somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কনষ্টিটিউশন সংশোধন পর্যালোচনা

১৮ ই আগস্ট, ২০১০ রাত ২:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের জাতীয় সংসদে “সংবিধান সংশোধনের” লক্ষ্যে একটা ‘বিশেষ কমিটি’ গঠন করা হয়েছে গত ২১ জুলাই ২০১০। ইতোমধ্যে ঐ কমিটি বেশ কয়েকটা বৈঠকও করে ফেলেছে। এদিকে এবিষয় নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো কিছু পরিপূরক কাজ হাতে নিয়েছে, আমরা দেখতে পেয়েছি। প্রথম আলো আমাদের জানাচ্ছে, “সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার সংবিধান সংশোধনের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। এ ব্যাপারে প্রথম আলো মুখোমুখি হয়েছে বিশেষজ্ঞদের”। এরই প্রথম পর্ব হিসাবে ১১ আগষ্ট ২০১০ প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছে “সংসদীয় বিশেষ কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অভিমত”। পাঠককে সাথে নিয়ে এখন সেই ‘অভিমত’ পর্যালোচনা করব ।

প্রথম আলোর কথোপকথনের এই বিশেষ পর্ব কী ‘সাক্ষাতকার’, না ‘মুখোমুখি হওয়া’, না কেবল ‘অভিমত’ নিয়ে ছাপিয়ে দেয়া তা নির্ণয় করে বলা মুশকিল। পাঠক তা নির্ধারণে ধন্ধ্যে পড়তে পারেন। যেটাই নেয়া হয়ে থাক, সোজা কথায় এই কথোপকথনের ফরম্যাটটা দেখে মনে হয়েছে, তৈরি প্রশ্ন আগেই পাঠিয়ে দিয়ে পরে জবাব সংগ্রহ করে নেয়া ধরণের; উত্তরদাতার জবাবের পিঠে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করার অথবা অপরিস্কার বক্তব্য পরিস্কার করে নেবার কোন সুযোগ ওখানে নেওয়া হয়েছে এমন মনে হয় নাই; এটা হয়ত ইচ্ছা করেই অথবা ইচ্ছা করতেই চাওয়া হয় নাই কোন সীমাবদ্ধতার কারণে, এমন এক সীমিত ফরম্যাটে এই কথোপকথন ঘটেছে। তবে পরিচিতি পর্ব শেষে প্রথম আলো আবার আমাদের জানিয়েছে, “সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও মিজানুর রহমান খান"”।

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শুধু ঐ বিশেষ কমিটির কো-চেয়ারম্যানই নন, কমিটির কমবিনেশন দেখে বুঝা যায় কাজের টেকনিক্যাল ষ্টেয়ারিং সুরঞ্জিতের হাতে আর বাকিরা কমিটির অলঙ্কার বিশেষ। আর ওদিকে উপরে আছে শেখ হাসিনার ইচ্ছা-অনিচ্ছা তো আছেই। সারকথায়, চলতি কনষ্টিটিউশনে ঠিক আওয়ামী লীগেরও নয় আর, জনগণ তো নয়ই, বরং হাসিনার অলিগর্কি চোরা গলির ক্ষমতাকে আরও নিরঙ্কুশ করতে সাজিয়ে গুছিয়ে কনষ্টিটিউশনকে ‘সংশোধন” করে হাজির করে দেবার কাজের মধ্যমনি হিসাবে হাজির আছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, তা বলাই বাহুল্য। সেই কথা মনে রেখে আমরা সুরঞ্জিতের কথাগুলো এখন বুঝতে যাব।

