somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নস্টালজিয়া ৩- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: যখন ধোঁয়া মেঘে ঢাকা আমার মন

০৩ রা জুলাই, ২০১৭ দুপুর ১২:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


নোয়াখাইল্যা রিপন হঠাৎ করে বলল, ক্যাম্পাসে আসার কুড়ি বছর হয়ে গেল... !! বেমক্কা এক ধাক্কায় আমার বাস্তব পরাবাস্তব সব মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল যেন।

আমরা বসে আছি টিএসসির সড়ক দ্বীপের উত্তর কোণার দেয়ালে পা ঝুলিয়ে। বাম দিকে রোকেয়া হলের দেয়াল ভেঙে কিছুটা উম্মুক্ত করে দিয়েছে তমা কনস্ট্রাকশন। হলের ভেতরের কয়েকটা গাছ নিকেশ করে নির্মাণ করছে বহুতল ভবন। উন্নয়নের মহাসড়কে এক দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে দেশ।


কিন্তু আমি দেখছি রোকেয়া হলের পকেট গেটটার দুই পাশে বেশ কিছু ছেলে ইতস্তত দাড়িয়ে আছে ঘন্টার পর ঘন্টা। হাতে হলের কোন একটা মেয়ের নাম আর রুম নাম্বার লেখা চিরকুট। কোন মেয়ে বাইরে থেকে হলে ঢুকতে গেলেই তিন চারজন ছেলে এগিয়ে যাচ্ছে: আপু একটা স্লিপ... কেউ হয়তো নিচ্ছে, কেউ প্রত্যাখান করছে। এভাবেই কাঙ্খিতজনের দেখা পেতে পেতে কখন কিভাবে কেটে গেল তিনটে ঘন্টা, ছেলেটা বুঝলোও না, ঠিক যেভাবে আমাদেরও চলে গেল কুড়িটা বছর...

রোকেয়া হলের গেটের ফুলে ফুলে হেলে পড়া বাগানবিলাস গাছটা দেখতে দেখতে একদা আমি আর জিয়া মিতা’পুর জন্য এখানে এ রকম তিন ঘন্টা কাটানোর পর জানতে পেরেছিলাম মিতা’পু হলে নেই। আজকের দিনের ছেলে মেয়েরা বলবে; এটম খাইয়া লাভ নাই মাম্মা, চাপা কম পিটাও...

আটানব্বুইয়ের এক তপ্ত দুপুরে ক্যাম্পাসে পা রেখেই যেন মিশে গেলাম সময়ের মহামিছিলে। এ কে আজাদ স্যার বলেছিলেন, এখানে কেউ শিক্ষক বা ছাত্র নয়, এখানে সবাই স্কলার। আমরা সিনিয়র স্কলার, তোমরা জুনিয়র স্কলার... সেই থেকেই তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে দু’হাত উজাড় করে ভালবাসা দিতে শুরু করলো, সে ভালবাসা এমনই যে এখনও, এই কুড়ি বছর পরেও শাহবাগের সিগন্যালে দাড়ালেই মাথা থেকে হেলমেটটা খুলে নিয়ে লুকিং গ্লাসের উপর লটকে দিই, মনে মনে ভাবি, আমার এলাকায় এসে পড়েছি, দেখি কোন শালা কি কয়!!


আমরা টিএসসি থেকে সেন্ট্রাল লাইব্রেরির দিকে হাটছিলাম। সেন্ট্রাল লাইব্রেরি আর ডাকসুর মাঝের যায়গাটায় কি সব হাতি ঘোড়া বানিয়ে রেখেছে। দোকানে দোকানে ভরে গেছে। অথচ এই যায়গাটা বনবীথি ধরণের ছিল। কোন এক নতুন ভবন নির্মাণের জন্য একবার যায়গাটা বাশ দিয়ে ঘিরে রেখেছিল কর্তৃপক্ষ। দু একটা গাছ কাটার পরেই শুরু হয় প্রতিবাদ বিক্ষোভ। কবির সুমনের সাথে গলা মিলিয়ে আমরাও গেয়ে উঠেছিলাম, আমি চাই গাছ কাটা হলে শোকসভা হবে রাজ্যসভায়... ব্যাস, বন্ধ হয়ে গেল বৃক্ষনিধন।

তবুও দীর্ঘদিন বাশের ঘেরায় আটকে ছিল যায়গাটা। ২০০৭ এ জিমনেশিয়াম মাঠে আর্মিদের সাথে মারামারির পরদিন যখন রাজু ভাষ্কর্যের মুখে জলকামান আর টিয়ার গ্যাসের গাড়ি নিয়ে আমাদের পুলিশ ভায়েরা উপস্থিত, তখনই এই বেড়াটা উধাও হয়ে বাঁশগুলো সব ছাত্রদের হাতে হাতে উঠে গেল...।

কলাভবনের মেইন গেটে একঝলক যেন শফিককে দেখলাম। সেই শফিক, লেবু চায়ের একটা বড় ফ্লাক্স নিয়ে দাড়িয়ে আছে! জানি সম্ভব নয়। আমরা ক্যাম্পাসে থাকতে থাকতেই শফিক আমাদের হলের ক্যান্টিনে কাজ নিয়ে নেয়। কিন্তু রিপনের ওই কুড়ি বছরের ধাক্কা কি যেন একটা এলোমেলো করে দিয়েছে....


