প্রথম পর্বঃ Click This Link
দ্বিতীয় পর্বঃ Click This Link তৃতীয় পর্ব: Click This Link
চতুর্থ ও শেষ পর্ব: তৃতীয় পর্বের ধারাবাহিকতায়
চতুর্থ সংশোধনীর ঝাপ্টায় এর তাৎপর্য নিয়ে আলোচনার চেয়ে বিষয়টাকে কেবল বাকশাল বিরোধী ক্যাম্পেন হিসাবে নিয়ে প্রচারণা হয়েছে বেশী:
বাকশাল ঘোষণা কায়েম করার পর এমনকি শেখ মুজিবের হত্যার পর সমাজের বাকশাল নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় আমাদের কনষ্টিটিউশন যে ইতোমধ্যেই মৃত জানাজা দাফন সম্পন্ন হয়ে গেছে সে দিকটা উপেক্ষায় থেকে গেছে। সেসময় থেকে আজ অব্দি সবচেয়ে বেশী মাতামাতি চলেছে ১। ষষ্ট অধ্যায়ে Part VIA সংযুক্তিতে সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একটাই সরকারি জাতীয় দল বাকশাল নিয়ে,
২। সব জেলাকে বাকশালী গভর্ণর একছত্র রাজনৈতিক, প্রশাসনিক কর্তৃত্ত্ব আনার আইন District Administration Act 1975,
৩। চারটি পত্রিকাকে সরকারি মালিকানায় নিয়ে বাকিদের নিষিদ্ধ ঘোষণার The Newspapers (Amendment of Declaration) Act 1975
উপরের এই তিনটা প্রসঙ্গকে ঘিরে আওয়ামী লীগ বা বাকশালের বিরুদ্ধে প্রচারণা, ক্ষোভ প্রকাশ হয়েছে সবচেয়ে বেশী। কিন্তু এগুলো ছাড়া কনষ্টিটিউশনের চতুর্থ সংশোধনী ঘটনার রাজনৈতিক তাৎপর্য কী, এই সংশোধনীর কোন রাজনৈতিক পর্যালোচনা, কেন বাকশাল খারাপ সেদিকে থেকে কোন আলোচনা - এসব হয়নি বললেই চলে। এমনকি কেবল আইনের দিক থেকে আইনী পেশার কেউ, বিচারক এদের রাজনৈতিক নয় আইনী পর্যালোচনাও আমরা দেখিনি। প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামালের একটা বই অবশ্য দেখা যায়। সেটা চতুর্থ সংশোধনীতে কনষ্টিটিউশনের বদল কী হয়েছে, এর আইনী তাৎপর্য কী সেদিকে স্পষ্ট করে না গিয়ে বরং শেখ মুজিব নিহত হবার পর চতুর্থ সংশোধনীতে করা বদলগুলো পুনস্থাপন বা amendment করতে গিয়ে মোস্তাক, সায়েম, জিয়া মুল কনষ্টিটিউশনের “মৌলিক চরিত্রে” কী কী বদল ঘটিয়ে ফেলেছেন তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা আছে সেখানে। অথচ সেসময় থেকে এগুলো শুরু হতে পারলে রাজনৈতিক বিষয়ে, কনষ্টিটিউশনের রাজনৈতিক পর্যালোচনার মাধ্যমে ব্যাপক জনগণকে সম্পৃক্ত করা যেত। শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর সমাজ একটা বড় তোলপাড় আলোড়নের ভিতর দিয়ে গিয়েছে। সবাই কান খাড়া করে শুনতে চেয়েছিল - সেই সুযোগ নিয়ে শুনানোর কর্তব্যকাজ করলে আগামী কোন কনষ্টিটিউশনের রক্ষা পাবার একমাত্র পথ হতে পারে সেটা। সে যা হোক, বিচারপতি মোস্তফা কামালের বইটা রাজনীতি অথবা আইনের দিক থেকে বাংলাদেশের কনষ্টিটিউশনাল জার্নি বুঝার জন্য একটা ভাল বই হওয়া সত্ত্বেও এই ঘাটতি পাঠককে অতৃপ্ত রাখবে। তিনি এর একটা ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, চতুর্থ সংশোধনীতে এলোমেলো করে দেয়া রদবদলগুলো নিয়ে বেশী ঘাটাঘাটি করা অপ্রয়োজনীয় কারণ সে শাসন ছিল স্বল্পকালীন। অথচ সেই ১৯৭৪ সাল থেকেই