স্মৃতির শহরে ফেরা
রাজশাহী আর খুলনা বিভাগ আমি ধারাপাতের নামতার মত পড়তে পারি এক নিঃশ্বাসে।
রাজশাহী, বগুরা, গাইবান্ধা, নওগাঁ, দিনাজপুর, দামুরহুদা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর, এদিকে পাবনা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, খুলনা, মুলঘর, অভয় নগর, যশোর, ঝিকরগাছা, শার্শা, বাগেরহাট, ফরিদপুর, আরো আরো আরো....
এই সব যায়গাতেই আমরা থেকেছি বাবা এবং মা'এর বদলীর চাকুরীর বদৌলতে।
এসবগুলোর ভেতরে নাটোর আমার কাছে একদম অন্যরকম, স্মৃতির শহর হয়ে আছে। হয়ত এজন্য যে, এখানেই আমি রংধনু চিনেছিলাম প্রথম আর জীবন নাটকের আবেশটা ধরতে শুরু করেছিলাম।
নাটোর ছেড়ে ঝিকরগাছা এসেছিলাম আমরা সাতাশিতে, আমি তখন থ্রিতে।
রেল স্টেশন থেকে দশ মিনিটের দুরত্বে বন বেলঘড়িয়া ফরেস্ট অফিসের পাশে প্রাচীর ঘেরা শিশু সদনে আমরা ছিলাম।
বিশাল এক এলাকা। মেইন গেট দিয়ে ঢুকলে প্রথমেই বাঁ হাতে আমাদের বাংলো, তার আগে অবশ্য বেশ ক'টি আম, জামরুল আর পেয়ারা গাছ।
সমস্ত শিশু সদনটাই গাছগাছালী, ফুল আর সবুজে ভরা ছিল।
রাস্তার দুপাশে পেয়ারা গাছের সারি। কোনার দিকে লম্বা লম্বা ইউক্যালিপটাসে ঘেরা মাঠ, বড়রা ওখানে ফুটবল খেলতো,
আর পাশে আমরা ছোটরা খেলতাম নাম না জানা সব খেলা।
তার পরেই ছিল বেত গাছ আর কাগজী লেবুর বাগান, পুরো বসন্ত জুড়ে মৌ মৌ গন্ধ।
পূর্ব দক্ষিণ কোনে বড় এলাকা নিয়ে কাশবন, এক বর্ষায় সেখানে একটা গেছো বাঘ পাওয়া গিয়েছিল। তার পেছনে বড় পুকুর, ছিপছিপে বর্ষায় আমরা পুকুর পাড়ের কলাবাগানে শেয়াল দেখতে যেতাম।
আমার নাটোর ছিল ছায়াঘেরা, মায়া ভরা।
ঢাকা- নাটোর- রাজশাহী মেইন রোডের দু পাশে ছিল বিশাল বিশাল সব শীল কড়ই গাছ, সকাল দুপুর বিকেল, সব বেলাতে ছায়ায় ঢেকে রাখত। রাস্তায় টক্কর, টক্কর, টক্কর, ঘোড়ার গাড়ী,
গরুর বদলে মহিষের গাড়ি।
নাটোর থাকতে আমরা দোয়েলের গান শুনতাম শীতের হীম হীম ভোরে, আলো ফুটলে মা খালাদের হাতে বোনা উলের মোটা সোয়েটারে শরীর মাথা ঢেকে আপুদের সাথে যেতাম শিউলী ফুল কুড়াতে, কোন কোন দিন বকুল ফুল।
তারপর মসজিদে গিয়ে সুর করে দুলে দুলে আরবী পড়া আর আটটা বাজতেই টিনের বাক্স হাতে নিয়ে নতুন আসা স্কুল ভ্যানে করে বড়গাছায় কিন্ডার গার্টেনে পড়তে যাওয়া।
স্কুলে যাওয়ার পথেই ছিল বেলঘড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়।
নিচু একতলা টিনশেড বিল্ডিং, সামনে মাঠ, একপাশে আখ বন।
যেকোন ভাবেই হোক, আমরা জানতাম ছুটির ঘন্টা সিনেমার সেই বাথরুমে আটকে যাওয়ার ঘটনাটা ঘটেছিল এই স্কুলে।
যখনি এই স্কুল পেরুতাম, ছম ছম করে উঠতো বুকের ভেতর।
