সর্বশেষ পাহাড়ে গিয়েছিলাম ২০০৮ এ। এরপর শুধুই সমতল, বনানী আর সাগরের গল্প জমেছে। কিন্তু পাহাড়ের বেলায় ‘পাহাড়ে-আহারে!’ হয়েই রয়ে গিয়েছে। সেই ক্যাম্পাসকালীন সময় থেকেই আমাদের এই গ্রুপটা টি টোয়েন্টি থেকে শুরু করে একদিবসীয় এবং টেস্টম্যাচ, সবধরণের ট্যুর করছি। ক্যাম্পাস ছাড়ার পর কর্মজীবন এবং বিয়ে, সব মিলিয়ে আগের মত ফ্রিকোয়েন্টলি না হলেও ট্যুর আমরা করেছিই। তবুও অনেকদিন হয়ে গেল পাহাড়ে যাই না, মনটা উচাটন হয়ে যায়। সবুজ পাহাড় আমায় ডাকে আয়.... অগত্যা সাজেক ট্যুরের রণদামামা বেজে উঠলো।
ইন্টারনেটে সাজেক ভ্যালির যে সব ছবি ঘুরঘুর করে, তা আমাদের সমতলের মানুষের কাছে এতটায় অন্যরকম, এর আকর্ষণ এড়ানো অনন্ত জলিলের জন্যও অসম্ভব, আর আমরা তো কোন ছার! তারপরও যেটুকু দ্বিধা ছিল, তার পুরোটাই কেটে গেল মেঘকাব্য’র মাসুদ ভায়ের সৌজন্যে। আমরা সাজেক গিয়ে এই কটেজেই ছিলাম। খুবই সুন্দর কাঠের কটেজ। অবস্থান, নির্মাণ ও আতিথ্যে মুগ্ধ হওয়ার মতই।
সাজেক হলো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দুই হাজার ফিট উপরে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর পাহাড়ঘেরা একটা রাস্তা। মোটামুটিভাবে দেড় থেকে দুই কিলোমিটার লম্বা এই রাস্তাকে ঘিরে এখানে খুবই ছোট দুটো আদিবাসী পল্লী রয়েছে। এই রাস্তাটা নির্মাণের পর বছর দু’য়েক আগে সেনাবাহিনী এবং সরকারের তরফে কয়েকটি রিসোর্ট বানিয়ে পর্যটক আকৃষ্ট করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সবার আগে বোধহয় হয়েছিল সেনাবাহিনীর রুনময় রিসোর্ট। এরপর আস্তে আস্তে এখানে বেসরকারি উদ্যোগে রিসোর্ট হতে থাকে, বর্তমানে প্রায় দেড়শটির মত রিসোর্ট নিয়ে সাজেক ভ্যালি বাংলাদেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকা।
সাজেক ঢুকতেই এই গেটটা আপনাকে স্বাগতম জানাবে
সাজেকের সাথে রয়েছে ভারতের মিজোরাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত। সাজেকের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আপনি দেখতে পাবেন মিজোরামের সীমান্তঘেঁষা লুসাই পাহাড়। রাতের বেলা মিজোরামের জনবসতি ও বাজারের আলোও দেখতে পাবেন। এখানকার নিবিড়, সবুজ পাহাড় শ্রেণী এবং তার শরীরের ভাঁজে ভাঁজে শুয়ে থাকা মেঘ যখন আপনার মুখ, শরীর ভিজিয়ে দেবে, তখন আপনাকে আপ্লুত হতেই হবে।
সাজেকের ত্রিপুরা ও লুসাই জনগোষ্ঠী মোটামুটিভাবে ১৮০০ সাল থেকেই এখানে বাস করছে। লুসাইরা সংখ্যালঘু হলেও তারাই এখানে প্রভাবশালী। এদের প্রায় শতভাগ ছেলেমেয়েই মিজোরামে গিয়ে ইংরেজি মিডিয়ামে পড়াশুনা করে। তারা সবাই খুবই ভালো ইংরেজী বলে, তুলনায় বাংলাটাই বলতে পারে না ঠিকঠাক। লুসাইরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, মিজোরাম তাঁদের দেশ এবং সাজেকের এই পাহাড়ী এলাকাও মিজোরামের অংশ। এজন্য সাজেক ও পাশ্ববর্তী এলাকা এবং মিজোরামের মধ্যকার সীমান্ত তাঁদের কাছে কোন বিষয়ই না। তাঁরা অহরহই বিনা বাধায় এপাড়-ওপাড় যাওয়া আসা করে।
যদিও আমি খুবই অন্তর্মূখী চরিত্রের, তবুও কিভাবে কিভাবে যেন লালরিন কিমা নামের স্থানীয় এক লুসাই যুবকের সাথে আমার ভাব হয়ে যায়, (চুপিচুপি বলি, ও আমাকে বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে স্থানীয় মদ অফার করেছিল, যেটা আমার টিমের একজন চাইলেও দিতে চায়নি)। তথ্যগুলো কিমা’র কাছ থেকে পাওয়া। কিমার বাবা কংলাক এলাকার হেডম্যান।
