অফিসে আসার পথে হাতিরঝিলের যে মোড়টায় এসে আমি প্রত্যেকদিন জ্যামে পড়ি, সেখানকার দেয়ালে এই লেখাটা রয়েছে। অবস্থান বিবেচনায় একদম উপযুক্ত যায়গায় হয়েছে লেখাটা। মহীনের ঘোড়াগুলি’র একটা গান আছে ‘আমি ডানদিকে রইনা, আমি বামদিকে রইনা, আমি দুইদিকেতেই রই, পরান জলাঞ্জলি দিয়া...’। কিন্তু এই দেয়াল লেখক ডানে বামে না গিয়ে মাঝখানেই থাকতে চাচ্ছেন। ভালো, খুবই ভালো। ইসলামে মধ্যমপন্থাকে উত্তম বিবেচনা করা হয়।
প্রায় প্রতিদিনই অলস চোখে দেয়ালের এই লেখাটি দেখি আর ঠিক কি চিন্তা করে লেখক এটি লিখেছেন সেটা ভাবতে ভাবতে জ্যামটুকু পার করি। দেয়াললিখনের পেছনের এই চিন্তা নিয়ে লিখব বলে একদিন ছবিও তুলে রাখলাম। কিন্তু কি যে গেরো লাগলো এরপর, গত দু’ সপ্তাহ ধরে মাথার ভেতরে কেবল একটা লাইনই ঘুরছে। ‘আমি ডানদিকে রইনা, আমি বামদিকে রইনা...’ । লাইনটা বাড়ছেও না কমছেও না। মহা যন্ত্রণা!!
আমার দৈনন্দিন কাজের রুটিনে অফিস করার পাশাপাশি আউটসোর্সিংয়ে ক্রিয়েটিভ ডিজাইন করা এবং এই ব্লগে লেখার কাজটাও রয়েছে। অফিস তো বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই, কিন্তু খেয়াল করে দেখলাম, বাকি দুটি কাজের মধ্যে একটিতে যখন বেশি মনোযোগ দিই, তখন অন্যটা আর পারি না। যখন একটু আধটু লিখতে পারি, তখন ডিজাইনটা মাথায় আসে না আর ডিজাইনে চাপা পড়লে লেখাটা আসতেই চায় না.... হায় প্রভূ! এত কম মেধা দিয়ে কেন পাঠালে এই ভুভারতে!
একদা আমরা যখন বড় হচ্ছি, তখনকার সময়ে যে সব দেয়াললিখনী থাকতো, সেগুলো হতো খুবই স্পষ্ট ভাষার, পরিষ্কার অর্থবোধক। অধিকাংশই রাজনৈতিক। সারা দেশেই এ ধরণের দেয়াললিখনী থাকতো। এক ধরণের শোভাও ছিলো ওগুলো। বিশেষ করে ছাত্র ইউনিয়ন আর শিবিরদের দেয়াললিখনীগুলো দৃষ্টিনন্দন হতো বেশি।
সময়ের সাথে সাথে রাজনৈতিক বক্তব্যের মত দেয়াললিখনীও বদলায়। আমরা ক্যাম্পাসে থাকতে দেখেছি বাম সংগঠনগুলো সান্ধ্যকালীন কোর্স চালুর দাবিতে হরহামেশাই মিছিল করতো। লেখচার থিয়েটারের পূর্বদিকের দেয়ালটা এখন অগুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাওয়াতে এই দাবিতে লেখা একটা দেয়াললিখনী এখনও রয়ে গেছে ওখানে। কিন্তু এখন ওরা বলে, ‘সান্ধ্যকালীন কোর্সের নামে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ চলবে না’। একই দাবির দেয়াললিখনীও নিশ্চয় আছে।
