নিজের একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা দিয়েই শুরু করি। মাত্র ব্যাংকে জয়েন করেছি। সে সময়ে ব্যাংকগুলোর যৌথ আয়োজনে একটা আন্তর্জাতিক সেমিনার হচ্ছিল। একদম নতুন এবং জুনিয়র হয়েও কিভাবে কিভাবে ওই আয়োজনের প্রকাশনা বিভাগে কাজ করার সুযোগ হয়ে গেলো। তারই অংশ হিসেবে একদিন একজন প্রাক্তন উপব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে গেলাম। ওই ভদ্রলোকের কক্ষে ঢোকার পর উনি আমাকে বসতেই বললেন না। পাশে ফাঁকা চেয়ার রেখে আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলে কাজ সেরে চলে আসলাম।
বেশ অবাক লাগলো। একজন আগন্তুক, সে বয়সে বা পদে যত ছোটই হোক না কেন, তাকে বসতে বলার মত সৌজন্যতাটুকু মানুষ কেন দেখাবে না?
আমি জানি এই ঘটনা দিয়ে পুরো সমাজকে বিচার করাটা অর্থহীন। কিন্তু দিনে দিনে আমাদের সৌজন্যতাবোধ কমে যাওয়ার একটা দৃষ্টান্ততো এটা বটেই। আগে পরিচিত-অপরিচিত কারো সাথে দেখা হলে মানুষ সালাম দিতো। এখন ওসবের কোনো বালাই নেই। তার উপর প্রথম দৃষ্টিতেই আমরা এখন মানুষের সামাজিক অবস্থান বিচার করি, তারপর কথা শুরু করি। নিজের থেকে নিচের অবস্থানে হলেই সম্বোধন হয়ে যায় ‘তুমি’, ক্ষেত্রবিশেষে ‘তুই’। সে অপরপক্ষ বয়সে বড় বা ছোট যাই হোক না কেন!
রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন সময়ে ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরী একটা সামাজিক আন্দোলন শুরু করেছিলেন “অপরিচিতজনকে আপনি বলুন”। বলাবাহুল্য, সেই আন্দোলন হালে পানি পায়নি! সম্বোধন যদি একই হবে, তাহলে আর আমাদের ভাষায় আপনি-তুমি-তুই এর এত স্তর কেন?!! বোধকরি, পৃথিবীর আর কোনো ভাষায় সম্বোধনের এত স্তরভেদ নেই।
এক সন্ধ্যায় বাসার সামনের রাস্তায় দাড়িয়ে আছি, পাশে এক রিকশাচালকের সাথে পথচলতি এক যুবকের তর্কাতর্কি শুরু হয়ে গেল কিছু একটা নিয়ে। যুবক বললো- ওই মিয়া, তুমি দেইখ্যা চালাইতে পারো না? রিকশাওয়ালা বললো- তুমি হুট কইরা রাস্তার মাঝখানে আইসা পড়লা ক্যানে? এই কথা বলার সাথে সাথে যুবক রিকশাচালকের মুখে এক চড় বসিয়ে দিয়ে বললো- তোর কত্তবড় সাহস! তুই আমারে ‘তুমি’ বলিস....
তার মানে বিষয়টা দাঁড়ালো যে, যেহেতু রিকশাচালক সমাজের নিম্নস্তরের মানুষ, তাঁকে যেকোনো পরিস্থিতিতে ‘তুমি’ বলা যাবে, ‘তুই’ বলা যাবে, কিন্তু প্রতিবাদে সে কাউকে ‘তুমি’ বলতে পারবে না।
হযরত আলী রা. বলেছেন Courtesy costs nothing, but buys everything. কিন্তু বিনা খরচের কাজটা করতে আমরা দিনকে দিন কৃপণ হয়ে যাচ্ছি। এই কিছুদিন আগেও বাসে মানুষজন বয়ষ্ক মানুষ দেখলে সিট ছেড়ে দিতো, এখন সেই ভদ্রতাটুকুও কেউ দেখাচ্ছে না। আমাদের জন্য এখনকার সময়ে সবচে কষ্টকর আর কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভদ্রতা ও সৌজন্যতা দেখানো।
এই সৌজন্যতা এবং ভদ্রতাবোধ কমে যাওয়ার সাথে সাথে সামানুপাতিক হারে আমাদের মধ্যে অশিষ্ট আচরণ করার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। ঘরে বাইরে সবখানেই। বাইরের দেশে গেলে বাংলাদেশীদের আচরণ দেখলে অনেক সময় খুব লজ্জায় পড়তে হয়। আমাদের প্রতিবেশি ভারতীয়রা মোটামুটিভাবে বিশ্বে স্বার্থপর হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছে। কদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এ বিষয়ে বলেছিলেন। কিন্তু আমরা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছি, তাতে করে খুব শীঘ্রই আমরা বিশ্বে অভদ্র জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবো।
