ইটের বদলে পাটকেল মারা বিষয় করে লেখা দাসত্বের "মূলত রিঅ্যাকশন পোস্ট" - মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করছিলাম। ওখানে পাটকেলের জোড়ে ইট আপাতত পরাস্ত হয়েছে মনে হচ্ছে। ওদিকে আমি চোখ রাখছিলাম, ইট-পাটকেলের যুদ্ধ থেকে বের হয়ে এর উত্তরণের কোন সম্ভাবনা শেষতক থাকছে কী না; না কী আওয়ামী লীগের বদলে বিএনপির মধ্যেই এটা শেষ হয়ে যাবে - একথা ভাবছিলাম। আজ সকালে অবশ্য দাসত্বের নতুন সারমর্মমূলক পোষ্ট দেখে মনে হয়েছে ইট-পাটকেলের যুদ্ধের একটা আপাত পরিসমাপ্তি হয়েছে।
দাসত্ব ও তাঁর মত অন্যেরা যদি খেয়াল রাখতে চান, বিএনপির রাজনীতি, সীমাবদ্ধতাগুলো মানে নিজের সীমাবদ্ধতা নয়, নিজেকে ওর সীমায় সীমাবদ্ধ করবেন না তবে এখন আমি যা বলব তা আপনাদের ভাল লাগলেও লাগতে পারে। সেক্ষেত্রে বিএনপি-আওয়ামী বিষয়ক তর্কের বাইরে আমাদের রাজনৈতিক চিন্তার জটগুলো খুলার দিকে মনোযোগ দিয়ে পরিপক্কতা অর্জনের চেষ্টা করতে হবে।
গতপরশু দাসত্বের মুজিব অফেন্ডিং বিষয়ক পোষ্টে রাগইমনের মন্তব্য দেখার পর থেকেই ভাবছিলাম, বিতর্ককে আরও কোন ইতিবাচক উত্তরণের জায়গা নেবার দিকে মোড় ঘুরার সুযোগ সেখানে তৈরি হচ্ছে, আমরা বোধহয় সে সুযোগ নিতে পারেন। বিশেষত পরিপক্কভাবে রাগইমনের প্রশ্ন তোলা ও দাসত্ত্বে সাথে কথা চালাচালি থেকে আমার সেই আগ্রহ জেগেছিল।
আমি এখান থেকে আপনাদের দুজনের বিতর্কের ভিতর বিতর্ক নিরসনের একটা পদ্ধতিগত উপায় নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলে সেদিকে যাবার চেষ্টা করব।
দাসত্ব ও রাগইমনের বিতর্কের সার কথা হলো,
১৯৭৭ সালের ক্যু এর পর "২৫০০ কিংবা ১১৮৩ অফিসার বিনা বিচারে হত্যা হয়েছিলো কি না" - রাগইমনের এমন প্রশ্নের উত্তরে দাসত্ব সারকথায় বলতে চাচ্ছিলেন, নুরুন্নবী (সম্ভবত উনি লেঃ কর্ণেল এবং এই বিতর্কের সোর্স রেফারেন্স) বিশ্বাসযোগ্য সোর্স নয়।
এই তর্কটা এমনভাবে হচ্ছিল যাতে বল ব্যাটের সঙ্গে লাগছে না; যদিও বলও জোড়ে ছুটছে ব্যাটও জোড়ে হেকেছে । কিন্তু আমি পরিস্কার এটাও দেখতে পাচ্ছিলাম এখানে ব্যাট বলের মুখোমুখি হতেই পারবে না। ফলে এই বিতর্ক নিরসনের কোন সম্ভাবনা নাই। কারণ বল আর ব্যাট দুই আলাদা তলে, দুই প্যারাডিয়ামের পাটাতনে ঘোরাফিরা করছে। ফলে তাদের মুখোমুখি হয়ে সংঘাতের ফলে বিতর্কের একটা মীমাংসা বের হবার সম্ভাবনা নাই।