আমাদের সমাজের এই মুহুর্তে এক অদ্ভুত বৈপরিত্যে চলছে; একদিকে দাবী করা হচ্ছে ‘জনগণের’ জন্য নাকি কনষ্টিটিউশনকে ‘সংশোধন” এর কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। অথচ ওদিকে আমরা দেখতে পাচ্ছি কনষ্টিটিউশনে যাই থাক বা না থাক নিম্ন থেকে উচ্চ সারা বিচার বিভাগ নির্বাহী হাসিনার সরকারের কব্জার মধ্যে তড়পাচ্ছে; শ্যোন এরেষ্ট, রিম্যান্ড, একই ঘটনায় ৬৪ জেলা জুড়ে মামলার উপরে মামলা, চেম্বার জাজ ইত্যাদি এখন মুখে মুখে আলোচনার বিষয়। এসবের পরিণতিতে, সমাজে আইন-আদালত কোথায় জনগণকে আইনী নিরাপত্তা দিবে, মানুষকে নিরাপদ বোধ দিবে এর বদলে সমাজের আইন-আদালত হয়ে উঠেছে জনগণকে ক্ষমতাসীনের নির্যাতন ও হয়রানির হাতিয়ার।
কথিত আসামীকে পুলিশী হেফাজতে নিয়ে নির্যাতন ঠেকাতে কথিত আসামীর সাথে পুলিশ (সেই সাথে অদৃশ্যরা) কেমন, কীভাবে ব্যবহার করবে, আর হেফাজত-কালীন সকাল বিকাল ডাক্তার দেখিয়ে চেকআপ করাবে হেফাজতে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে কী না ইত্যাদি বিষয় রেখে হাইকোর্ট এক নির্দেশনা দিয়েছিল ২০০৫ সালে। হাসিনার এটর্নী জেনারেল সম্প্রতি সেই নির্দেশনার বিরুদ্ধে, ঐ নির্দেশ স্থগিত করাতে চেম্বার জাজের কাছে ধর্না দিতে গিয়েছিল। অর্থাৎ হাসিনা ও তাঁর সরকার নিজেই পুলিশী হেফাজত বা রিম্যান্ডে নিয়ে যে নির্যাতন করতে চায়, এই ধর্ষকামী ইচ্ছা যে তাঁর আছে এটাই প্রকাশ্যে প্রমাণিত করেছিল এবং বেহায়ার মত নির্যাতনের স্বপক্ষে সরকার যে আদালতের সীলমোহরও হাসিল করতে চায় তা প্রকাশ করেছিল।
এর মানে, একদিকে নির্যাতনের জন্য এই উলঙ্গ ইচ্ছাপ্রকাশ চলছে অথচ অন্যদিকে কনষ্টিটিউশনকে ‘সংশোধন” এর নামে যে দোকান খোলা হয়েছে সেখানে এই গুরুত্ত্বপুর্ণ বিষয়টা কোন ইস্যু হতে পারেনি; এই বিষয়ে কমিটি বা এর কো-চেয়ারম্যান এবং ‘কনষ্টিটিউশন বিশেষজ্ঞ’ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মুখে থেকে কোন কথা বের হচ্ছে না। যেন তিনি এগুলো দেখতে পাচ্ছেন না। অথচ প্রতিদিনই জনগণের দোহাই দিয়ে আইন, কনষ্টিটিউশন ‘সংশোধন” নিয়ে তত্ত্বের কচকচানি ফুলঝুরির মত সেনগুপ্তের মুখ দিয়ে বের হচ্ছে। কিন্তু নির্যাতনের জন্য যে উলঙ্গ ইচ্ছাপ্রকাশ, ধর্ষকামিতা চলছে এ দিকটা উনি না দেখার ভান করে আছেন। এ বিষয়ে উনি অন্ধ হয়ে গেছেন, কিছু দেখেন না। অথচ উনিই আবার আমাদের আইন, কনষ্টিটিউশন শিখাইতেছেন; আর বাস্তবে আমরা আইন, কনষ্টিটিউশনের জানাজা পড়ানো হতে দেখছি; আইনের নামে হয়রানী, নিপীড়ন, নির্যাতনের জন্য লালায়িতদের ধর্ষকামীতা দেখছি।