কনষ্টিটিউশন আজ পর্যন্ত মৃত, ওর জানাজা দাফন সম্পন্ন হয়ে গেছে; সেদিকে তাকিয়ে নতুনের সম্ভাবনা কী সেই আলো ফেলতে পারতেন। সে কাজ না করে মৃত কনষ্টিটিউশনের ভিতরেই গভীর মনোযোগে মোস্তাক, সায়েম, জিয়া এমেন্ডমেন্ট করতে গিয়ে মুল কনষ্টিটিউশনের “মৌলিক চরিত্রে” কী কী ক্ষুন্ন করেছে তাই দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তাঁর বিষয় হয়েছে। যে কনষ্টিটিউশন তার মৌলিক ভিত্তি নুন্যতম জনগণের শাসন কর্তৃত্ত্বের দলিল হওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে সে তো মৃত। এরপর ওর “মৌলিক চরিত্রে” বলে আলাদা বৈশিষ্ট আরোপ করে তা তালাশ করা অর্থহীন। শুধু তাই নয় আমি মনে করি কনষ্টিটিউশন তার মৌলিক ভিত্তি ওর প্রাণের দিক ভুলে “মৌলিক চরিত্রে” তালাশের প্রচেষ্টা থেকেই আজকের আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রের মৌলিক চারনীতি বলে অন্তসারশুণ্য দলবাজির রাজনীতি জন্মাবার কারণ খুজে নিয়েছে।
এগুলো আমাদের সমাজের রাজনৈতিকতা (Polity) মাত্রা বা আমাদের রাজনৈতিক সচেতনতার দুর্বলতা চোখে আঙুল দিয়ে প্রকাশ করে। অবস্হা এমনই যে কনষ্টিটিউশনের প্রাণভোমরা বের করে নিয়ে তা হত্যা করা হয়ে গেছে বহু আগেই সে নজর খবর নাই অথচ ঐ মৃত কনষ্টিটিউশনের “মৌলিক চার নীতির” গেল গেল বলে রব তুলে সেই আততায়ী ও হত্যা ঘটনাকে আড়াল করা হচ্ছে; আবার এই রব তোলা ব্যক্তিবর্গরা নিজেদের মহান গণতন্ত্রী, আইনের শাসন ও ১৯৭২ সালের কনষ্টিটিউশনের অটুট পৃষ্টপোষক বলে জায়গা করে নিচ্ছেন। এযেন সেই গ্রামের সেই প্রবাদ, বলছে মানুষটা সাপে কেটে মারা গেছে ঠিকই কিন্তু ভাগ্যিস চক্ষুতে ছোবল পরে নাই।
আমাদের কনষ্টিটিউশনের মৌলিক ভিত্তি যাকে আমি প্রাণভোমরা বলছি এটাই কনষ্টিটিউশনের মৌলিক দিক না কী 'রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি' বলে অন্য আর যা লেখা আছে তা কনষ্টিটিউশনের মৌলিক দিক? নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের মুরোদ যদি কোর্টের না থাকে, নাগরিকের মৌলিক অধিকারের বিরোধী সাংঘর্ষিক যা খুশি তাই আইন বানানোর ক্ষমতা যদি জাতীয় সংসদ পায় তবে ঐ মৃত কনষ্টিটিউশনে রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি থাকলো না গেল তাতে কী কিছু যায় আসে?
তাহলে রাষ্ট্রের মৌলিক নীতির ধুয়ো তুলা একটা রাজনৈতিক শঠতা ছাড়া আর কী? শেখ মুজিব তো রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি অটুট রেখেই চতুর্থ সংশোধনী দিয়ে কনষ্টিটিউশনের উপর বলাৎকার করেছেন তাতে কী এরপরও আমাদের কনষ্টিটিউশন জীবিত ছিল আমরা ধরে নিব? বিচারপতি মোস্তফা কামাল নিজেই তাঁর বইতে চতুর্থ সংশোধনীকে ব্যাপক ধবংসযজ্ঞ বলছেন (havoc wrought by the Fourth Constitution to the original basic structure of the constition, পৃষ্টা ৫৩) । এর তিনপাতা পরে তিনিই আবার প্রশ্ন তুলে বলছেন, The ‘fundamental principles of the constitution’ had undergone a fundamental change.