কিমা আমাকে আরো বলে যে সমতলের মানুষেরা কিভাবে সাজেকের পরিবেশ নষ্ট করছে। আমার একজন প্রিয় ব্লগার সারাফত রাজ ‘বাংলাদেশি ট্যুরিস্ট ও স্থানীয় মানুষ’ লেখায় পর্যটন এলাকায় বাঙালির অভব্যতা নিয়ে বলেছিলেন, সম্ভবত ওই লেখাটা মনে থাকাতেই এবার সাজেক গিয়ে যেন পর্যটকদেরকেই বেশি দেখেছি। তাঁরা কি করে, কিভাবে চলে, এই সব আর কি এবং বলাই বাহুল্য যে অভিজ্ঞতাটা সুখকর নয়। তাই যদি এখনও না গিয়ে থাকেন, তাহলে শীঘ্রই সাজেক ঘুরে আসুন। যে হারে ওখানে এখন পর্যটক যাচ্ছে, ওটাও সেন্টমার্টিন্সের মত ধ্বংস হতে খুব বেশি সময় নেবে না বলেই মনে হয়।
মেঘ আর মিজোরামের পাহাড়ের ওপাশ থেকে উঁকি দিচ্ছে নতুন দিনের সূর্য
সাজেকে যাওয়া মানে শুধুমাত্র সাজেকের লাল-নীল রঙের রিসোর্ট, পাহাড় আর মেঘ দেখে ফিরে আসা নয়; বরং সাজেকের পথে যাত্রা, দু’পাশের পাহাড়ঘেরা নিসর্গ, হাজাছড়ার ঝর্ণা, রুইলুইপাড়ার স্টোনগার্ডেন, কংলাকের পাহাড়ে ওঠা, হেলিপ্যাডে গিয়ে পাহাড়ের মাঝ দিয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত উপভোগ করা, রাতের সাজেকের উচ্ছলতা, সবই সাজেক ভ্রমণের অনুসঙ্গ।
তবে সত্যি বলতে কি, যোগাযোগপ্রযুক্তির এই সুবর্ণসময়ে কোন কিছুতেই আসলে মুগ্ধ হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু আপনি যদি রোমান্টিক হন, তাহলে ঢাকার এই উদয়াস্ত ব্যস্ততা থেকে পালিয়ে, চাঁদনী রাতে মেঘকাব্য’র ওপেন টেরেসে বসে পাহাড়-জোছনার গলাগলিতে নিজেও গলে যেতে পারেন। যদি আপনি নিসর্গপ্রেমিক হন, তাহলে সবুজ পাহাড়ের ভাজে ভাজে ঘুমিয়ে থাকা মেঘের দল যখন আপনার শরীরে সুর ছড়িয়ে দেবে, তার অনুভূতিতে মুগ্ধ হতে পারেন। আর আপনার যদি একটা সংবেদনশীল মন থাকে, তাহলে আপনি এই দুর্গম পাহাড়ের কাঠিন্যের মধ্যেও আদিবাসীদের জীবনীশক্তি দেখে আভিভূত হবেন। দেখতে পারবেন তাঁদের সরলতা, সততা আর পরিশ্রমী জীবনের গল্প।
সাজেকে চাইলেই দিনের যে কোন সময় যাওয়া যায় না। প্রতিদিন বেলা সাড়ে নয়টা থেকে এগারোটার মধ্যে খাগড়াছড়ির বাঘাইহাট বাজার থেকে সেনাপ্রহরায় সবাইকে একসঙ্গে সাজেকের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হয়। মাসালং সেনাক্যাম্পে এই সেনাপ্রহরা বদল হয়ে নতুন একটা দল পর্যটকদের কনভয়কে সাজেক পৌঁছে দেয়। ফেরত আসার সময়ও একই নিয়মে আসতে হবে। সকাল দশটা এবং বিকেল সাড়ে তিনটা, দিনে দু’বার সাজেক থেকে পর্যটকদের ফেরত আনা হয়। এই যাত্রাটা মাত্র ৩৩ কিলোমিটারের মত হলেও আঁকাবাঁকা এবং উঁচুনিচু পাহাড়ী পথ হওয়ায় প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিনঘন্টা লাগে। তাই আপনি যদি দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসতে চান, তাহলে সাকুল্যে দুই ঘন্টা সময় পাবেন সাজেকে থাকার। আর যদি একরাত থাকেন, তাহলে আপনি পরদিন সকালের প্রথম যাত্রা অথবা বিকেলের দ্বিতীয় যাত্রা পর্যন্ত সময় পাবেন।
এভাবেই দল বেধে সেনাপ্রহরায় সাজেক যাওয়া আসা করতে হয়
সাজেক রাঙামাটি জেলার ভেতরে হলেও খাগড়াছড়ি দিয়ে যাওয়াটাই বেশি সুবিধাজনক। প্রথমে আপনাকে ঢাকা থেকে বাসে করে খাগড়াছড়ি পর্যন্ত যেতে হবে। বাস টিকেট নন এসি ৫২০ টাকা এবং এসিতে ৮৫০ থেকে ১০০০ টাকা করে লাগবে। ছয় সাত ঘন্টা লাগবে। ঢাকার কমলাপুর, ফকিরাপুল, সায়েদাবাদ, কল্যাণপুর, কলাবাগান থেকে খাগড়াছড়ির বাস পাওয়া যায়। সেন্টমার্টিন, শান্তি পরিবহন, হানিফ, শ্যামলী, ইকোনো, ঈগল, সৈৗদিয়াসহ আরো বাস আছে, এর মধ্যে প্রথম তিনটির এসি সার্ভিস রয়েছে।
এরপর খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক পর্যন্ত যেতে হবে চাঁন্দের গাড়িতে। এই গাড়ি রিজার্ভ করতে হবে একদিনের জন্য কম বেশি হাজার চারেক এবং একদিন সাজেকে রাখতে হলে সাড়ে সাত হাজার থেকে নয় হাজার টাকার মত লাগবে। চান্দের গাড়িতে নয় সিট থেকে ১৬ সিট থাকে, যেগুলোতে গড়ে ৩ থেকে ৬জন বেশি যাওয়া যায়।
খাগড়াছড়ি থেকে পর্যটকদের প্রথম র্যালিটি যায় সাড়ে নয়টা থেকে দশটার ভেতরে। তাই ঢাকা থেকে আপনার যাত্রা পরিকল্পনা এমনভাবে করা উচিৎ হবে, যেন আপনি সকাল সকাল খাগড়াছড়ি পৌঁছে একটু ফ্রেশ হওয়ার সময় পান। খাগড়াছড়ি বাজারে হোটেলগুলোতে স্বল্প সময়ের জন্য রুম পাওয়া যায় পাঁচ-ছয়শ টাকায়, এগুলোর একটা নিয়ে ফ্রেশ হতে পারেন। আর যদি সেটা না করতে চান, তাহলে খাগড়াছড়ি বাজারের ছোট ছোট যে রেস্টুরেন্ট আছে, ওগুলোর কোনটাতে যেতে পারেন নাস্তার জন্য। অপরিচ্ছন্ন টয়লেট সুবিধা আছে এই রেস্টুরেন্টগুলোয়। তারপর একটা চাঁন্দের গাড়ি ভাড়া নিয়ে সোজা সাজেক।
একটা কথা এখানে বলা প্রয়োজন, আমি সাজেকে বেশ কিছু ব্যক্তিগত সেডান কার বা এসইউভি দেখেছি। আমার মতে এটা একেবারেই অপ্রয়োজনীয় প্লাস অনিরাপদও। প্রথমত, এই রাস্তায় চলার জন্য যে ধরণের ইঞ্জিন দরকার হয়, ব্যক্তিগত গাড়িগুলোতে সাধারণত সে ধরণের হয় না। চাঁন্দের গাড়িগুলোর মূল বৈশিষ্ট্যই এটা। এগুলো একদিকে যেমন ২৭০০ থেকে ৩০০০ সিসির গাড়ি, অন্যদিকে অধিকাংশই ফোর হুইল ড্রাইভ সুবিধাযুক্ত। তাই পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে এরা কোন সমস্যায় পড়ে না। দ্বিতীয়ত, এই রাস্তায় নিয়মিত চলতে চলতে চাঁন্দের গাড়ির ড্রাইভারদের কাছে সাজেকের পথ মুখস্ত হয়ে গেছে। এ জন্য সামনের বাঁকটি ৪৫ ডিগ্রি কৌণিক নাকি ১১০ ডিগ্রি, তা তাঁরা আগে থেকেই জানে এবং সে মতে ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু বাইরের একজন ড্রাইভারের এই বিষয়টি জানা থাকার কথা নয়, ফলে পুরো রাস্তাটাই তাঁর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। যেখানে কোনরকম ভুল হলে সাজেক নয়, বরং পৃথিবীর বাইরে পৌঁছে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা।
সাজেক যাওয়ার পথে মোটর বাইকারদেরও দেখলাম। আমি গাড়ির ছাদে ছিলাম। ওখান থেকে ওই রাস্তায় বাইকারদের মুভমেন্ট দেখে আমি রীতিমত আতঙ্কে জমে যাচ্ছিলাম। একই ধরণের অবস্থা আমার হয়েছিল দু’হাজার চার সালে ভারত নেপাল সীমান্ত কাঁকরভিটা থেকে বাসে করে কাঠমান্ডু যাওয়ার পথে। কানে ধরেছিলাম যে আর কোনদিন এই পথে যাব না। আমি তাই চাঁন্দের গাড়িতেই যেতে পরামর্শ দেব। জানেনইতো একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না।
সবশেষে আমাদের বদন দেখানোর লোভ সামলাতে পারলাম না, ক্যামেরার পেছনে একজনসহ আমরা দশজন ছিলাম এবারের ট্যুরে
রোদ পাহাড়ের নিরব গান: সাজেক ট্যুরের অদ্যপান্ত- শেষপর্ব
ক্যামেরার পেছনে: হান্নান ও মার্গুবুল্লাহ
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মার্চ, ২০১৮ সকাল ১০:৫৭