কৈশোরে অধরা জিনিসগুলোর প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধহয় সবারই থাকে। একটা সুন্দর সবুজ জ্যাকেট, পিঠে ঝুলানো স্কুল ব্যাগ, পাঁচ নম্বর ফুটবল, ক্রিকেটের ব্যাট, হাত ঘড়ি, ওয়াকম্যান বা সোজা হাতলের নিচু সাইকেল... আরো কতসত কি।
মধ্যবিত্তের অন্তসারশূন্য লৌকিকতা কালে ভদ্রে সে আকর্ষণ পূরণ করতে পারলেও না পাওয়ার তালিকা শুধু লম্বাই হত দিন কে দিন।
আমার যত আকর্ষণ ছিল ক্যামেরাতে। কি এক যন্ত্র, টিপ দিলেই ছবি উঠে যায়। হাতে নিলেই বুকের মধ্যে অন্যরকম এক অনুভূতি এসে ভর করে।
চোরা চোখে তাকিয়ে দেখি কে কোন কোণা থেকে আমাকে দেখছে।
কিন্তু এমন দূর্লভ মূহুর্ত কমই আসতো। ক্যামেরার মত এমন মহার্ঘ বস্তু বাচ্চা কাচ্চার হাতে দিয়ে কে-ইবা নষ্ট হওয়ার আতংক ঘাড়ে নিতে চায়!
আমার ফ্যামিলিতে ক্যামেরা থাকার প্রশ্নই ওঠেনা। টিভিটাই দেখতাম অন্যের বাসায়, সেটা আবার সাদাকালো স্ক্রীনের উপর সেলোফেন পেপার মুড়িয়ে রঙিনের আমেজ আনা। কখনও সখনও কোন অনুষ্ঠানে কোন আত্মীয়ের বা ভার্সিটি পড়ুয়া ভাইয়াদের বন্ধুরা বেড়াতে এলে তখন ক্যামেরা হাতড়ানোর একটা মওকা পাওয়া যেত।
এরকম মুফতে কোন ক্যামেরা পেলে পাড়ার বন্ধুরা মিলে চাঁদা দিয়ে কিনে নিয়ে আসতাম ফিলম, ব্যাটরী। তারপর মাথাপিছু সাত থেকে দশটা ছবির হিস্যা নিয়ে শুরু হয়ে যেত ছবি তোলার মহড়া...
সে এক মজা ছিল বটে।
ওই বয়সের মফস্বলে সেসময় চলতি ফ্যাশন ছিল বাটার পাওয়ার কেডস এর সাথে নর্মাল প্যান্ট আর শার্ট বা টি-শার্ট প্রায় বুকের কাছে প্যান্টের ভেতরে গুঁজে দুই পকেটে দুই হাত দিয়ে বেঢপ সাইজের এক চশমা পড়ে ৯০ ডিগ্রি থেকে কৌণিকভাবে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ছবি ওঠানো। অথবা প্রখর রোদ্রে আগের মতই সাঁজে ঘামতে ঘামতে সর্ষে ক্ষেতে গিয়ে দুজন হ্যান্ডশেক করা বা বিকেলের মরা আলোয় গোলাপের ডাল ধরে
ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসি দেওয়া এবং তার ছবি তোলা।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যেত ফিগারটা আউট অব ফোকাস হয়ে ঝাপসা হয়ে গেছে আর ফুলটা খুব প্রমিনেন্ট ।
আরেকটা বাদ পড়ে গেল, ইউভি লেন্স ছাড়াই এইসব এ্যামেচার ক্যামেরায় সূর্য ধরার হাস্যকর চেষ্টা করা।
আমিও করেছি। এখন দেখলে খুব হাসি পায়। কিন্তু তখন এটাই ছিল বাস্তবতা।
কিন্তু ক্যামেরা হাতে পাওয়াই ছিল চাঁদ হাতে পাওয়ার মত। মফস্বলে পিকনিক বা পারিবারিক উৎসবে গ্রুপ মিলে ভাল-খারাপ একটা ক্যামেরা ম্যানেজ হয়েই যেত।
কিন্তু ততদিনে এসএসসি দিয়ে ঢাকা এসে গেছি, কথাবার্তায় কেতা দুরস্ত ভাব চলে এসেছে। ঢোলা ঢোলা প্য্যন্ট বুকের কাছে ইন করার বদলে খোলা শার্ট, টি-শার্টের সাথে জিন্স চলে এসেছে। আর সাথে সাথে প্রয়োজন বেড়েছে একটা ক্যামেরার। এই পিকনিক, এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, এই ঘুরতে যাওয়া, এই...এই..। মাঝে মাঝে আবার প্রাকৃতিক কোন দৃশ্য দেখে হেনরী কার্টিয়ের ব্রোসো হওয়ার সাধ জাগে।
এখন আর দলীয় ক্যামেরায় পোষায় না।
অন্যের ক্যামেরা চাইতে গেলেও নানান ছুতো, এটা নষ্ট, ওটা নেই, বুকড আছে, ফিলম ভরা, কাল প্রোগ্রাম ইত্যাদী ইত্যাদী। আর চরম অনিচ্ছায় দিলেও শেষ মূহুর্তে উপদেশ, এইভাবে ধরবে, ওইভাবে খুলবে... মেজাজটাই খারাপ হয়ে যায়...