দুইটা কম্পার্টমেন্টে ভাগ করা আমরা দুইটা বাংলাদেশ দেখছি, একটা কম্পারমেন্টে চলছে মানুষকে হয়রানী, নিপীড়ন, নির্যাতনের ধর্ষকামীতা আর এক কম্পার্টমেন্টে চলছে জনগণের নামে দোহাই কিরা কেটে আইন, কনষ্টিটিউশন শিখানোর কেচ্ছা ক্লাস। এটা এমনই দুই শক্ত কম্পার্টমেন্ট যে এর একটা থেকে আর একটার ভিতরে কী চলছে যেন দেখা না যায়। এতে এখনই প্রশ্ন উঠেছে যে কনষ্টিটিউশন ‘সংশোধন” কমিটির কো-চেয়ারম্যান এবং কনষ্টিটিউশন বিশেষজ্ঞ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের আমাদের কী আইন শিখাবেন, ধব্জাধারী এই কমিটি জনগণের কোন ছাতার কাজে লাগবে? ওখান থেকে কী ফল বের হবে সেটা আমরা আগেই দেখতে পাচ্ছি। ফলে, কনষ্টিটিউশন ‘সংশোধন” নামে এর কাজের শুরুতেই জনগণের কাছে এর আর ন্যায্যতা, প্রয়োজন কী থাকল?
সে বিচারে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ডঃ মিজানুর রহমান প্রশংসা পাবার যোগ্য।
জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা, ধর্ষকামীদের হয়রানী, নিপীড়ন, নির্যাতনের হাত থেকে মুক্ত নিরাপদ যদি নাই থাকতে পারে তবে এই সরকার, সংসদ, কনষ্টিটিউশন, বিচার বিভাগের টিকে থাকার ন্যায্যতা কী? এর উপরে আবার এই কনষ্টিটিউশনের ‘মৌলিক নীতি’ বলে কিছু থাকুক না থাকুক, কনষ্টিটিউশন জন্মের সময়কার ‘মৌলিক নীতি’ ফিরিয়ে আনা হোক না হোক আসলেই কী তাতে কিছু জনগণের যায় আসবে? কোন ফারাক আমরা দেখতে পাব? পাঠক বিচার করবেন।

এদিকে প্রথম আলোও দেখা যাচ্ছে এসব প্রসঙ্গ, প্রশ্ন ত্যাগ করে তার ‘অভিমত’ অথবা ‘সাক্ষাতকার’ এর প্রশ্নমালা সাজিয়েছে। সেখান থেকেই একটা প্রশ্ন এবং সুরঞ্জিতের জবাব এখানে তুলে আনছি, যেখান থেকে সুরঞ্জিতের বক্তব্যের ভিতরে ঢুকবো।

প্রথম আলো: উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতেই আপনারা সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছেন। রায় না হলে কি আপনারা এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিতেন না?
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত: রায়টি ঐতিহাসিক। প্রতিটি দেশের সংবিধানে কিছু মৌলিক নীতি থাকে। সাংবিধানিক পরিষদে যা প্রণীত হয়। পঞ্চম সংশোধনী কি সে ধরনের কোনো পরিষদে হয়েছে? হয়নি। তারা সামরিক অধ্যাদেশবলে এসব আইন করেছে এবং সংসদে তা অনুমোদন করিয়ে নিয়েছে।


ইদানিং আমাদের ১৯৭২ সালের কনষ্টিটিউশনের “মুল নীতি”, “মৌলিক নীতি”, “মৌলিক দিক নির্দেশনা” ইত্যাদি নানান শব্দে একই গান শুনতে শুনতে আমাদের কান ঝালাপালা হবার অবস্থা। এই অবস্থা শুরু হয়েছে হাইকোর্টের পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ের বিচারক বিচারপতি খায়রুল হকের রায় দেয়া থেকে। তবে এর বহুকাল আগে থেকেই বহু আওয়ামী ড্রয়িং রুমে এই ধরণের যুক্তিতর্ক আমরা শুনে আসছি। যদিও কখনও ভাবা যায়নি এই ধরণের যুক্তি পেশাদার আইনী পরিসরে এমনকি বিচারকের রায়ে জায়গা পাবে। অথচ এটাই এখন আমাদের আপিল কোর্ট ঘুরে রাজনীতিক সুরঞ্জিতের মুখেও হাজির হয়েছে। সুরঞ্জিত জবাবের শুরুতে বলছেন, কোর্টের পঞ্চম সংশোধনী মামলা বিষয়ক ‘রায়টি ঐতিহাসিক"’। হয়ত তা ঐতিহাসিকই বটে তবে রায়টা না, সুরঞ্জিতের জবাবটা।
তিনি দাবী করছেন, “প্রতিটি দেশের সংবিধানে কিছু মৌলিক নীতি থাকে। আচ্ছা, তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম সুরঞ্জিতের কথা সত্য। তিনি আসলে পৌছাতে চান যে, মৌলিক নীতিতে হাত দেয়া যায় না, এটা পুত-পবিত্র ধরণের একটা বিশেষ ট্যাগ লাগানো, এই কথায়। এই কথার সূত্রে বলতে চান বিএনপি বা জিয়া এতে হাত দিয়ে অপরাধ করেছেন; অবৈধ ভাবে “তারা সামরিক অধ্যাদেশবলে এসব আইন করেছে এবং সংসদে তা অনুমোদন করিয়ে নিয়েছে“ ইত্যাদি ইত্যাদি বলে এইখানেই আওয়ামী নেতাদের আমরা সাধারণত থামতে দেখি; ঠিক যে ভাষ্যটা আওয়ামী বৈঠকখানা, হাইকোর্ট, আপিলকোর্ট ঘুরে এখন সুরঞ্জিতের পকেটে সেখানে। এতটুকুতে সুরঞ্জিত থেমে থাকলে আমরা বুঝতাম এটা আওয়ামী দলবাজির বুঝেরই আর একটা প্রচলিত প্রকাশ মাত্র। কারণ আওয়ামী লীগের কোন অন্যায় সিদ্ধান্ত বা কাজের সাফাই বা পারমানেন্ট সাক্ষী হলো বিএনপি। বিএনপিও একই অন্যায় করেছিল সুতরাং আমার অন্যায়টা জায়েজ, হরহামেশা এই দলবাজি আমরা দেখে দেখে অভ্যস্থ। দলবাজির এই বুঝের উপর এখন আবার, হাইকোর্ট, আপিলকোর্টের সীল লাগিয়ে সেসব কথা হালাল হয়ে এসেছে ফলে, সুরঞ্জিত এবার বুক ফুলিয়ে একই কথা বলবেন এটা হয়ত কোন নতুন কথা নয়। কিন্তু এই ‘অভিমত’ অথবা ‘সাক্ষাতকারে’ সুরঞ্জিত আওয়ামী দলবাজির প্রচলিত কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি। নতুন কিছু কথা বলেছেন যা ভীষণ গুরুত্ত্বপূর্ণ। স্বভাবতই তাতে সুরঞ্জিতের কিছু বিদ্যা জাহির হয়েছে ঠিকই কিন্তু খোদ সুরঞ্জিত ও আওয়ামী লীগের জন্য এটাই বিপদের কারণ।