আমার মনে হয়, এই যে ক্রমেই আমরা স্বার্থপর, সৌজন্যতাবোধহীন হয়ে যাচ্ছি, এর একটা বড় কারণ হলো, আমরা নিজেরা নিজেদেরকে সম্মান করি না, করতে শিখি না। যেহেতু নিজেকে সম্মান করতে শিখি না, তাই অন্য কাউকেও সম্মান করতে পারি না। আমাদের সব কিছুতেই বিতর্ক। আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে বিতর্ক হয়, আমাদের নেতা নেত্রীরা অসম্মানিত হন, গুরুজন-শিক্ষকেরা হন অপদস্ত। আর এ কারণে অন্যরাও আমাদেরকে একই দৃষ্টিতে দেখে। বিভিন্ন দেশের ইমিগ্রেশনে বাংলাদেশি সবুজ পাসপোর্টকে এখন এলিমিনেট করে আলাদা লাইনে পাঠানো হয়।
মহান দার্শনিক কনফুসিয়াস বলেছেন- Respect yourself and Others will respect you. কিন্তু শিশুদের যৌনশিক্ষায় শিক্ষিত করা নিয়ে আমাদের যত মাতামাতি, যত আগ্রহ, তার কিঞ্চিত পরিমাণ কি আমরা ওদেরকে ভদ্রতা, সৌজন্যতা বা আত্মসম্মানবোধ শেখাতে দেখাচ্ছি? দিনের পর দিন এ প্লাস পাওয়ার দৌঁড়ে কখন যে সে নরম কাদামাটি থেকে বদলে রূঢ় শক্ত পাথর হয়ে যাচ্ছে আমরা বুঝতেই পারছি না অথবা বুঝতেই চাচ্ছি না? আমাদের এই না বুঝতে পারা বা না বুঝতে চাওয়ার দোলাচলে পড়ে কেবলি এ প্লাসের পেছনে ছুটতে ছুটতে ছেলেমেয়েরা জানছেই না যে নিজেকে সম্মান করতে শেখা কতটা জরুরী।
আমরা নিজেরা কি বুঝছি তা? মনে তো হয় না। আর এ কারণে এমন এক প্রজন্ম আমরা গড়ে তুলছি, যারা ভদ্রতার বদলে স্বার্থপরতা, সৌজন্যতার বদলে অভব্যতা নিয়ে চরম অস্থিরভাবে বড় হচ্ছে এবং এর প্রভাব পড়ছে সমাজের বাকিদের উপরেও। রাস্তায় বের হলেই তার প্রমাণ দেখতে পাবেন। সবাই অস্থির, চরম ব্যস্ত। গাড়ি এক সেকেন্ড বেশি দাড়ালো তো পেছন থেকে অনবরত হর্নের আওয়াজ, লাইনে একটু বেশি সময় লাগলো তো শুরু হয়ে গেলো হট্টগোল, চলতি পথে কারো সাথে একটু ধাক্কা লাগলো তো নির্ঘাৎ তর্কাতর্কি শুরু। হাতাহাতি হয়ে খুনোখুনিও হয়ে যেতে পারে। আমরা এখ আর কেউ হারতে রাজি নই।
আমি আমার আগের পোস্টে লিখেছিলাম যে এ মাসের শুরুর দিকে ভারতের বিভিন্ন যায়গায় যেতে হয়েছিলো। তারই অংশ হিসেবে বেশ ক’দিন তামিলনাড়–তে ছিলাম। ওখানকার লোকজনের আকৃতি বেশ বড়সড়, হৃদয়ও একইরকম বড়। আমি যে কদিন ওখানে ছিলাম, একদিনও রাস্তাঘাটে বা দোকানে-বাজারে কাউকেই জোরে কথা বলতে শুনিনি। কোনো হট্টগোল বা তর্কাতর্কি শুনিনি।
শুনেছি জাপানে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার প্রথম পর্যায়ে শুধুমাত্র ভদ্রতা এবং সৌজন্যতাবোধই শেখানো হয়। যার রেশ থাকে জীবনের শেষ পর্যন্ত। জাপানিজদের ভদ্রতা এবং সৌজন্যতাবোধ প্রবাদতূল্য। ব্লগের প্রথম দিকে ‘রুখসানা তাজীন’ নামে জাপানপ্রবাসী একজন ব্লগার জাপানিজদের সততা, সৌজন্যতা, জীবনাচারণ নিয়ে প্রচুর লিখতেন।
আবার শুরুতে ফিরে আসি। নিত্যদিনের চলাফেরায় অসৌজন্যতার এমন অনেক ঘটনার সম্মুখীন হতে হয় যে মাঝে মধ্যে নিজেকে খুবই অসহায় মনে হয়। শুধু আমি নই, আমরা যারা ব্লগে আছি বা নেই, অনেকেরই একইরকম অভিজ্ঞতা হয় নিশ্চয়। কিন্তু এই অতি সাধারণ সৌজন্যতাবোধ কেনো আমাদের ভেতর থেকে দুরীভূত হয়ে যাচ্ছে, সে বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় এখন যেমন অনেক দেশেই আমরা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছি, ভবিষ্যতে এর পরিধি আরো বেড়ে যাবে। দেখার কথা, এ বিষয়ে আমরা সঠিকভাবে কিছু ভাবছি কি?
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:৫২