স্কুল ছুটির পরে মা বাবারা ঘুমিয়ে গেলে আমরা বাঁদরেরা, পা টিপে টিপে বাসা থেকে বের হয়ে শিশু সদনের পেছন সীমানা প্রাচীরে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতাম।
ফরেস্ট অফিসের পাশ দিয়ে ইট বিছানো রাস্তা চলে গেছে নাটোর সুগার মিল পর্যন্ত। এই রাস্তায় কিছুক্ষন পর পরই আখ ভর্তি লরি আসতো। আমাদের কাজই ছিল পেছন থেকে এই আখ টেনে খাওয়া।
আর নাটোরে ছিল তরমুজ; বাজারে গেলেই দেখা যেত এক তলা, দোতলা সমান উঁচু উঁচু তরমুজের গাদা।
আমার নাটোর ছিল সহজ সরল দয়ালু মানুষে ভরা।
সাতাশির পর দিন যত গিয়েছে, নাটোর কেন্দ্রিক আমার স্মৃতিগুলো আরো আরো বেশী সবুজ হয়েছে। শয়নে স্বপনে সব সময় মনে মনে বলেছি,
একদিন আসবো, ফিরে আসবো আবার...
কিছুদিন আগে দাপ্তরিক কাজে মাসখানেকের জন্য উত্তর বঙ্গে থাকতে হয়েছিল। ভুরঙ্গমারী, রাজীবপুর, রৌমারীর চর আর রঙপুর, গাইবান্ধায় প্রাণান্ত ব্যস্ততা শেষে ঢাকা ফেরার পথে বগুরার নট্রামসে একটু থেমেছিলাম। ইডেনের রিয়া'পু এখানে আছে ট্রেইনার হিসেবে, দেখা করার জন্যে।
কথায় কথায় উঠে এলো নাটোর। রিয়া'পু জানালেন এখান থেকে মাত্র এক দেড় ঘন্টার রাস্তা বাসে।
বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো, এত কাছে!!
শেষে আবেগের কাছে হার মেনে, গাট্টি বোচকা এবং ক্লান্ত সহকর্মীদের রিয়া'পুর জিম্মায় রেখে অফিসের গাড়ীতেই নাটোর রওনা দিলাম।
নাটোরে ঢুকতেই বড় একটা ধাক্কা। বিশাল বিশাল শীল কড়ইয়ের অস্তিত্ব বিনাশ করে সেই মেইন রোড এখন পুরোদস্তর তেল চকচকে পীচ ঢালা হাইওয়ে।
মাদল বাজানো ঘোড়ার গাড়ি নেই একটাও, তার বদলে হুশ হুশ করে বেরিয়ে যাচ্ছে বিশালাকায় সব বাস ট্রাক।
ফরেস্ট অফিস আর বেলঘড়িয়া স্কুলের মাঝামাঝি যায়গায় একটা কালভার্টের পাশে কয়েকটা টং দোকান নিয়ে বাজার মত ছিল, সেখানে এখন বিশাল এক গোল চক্কর।
বুকে চিন চিন ব্যথা নিয়ে একসময় শিশু সদনে ঢুকে আমি হতভম্ভ হয়ে গেলাম।
আমার কাছে মনে হতে লাগল, কোন না কোন ভাবে পুরো সদনের আয়তন ছোট করে ফেলা হয়েছে। অবকাঠামোগত পরিবর্তনতো আছেই।
চার পাশের সীমানা প্রাচীরটাই একবারেই দেখে ফেলতে পারছি আমি গেটের মুখে দাড়িয়েই।
যে বড় মাঠে ফুটবল খেলা হত, সেটাকে মনে হচ্ছে শাহবাগের টেনিস কোর্টের চেয়ে একটু বড়।
যেই হলুদরঙা দোতালা ডরমেটরীতে ছেলেরা থাকতো, সেটার পলেস্তারা খুলে ইট সুরকি বের হয়ে যেন আমাকে ব্যাঙ্গ করছে।
কিছুই আমার স্মৃতির সাথে মিলছে না।
আমি স্থানুর মত কিছু সময় গেটের মুখে (বা পুরো শিশু সদনে কেন্দ্রে) দাড়িয়ে থাকলাম।
এক ভদ্রলোক এসে জানতে চাইলেন, কারো কাছে এসেছেন?
না, ঠিক তা না
ঘুরতে এসেছেন?
আসলে আমরা এক সময় এখানে ছিলাম, আমার বাবা চাকুরী করতেন।
এই যে, এই বাসাতে আমরা ছিলাম। বাঁ পাশের বাংলোটা দেখিয়ে দিলাম।
আপনার বাবার নাম কি?
বললাম।
উনি চিনলেন। না চেনার কোন কারণ ছিলনা। বাবা এই শিশু সদনের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন, তাঁর হাতেই এটা গড়ে উঠেছিল।
ভদ্রলোক অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে আমাকে সব ঘুরিয়ে দেখালেন, কিন্তু আমি কোন প্রাণের ছোঁয়া পাচ্ছিনা।
এক সময় জিজ্ঞাসাই করে ফেললাম, আচ্ছা কোন কারণে কি সদনের আয়তন কমিয়ে ফেলা হয়েছে? আমার কাছে খুব ছোট মনে হচ্ছে...
উনি মৃদু হেসে বললেন, না, আসলে আপনিই বড় হয়ে গিয়েছেনতো....
আমি জেনে গেলাম, মানুষ বড় হয়। আর বড় হলে কখনোই ছোট বেলায় ফেরা যায়না।
![](https://s3.amazonaws.com/somewherein/pictures/ajax-loader.gif)
![](https://s3.amazonaws.com/somewherein/assets/css/images/generic-ads-580x400.jpg)
জাস্টিসের পক্ষে আছি, মবের পক্ষে নই!
♦أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشِّيْطَانِ الرَّجِيْمِ (বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহ্'র নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি)
♦بِسْمِ ٱللَّٰهِ ٱلرَّحْمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ (পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহ্'র নামে)
♦ٱلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ (আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক)
(ছবি নেট হতে)
ব্লগে... ...বাকিটুকু পড়ুন
বাংলাদেশ কি চিরকাল বিদেশি শক্তির ক্রীড়নক হয়েই থাকবে? আপনার কি মনে হয়?
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। তবে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতায় কোনো দেশই পুরোপুরি স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, বিশেষত যখন দেশটি ভূকৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকে। দক্ষিণ এশিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা বাংলাদেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমাদের শবে বরাতের দিন গুলো সব বদলে যাচ্ছে....
যখন ছোট ছিলাম তখন শবে ই বরাত এলে আমাদের বাসায় বাসায় একটা উৎসবের মত অবস্থা হত। ঈদের আগের উৎসব এই দিন দিয়েই শুরু হত তখন । যতই ধর্মীয় গাম্ভীর্যের ভাব... ...বাকিটুকু পড়ুন
আওয়ামী লীগ বর্তমানে বিজেপির বাংলাদেশি শাখা.....
হিসাবে দায়িত্ব পালন করছে এমন মন্তব্য করেছেন কলকাতার সাংবাদিক ও লন্ডন ভিত্তিক একটিভিস্ট অর্ক ভাদুড়ী। ফাইনালি কলিকাতার একজন দাদা বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যে হারে কলিকাতার ফাটাকেস্ট শুভেন্দু ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন
রাজনৈতিক দলের দোষ বনাম ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিস্টেম লস ।
আমরা খুব দু:খের সাথে দেখছি , ম্যাচিউর ব্যক্তিদের চিন্তা ভাবনার লেবেল নাবালক বা ১৮/২০ বয়সের স্থরে অবস্থান করা নিয়ে । যারা নিজেদের শুধু রাজনৈতিক দলের দোষ চর্চার... ...বাকিটুকু পড়ুন