তাঁর fundamental principles of the constitution’ প্রসঙ্গের তোলা কথা সুরঞ্জিত, আওয়ামী লীগ সহ তথাকথিত আইন বিশেষজ্ঞদের মুখে কুতর্কের কথা ফুটতে সাহায্য করেছে, কনষ্টিটিউশনের মৌলিক ভিত্তি কী, যাকে আমি প্রাণভোমরা বলছি সে সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়াতে সাহায্য করেছে, করে যাচ্ছে।
যারা যারা রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তি কী এনিয়ে কুতর্কে মেতেছেন এরা পড়ালেখা না জানা কেউ নন। এরা কীভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন এর বিচার পাঠক নিজেরাই করতে পারবেন। কনষ্টিটিউশনের FUNDAMENTAL PRINCIPLES OF STATE POLICY শিরোনামটা ওর দ্বিতীয় অধ্যায়ের। এই অধ্যায়ের প্রথমটা হলো অনুচ্ছেদ ৮, যা FUNDAMENTAL PRINCIPLES প্রসঙ্গে কথা বলেছে। অনুচ্ছেদের ৮ এর শেষ কয়েক শব্দ হলো, .........but shall not be judicially enforceable. অর্থাৎ বিচারআচারের কর্তৃত্ত্ব দিয়ে প্রয়োগে নেবার বিষয় এটা নয়। পাঠকের আরও বুঝবার জন্য একটা তুলনা দেই। কনষ্টিটিউশনের তৃতীয় অধ্যায় নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। নাগরিকের মৌলিক অধিকার judicially enforceable বিষয়। অর্থাৎ এটা প্রয়োগ প্রতিকার চাইতে নাগরিক মৌলিক অধিকার বলে move to High Court এর অধিকার রাখে (অনুচ্ছেদ ৪৪) এবং enforcement of any the fundamental rights (অনুচ্ছেদ ১০২) এর ক্ষমতা বলে হাইকোর্ট এর প্রতিকার দিতে সরকার বা সংসদের আইনের উপরে নির্দেশ জারি করে তা নাকচ, বাতিল করার ক্ষমতা রাখে।
তাহলে STATE POLICY যেটাকে judicially enforceable রাখা হয়নি তাকেই “বিশেষজ্ঞরা” কনষ্টিটিউশনের মৌলিক নীতি ইত্যাদি বলে গগন ফাটাচ্ছেন, আর যেটা judicially enforceable সেটার ব্যাপারে নিশ্চুপ কেন? চতুর্থ সংশোধনী judicially enforceable বিষয়ের আসল দিক কোর্টের ক্ষমতাটাই নাকচ করে দিয়েছে – এর চেয়ে কনষ্টিটিউশনের মৌলিক দিক নাকচ আর কী হতে পারে? জরুরী আইন অথবা সামরিক আইন যে কোনটাই হোক না কেন কনষ্টিটিউশনের মৌলিক নীতিগত দিক বৈশিষ্ট নাকচ করা মানে কনষ্টিটিউশনের উপর বলাৎকার করে ওর মৃত্যু ঘটানো।
এখন তাহলে কী করব? কারণ প্রশ্ন হলো, কনষ্টিটিউশনের মৌলিক দিক, প্রাণভোমরার রক্ষার কথা লিখে রেখেও কনষ্টিটিউশনের হত্যা বলাৎকার বন্ধ করা যায় নাই – এটাই বাস্তবতা। তাহলে উপায় কী? একমাত্র উপায় আবার সেই ঘুরে ফিরে জনগণ। কনষ্টিটিউশন লিখে কায়েম করার জিনিষ না। কনষ্টিটিউশনের মৌলিক ইস্যুগুলো নিয়ে সমাজে রাজনৈতিক আন্দোলন হতে হবে, কেন ইস্যুগুলো জনগণের প্রত্যেকের জন্য গুরুত্ত্বপূর্ণ তা নিয়ে সমাজে নাড়াচাড়া ফেলতে হবে, আন্দোলিত করে ফেলতে হবে। এরপরে বসে লেখালেখির চেয়ে ওটাই মুল গুরুত্ত্বপূর্ণ কাজ। ওকাজে