রাগইমনের "বিনাবিচারে" শব্দটা আমি বোল্ড করেছি, শব্দটা গুরুত্ত্বপূর্ণ। ওটা গুরুত্ত্বপূর্ণ এজন্য যে ইমন প্রশ্নটা তুলছে আইনী দিক থেকে, আইন (সেনা বা সিভিল আইন) পরিসীমায় দাড়িয়ে - এটা তারই লক্ষণ; সেই সাথে ওই শব্দের ভিতর একটা নৈতিকতার দিকও আছে যে বিচারের নাম করে অফিসার, জওয়ানদের ফাঁসি দেয়াটা ঠিক বা নৈতিক হয়েছে কী না।
আইনমূলক চোখে তোলা এই প্রশ্নে, এই তর্ক দাসত্ব আইন দিয়ে বা আইনের রেফারেন্স দিয়ে মোকাবিলা করতে যান নি। বরং সোর্স নুরুন্নবী অর্থাৎ ফ্যাক্টসটা দূর্বল তাই তর্ক ডিসমিস - এই পথ ধরে আগিয়েছেন।
ফ্যাক্টস দূর্বল একথা বলে আপাতত তর্কে জিতা গেছে মনে হলেও কিছু কিছু ফ্যাক্টস অবভিয়াস, প্রকাশ্য প্রমাণিত সত্য। ডকুমেন্টস, রেফারেন্সে যাওয়ার দরকার থাকে না; ঘটনা যেখানে নিজেই বলে যে ঘটনা ঘটেছে। যেমন পঁচাত্তরের সাতই নভেম্বর তাহেরের সৈনিক সংস্হার বিপ্লব ঘটা ও পরবর্তীতে হেরে যাওয়াতে তাহের ও তাঁর সাথীদের ফাঁসিতে লটকে দেয়া, ১৯৭৭ সালের বিমানসেনা ক্যু আর সর্বশেষ ১৯৮০ সালে মঞ্জুরের ক্যু যাতে জিয়া নিজেই শিকার হয়ে মারা গেলেন। এতে কতজন মারা গেছেন, কতজনের ফাঁসি হয়েছে, যাবজ্জীবন হয়েছে সেসব সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে কিন্তু এসব ঘটনা ঘটেই নাই একমাত্র প্রতিষ্ঠিত ফ্যাক্টস লাগবে - ব্যাপারটা এমন নয়।
এখন তাহলে রাগইমনের আইনমূলক চোখে তোলা প্রশ্নকে দাসত্ব মোকাবিলা করবে কী ভাবে? জিয়ার পক্ষে আইনী ও নৈতিক ডিফেন্স বা ডিফেন্ড করার মত যুক্তি কী আছে?
এর উত্তর পেতে "আইন" বা "বিচার" কথাটাকে পরখ করতে হবে। শুধু তাই নয়, আইন ও ক্ষমতার সম্পর্ক কী? আইন কী ক্ষমতা-ইনডিপেন্ডেন্ট স্বাধীন সত্ত্বা হয়ে বিরাজ করে? না কী আইন মানেই আইন বানানো ও প্রয়োগের ক্ষমতা? এসবের মধ্যেই "আইন" কথাটা অর্থ ধরতে চেষ্টা করতে হবে। এসব নিয়ে আলোচনা এই পোষ্টের মুল বিষয়।
রাগইমনের আইনী প্রশ্নে যদিও আপাত চোখে সবার মনে হতে পারে যে ইমন একটা "বেআইনী" বিষয়কেই সবার সামনে আনতে চাইছেন। জিয়ার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সমর্থক ও সমাজের অনেকের মনে একই প্রশ্ন উঠতে প্রায়ই দেখা যায়। আমাদের এমন মনে হবার কারণ, আমাদের অভ্যস্ত চোখ আইনকে ক্ষমতা থেকে আলাদা করে বিচার করে দেখে। আইনের সাথে ক্ষমতার সম্পর্কটা কী আমাদের নজর করে দেখা হয় নাই, তাই।