মল চত্বরে ছাতিম গাছটার তলায় এসে পুরোনো সেই গন্ধে মনে হল, হয়ত আজও আমরা হাটতে বেরিয়েছি। আমাদের ভেতরে হাটা ব্যারাম ছিল তখন। প্রায় রাতে আমরা হল থেকে বের হতাম শহরের রাস্তায় হাটতে। স্টাডিজের মুকুল, ওয়েলফেয়ারের আবু সাঈদ, মাকসুদ, সোশিওলজির জিয়া, আনোয়ার, ল এর আরিফ, তারপর আমিন, হাসান, রিপন, ইসহাক, মোবারক, সেলিম মিলে আমরা একেকদিন হাটতে হাটতে চলে গেছি কত কত দুরে। তারপর শেষ রাতের দিকে চানখারপুলের সোহাগ হোটেলের প্যাচ পরোটা আর গরুর চাপ খেয়ে হলে ফিরেছি। এ রকম এক রাতে একা একা বেরিয়ে আবু সাঈদ পুলিশের হাতে ধরা খেয়ে পরদিন ছাড়া পেল। তবুও আমাদের রাতে হাটার ব্যারাম কমেনি হলের শেষ দিন পর্যন্ত।


আর ইউনিভার্সিটির লাল বাসগুলোতে চড়ে অনির্দিষ্ট গন্তব্যে চলে যাওয়ার গল্পতো আছেই। সাথে থাকতো রিন্টু-জুঁথি, সাবরিনা, রলি, তিথি, সাল্লু, শিল্পী, কখনো মাহফুজ, লুবনা। রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের পেছনে সিনেট ভবন তৈরী হওয়ার সময়টাতে লাল বাসগুলোর অস্থায়ী আবাস হয়ে গিয়েছিল মল চত্বরের রাস্তাগুলো। এই মল চত্বরের জারুল-হিজল-কৃঞ্চচুড়া-রাধাচুড়া-সোনালু আর বিশাল শীল কড়ইগুলো শেষ বসন্তে আমাদেরকে উপহার দিত কতশত নবীন কবি আর প্রেমিককে।

ক্যাম্পাস ছেড়ে যাওয়ার পরও দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসে এসেছি নিয়মিত। এখনও অনিয়মিতভাবে আসি। বন্ধুরা আসে। আড্ডা দেই বেলালের দোকানের চা আর পুরির সাথে। অফিসের কাজে বা পারিবারিক কাজে ওদিকে ক্যাম্পাসের ওদিকে গেলেই ইচ্ছাকৃতভাবে রুটটা বানাই ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে। একটু ঢুঁ মেরে যাই। কখনোই মনে হয়নি আমি বড় হয়ে গেছি। আমি এই ক্যাম্পাসের বাইরে চলে গেছি।


কিন্তু আজ যেন গিটারের তার একটা ছিড়ে গেছে একদমই আচানক। স্যাতসেতে বৃষ্টিভেজা এই মনমরা বিকেল পেরুনো সন্ধ্যায় চারদিক বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের আলোকসজ্জায় উচ্ছল। এখানে ওখানে ছেলে মেয়েরা তুমুল আড্ডা হাসিতে ভেঙে পড়ছে। শুধু আমি বসে আছি সেই কুড়ি বছর আগের সময়ে।

নস্টালজিয়া ১- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: পৌষের কাছাকাছি রোদ মাখা সেই দিন...
নস্টালজিয়া ২- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: সবকিছুই কফি হাউজ হয়ে যায়...

ছবিগুলো অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুলাই, ২০১৭ দুপুর ১২:১১
১০টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখানে সেরা ইগো কার?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪






ব্লগারদের মাঝে কাদের ইগো জনিত সমস্যা আছে? ইগোককে আঘাত লাগলে কেউ কেউ আদিম রোমান শিল্ড ব্যবহার করে,নাহয় পুতিনের মত প্রটেকটেড বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহার করে।ইগো আপনাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে, টের পেয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবং আপনারা যারা কবিতা শুনতে জানেন না।

লিখেছেন চারাগাছ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮

‘August is the cruelest month’ বিশ্বখ্যাত কবি টিএস এলিয়টের কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘The Westland’-র এ অমোঘ বাণী যে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমন করে এক অনিবার্য নিয়তির মতো সত্য হয়ে উঠবে, তা বাঙালি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×