সফল হতে পারলে কামাল হোসেনের মত কোন লোক বাপবাপ বলে তা গুছিয়ে লিখতে বাধ্য। কারণ, সে লিখুক আর নাই লিখুক সমাজে আসল কনষ্টিটিউশন আগেই প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে, যেন সে কেবল ঐ সামাজিক আলোচনা মিটিংয়ের বড় জোড় সেক্রেটারী, মিনিটস লেখক। এর বদলে উল্টাচিত্রে আমরা যদি দেখি, কামাল হোসেন নাকি কনষ্টিটিউশন প্রণেতা তাহলে তো যা আমরা দেখছি তাই-ই হবার কথা।
দেশী বিদেশী যে কেঊ, সমাজের যে কোন সংকীর্ণ স্বার্থ জরুরী আইন অথবা সামরিক আইনের নামে ক্ষমতা দখল করলে আমরা ব্যাপক বিক্ষোভে ফেটে পড়িনা, আপত্তি প্রতিবাদে পর্যদুস্ত করিনা। এই দুরাবস্তা থেকে জনগণকে বের করে আনতে হবে। এটাই হতে পারে একমাত্র প্রতিকার রক্ষাকবচ। অথচ আমরা মশগুল আছি, রাষ্ট্রের চার নীতি নিয়ে দলবাজিতে, মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি তৈরিতে।
আচ্ছা প্রশ্ন করা যাক রাষ্ট্রের মুলনীতি যাই থাক তা judicially enforceable নয় কেন? কারণ, লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, রাষ্ট্রের মুলনীতি বলে যা বলা হয়েছে, এগুলো মুলত রাজনৈতিক কর্মসুচী। রাজনৈতিক কর্মসুচী কোন কোর্টের হুকুম দিয়ে বাস্তবে বাস্তবায়ন করা যায় না, বিষয়ও নয়। আবার রাজনৈতিক কর্মসুচী নিয়ে সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে রাজনৈতিক মতভেদ বিরোধীতা থাকাটাই স্বাভাবিক। এগুলো কাটানোর একমাত্র পথ হলো, রাজনৈতিক মতাদর্শগত লড়াই, তর্কবিতর্ক । রাষ্ট্র, কনষ্টিটিউশন কোর্টের ভুমিকা সেখানে বড় জোড় কেঊ কারও মৌলিক অধিকারের দিক যাতে খর্ব না করে সেদিকে নজর রেখে রাজনৈতিক মতাদর্শগত লড়াই তর্কবিতর্ক চলতে দেয়া, আর সামাজিক সে বিরোধীতা বিতর্ক নিরসনের জন্য অপেক্ষা করা। যার মাথা ইসলামী চিন্তায় আচ্ছন্ন ওকে রাস্তায় পিটিয়ে মেরে ফেলে সমাজ থেকে ঐ চিন্তা ঊধাও করা যাবে না, যায় নাই। নকশালী রাজনীতির চিন্তা এত সীমাহীন নিপীড়নের পরও এখনও সমাজে অটুট আছে।
আবার সুরঞ্জিতের কথায় ফিরে আসি। সুরঞ্জিতের সাংবিধানিক পরিষদে মানে কনষ্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলী বা গণপরিষদের সভা বসানো ছাড়া জাতীয় সংসদে বসে কনষ্টিটিউশন ও এর মৌলিক নীতি কায়েমও করা যায় না, বদলও করা যায় না। আমরা এটা একবাক্যে মানতে চাই বলেছি। সেই সাথে সুরঞ্জিতকে সৎভাবে ভেবে দেখতে পরামর্শ দেই, শেখ মুজিবের চতুর্থ সংশোধনী কী একই অভিযোগে অভিযুক্ত নয়? কনষ্টিটিউশনের মৌলিক নীতি নিয়ে কথা তুলার আগে শেখ মুজিবই প্রথম কনষ্টিটিউশনের মৌলিক নীতি অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ করেছেন, ধুলায় লুটিয়েছেন। আমাদের কনষ্টিটিউশন কাঊকেই কোর্টের enforcement of any the fundamental rights (অনুচ্ছেদ ১০২) এর ক্ষমতা নাই, কেড়ে নিলাম একথা ঘোষণার অধিকার দেয় নাই। শেখ মুজিবই প্রথম সে কাজ এবং অপরাধ করেছেন; খোদ কনষ্টিটিউশনে চতুর্থ সংশোধনী সংযোজন করে। এর একটাই অর্থ হয়, কনষ্টিটিউশনকে বলাৎকার করে মৃত ঘোষণা করে ফেলে রাখা। এর পরবর্তীকালে আজ পর্যন্ত কনষ্টিটিউশনে আরও যেসব সংশোধনী নামে তামাশা হয়েছে তাকে বলাৎকারে মৃত মানুষের উপর পুনর্বার বলাৎকারে ওকে জীবিত করার প্রচেষ্টা বৈ আর কিছু নয়। রাজনীতিবিদ নয়, একজন এডভোকেট হিসাবে এসব আপনার আমার চেয়ে ভাল জানার কথা। জনগণকে বিভ্রান্ত না করে সত্য জানতে দেয়া ভাল। এতে অন্তত আগামী প্রজন্ম নতুন করে কিছু গড়ার সুযোগ পেতে পারে।
নতুন করে জনগণকে সংঘবদ্ধ করে নতুন রাষ্ট্রে সংগঠিত হবার ভিত্তি কী হবে তা নিয়ে পরস্পর আলোচনা তর্কবিতর্কে লিপ্ত হয়ে নতুন কনষ্টিটিউশন প্রণয়ন করতে বসতে পারে। নাগরিকদের পরস্পরের সাথে আলোচিত সেই আন্ডারষ্টান্ডিংয়ের ভিত্তিতে একটা নতুন রাষ্ট্র গঠন কায়েম হোক, আজ অথবা কাল এঘটনাটাই ঘটবে, ওকে জায়গা ছেড়ে দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
সবশেষে আমার এত কিছু বলবার আগেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রথম আলোর সাক্ষাতকারে তাঁর বিশেষ সাধের ১৯৭২ সালের কনষ্টিটিউশনের চার মুলনীতির একটা, সমাজতন্ত্র নিয়ে কী বিপদে পড়েছিলেন “মুলনীতির” সেই তামাশা দেখে আমার পোষ্ট শেষ করব।
প্রথম আলোর সুরঞ্জিতকে করা প্রশ্নটা ছিল, চার মুলনীতি ঠিক থাকবে কি না?
সুরঞ্জিতের জবাব বেশ লম্বা। ওখান থেকে শেষ অংশ এখানে তুলে এনেছি। এরপরেও তা অনেক বড়। পাঠক কষ্ট করে আগে পড়ে নিন।
......সে ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই সংবিধানের চার মূল নীতি পুনঃস্থাপিত হবে। তবে এ ক্ষেত্রেও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য থাকতে পারে। যেমন—চার মূল নীতিতে সমাজতন্ত্রের কথা আছে। প্রশ্ন হলো, ওয়ার্কার্স পার্টি যে সমাজতন্ত্র চায়, তার সঙ্গে জাসদের সমাজতন্ত্রের মিল নেই। আবার তারা যে সমাজতন্ত্র চায়, তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের সমাজতন্ত্রেরও মিল নেই। সমাজতন্ত্রের মূল কথা হলো রাষ্ট্রীয় মালিকানা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয়, ব্যক্তি ও সমবায়—তিন ধরনের মালিকানার কথা বলেছিলেন।
আমরা মনে করি, সবকিছুই করতে হবে বাস্তবতার নিরিখে। বাহাত্তরের সংবিধান হয়েছিল ৩৮ বছর আগে। বর্তমানে দেশীয় ও বিশ্ববাস্তবতা ভিন্ন। এসব বিবেচনা রেখেই কমিটি সম্ভাব্য সবকিছু করবে। এটিকে উল্টোরথও বলা যায়। পঁচাত্তরের পর দেশকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। তার বিপরীতে যে লক্ষ্য নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম, সেই লক্ষ্যেই আবার পৌঁছাতে চাই।
