প্রতি সপ্তাহে শুক্রবারগুলো আসে খুব দেরি করে আর চলে যায় অতি দ্রুত। বৃহস্পতিবার অফিসে এসে প্রথমেই যে কাজ করি তা হলো রিন্টুকে ফোন করা। মুঠোফোনের কল্যাণে ধুন্ধুমার ব্যস্ততার মধ্যেও রিন্টুকে আমি কাছে পেয়ে যাই। ‘জুঁথিকে নিয়ে কাল চলে আসিস... দেখি দোস্ত, সময় পাইনা...
শুক্রবারে কোন স্যিডুল রাখতে ভাল লাগেনা, রাখিও না। বেশ বেলা করে উঠে অলস অলস শরীরে পত্রিকার সাথে নাস্তা সেরে আস্তে আস্তে নামাজের জন্য প্রস্তুতি, তারপর দুপুরের খাওয়া শেষ হতেই চলে আসি এই জায়গাটাই, এই জাম গাছটার নিচে। পেছনে একটা তালগাছ, নতুন যৌবনের হাতছানিতে উচ্ছল, আমাদের ছায়া দিচ্ছে তার নবীন পাখায়। ক’বছর আগে একদিন ভাষা ইন্সটিটিউটের পেছনে জল বিয়োগের তাড়নায় হাটু সমান উঁচু আমাদের বসার প্রাচীরটা দ্রুত পার হতে গিয়ে ছোট্ট যে তালগাছের চারাটা মাড়িয়ে গিয়েছিলাম, এখন সেটাই আমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যেই হঠাৎ বেশ বড় হয়ে গেছে।
কত দ্রুত দিনগুলো ধুসর হয়ে গেল...
আমরা যখন ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হলাম, তখন লেকচার থিয়েটার’র নিচ দিয়ে কমার্স ফ্যাকাল্টির উঠোন মাড়িয়ে হলে ফিরতাম, আসতাম। এখন সেখানে চোথাপত্র হাতে নিয়ে ইয়াং সব প্রভাষকেরা আস্তানা গেড়েছে, ক’দিন হলো? মধুর ক্যান্টিনের সামনে আইবিএ’র যে গেটটা ছিল, সেটা এখন আর নেই, ওটা চলে গেছে সেন্ট্রাল মসজিদের পেছন দিকে। আইবিএ-ওয়ালাদের অনেক টাকা, ওরা নতুন রাস্তা করে নিয়েছে। এই রাস্তা আর মধুর ক্যান্টিনের মধ্যবর্তি যে জংলার মধ্যে ঝুপ করে সন্ধ্যা নামার আগে আমরা বেজির আনাগোনা দেখতাম, থার্ড ইয়ারের প্রথম দিকে এসে সেলিম ভাই সেখানে চা’য়ের দোকান দেয়ার পর পুরো যায়গাটা বদলে গেল। সেলিম ভাই ডাকসু ক্যাফেতে চাকুরী নিয়ে চলে গেছে আমরা যখন ফোর্থ ইয়ারের শেষ প্রান্তে।
কিন্তু আমাদের মত বখাটেদের সেরা পছন্দ হয়ে যায়গাটা আবাদ হতে থাকল সেলিম চত্তর নাম নিয়ে। এখন দেখি কর্তৃপক্ষ আমাদের উচ্ছেদ করে সেখানে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের জন্য নতুন ভবন তৈরী করছে। আজকের নতুনরা জানবেইনা, এখানে কি বিশাল এক শীলকড়ই গাছ আমাদের আশ্রয় দিয়েছিল দিনের পর দিন, মায়ের মত। শামসুননাহার হলের সেই ঘটনার পরদিন ক্যাম্পাসে প্রথম যখন ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হল, আমরা তখন এই গাছটার নিচে বসা ছিলাম, তিথি, সাবরীনা, মাহফুজ, লুবনা, জুঁথি, শিল্পী, সালাম, রিন্টু কানিজ....
আমরা যেখানে বসি এখানে সুবিধা হল সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে মূল রাস্তা ধরে যারাই যাওয়া আসা করবে, তাদেরকে দেখা যাবে ভালভাবে। পরিচিত চেহারা হলেই ডাক দেয়া যায়, আবার সাদ্দামকে ডাক দিলেই চা বা পুরি দিয়ে যায়।
তারপর একেক করে আসে রিন্টু-জুঁথি, মিরপুর থেকে মুকুল, মোহাম্মদপুর থেকে রিপন, যাত্রাবাড়ী থেকে শাওন-মিপু, মুন্সীগঞ্জ থেকে ইসহাক, কোন কোন সময় ইকবাল আসে কলিকে সঙ্গে নিয়ে। আবার মাহফুজ আসে লুবনার সাথে, ওদের একটা ফুটফুটে মেয়েও জুটেছে ইদানিং, নাম সুবাতা। মুকুলকে বিয়ে করে দ্রুত সিনিয়র হয়ে যাওয়া মনি আসে, এখনও হলে থাকা আমাদের ছোট বোন কাম বন্ধু রুমানা আসে, আর আসে মুকুলের শালী এ্যানথ্রোতে পড়া তান্নি।
তুমুল অপরিচিতদের ভীড়ে পরিচিতদের খোঁজার চেষ্টা মাঝে মধ্যে সফল হয়ে যায়। দেখা হয় অনেকদিন পরে ভাল লাগা কিছু মুখের সাথে। বা কোন সময় তা হয় মরিচিকার মত। হয়ত পিঠ সোজা করে রাস্তার দিকে চোখ রেখে একটু দুলে দুলে কোন মেয়ে হেটে যাচ্ছে, বুকের এক অচিন কোনায় ধ্বক করে ওঠে...
তারপরও বেশ জমে যাায় হলুদ হয়ে আসা বিকেলটা। প্রাণ খুলে হাসি আমরা, ধুসর সময়ে সবুজকে ফিরিয়ে আনার ব্যর্থ চেষ্টা। বর্তমানের এই ব্যস্ততার মাঝেও শুক্রবারের এই সময়টুকুতে আমরা ফিরে যাই আমাদের সময়ে।
এক সময় বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়। ছয়টা বাজে, সাতটা, আটটা, সাড়ে আটটা তারপর নয়টা... সেন্ট্রাল লাইব্রেরির বাতিগুলো নিভে যায় একটা একটা করে। বিদায় নেয় সবাই। আমি চুপচাপ বসে থাকি আরো কিছু সময়। আমাদের সময়ের দুর্বল পরাজিত এক প্রতিনিধি হয়ে।
তারপর জাকিরের দোকান থেকে একটা বেনসন নিয়ে অগত্যা আমিও পা বাড়াই সেই অর্থহীন ব্যস্ততার দিকে....
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুলাই, ২০১৭ সকাল ১০:৫০