যেমন, যে কোন সেনা প্রতিষ্ঠান গঠন আইন (আর্মি কোর্ট মার্শাল) অনুযায়ী সেনা বিদ্রোহ বেআইনী এবং মারাত্মক অপরাধ; এবং শাস্তি মৃত্যুদন্ড। তাহলে সাতই নভেম্বরসহ তাহেরের এবং পরবর্তীকালের দাবী করা ২১ ২২টা সব ক্যুই বেআইনী ও মারাত্মক অপরাধ। আইনী এই দৃষ্টিতে, বিচারে রাগইমনের আইনমূলক চোখে তোলা প্রশ্ন ইনভ্যালিড। নাল এন্ড ভয়েড। ফলে জিয়া ডিফেন্ডেড।
আচ্ছা, এখন একটু ভিন্ন দিক থেকে দেখি; ধরা যাক, তাহেরের সিপাই বিল্পব বিজয়ী হয়ে গেছে। বিজয়ী মানে? বিজয়ী মানে ক্ষমতা, ক্ষমতা দখলে বিজয়ী। তাহলে সেক্ষেত্রে আর্মি কোর্ট মার্শালের বিচার-ব্যাখ্যায় এবার তাহেরের ক্ষমতা দখল কী বেআইনী ও মারাত্মক অপরাধ বলে বিবেচিত হবে? প্রশ্নই আসে না।
যে কোন ক্ষমতা দখলের আগের বিদ্যমান আইনের চোখে বিপ্লব, বিদ্রোহ, প্রতিরোধ, অস্ত্র হাতে তুলে নেয়া ইত্যাদি সবই বেআইনী। পাকিস্তান রাষ্ট্রের আইনে ১৯৭১ সালে আমরা সবাই, আমাদের সব কাজ বেআইনী; বেঙ্গল রেজিমেন্ট, পিলখানার ইপিআর, রাজারবাগের পুলিশের প্রতিরোধ তৎপরতা সবই বেআইনী, কোর্ট মার্শালে শাস্তির যোগ্য।
একথাগুলো বলে তর্ক যাতে নানা দিকে ছড়িয়ে না যায় সেদিকে পাঠককে খেয়াল রাখতে বলব। কারণ, এগুলো এখানে উল্লেখের উদ্দেশ্য একটাই ক্ষমতা - এই বিষয়টাকে বাদ রেখে "আইন" ব্যাপারটা বুঝা যাবে না; ক্ষমতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে বা ক্ষমতা বিষয়টাকে উহ্য রেখে "আইন" বিষয়টাকে বুঝা, আলোচনা করা যায় না - এই সার কথা পাঠককে মনে করিয়ে দিতে চাই। এতটুকুর মধ্যেই আপাতত আমাদের কথা সীমাবদ্ধ রাখব।
তাহলে দাঁড়াল, "আইন" কথাটার কোন সার্বজনীন, সবকালে, সব রাষ্ট্রের জন্য প্রযোজ্য অর্থে - ক্ষমতা থেকে বিচ্ছিন্ন, ইনডিপেন্ডেন্ট অর্থে স্বাধীন এমন কোন বিষয় নয়। বরং আইন ঘোরতরভাবে ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত একটা ধারণা। তাই "ক্ষমতা" বিষয়টা সাথে মনে না রেখে "আইন" বুঝা যাবে না।
এছাড়াও সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ হলো, আইন ক্ষমতার উৎস নয়। আগে আইন এরপর সে আইন থেকে ক্ষমতা উৎসারিত হয় না। ক্ষমতা মানে ক্ষমতা, বল প্রয়োগের ক্ষমতা, একেবারেই খাঁটি বাংলায় গায়ের জোড় এবং মুরোদ। তবে এই ক্ষমতাকে জনগণের ক্ষমতা হবার একটা সাধনা হওয়ার ব্যাপার আছে। নইলে তা এরশাদের ক্যু এর মত।