আমাদের লক্ষ্যণীয় পর্যবেক্ষণে ধরা পড়া বিষয়গুলো হলো,
১। চার মূল নীতি পুনঃস্থাপিত হবে বলে এখনো তিনি দাবি করছেন, তবে if, but আছে প্রচুর।
২। আমাদের জনগোষ্ঠির এ ক্ষেত্রেও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য থাকতে পারে এটাও মেনে নিচ্ছেন।
৩। তিনি যে সমাজতন্ত্রের এই আকালে সময় মুলনীতির সমাজতন্ত্র নিয়ে বিপদে পড়েছেন তা বুঝা যাচ্ছে। নানান সংজ্ঞার সমস্যা, তিনি নিজে কী সংজ্ঞা নির্ধারণ, পছন্দ করবেন সে সমস্যা তিনি প্রকট ভাবে টের পেয়েছেন। একই দশা বাকি চার “মুলনীতি” নিয়েও যে পড়বেন তা বলাই বাহুল্য।
৪। কনষ্টিটিউশনের বয়স, দেশীয় ও বিশ্ববাস্তবতা ভিন্নতা – এসব কথা তুলার একটাই মানে বাস্তবতার নিরিখে –এই অজুহাতে তিনি তার শখের চার “মুলনীতি” তে বাঁ হাত ঢুকাবেন এটা পরিস্কার বুঝাই যাচ্ছে।
এখান থেকে আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারি,
১। চার “মুলনীতি” বলে যে আমাদের মধ্যে একটা কপট পবিত্র ভাব ধরার চেষ্টা সুরঞ্জিত ও আওয়ামী বৈঠকখানা গুলো করে সেগুলো মিথ্যা বুজরুকী। কারণ নিজেদেরই মুলনীতি বলে অনড় কোন কিছুতে যে বিশ্বাস নাই সেটাই এখানে স্পষ্ট।
২। চার “মুলনীতি” পবিত্র কিছু নয়। ওর পুরোহিত সুরঞ্জিত তাই ওগুলো নিয়ে উঠাচ্ছেন আর ফেলছেন, পায়ে দলে “বাস্তবতার নীরিখে” সহজেই বদলে ফেলার ইংগিত দিচ্ছেন।
৩। আগে আমরা দেখেছিলাম চার “মুলনীতি” judicially enforceable রাখা হয়নি। এখন দেখছি শুধু তাই নয় এগুলো সহজে বদলেও ফেলা যায় এবং সুরঞ্জিত তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করছেন। তাহলে মুখটা গম্ভীর করে ঘাড় বাকিয়ে কপট পবিত্রতায় চার “মুলনীতি” ভক্তিভাবে উচ্চারণ করার কোন কারণ আসলে নাই। এনিয়ে লাঠালাঠি আসলে দলবাজি রাজনীতির হাতিয়ার মাত্র।
৪। আমরা আগে বলেছিলাম রাষ্ট্রের এই তথাকথিত চার “মুলনীতি” আসলে বড় জোড় একটা দলের রাজনৈতিক কর্মসুচী বলে বিবেচিত হতে পারে। কোনভাবেই কনষ্টিটিউশনের মৌলিক ভিত্তি নয়। রাজনৈতিক কর্মসুচী সমাজে তর্কবিতর্কে নিরসন নির্ধারণ করার বিষয়। আমরা কী বাঙ্গালি বা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ করব, গণতন্ত্র না সমাজতন্ত্র করব, না কী আল্লাহর উপর আস্থা বিশ্বাস রাখব, না কী সমাজে ন্যায়বিচার বা ইনসাফের রাস্তা ধরব ইত্যাদি।
অতএব স্পষ্ট করে বলে রাখার সময় এসেছে কনষ্টিটিউশনের মৌলিক ভিত্তির দিক ভুলে, এর সাথে তথাকথিত রাষ্ট্রের চার মৌলনীতির বলে কোন কিছু মিশিয়ে ফেলার চেষ্টা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মানুষ, রাজনীতিকে বিভ্রান্ত করা। এক দলবাজি রাজনীতির চর্চা করা।
সমাপ্ত।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে আগস্ট, ২০১০ বিকাল ৪:১৪