রাজনৈতিক দেয়াললিখন এখন খুব একটা দেখা যায় না। তার বদলে এসেছে বাণিজ্যিক আর দার্শনিক দেয়াললিখনীগুলো। একদা ঢাকা শহরে খুবই পরিচিত ‘অপেক্ষায় থাকা নাজির’ আর ‘কষ্ট পাওয়া আইজুদ্দিন’ জুটি অবসরে গেলেও তার যায়গায় এখন রয়েছে অসংখ্য দার্শনিক দেয়াল লেখকবৃন্দ। তাই এখনকার শহুরে দেয়াললিখনগুলো মর্মোদ্ধার করা বেশ কঠিন।
সুবোধ’র গ্রাফিতি যেমনটা আলোচিত, আলোড়িত, সে রকমটা না হলেও বিভিন্ন দেয়াললিখন দেখলে বেশ দুর্বোধ্য মনে হয়, ঠিক কি অর্থে বলা হয়েছে, ধরতে পারি না। দ্রুত বদলে যাওয়া সময়ের সাথে সাথে জ্ঞানও বদলে যাচ্ছে, যেটা আমি হয়তো ধরতে পারছি না। ঠিক যেমনটা সেই ছোট্টবেলাতে যশোর জেলা স্কুলের লম্বা সীমানা প্রাচীরে লেখা ‘মুজিব হত্যার পরিণাম-বাংলা হবে ভিয়েতনাম’ দেখেও বুঝতে পারতাম না যে বাংলা কিভাবে ভিয়েতনাম হবে।
এই দেয়াললিখনটার পাশেই আরেকটা লেখায় যেমন বলা হচ্ছে ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ’... দাশ বাবুর কবিতাটা নিঃসন্দেহে অর্থবোধক, কিন্তু এখানে এই দেয়াল লেখক ঠিক কোন অর্থে লিখেছেন বোঝা মুশকিল আছে। একই রকমভাবে চট্টগ্রামে চলতি পথে এক দেয়ালে দেখলাম লেখা- ‘দুধ চা খেয়ে তোকে গুলি করে দেব...’ অদ্ভুত কথা। কাওকে গুলি করতে হলে কেন দুধ চা খেতে হবে, বুঝতে পারি না। বহুদ্দিন পর ক্যাম্পাসে গিয়ে ডাকসুর সামনে বৃষ্টিতে আটকে দাঁড়িয়ে গেলাম, দেখি ডাকসুর দেয়ালে লেখা দ্য ওয়ার্ল্ড নিডস মোর লাভ, মোর ট্রুথ, মোর ...। এখনকার শহুরে দেয়াললিখনগুলো এমনই।
এক সময় নিজে দেয়াল লিখেছি। নব্বুই দশকের শেষদিকে আমার নিজের লেখা এরকম একটা দেয়াললিখনের অপসৃয়মান অংশ আজাদ প্রোডাক্টের পাশের ভবনে এখনও দেখতে পাই ওদিকে গেলে। এ জন্য দেয়াললিখনীগুলো আমার কাছে সবসময়ই অন্যরকম কিছু। চলার পথে যখনই কোন দেয়াললিখনী দেখি, তখনই ইমপ্যাথাইজড হয়ে যাই। বুঝতে চেষ্টা করি- লেখক ঠিক কি ভাবছিলেন এটা লেখার সময়ে।
কদিন আগে পত্রিকায় দেখলাম, তেজগাঁও কলেজের মাঠের এক কোণায় লোহার সিন্ধুকে কিছু চলতি জিনিসপত্র ভরে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে, যেটা ৫০ বছর পর উত্তোলন করা হবে। যেন সে সময়ের মানুষেরা ৫০ বছর আগের সমাজ-সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা পেতে পারে। একটা সময়কে আরেকটা সময়ে নিয়ে যাওয়ার এই আইডিয়াটা আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে।
দেয়াললিখনীগুলোও এরকমই সমাজের একটা প্রতিচ্ছবি; যেটি কোন এক নিঝুম যায়গায় ঘাপটি মেরে বেঁচে থাকে বছরের পর বছর আর একটা সময়কে নিয়ে চলে অন্য একটা সময়ে।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৪১