কত মানুষের মামু চাচা খালুরা দুবাই আমেরিকা হল্যান্ড থাকে, জাতিসংঘ মিশনে লাইবেরিয়া যায়, আর আসার সময় আমার বয়সীদের জন্য ক্যামেরা নিয়ে আসে। আমার চৌদ্দ গুষ্ঠির কেউ দেশের বাইরে থাকেনা, বাবার ট্যাকেও পাত্তি নাই, আমার ক্যামেরার শখও মেটেনা।
ছিয়ানব্বুইয়ে, তখন আমি ইন্টারে। কিসের যেন এক পিকনিকে যাব, যথারীতি ক্যামেরা দরকার, কিন্তু ক্যামেরা আর পাইনা। যাকেই ধরি, তারই প্রোগ্রাম থাকে।
তদ্দিনে কিভাবে কিভাবে পকেটে কিছু টাকা জমেছে। সেই টাকা আর কাওসার ভাইয়ের দেওয়া যত্নে রেখে দেওয়া ৫০ পাউন্ডের এক নোট ভাঙিয়ে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকার মত পাওয়া গেল। তখন ছিল ডিসেমন্বর মাস, বানিজ্য মেলা চলছিল। সোজা র্যাংস এর প্যাভিলিয়নে গিয়ে কিনে ফেললাম ক্যাননের এক অটোমেটিক ক্যামেরা।
নতুন ক্যামেরা হাতে নিয়ে বুকে নতুন ভাব এসে গেল। বাসে ফেরার সময় কিছুক্ষণ পরপর ব্যাগের ওজন অনুভব করি।
অতপর আমি ক্যামেরার মালিক হইলাম।
এবং তারপরই বুঝতে পারলাম, ক্যামেরা হল এমন একটা বস্তু, যেটা না থাকলে প্রয়োজনের শেষ থাকেনা, কিন্তু নিজের থাকলে আর কোন প্রয়োজনেই লাগেনা।
অদ্ভূত ব্যাপার। ক্যামেরা হওয়ার পর দেখি এটি আল্লার দুনিয়ার মাসের ত্রিশ দিনের মধ্যে বত্রিশ দিনই পড়ে থাকে আর লকারের মধ্যে এটির দিকে তাকালেই বিরক্তি লাগে।
শেষে মুহসীন হলে থাকার সময়ে আবু সাইদ মাত্র ১০০০ টাকা দিয়ে ক্যামেরাটা কিনে আমাকে উদ্ধার করে। আমার ক্যামেরা বাতিকও দুর হল।
ক্যামেরা মুক্ত হয়ে আমি বাঁচলাম। কিন্তু ক্যামেরার উপর এই অনাগ্রহ প্রকাশ বোধ হয় ক্যামেরা সহ্য করতে পারেনি। পরবর্তীতে যখনই আমি কোন ক্যামেরা হাতে নিয়েছি, কিছু না কিছু ক্ষতি হয়েছে এবং আমাকে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে।
গেল বছরের শেষের দিকের কথা, বাঁধন থেকে ব্লাড গ্রুপ টেস্টিং এর এক প্রোগ্রামে গেছি মুন্সীগঞ্জে প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন কলেজে। ওখানকার টিচার আমার হল মেট ইসহাকের অনুরোধে ছাত্র ছাত্রীদের ছবিও উঠিয়ে দিতে হবে, সুতরাং ক্যামেরা দরকার। আমার মত অনুরোধে ঢেকি গিলে আমার এক বন্ধু, তার এক মেয়ে বন্ধুর কাছ থেকে একটা ডিজিটাল ক্যামেরা এনে দিল।