এখন ক্ষমতা মানে সবসময়ই গায়ের জোড়, মুরোদ - তা সে জনগণের ক্ষমতাই হোক আর এরশাদের ক্যুই হোক। এরপর সেই ক্ষমতার জোড়ে - কনষ্টিটিউশন (সব আইনের উৎস আইন) ও এর অনুগত অন্যান্য আইনের জন্ম ও প্রয়োগ। জনগণের ক্ষমতা হলে জনগণের কনষ্টিটিউশন ও এর অনুগত অন্যান্য আইনের জন্ম ও প্রয়োগ হবে, নইলে এরশাদের মত, "আচার, আচরণ ও উচ্চারণে রাজনৈতিক আলাপ" করলে ৭ বছরের সশ্রম কারাদন্ডের মত আইনের জন্ম ও প্রয়োগের ক্ষমতা হবে সেটা।
সেজন্য আইন ক্ষমতার উৎস নয়। বরং উল্টোটা। ক্ষমতা থাকলে তা আইনের জন্ম দেয়ার ক্ষমতা ও প্রয়োগ করার ক্ষমতা হিসাবে হাজির হওয়া সম্ভব। সার কথায় আইন মানে আইন বানানোর ক্ষমতা। এবং আইন ক্ষমতার অবিচ্ছেদ্দ। আইন কথাটা তখনই অর্থপূর্ণ।
ক্ষমতা অর্থাৎ আইন বানানো ও প্রয়োগের ক্ষমতা থাকলে, সেই ক্ষমতা বলে সুন্দর আইন দিয়ে সমাজে রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব, এরপর কেউ আইন মান্য করে চলা নিবিষ্ট ভদ্রলোক নাগরিক হতে পারে। তবে তখন আর হয়ত আইনের পিছনে ক্ষমতার ডান্ডাটা আর চোখে পড়ে না, ভুলে যেতে পারি। এমন আইন ভক্তও হয়ে যেতে পারি যে আইনের সাথে - (গায়ের জোর, মুরোদের) ক্ষমতার সম্পর্কের দিকটা আর ধরতেই পারি না। বরং ভ্রমে, মনে হতে পারে সব ক্ষমতার উৎস আইন, আইনই আইন।
রাগইমনের প্রশ্নের ভিতর এই বিভ্রম আছে। অনেক পাঠকের মনেও আমাদের অভ্যস্ত চোখ আইনকে ক্ষমতা থেকে আলাদা করে বিচার করে দেখার বিভ্রম আছে। এই বিভ্রম কাটাতে ক্ষমতাসহ আইন ব্যাপারটা বুঝতে বা ক্ষমতা বলতেই বা কী বুঝব?
আমরা পছন্দ করি বা না করি, ক্ষমতার নির্মম নেংটা দিকটা দেখানোর জন্য নেংটা করে বলেছি, ক্ষমতা মানে গায়ের জোড়, মুরোদ। ক্ষমতার বৈশিষ্টসূচক এই দিকগুলোকে আড়াল করার কারণ নাই।
এছাড়া, ক্ষমতার আরও গুরুত্ত্বপূর্ণ বৈশিষ্টসূচক কতগুলো দিক আছে। যেমন নিরঙ্কুশ। ক্ষমতা মানেই নিরঙ্কুশ ক্ষমতা; মাঝে কোন কাঁটা নাই, এককাট্টা, একছত্র, কর্তৃত্ত্ববাদী। কোন ভাগীদার নাই, অস্বস্তি নাই। থাকলে, সে ক্ষমতা হাত ছাড়া হবে, ভেঙ্গে পড়বে, পতন হবে। ক্ষমতা শেয়ার করার জিনিষ না, সতীন বা কোন চ্যালেঞ্জ সে সহ্য করে না। যে সহ্য করবে বা করতে যদি কেউ বাধ্য হয় তাহলে বুঝতে হবে ক্ষমতার এখন পালা বদলের সময়। ফলে স্বভাবতই তা আইনের জন্ম ও