কথায় আছে, মনের খারাপ বা ভাল উদ্দেশ্য শরীরে মুখে ছাপ ফেলে হাজির হয়ে যায়, ধরা পড়ে যায়। মুখ নাকি মনের আয়না। মুখে ভেসে উঠা মনের ছবি এড়ানো মুসকিল, ইত্যাদি। ফার্সি ভাষায়, এই ভাবটা নিয়ে লেখা অসংখ্য কবিতা, গজল পাওয়া যাবে। সুরঞ্জিত সেভাবে ধরা পরে গিয়েছেন। তিনি মহা বিদ্যান, আইনের বিশেষজ্ঞ; মুখ বাকিয়ে অশ্লীল ভঙ্গিতে তিনি বিপক্ষের চিন্তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, অসম্মানের ভয় দেখিয়ে তর্কে জিততে অভ্যস্থ, মগজ বা চিন্তার ক্ষমতা দিয়ে নয়। যারা তাঁকে টেলিভিশনে বা মুখোমুখি বসে সেমিনার বা ছোট আসরে কথা বলতে দেখেছেন তারা ভাল বুঝবেন আমি কী বলছি। সুরঞ্জিত বোধকরি পত্রকারদের সামনে একই ভঙ্গিমা করে নিজের বিদ্যা দেখানোর খায়েস সামলাতে পারেননি। তিনি সাংবিধানিক পরিষদ (Constituent Assembly) নিয়ে কথা তুলে ফেলেছেন।

আমাদের কনষ্টিটিউশন প্রণয়ন লক্ষ্যে গঠিত ১৯৭২ সালের যে গণপরিষদ (ইংরাজীতে Constituent Assembly এবং সুরঞ্জিতের এখানকার ভাষায় যাকে সাংবিধানিক পরিষদ বলে বুঝাতে চেয়েছেন) বসেছিল সেই গণপরিষদের সদস্যরা কেউই বাংলাদেশে নির্বাচিত ছিল না; ফলে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠির নির্বাচিত প্রতিনিধি বলতে তাঁরা কেঊ ছিলেন না। এতদিন পর্যন্ত দেখা গেছে, বাংলাদেশের চলতি কনষ্টিটিউশনের এই জন্মগত প্রতিনিধিত্ত্ব বিষয়ক ত্রুটি এবং আইনগত ত্রুটি নিয়ে কেউ কথা তুললে কামাল হোসেন বা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রমুখ নেতারা প্রবল অস্বস্তি, বিব্রতবোধ করেন। এরপর সে পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেন। হিতাহিতজ্ঞানশুন্য হয়ে নিজের পোষাকের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ করতে ভুলে যান। টিভি টক শো তে অনেকবার এমন হতে আমরা দেখেছি।

সেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রথম আলোর‘অভিমত’ অথবা ‘সাক্ষাতকারে’ নিজেই গণপরিষদ (Constituent Assembly) প্রসঙ্গ তুলেছেন। এবং এতে নিজের ও দলের জন্য কী বিপদ ডেকে এনেছেন - মনে হয় না তিনি এ প্রসঙ্গ তোলার আগে বুঝেছিলেন। আসলে সুরঞ্জিত যে Constituent Assembly ব্যাপারটা বুঝেন যেন এটা জানান দেবার লোভে পড়েছেন। ফলে Constituent Assembly এর রেফারেন্স দিয়ে জিয়া, বিএনপিকে পঞ্চম সংশোধনী করার জন্য মারাত্মক দোষে দোষী করতে আমরা দেখেছি।
আইনী চোখের বিচারে, প্রচলিত কনষ্টিটিউশন ও জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দুই বিপরীত প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে আছে, থাকবে। ফলে এর আইনী সমালোচনার সুযোগও সবসময় থেকে যাবে এবং যে কেউই এর সমালোচনার সুযোগ নিবে, এবং আওয়ামী লীগ বা সুরঞ্জিতও বলা বাহুল্য। ফলে সেটা নিয়ে আমার নতুন করে বলার কিছু নাই। কিন্তু পঞ্চম সংশোধনী কোন "সাংবিধানিক পরিষদে প্রণীত হয় নাই" - সুরঞ্জিতের এই সমালোচনা, এই ব্যাপারটাই নতুন।
আওয়ামী রাজনীতি যারা করেন তাদেরকে আমরা দেখেছি, জিয়ার - সামরিক ক্ষমতা দখল ও কনষ্টিটিউশনে বদল আনা – কনষ্টিটিউশনে পঞ্চম সংশোধনী প্রসঙ্গে অভিযোগ এখানেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু আমার জানা মতে সুরঞ্জিতই প্রথম কোন আওয়ামী নেতা যিনি ঐ সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে এককদম আগে বেড়ে জিয়ার বিরুদ্ধে নতুন অভিযোগ দায়ের করলেন।

সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে নতুন অভিযোগের ভুবনে স্বাগত জানাই। আমরাও এতদিন দলবাজি ধরণের অভিযোগগুলোর ভিতর ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না, জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সিরিয়াস চোখা সরাসরি অভিযোগটা কী? ১। সামরিক ক্ষমতা দখল করা, ২। জাতীয় সংসদের মাধ্যমে কনষ্টিটিউশনে পঞ্চম সংশোধনী করে বদল আনা, না কী ৩। গণপরিষদ (বা সুরঞ্জিত যেটাকে সাংবিধানিক পরিষদ বলে বুঝিয়েছেন) না ডেকে কনষ্টিটিউশনে পঞ্চম সংশোধনী করে বদল আনা।

পাঠককে মনে করিয়ে দেই, প্রথম আলো পত্রিকায় ছাপা হওয়া যে মুল জবাব আমি উপরে তুলে এনেছি ওর বোল্ড করা অংশটা দিকে নজর করুন ওটাই সেই বাড়তি কথা। বোল্ড করা আমার। সুরঞ্জিত বলছেন, “সাংবিধানিক পরিষদে যা প্রণীত হয়। পঞ্চম সংশোধনী কি সে ধরনের কোনো পরিষদে হয়েছে? হয়নি"। অতএব জিয়ার কাজকারবার অবৈধ।

আমরা সুরঞ্জিতের পরিস্কার করে বলা কথা, দাবী সজোড়ে সমর্থন করতে চাই।
সে নিয়ে কথা আরও আগে বাড়ানোর আগে উপরের কথাগুলো আর একবার ঝালাই করে নেই, অনেক পাঠক খেই না হারিয়ে আমাদেরকে অনুসরণ করতে পেরেছেন কী না এই ভেবে।
অর্থাৎ সুরঞ্জিত বলতে চাচ্ছেন, আমাদের ১৯৭২ সালে কনষ্টিটিউশনের ‘মৌলিক নীতি’ – বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র – কনষ্টিটিউশনে প্রবিষ্ট করা হয়েছিল Constituent Assembly তে বসে কনষ্টিটিউশন প্রণয়ন সভা থেকে এবং সেটা কোন পার্লামেন্ট বা জাতীয় সংসদ ছিল না। অতএব, কনষ্টিটিউশনের ‘মৌলিক নীতি’ কে বদলাতে চাইলে জিয়াউর রহমানকে ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নয়, বরং আবার একটা নতুন কনষ্টিটিউশন প্রণয়ন সভা (গণপরিষদ বা সুরঞ্জিতের সাংবিধানিক পরিষদ ) ডাকতে হত; কারণ, কনষ্টিটিউশন প্রণয়ন সভা বা "সাংবিধানিক পরিষদ" এর একমাত্র ক্ষমতা আছে কনষ্টিটিউশনের ‘মৌলিক নীতি’ পরিবর্তনের; কোন জাতীয় সংসদের নয়।
কথা সুরঞ্জিত খারাপ বলেন নাই। কিন্তু এসব কথা প্রসঙ্গে খোদ আওয়ামী লীগের অবস্থান কী সেটাও যদি বাদ রাখি – কেবল সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও কী তাঁর বক্তব্যে অটল আঁকড়ে ধরে দাঁড়াতে রাজি হবেন? পাঠকের সন্দেহ করার কারণ রয়েছে। কারণ, ঐ সাক্ষাতকারের শেষে সুরঞ্জিত সে প্রমাণ রেখেছেন। সেখানে যাব। এছাড়া ‘সাংবিধানিক পরিষদ’ না ডেকে কনষ্টিটিউশনের মৌলিক নীতিগুলোতে কোন বদল, হাত দেয়ার অধিকার কারও নাই – সুরঞ্জিতের ঠিক এই বক্তব্যের উপর দাঁড়িয়ে আমাদের কনষ্টিটিউশনের চতুর্থ সংশোধনী (যেটা বাকশাল বলে সমাজে অধিক প্রচলিত) কেও বিচার করে দেখব।

সে প্রসঙ্গে যাবার আগে, আমি মনে করি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যা বুঝেই সাংবিধানিক পরিষদ এর কথা তুলে থাকুন না কেন – বাংলাদেশের আজকের এবং আগামী দিনের রাজনীতির দিক থেকে সাংবিধানিক পরিষদ অথবা Constituent Assembly একটা গুরুত্ত্বপুর্ণ ইস্যু হতে বাধ্য। প্রচলিত যে রাজনীতি আমরা দেখছি অথবা বিপ্লবী রাজনীতির জন্য কারও মনে কোন স্বপ্ন যদি থেকে থাকে, সবক্ষেত্রেই এটা গুরুত্ত্বপুর্ণ ইস্যু হতে বাধ্য।

এই বিবেচনায়, কনষ্টিটিউশন প্রণয়ন সভা, বা Constituent Assembly, অথবা গণপরিষদ জিনিষটা কী? আর এর সাথে ‘জাতীয় সংসদ’ - এর তফাতটাই বা কী? কেন সুরঞ্জিত এই দুই ধরণের প্রতিনিধিত্ত্বমুলক সভার তফাতকে এতই গুরুত্ত্বপুর্ণ মনে করছেন – পঞ্চম সংশোধনী সাংবিধানিক পরিষদ এর বদলে জাতীয় সংসদে পাশ হয়েছে বলে – তিনি এটাকে অগ্রহণযোগ্য বলে আঙুল তুলছেন, সেটা গভীরে এবং পরিস্কার করে বুঝবার দরকার আছে। এনিয়ে আগে ছোট একটা আলোচনা তুলব। এরপর আবার সুরঞ্জিতের মুল বক্তব্যে ফিরে আসব। এদিকে উপরের বাক্যে অনেকগুলো নতুন শব্দ এসে গিয়েছে, পাঠকের বুঝতে সহজ করতে সেগুলোকেও এসময় ব্যাখ্যা করে নিব।

এই পোষ্ট তিন থেকে চার পর্বের আগে শেষ করতে পারব বলে মনে হয় না। তাই, পাঠকের ধৈর্য ও সহানুভুতি আশা করছি। দ্বিতীয় পর্বে দেখা হবে।

দ্বিতীয় পর্ব: Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০১০ রাত ৩:২৪
২৫টি মন্তব্য ২৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×