ঢাকা ফিরে আসার পর এক ছোটভাই ক্যামেরাটা একটু দেখার জন্য নিল। সে এমন দেখাই দেখলো যে এর পর আর ক্যামেরার মেমোরী কার্ড রিড করেনা।
নতুন এক মেমোরী কার্ডসহ ক্যামেরা ফেরত দিয়ে এযাত্রা রক্ষা পেলেও সমস্যা বাঁধলো অন্য যায়গায়। ছবিগুলোতো লাগবে। বলে কয়ে আবার আরেকটা ক্যামেরা ম্যানেজ করে ছবি উঠানো হলো, পিসিতে নেয়ার পর দেখা গেল রেজুলেশন খারাপ, কাজ হবেনা। ক্যামেরাটা অতো ভাল ছিলনা।
অগত্যা কি আর করা, বিটু কে ফোন করলাম; একজন ফটোগ্রাফার দাও, দরকার হয় কিছু টাকাও দিয়ে দিব। বিটু তখন ডিইউপিএস এর সেক্রেটারি, শাকিল নামে থার্ড ইয়ারের এক ছেলেকে পাঠালো।
পরদিন সকালে ওদেরকে মুন্সীগঞ্জের পথে টিএসসি থেকে রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে হেটে হেটে মাত্র হলে ঢুকেছি, ওমনি ফোন, ভাইয়া, এক সর্বনাশ হয়েছে...
ঘটনা হলো, ওদের রিকশা যখন প্রেসক্লাবের সামনে দিয়ে পল্টনের দিকে যাচ্ছিল, পেছন থেকে এক সিএনজি এসে শাকিলের ক্যামেরার ব্যাগ ধরে টান দিয়ে সবকিছুই নিয়ে চলে গেছে, আর শাকিল এবং সাথে থাকা জুয়েল দুজনেই রিকশা থেকে পড়ে হাত পা ছড়ে ফেলে এক বিতিকিচ্ছিরি কান্ড... আমি তাড়াতাড়ি পল্টন থানায় গেলাম।
কিন্তু ক্যামেরা কি আর পাওয়া যায়! বেচারা শাকিলের ক্যামেরা, লেন্স, শাটার গান, সব মিলিয়ে প্রায় এক লাখ টাকার ইন্সট্রুমেন্ট। আমার পক্ষে যেটুকু করার, সেটুকুই করেছি।
এই ঘটনার পর কানে ধরেছিলাম, অনেক হয়েছে বাবা, আর ক্যামেরা ধরছিনা কারো।
কদিন আগের ছুটিতে বন্ধুরা মিলে গিয়েছিলাম বান্দরবন, চিটাগাং এবং রাঙামাটি। পূর্ব প্রতিজ্ঞায় অটল থেকে আমি ক্যামেরার ব্যাপারে চিন্তাই করিনি। বাস ছাড়ার ঘন্টা দুয়েক আগে আইজ্যাক জানালো, ভালো ক্যামেরা পাওয়া যাচ্ছেনা, তুই একটু দ্যাখ।
অফিসের একটা টিম আমাদের ট্যুর রুটে ছিল নোকিয়ার কাজে, ওদের সাথে অফিসের হাইরেজ ক্যামেরাটা আছে। আমি ইলিয়াসকে ফোন করলাম, কোথায়?