প্রয়োগের ক্ষমতা বদলেরও সময় সেটা। ক্ষমতা হাতে রাখতে হয় তাকে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম হতে হবে, নইলে পাল্টা ক্ষমতার করুণ পরিণতি ভোগ করতে হবে। ফলে এখানে মায়া-দয়া, নৈতিকতা অথবা কোন আইন দিয়ে বিচারের কোন জায়গাই নাই। ক্ষমতা মাত্রই তাই নির্মম, নিষ্ঠুর একছত্র কর্তৃত্ত্ববাদী ক্ষমতা। ক্ষমতা লাভে বিজয়ী হওয়ার পর আইন - আইনের জন্ম ও প্রয়োগের ক্ষমতা অর্থে আইনের চর্চা ও কাঠামো তৈরি হতে পারে।
সশস্ত্র ক্ষমতার সরাসরি প্রতিষ্ঠানগুলো এজন্য আগেই আইন করে রেখে বলে,আমার ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ, বিরোধিতা, বিদ্রোহ করা গুরুতর অপরাধ, শাস্তি মৃত্যুদন্ড।
তাহলে অধিষ্ঠিত কোন ক্ষমতা উৎখাত করে নতুন ক্ষমতা, জনগণের ক্ষমতার জন্ম দেয়া কী সম্ভব না? অবশ্যই সম্ভব, তবে আইনী অর্থাৎ উপস্হিত আইনের চোখে আইনীভাবে সম্ভব না। সবদেশেই বহুবার সেসব প্রচেষ্টা উদ্যোগ আমরা দেখেছি। আবু তাহেরে সিপাই বিপ্লব সে রকমই একটা, তবে ব্যর্থ প্রচেষ্টা। ব্যর্থতার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি মৃত্যু, মৃত্যুর দন্ড। জিতলে গাজী। ক্ষমতা পাওয়ার অর্থে। তবে এটা প্রথম পরীক্ষা। এরপর আসল পরীক্ষা। জনগণের ক্ষমতা হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করা। উল্টো করে বললে জনগণ সেটাকে নিজেরই ক্ষমতা হিসাবে দেখতে শুরু করে কী না, জনগণের নিজেরই হয়ে ক্ষমতা প্রয়োগ হিসাবে দেখে কী না। এই পর্যায়টাকে দখলী ক্ষমতার অভিষেক, জনগণের দ্বারা ক্ষমতার অভিষিক্ত হওয়া বলা যেতে পারে। যাই হোক তাহের সেই পরীক্ষা পর্যন্ত যেতেই পারেন নাই। এর আগেই জিয়ার কাছে হেরে গেছে, নিজের ক্ষমতা রক্ষা, মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে সেনা কোর্ট মার্শালের আইন জিয়ার হাত ধরে তাহের ও তাঁর সঙ্গীসাথীদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ হয়েছে।
রাগইমনের আইনমূলক চোখে তোলা প্রশ্ন তাই অবান্তর। যদিও কেবল দাসত্বকে নয় অনেক পাঠককেই তা বিব্রত করে ফেলতে পেরেছে এজন্য যে রাগইমন আপাত চোখে আইনকে ক্ষমতার প্রশ্ন থেকে ইনডিপেন্ডেন্ট ধরার বিভ্রমে থাকায় পাঠকের অনেকেই সে বিভ্রমে পড়েছে।
এজন্য এই পুরা ঘটনার বাছ-বিচার শুরু করতে হবে ক্ষমতার প্রশ্নের জায়গায় দাঁড়িয়ে, ইনডিপেন্ডেন্ট আইনের জায়গায় দাঁড়িয়ে নয়। কারণ ক্ষমতা বিনা ইনডিপেন্ডেন্ট আইন বলতে কিছু নাই।
২৫০০ কিংবা ১১৮৩ অফিসার বিনা বিচারে হত্যা হয়েছিলো কি না" -
ক্ষমতা ও আইনের সম্পর্কের দিক খেয়াল রেখেই একমাত্র এই বাক্যের সঠিক বিচার সম্ভব।
উপরের কথাগুলো মনে রেখে, নীচে তাহেরের সৈনিক সংস্হা ও জিয়ার সাথে এর সম্পর্ক ও সংঘাতের বিষয়ে সংক্ষেপে একটা অবজেকটিভ মুল্যায়ন সারব।
সেনাবাহিনীর ভিতরে তাহেরের সিপাইদের নিয়ে গড়া "সৈনিক সংস্হা" - এই সংগঠনের জন্ম ও অস্তিত্ত্ব ৭৫-৭৮ সালের সমস্ত ঘটনায় মুল নির্ধারক ফ্যাক্টর।
১. সৈনিক সংস্হা থাকার কারণেই জিয়ার জানে বেঁচে যাওয়া ও পরবর্তীতে ক্ষমতায় উত্থান।
২. সৈনিক সংস্হার বড় দূর্বলতা ছিল, সব সেনানিবাসে এমন সংগঠিত ছিল না যে একক কর্তৃত্ত্ব করতে পারে।
৩. সব জায়গায় কর্তৃত্ত্ব নিয়ে গড়ে উঠার আগেই ১৫ আগষ্টের ক্যু থেকে ব্যারাকে পরবর্তী ঘটনাবলী শুরু হয়ে যায়।
৪. আগষ্ট থেকে নভেম্বর ক্যু পাল্টা ক্যু এর রাজত্ত্বে সৈনিক সংস্হার কোন না কোন পক্ষে অথবা নিজেই একটা পক্ষ তৈরি করে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়া এড়ানো অসম্ভব ছিল। কারণ সেক্ষেত্রে সংগঠনের পরোয়া না করে বিচ্ছিন্ন সৈনিকেরা বিভিন্ন ক্ষুদ্র স্বার্থে নানান ক্যু এর দলের সাথে তাঁরা পরস্পর বিরোধী হয়ে জড়িয়ে পড়তই। সংগঠন বলে কিছু থাকত না।
৫. সাংগঠনিক দূর্বলতা ঘাটতি মিটাতে, জিয়ার অনুরক্ত সৈনিকদের সাথে নিবার প্রয়োজন অনুভব করে; ফলে এই কম্প্রোমাইজে আগানোর সিদ্ধান্ত নেয় তাহের। ফলে বন্দী জিয়াকে মুক্ত করে আনার পর কম্প্রোমাইজ এই এলায়েন্সের রূপ কি দাঁড়াবে তা না জেনেই আগানোর রিস্ক নিতে হয় তাহেরকে, অন্যোন্যপায়।
৬. জিয়াকে মুক্ত করে আনা পর্যন্ত পরিস্হিতি তাহেরের নিয়ন্ত্রণে ছিল, পরে রিস্ক বাস্তব বিপদ হয়ে হাজির হয়ে যায়। জিয়ার সাথে অনুমিত সম্পর্ক কাজ করেনি।
৭. মুল কারণ, তাহেরের পরিকল্পনার এক বড় ত্রুটি; যেটা বহির্দেশীয় স্বার্থ ও ফ্যাক্টর। ১৫ আগষ্টে আমেরিকান সংশ্লিষ্টতার মাত্রা ও স্বার্থকে তাহের খাটো করে দেখেছিল বা বলা যায় গোনায় ধরে নাই। ফলে এই ফ্যাক্টর কীভাবে মোকাবিলা করবেন; কনফ্রন্ট না ডিল করবেন কোন ধারণা প্রস্তুতিই ছিল না।
৮. জিয়াকে সৈনিক বিপ্লবের বিশ্বাসঘাতক বলে মনে করেন তাহের। এটা নিজের হতাশা ব্যর্থতার কথা। জিয়া তাহেরের সাথে মিলে সৈনিক সংস্হা গড়তে যান নাই। ফলে সৈনিক বিপ্লব কবুলের দায় তাঁর উপর চড়ানো, বিশ্বাসঘাতক বলার সুযোগ আমরা দেখি না। জিয়া তাহেরের অর্থে বিপ্লবী রাজনীতি ওন করেন এটা কবুল করলেই না বিশ্বাসঘাতকতার প্রশ্ন আসে। জিয়ার নিজস্ব কোন সক্রিয় সচেতন রাজনৈতিক পরিচয়ের কথা নভেম্বরের আগে কেউ জানে না।
৯. বস্তুত জিয়া নন, জিয়ার অনুগত সৈনিকরা ছিল ফ্যাক্টর। যাদের সাথে একটা এক্সটারনাল এলায়েন্সের ভিত্তিতে নিজের সাংগঠনিক ঘাটতি মোকাবিলা ও ঢাকা ব্যারাকের সম্ভাব্য প্লেয়ারদের ভারসাম্যের হিসাব মিলিয়ে ছিলেন তাহের। পরবর্তী ঘটনা প্রমাণ করে তাহের হিসাব সঠিক ছিল। কিন্তু ব্যারাকে প্লেয়ারদের মধ্যে মাঠের গায়ের জোরের হিসাব এক জিনিষ আর জিয়ার সাথে বিপ্লবী রাজনীতি ও সৈনিক বিপ্লবের তাৎপর্য বুঝিয়ে একটা রাজনৈতিক পরিচয় হাজির করানো সম্পূর্ণ অন্য জিনিষ। মাঠের এল্যায়েন্স আর রাজনৈতিক এলায়েন্স এক জিনিষ নয়। তাহের জিয়ার জান বাঁচিয়ে বলে জিয়াকে তাহেরের রাজনীতির সাথে একমত হতে হবে - এমন দাবি আমরা কেউ করতে পারি না। তবে শর্ত আবহ তৈরি করা যেত হয়ত। যেটা ছিল অনুপস্হিত। ওদিকে আমেরিকান স্বার্থের মোকাবিলার কোন প্রস্তুতি আমরা দেখি নাই। যেন তা নাই ধরে নেয়া হয়েছিল।
১০. বিজয়ী সিপাহি বিপ্লবে জীবিত জিয়াকে কে কেন্দ্র করে আমেরিকানদের নতুন ক্ষমতা যতই পোক্ত ও দৃশ্যমান হতে থাকে ততই তাহেরের সাংগঠনিক দূর্বলতা স্পষ্ট হতে শুরু করে, জিয়ার নতুন ক্ষমতাকে সক্ষম মোকাবিলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন।
১১. ক্ষমতা নির্মম, নিষ্ঠুর। নতুন ক্ষমতা নিরঙ্কুশ হতে সবচেয়ে বড় বাধা হাজির হয় তাহের, ফলে তাহেরের ক্ষমতাকে নির্মমভাবে বিদায় নিতে হয়।
১২. তাহের একা নন, তাঁর সৈনিক সংস্হার সাথীরা আছে। ফলে তাহেরের ১৯৭৬ এপ্রিলে ফাঁসির রায়ের নাটকের পরও সৈনিক বিদ্রোহের পরম্পরা ঘটতে থাকে। এখান থেকেই ২১-২২ টা ক্যু এর কাহিনীর সৃষ্টি, যার সর্বশেষ সিরিজ সমর্থিত বিমানবাহিনীর নেতৃত্ত্বে ১৯৭৭ সালের ক্যু প্রচেষ্টা। তবে এগুলো কোনটাই সৈনিক সংস্হা বা জাসদের একক প্রচেষ্টা নয়। বিভিন্ন বিরোধী স্বার্থ, অন্যান্য বিভিন্ন ক্ষুব্ধ গ্রুপের সাথে নানান এল্যায়েন্সে ঘটা ঘটনা এগুলো। নুরন্নবীসহ অনেকের বরখাস্ত, মৃত্যু, জেল যাবতজ্জীবন।
১৩. ব্যর্থ হোক আর নাই হোক ঘটনা পরবর্তীতে ঘটনাগুলোর একটা প্রচারমূলক দিক বিবদমান সবার থাকাটাই স্বাভাবিক। সেগুলো এড়িয়ে অবজেকটিভ মুল্যায়ন টানার চেষ্টা করলাম।
১৪. সিপাহী বিপ্লবের ঘটনার শেষে তাহেরকে বিজয়ী দেখতাম যদি তবে সৈনিক অফিসার হত্যা, মৃত্যু, ইত্যাদিগুলো নিয়ে যে প্রশ্ন উঠছে বিচার আইনের দৃষ্টিতে দেখা সেসব প্রশ্ন তখনও থাকত না - একথা হলফ করে বলা যাবে না। ক্ষমতা নির্মম, নিষ্ঠুর। ক্ষমতার এসব অনুষঙ্গ কে এড়াতে পারা কঠিন। বিশেষত সাংগঠনিক দূর্বলতা, রিস্ক এলায়েন্স, পরিকল্পনা ত্রুটি নিয়েই যে ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা থাকে; এবং সর্বোপরি যে ধরণের প্রচেষ্টা উদ্যোগ না নিয়ে তাহেরের উপায় ছিল না!
ফলে এখন নুরন্নবী ঘটনার কী ব্যাখ্যা দেন, কী ভাবে বর্ণনা করেন তাতে ইতিহাসের খুব কী কিছু হেরফের ঘটে না।
রাগইমন ইউটিউব দেখে বলছেন, "নুরুন্নবী জোর দিয়ে যেই কথাটা বলেছেন " ওই সব ক্যু ট্যু কিছু না , সব সাজানো।" " -
নুরন্নবীর এসব কথার একটাই মূল্য থাকতে পারে যদি টার্গেট হয়, "জিয়া একজন মানুষ হত্যাকারী সাইকিক ব্যক্তি ছিলেন" - এমনভাবে ব্যক্তিগত স্বভাব চরিত্রকে ডেমোনাইজ করে ইতিহাস লেখার তাগিদ যদি কারও থাকে।
সবশেষে, ক্ষমতা ও আইনের সম্পর্ক বিষয়ে একটা প্রমাণমূলক কথা। আইন ক্ষমতাকে কীভাবে সমীহ করে চলে এর একটা প্রমাণ দিয়ে শেষ করব। এখানে আইন মানে, আইনের আইন আমাদের কনষ্টিটিউশন।
আমি যদি বলি বাংলাদেশের কোথায় আমাদের বিচার বিভাগের এক্তিয়ার রহিত; অথবা যদি বলি বাংলাদেশের ভুখন্ডে দুই ধরণের বিচার ব্যবস্হা যার যার এক্তিয়ারের মধ্যে থেকে পাশাপাশি চলছে, কেই কাউকে ঘাটায় না - সেটা কী করে?
অনেকে আঁতকে উঠতে পারেন।
আমাদের কনষ্টিটিউশনের তৃতীয় ভাগ বা পার্ট থ্রি; এটায় নাগরিকের মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ আছে যা কোন আইনী সরকার খর্ব করতে পারবে না এবং সুপ্রীম কোর্ট সেগুলো হেফাজত করতেও বাধ্য। এটা ৪৫ নম্বর আর্টিকেল। এই আর্টিকেলের সার সংক্ষেপ কথা হলো, যারা গায়ের জোরে বা মুরোদের ক্ষমতা নিয়ে সরাসরি নাড়াচাড়া করে, সেই সেনা প্রতিষ্ঠান নিজস্ব প্যারালাল বিচার ব্যবস্হায় চলবে (কোর্ট মার্শাল বলে যাকে আমরা চিনি), ওখানে বিচার বিভাগ সুপ্রীম কোর্টের কোন এক্তিয়ার নাই।
আগ্রহীরা আর্টিকেলটা পড়ে দেখতে পারেন।