ইদানিং সিটি কর্পোরেশন রাজধানীর হোর্ডিং বোর্ডগুলো নামিয়ে নিয়েছে। মারিয়া নূরকে তাই এখন আর দেখতে পাই না।
আড়ংয়ের পাশ দিয়ে হাতিরঝিল থেকে গুলশান রোডে নামার সাথে সাথেই দেখতে পেতাম ড. ফজলে রাব্বী পার্কের দখিন কোণে বিশাল এক হোর্ডিং বোর্ডে মারিয়া নূর বসে রয়েছে কেতাদুরস্ত সাজে।
নিকেতনের গেটে ঝাঁ চকচকে রাস্তায় আমি যখন বাইকে বসে চৈত্র বোশেখের রোদে দরদর ঘামতে থাকি, তখনও মারিয়া নূর ওই বিলবোর্ডে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে থাকে মুখে স্মিত হাসি নিয়ে।
প্রখর রোদে পুড়ে, তুমুল বৃষ্টিতে ভিজেও মারিয়া নূর কখনও মলিন হয় না।
এমনকি ওই হোর্ডিং বোর্ডের উপরে কাকেরা যখন কর্পোরেট সভা বসায় আর বিষ্ঠার আবরণে কিঞ্চিত ঢেকে যায় পিভিসি ব্যানার, তখনও মারিয়া থাকে আগের মতই।
দুপুরের গণগণে রোদে পথচলতি যুবকেরা এই স্নিগ্ধ মারিয়াকে দেখে ক্রাশ খায় দলে দলে।
মারিয়া নূর যে বিলবোর্ডের উপরতলায় নির্বিঘ্নে নির্ভাবনায় থেকে যায় শীত গ্রীষ্ম বর্ষায়, সেই বিলবোর্ডেরই নিচতলায় চলে জীবনের নিরন্তর সংগ্রাম। ঠিক যেমন আমাদের সমাজে চলে নীচু আর উঁচুর দরদাম।
পিঠে বস্তা নিয়ে শৈশব চুরি হয়ে যাওয়া শিশুরা ওই বিলবোর্ডেরই নিচে আবর্জনার স্তুপে খুঁজে ফেরে বেঁচে থাকার অবলম্বন। শ্রেণিবৈষম্যের এই পরম্পরা হয়ত আগামী শতবর্ষেও একই থাকবে।
একইভাবে চলতে থাকবে এই দ্বৈরথ। দুই শ্রেণির চিন্তাভাবনাও থাকবে একই।
অফিসে আমার নেক্সট ডোর নেইবার ছিল মারিয়া নূর প্রজাতির এক মেয়ে। তিথি নাম। একদিন হঠাৎ বললো, ওরা অস্ট্রেলিয়ায় সেটল্ড হবে। আমি একটুও অবাক হইনি।
সমাজের যে শ্রেণিকে তিথিরা বিলং করে, সে শ্রেণির লোকেরাই সাধারণত কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় সেটল্ড হতে চায়।
বাবা এবং স্বামীর তরফে ঢাকা শহরে দুই তিনটি বাড়ির মালিক হওয়ার পরও দেশ ছাড়ার প্রণোদনা এদের অফুরন্ত।
বরং আমি অবাক হয়েছিলাম যখন তিথি আমাদের অফিসে এসে জয়েন করলো।
এ রকম নয়টা পাঁচটার ধরাবাঁধা ম্যাড়মেড়ে জীবনে ওদের মানায় না।
তিথির ভেতরে আলাদা একটা জেল্লাদার ভাব ছিল। ডাকবুকো চলাফেরা আর কথাবার্তায় বোঝা যেত যে সে আমাদের প্রজাতির না, মারিয়া নূর প্রজাতির।
তিথি প্রিভিলেজড অফিসার হিসেবেই এখানে ছিল, যতদিন সে ছিল। তারপর অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেল স্বপরিবারে।
এই পোড়া দেশের জরা-দুঃখ-ক্লান্তিকে অতীত করে আরো সুখের সন্ধানে। দেখে দেখে মনে হয়, এ দেশের জল হাওয়ায় বড় হয়েও অনেকেই এ দেশের হতে পারেনা, ওরা থাকে অস্ট্রেলিয়ায় আর এ দেশের বিলবোর্ডগুলোয়।
তিথি তাই এখন সিডনি অপেরার সামনে দাড়িয়ে ছবির জন্য পোজ দেয়।
**ছবিসূত্র: ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০১৮ সকাল ১১:২৪