ইলিয়াস বলল, ভাইয়া দামপাড়া বাসের কাউন্টারে বসে আছি, ঢাকা ফিরছি। আমি বললাম, রাখো রাখো, ক্যামেরাটা লাগবে। আমি একজনকে পাঠাচ্ছি, তুমি ক্যামেরাটা দিয়ে দাও।
বান্দরবান, রাঙামাটিতে আমাদের ট্যুর শেষ হল।
ক্যামেরা বিষয়ক অতি সতর্কতার কারণে কোন ঝামেলা হয়নি। শেষদিন রাতে বাস, বিকালে আমরা গেছি ভাটিয়ারি বিএমএতে। পরিচিত এক কর্নেল আছেন।
তাঁর বাসায় তুমুল আড্ডার মধ্যে একজন জিজ্ঞাসা করল, ক্যামেরাটা কই...... নেই, নেই তো নেইই, পরে আবিষ্কার হল সিএনজিতে ফেলে এসেছি......
কিসের আড্ডা, কিসের চিম্বুক, মাইনিমুখ, কাপ্তাই আর ঝুলন্ত ব্রিজ, আর কিসের কি... অফিসে কি বলব, ওই ক্যামেরার দাম কত, এইসব চিন্তায় মাথাব্যাথা শুরু হয়ে গেল...
পরদিন সক্কাল বেলায় ঢাকা ফিরে প্রথমেই গেলাম আইডিবিতে, খুঁজে খুঁজে একই মডেলের ক্যামেরা কিনে তারপর অফিসে ঢুকলাম।
ক্যামেরাটা ফেরত দেয়ার সময় ম্যানেজার বলল,
কি ভাই হেভী একটা ট্যুর দিলেন.... আমি বললাম, হ ভাই, পুরা হেভী....
আলোচিত ব্লগ
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় দেশনায়ক তারেক রহমানকে সম্পৃক্ত করার নেপথ্যে
আগেই বলেছি ওয়ান ইলেভেনের সরকার এবং আওয়ামীলীগের যবনায় জনাব তারেক রহমানের বিরুদ্ধে পৌনে একশ মামলা হলেও মূলত অভিযোগ দুইটি। প্রথমত, ওই সময়ে এই প্রজন্মের নিকট উপস্থাপন করা হয়েছিল দেশনায়ক তারেক... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্পকে নিয়ে ব্লগারদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা
ে
**** এডমিন টিমের ব্লগারেরা আমাকে বরাবরের মতোই টার্গেট করে চলেছে, এভাবেই সামু চলবে। ****
ট্রাম্পের বিজয়ে ইউরোপের লোকজন আমেরিকানদের চেয়ে অনেক অনেক বেশী শংকিত; ট্রাম্প কিভাবে আচরণ করবে ইউরোপিয়ানরা... ...বাকিটুকু পড়ুন
**** এডমিন টিমের ব্লগারেরা আমাকে বরাবরের মতোই টার্গেট করে চলেছে, এভাবেই সামু চলবে। ****
ট্রাম্পের বিজয়ে ইউরোপের লোকজন আমেরিকানদের চেয়ে অনেক অনেক বেশী শংকিত; ট্রাম্প কিভাবে আচরণ করবে ইউরোপিয়ানরা... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্পের বিজয়, বিশ্ব রাজনীতি এবং বাংলাদেশ প্রসংগ
ট্রাম্পের বিজয়ে বাংলাদেশে বা দেশের বাহিরে যে সব বাংলাদশীরা উল্লাস করছেন বা কমলার হেরে যাওয়াতে যারা মিম বানাচ্ছেন, তারাই বিগত দিনের বাংলাদেশের ফ্যাসিস্টের সহযোগী। তারা আশায় আছেন ট্রাম্প তাদের ফ্যাসিস্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন
ঠেলার নাম বাবাজী !
এক গ্রামীণ কৃষক জমিদার বাড়িতে খাজনা দিতে যাবে। লোকটি ছিলো ঠোটকাটা যখন তখন বেফাস কথা বা অপ্রিয় বাক্য উচ্চারণ করে ক্যাচাল বাধিয়ে ফেলতে সে ছিলো মহাউস্তাদ। এ জন্য তার... ...বাকিটুকু পড়ুন
শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!
অপেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন