাম! একজন বড় লেখকের এটাই তো কৃতিত্ব যে তিনি সমাজের সব ধরনের চরিত্রকেই খুঁজে পান এবং লেখায় তুলে আনেন।
পরিবারের সদস্য হিসেবে আমরা সবসময় একটা অন্তর্জ্বালার মধ্যে থাকতাম বাবাকে নিয়ে। অন্যদিকে আমাদের এলাকার, গ্রামের সবার কাছে বাবা হলেন আপনের চেয়েও আপন। সবার বিপদে-অবিপদে তিনি পাশে থাকেন। অবশ্য জীবনের মধ্যাহ্নে এসে বাবার সে চরিত্রের জন্য এখন গর্বিত হই। মনে হয়, ওটাই তো ঠিক। এই নশ্বর পৃথিবীতে মানুষের জীবনের দৈর্ঘ্য আর কতটুকুই বা লম্বা! জীবনকে পৃথিবীর সময়ের চেয়ে লম্বা করতে গেলে ‘ঘর জ্বালানী কিন্তু পর ভুলানি’ হওয়া ছাড়া উপায় তো নেই। এই তাড়না থেকেই তো ‘নীরজা’ মুভিতে নীরজারুপী সোনম কাপুর বলেছিলেন- বাবুমশায়, জিন্দেগী বড়ি হোনে চাহিয়ে, লম্বি নেহি।
এই করোনায় আমি এ রকম অনেককেই দেখলাম যারা জিন্দেগীকে বড় করতে চেয়েছে। আবার অনেককেই পাওয়া গেলো জিন্দেগী লম্বা করতে যেয়ে যারা আদতে নিজেকেসহ পরিচিতজনদেরকে ছোট করে ফেলেছে। একটা দুর্যোগকাল আমাদের চরিত্রকে কতোভাবেই না দেখিয়ে দিলো!
এখনকার সময়ে গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উছলে পড়া রোশনাইয়ে আলোকিত হওয়ার সুপ্ত আকাঙ্খা চাপা দিয়ে রাখা আমাদের জন্য খুবই কষ্টকর। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই যাদের ‘হাই বন্ধুরা, শুভ সকাল’ বলে নিজেকে জাহির করার অভ্যাস, তাদের কাছে করোনা একটা মহাসুযোগ হয়েই এসেছিলো। ত্রাণ বা খাবারের প্যাকেট দিয়ে তারাও মহান হওয়ার দৌঁড়ে শামিল হতে চেয়েছে। কিন্তু এই উদ্যোগের ছবি তোলা এবং ফেসবুকে আপলোড দিয়ে সাধুবাদ পাওয়ার আকাঙ্খাযজ্ঞে পড়ে বিষয়টা অনেকাংশেই ভেস্তে গিয়েছে।
এই নার্সিসিজম সুনামির মধ্যেও নিরবে নিভৃতে গলির ওই কুকুরকে খাওয়ানো ছেলেটার মত মানুষদেরকে আমি তাই শ্রদ্ধা জানাই। ‘যাও পাখি’র সোমেনের বাবার মতই জামশেদ নামে নোয়াখালীর এক অদম্য যুবককে আমি চিনি। আমারই বয়সী। কিছু বছর আগে কি এক খেয়ালে চাকরিবাকরি ছেড়ে দিয়ে বনের মোষ তাড়াতে লেগে গেলেন এবং অদ্যাবধি সেটাই করে চলেছেন। নিজের মত আরও কয়েকজনকে সাথে নিয়ে সম্পূর্ণ’ ব্যক্তি উদ্যোগে নোয়াখালী, ঢাকা, বগুড়া, পাবনাসহ আরও বিভিন্ন যায়গায় দুঃস্থ অসহায় মানুষের সাহায্য করে বেড়ান।
এ সংখ্যা নিতান্তই কম নয় এবং বলা ভালো, সাময়িক বিচ্যুতির মধ্যেও প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশের পরিচয় এটাই। আমার খুব আবেগের সাথে মনে পড়ে ‘জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা’য় মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়ার বলা এক ক্ষীণকায়া বৃদ্ধার কথা। লেখকের কুমিল্লায় ফিল্ড অপারেশনে শত্রুযান অ্যামবুশের জটিল মুহুর্তে এই বৃদ্ধা মা পরম মমতায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্না করা খাবার নিয়ে ট্রেঞ্চে চলে এসেছিলেন ভয়ডরহীনভাবে।
ওই নাম না জানা ছেলেটি, জামশেদ বা ওই বৃদ্ধার মত আলোকিত মানুষগুলো কখনওই প্রচারের আলোয় আসবেন না। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কর্পোরেট সিএসআর এর যুগে ‘টক অব দ্য টাউন’ হবেন না কোনদিনও। অবশ্য এ নিয়ে তাঁদের কোনো আক্ষেপও নেই, চিন্তাও হয়নি কোনোদিন; বরং অবচেতন মনেই তারা চেয়েছেন তাঁদের জীন্দেগী যেন বড়ই হয়, লম্বা নয়।
ছবি: ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত