ষষ্ঠ পর্ব Click This Link
পঞ্চম পর্ব Click This Link
চতুর্থ পর্ব Click This Link
তৃতীয় পর্ব Click This Link
দ্বিতীয় পর্ব Click This Link
প্রথম পর্ব Click This Link
সপ্তম পর্ব
এই পর্বে এবার আইএমএফের সর্বশেষ তিনটা কর্মসূচির মুল বিষয় নিয়ে একটা তুলনামূলক আলোচনা করব। প্রস্তাবিত শেষেরটাসহ এই তিন কর্মসুচির নাম:
১. Structural Adjustment Facility (SAF), ১৯৮৫। এটারই কন্টিনিউয়েড ভার্সানে Enhanced Structural Adjustment Facility (ESAF) ১৯৮৬
২. The Poverty Reduction and Growth Facility (PRGF) ১৯৯৯
৩. Extended Credit Facility (ECF) ২০১০ (প্রস্তুতি চলছে)
পাঠক লক্ষ্য করেছেন বোধহয় সবার নামের শেষে Facility শব্দটা আছে; এর ভাবের বাংলা করব - ঋণ-সুবিধা। কোন কিছু বেচার জিনিষ হওয়া মানেই তা কোন উৎপাদন নয়, উৎপাদন হয়ে যায় না। এই মূল সত্য ভুলিয়ে দিয়ে কোন ব্যাঙ্ক যেমন তার কার লোন দেবার কোন নতুন ঋণ-সুবিধাকে ব্যাঙ্কের প্রডাক্ট বা উৎপাদন বলে চালিয়ে দিতে চায়, এটা সেরকম। আইএমএফের বেচার জিনিষ বা (কোন উৎপাদন না করেই পাওয়া) "প্রডাক্ট"গুলোকে Facility নামে হাজির করে থাকে।
এর আগের পর্বে অর্থাৎ এই সিরিজ পোষ্টের ছয় নম্বরে ধারণা দেবার চেষ্টা করেছিলাম, জন্মের পর থেকে আইএমএফ আশির দশকে এসে সর্বপ্রথম তাদের চিন্তাভাবনায় মৌলিক বদল আনে। এই বদলটা কী, কোথায় তা বলতে বদলের আগের আইএমএফের ভাবনা-অবস্হা সম্পর্কে একটা সংক্ষিপ্ত সামআপ দিয়ে নেই।
আইএমএফ আগে মনে করত তার কাজ হলো, সদস্য গরীব দেশগুলোর balance of payments problems সমাধানে একটা ছাড়মূলক রেটে (concessional lending facilities) ০.৫% সুদে ঋণ দানের ব্যবস্হা আইএমএফের থাকতে হবে। অর্থাৎ সদস্য গরীব দেশের রপ্তানি আয়ের তুলনায় পণ্য আমদানিতে ব্যয় বেশি - বৈদেশিক এই আয়ব্যয়ের ঘাটতি (imbalance) মিটাতে অর্থ ঋণ দেবার বন্দোবস্ত রাখতে চায় আইএমএফ। গরীব দেশের জন্য এই দরদী কথা শুনতে ভাল লাগলেও এটা কিন্তু দরদের ব্যাপার নয়, বরং একটা একপক্ষীয় দিক হাইলাইট করে কথা উপস্হাপন। কারণ আমাদের ভুলা চলবে না, কোন গরীব দেশ তার রপ্তানি বা বৈদেশিক আয়ের সমানই কেবল আমদানি করবে - এই সিদ্ধান্ত নিলে গরীবদেশটার চেয়ে ঐদেশে রপ্তানিকারক দেশের স্বার্থটাই বেশি ক্ষুন্ন হয়। গ্লোবাল পূঁজির (অর্থনীতির) স্বার্থের দিক থেকে দেখলে - গ্লোবাল সামগ্রিক পণ্য চলাচল, বিচলন (circulation) এতে কমে যাবে। আর, গ্লোবাল পণ্য বিচলন কমা মানে পূঁজির মরণকাঠি, প্রাণবায়ু ত্যাগের দিকে তাকে ঠেলে দেয়া। অথচ এই ঘটনাটাকে বর্ণনার সময় আইএমএফের কিতাবে ভাষ্যে বলা হবে, "সদস্য গরীব দেশগুলোর balance of payments এর ঘাটতি মিটিয়ে একটা শ্বাস নেবার জায়গা (breathing room) করে দেওয়াই আইএমএফের লক্ষ্য"। যাইহোক, তার মানে মূলকথা হলো, balance of payments এর ঘাটতি মিটাতে স্বল্পসুদের কিন্তু ব্যাপক শর্তযুক্ত ঋণের কারবার করে আইএমএফ; যার মূল উদ্দেশ্য গ্লোবাল পূঁজির আত্মস্ফীতির স্বার্থে গ্লোবাল পণ্য বিচলন বাধাহীন করতে জোড় খাটানো।
কিন্তু তবু কেবল ঋণ দিয়ে পণ্য খালাশের ব্যবস্হা করে বাংলাদেশে মত দেশে রপ্তানির বাজার তেমন বাড়ছিল না; যথেষ্ট মনে হচ্ছিল না। অথবা উলটা করে বলা যায়, রপ্তানিকারক উন্নত দেশগুলোর বাড়তি উৎপাদন সক্ষমতা যে হারে বাড়ছিল সে তুলনায় আমাদের অর্থনীতিতে আমদানি বাজার সে হারে বাড়ছিল না। এই ভাবনা থেকে আইএমএফের নতুন তত্ত্বের, নতুন গা-ঝাড়া দেয়া (revamp) ভাবনা ও প্রোগ্রামের আবির্ভাব এবং, এটা তার ভাবনায় মৌলিক রদবদলও বটে।
আগে বাংলাদেশের মত দেশে আইএমএফের কারবার থাকলেও দেশের অর্থনীতি ছিল আভ্যন্তরীণ মুখী, একধরণের জাতীয় (national) অর্থনীতি তখনও দেখা যেত। উৎপাদন সংগঠিত হত আভ্যন্তরীণ ক্রেতা-ভোক্তা বাজারকে লক্ষ্য করে; আর ট্রাডিশনাল রপ্তানি পণ্য (যেমন পাট), ভুপ্রকৃতিগত কমপিটিটিভ সুবিধার উপর ভর করে এর উৎপাদন করে। আভ্যন্তরীণ উৎপাদককে সুবিধা সুরক্ষা (protection) দেওয়ার জন্য আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যের এক লম্বা লিষ্ট থাকত।
আইএমএফের চোখে গ্লোবাল পূঁজির স্বার্থে আমাদের সেই অর্থনীতিকে সমস্যা বা বাধা হিসাবে দেখেছিল, চিহ্নিত করেছিল এভাবে যে, আমাদের রপ্তানি আয় (মানে উন্নতদেশের পণ্য আমাদের আমদানির ক্ষমতা) তাদের আকাঙ্খার তুলনায় কম। পাঠককে খেয়াল করতে বলব, আমি জাতীয় সামগ্রিক উৎপাদন বা আয়ের কথা বলছি না, কেবল রপ্তানি আয়ের কথা বলছি । আইএমএফ আমাদের অর্থনীতিকে এই চেহারায় দেখতে রাজি ছিল না; গ্লোবাল পূঁজির আত্মস্ফীতির স্বার্থে গ্লোবাল পণ্য বিচলনে এটাকে বড় বাধা চিহ্নিত করেছিল। এটাই আইএমএফের নতুন তত্ত্ব-ভাবনায় মৌলিক রদবদল।
কেবল ঋণ আর শর্ত দিয়ে এটাকে পাম্প করে পুরানো সীমিত বিনিময় সম্পর্কের আয়ু বাড়ানোর চেয়ে যে কোন ভাবে রপ্তানি আয় বাড়াতে হবে - এটাই ওদের চোখে সমস্যা বা সমাধানে হাত দেবার জায়গা বলে মনে হলো; আইএমএফের নতুন তত্ত্ব, ভাবনা হাজির হয় এই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির উপর দাড়িয়ে। এখান থেকেই গরীব দেশের সবার অর্থনীতির জন্য সাধারণ তত্ত্ব - রপ্তানিমুখী উৎপাদন, সামগ্রিক উৎপাদনকে রপ্তানিমুখী করে সবকিছু ঢেলে সাজাতে হবে, রপ্তানিই উৎপাদনের মুল খাত হবে, বাকি উৎপাদন কিছু থেকে গেলেও তা হতে হবে এই রপ্তানিমুখী খাতের মুখ চেয়ে, অনুগত সাবসিডিয়ারি হয়ে।
এই নতুন ভাবনা কায়েমে - জোড় খাটিয়ে, সরকার বা রাষ্ট্রে বদল (Regime Change), সামরিক আইন, ক্যু করে হলেও জাতীয় উৎপাদনকে রপ্তানিমুখী করে সবকিছু ঢেলে সাজানোর কাজে আমাদের মত দেশ সবাইকে বাধ্য করা হবে। নতুন এই তত্ত্ব এতটাই ডেসপারেট ছিল। নতুন এই তত্ত্ব-ভাবনা আইএমএফের পলিসি হিসাবে ১৯৮১ সালের মধ্যে গৃহীত হয়ে যায়। তবে, দাতাদের কাছে টাকার কমিটমেন্ট নিয়ে কথাবার্তা চালাচালি করে ঋণ কর্মসুচি (Facility) নামে একে হাজির করতে ১৯৮৫ সাল লেগে যায়।
অতএব এখন শ্লোগান হিশাবে যদি বলি, আগের পরিস্হিতিতে মৌলিক চিন্তাভাবনায় বদল ঘটিয়ে আইএমএফ এবার হাজির হচ্ছে, "রপ্তানিমুখী উৎপাদন" নামে, জাতীয় উৎপাদনকে রপ্তানিমুখী করে গায়ের জোড়ে বদল ঘটাতে হবে - এই নতুন নীতিতে।
এখন এতে আমাদের নিজের স্বার্থের দিক থেকে এই নতুন নীতির নীট মানে কী হলো, এনিয়ে একটা পর্যালোচনা দরকার।
যদি প্রশ্ন করা হয়, আমরা রপ্তানিমুখী হতে পারব কেন? কী রপ্তানি করতে পারব? আমাদেরকে পশ্চিমা দেশগুলো রপ্তানী করতে দিবে কেন? সারকথায় সারা পশ্চিম দুনিয়া Multi-Fibre Agreement নামে এক আজীব আয়োজনের আওতায় আমাদের দর্জি জাতি বানিয়ে আইএমএফের সাধের "রপ্তানিমুখী উৎপাদনে" আমাদের নিয়ে যাবার ব্যবস্হা করেছিল। মুল উদ্দেশ্য হলো এতে আমাদের গার্মেন্টস বেচে রপ্তানী আয় বাড়লে সে আয় দিয়ে উন্নত দেশগুলোর বাড়তি উৎপাদন সক্ষমতা, রপ্তানি পণ্য আমদানি করতে পারব, মুল্য পরিশোধ করতে পারবে - আমাদের বাজার ওসব দেশের পণ্য ভোগের বাজার হয়ে উঠবে।
উন্নত দেশগুলোর বাড়তি উৎপাদন সক্ষমতা চালু রাখতে গেলে, আমাদের তার আমদানিকারক বানাতে গেলে তাদেরকে এমনসব নিচু মানের পণ্যোপাদন থেকে সরে আমাদের থেকে আমদানির দিকে যেতে হবে যা উৎপাদনে টেকনিক্যাল know how হয় কম বা তেমন প্রায় বালাই নাই- তবেই একমাত্র নতুন কায়দায় একটা নতুন ও গ্লোবাল বিনিময় সম্পর্ক আবার খাড়া করানো সম্ভব; আবার কিছুদিন গ্লোবাল পুঁজির বেঁচে থাকার, শ্বাস নেবার শর্ত হাজির করানো সম্ভব।
কোন দেশ কোন একটা পণ্য নিজের প্রয়োজন মিটানোর পরেও রপ্তানি করতে পারে - এটাকে পুরানো সংরক্ষণবাদী (protectionist) জাতীয় অর্থনীতির ভাবনায় জাতির উৎপাদনে একটা অগ্রগতির সূচক বলে বিবেচনা করা হয়; স্বভাবতই এই পণ্য কোন একটা হাই-টেক পণ্য। যেমন জর্মান ইস্পাত কোন দেশে রপ্তানি হলে এটা জর্মান অর্থনীতি, উৎপাদন অগ্রগতির গৌরবের সূচক অবশ্যই। এখান থেকে সংকীর্ণ করে (reduced) নতুন "রপ্তানিমুখী উৎপাদন ধারণার" এক মানে বের করে আনা হয়। কোন রপ্তানি মানেই বিরাট গৌরবের - এমন পুরনো আমলের সেই পপুলার ধারণাটাই যেন এখনও চালু হচ্ছে - এমন একটা ভাব ধরে আইএমএফের "রপ্তানিমুখী উৎপাদনে" সবাইকে বাধ্য করার ভাবনাটা আমাদের মত দেশে পাবলিক লেবেলে প্রচারের চালিয়ে দেবার চেষ্টা করে, রপ্তানি নিয়ে আগের পপুলার ধারণাকে abuse করতে সক্ষম হয়। অথচ মুল ব্যাপারটা হলো, একেবারেই লো-টেকনোলজি ও প্রচুর শ্রম লাগে - এমন যেকোন পণ্য পশ্চিমের তুলনায় আমাদের মত দেশে উৎপাদনে আকাশ পাতাল কম মুল্যে উৎপাদন সম্ভব। শ্রমঘন এই পণ্য আগে থেকেই আমাদের মত শস্তা শ্রমের দেশ কমপিটিটিভ এ্যাডভ্যনটেজে আগিয়েই ছিল। রপ্তানির দরজা অবাধ ছিল না বলে আমাদেরকে আমাদের সুবিধাটা নিতে দেওয়া হয়নি।
আইএমএফের নতুন "রপ্তানিমুখী উৎপাদনের" নীতির কারণে আমাদের মত দেশ:
১. দেশের অর্থনীতিতে কোন উৎপাদনে সুরক্ষা (protectionist) নীতি প্রয়োগের ক্ষমতা হারাল।
২. পণ্য আমদানির নিষিদ্ধ তালিকা ছোট হতে হতে এখন একেবারে নাই; অবাধ হয়ে গেছে। গ্লোবাল পুঁজির এই চক্করে পরে বাংলাদেশ একটা অবাধ আমদানির দেশ হয়ে গেছে। আইএমএফ বলপ্রয়োগের চাপে আমাদের রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতা লোপ করার দরকার পড়েছিল; নইলে বাছবিচারহীন অবাধ আমদানির দেশে পরিণত করা সম্ভব ছিল না; টার্গেট ছিল উন্নত অর্থনীতির দেশের উৎপাদন সক্ষমতাকে জায়গা করে দেয়া। একাজে আমরা এমনই দূর্বল হয়ে গেছি, বারগেনিং ক্ষমতা হারিয়েছি, রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতা লোপ পেয়েছে যে এর ফাঁক গলে আঞ্চলিক পড়শি ইন্ডিয়া এই সুযোগে তার পণ্যের একপক্ষীয়ভাবে বাংলাদেশে রপ্তানির বাজার বানিয়ে ফেলেছে - আমরা নুন্যতম কোন বারগেনিংও করতে পারিনি।
৩. আইএমএফ "রপ্তানিমুখী উৎপাদনের"নীতিতে আমাদের বাধ্য করেছে ঠিকই কিন্তু আজব ব্যাপার হলো Multi-Fibre Agreement দেওয়ার ক্ষমতা আইএমএফের নয়, আমেরিকায় গার্মেন্টস রপ্তানির সুবিধা দিলে আমেরিকান রাষ্ট্রের হাতে, ইউরোপ দিলে ইউরোপীয় রাষ্ট্রের হাতে। Multi-Fibre Agreement এর সুবিধা এমনিতেই পাওয়ার কোন সুযোগ নাই। Multi-Fibre Agreement এর আওতায় রপ্তানির সুযোগ (কোটা) পেতে আমাদের রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতা বন্ধক রাখতে হয়েছে। এটা আমেরিকা বা ইউরোপীয় রাষ্ট্রের হাতের কব্জায়, তাদের ইচ্ছায় - যেন একটা বিশাল অনুগ্রহ করে আমাদেরকে গার্মেন্টস রপ্তানি করতে দিচ্ছে। আইএমএফের অবস্হানটা হলো, শক্তের ভক্ত, আর নরম দূর্বলের যম। বাস্তবে দাড়িয়েছে গার্মেন্টেসের রাস্তায় আনার পর রপ্তানির কোটা দিয়ে আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা আমেরিকা বা ইউরোপীয় রাষ্ট্রের হাতের তুলে দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয় বাংলাদেশের যারা এই ব্যবসায় নিজেদের জড়িয়েছে তারা আমেরিকা বা ইউরোপীয় রাষ্ট্রের হাতের বশংবদ পুতুল হয়ে দাড়িয়েছে; বাংলাদেশ রাষ্ট্র রাজনীতিতে আমেরিকা বা ইউরোপীয় রাষ্ট্রের স্বার্থের প্রতিনিধি হয়ে গেছে এসব দেশীয় ব্যবসায়ী। বাংলাদেশকে বিক্রি করে দেবার বিনিময়ে হলেও আমেরিকা বা ইউরোপীয় রাষ্ট্রের হাত থেকে রপ্তানি কোটা পেতে এরা মরিয়া; এতে এসব ব্যবসায়ীদের সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র নিজের বিবেচনায় কোন নীতি, পলিসি নির্ধারণের ক্ষমতা হারিয়েছে।
৪. আমাদের রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতা লোপ পাবার এই ঘটনায় আইএমএফের কোন বিকার নাই; অথচ আইএমএফ নিজের তথাকথিত "রপ্তানিমুখী উৎপাদনের" নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের বার্গেনিং ক্ষমতা কমিয়ে দিতে হবে এমন কোন ঘোষিত লক্ষ্য কিন্তু নাই। ট্রানপারেন্সির জন্য মুখের ফেনা তুলে ফেলা আইএমএফের নীতি বাস্তবায়নে এই সততাটুকুও নাই।
৫. আমেরিকার দিক থেকে দেখে একটা কথা বলি। আগে আমি যদিও বলেছি, আইএমএফের "রপ্তানিমুখী উৎপাদনের" নীতিতে আমাদেরকে বাধ্য করে পরিচালিত করার একটা অর্থ - বড় অর্থনীতির দেশগুলো নীচু টেকনিক্যাল know how লাগে বা তেমন প্রায় বালাই নাই- এমন পণ্যোপাদন থেকে সরে আমাদের থেকে তা আমদানির দিকে যাওয়ার বিনিময়ে ওদের রপ্তানি পণ্যের আর বড় খাতক বানানো - এতেই নতুন কায়দায় একটা গ্লোবাল বিনিময় সম্পর্ক আবার খাড়া করানো সম্ভব ঘটাতে চেয়েছে আইএমএফ। এটা সত্যি বটে তবে এত সিম্পল নয়, আরও ঘটনা আছে।
বাংলাদেশের শ্রম শস্তা এই কথার অন্য মানে হলো, আমাদের কৃষি শস্তায় শহরের শ্রমিকের জন্য শ্রমের বড় উপাদান খাদ্য তৈরি করার ক্ষমতা রাখে। ফলে কৃষির এই সক্ষমতা বাংলাদেশের শস্তা পোষাক হয়ে আমেরিকার পোষাক ব্যবহারকারী শ্রমিকের চাহিদা শস্তায় মিটাতে পারে। ইনডাইরেক্টলি তা আমেরিকান শ্রমের মূল্য তুলনামূলক কম রাখতে সাহায্য করে।
শস্তায় শ্রম তৈরি করার আমাদের মত দেশের ক্ষমতা উন্নত বড় অর্থনীতির দেশের ভোগ করার (appropriation) ঘটনা সহসা অবসান ঘটছে না। তবে উৎপাদনে এর যে কমপিটিটিভ সুবিধা আছে সেদিকে তাকিয়ে আমাদের দূর্বলতাকে সবলতা হিসাবে ব্যব হারের সুযোগ বলে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু আইএমএফ বরং সেই সুবিধা যাতে না নিতে পারি তার ব্যবস্হা করেছে। পোষাকে কোটা ব্যবস্হা আমেরিকান জাতীয় অর্থনীতির পক্ষে একটা উৎপাদনে সুরক্ষা (protectionist) নীতি ও ব্যবস্হা। এর মাধ্যমে আমাদের রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতা আমেরিকার হাতে তুলে দেবার ব্যবস্হা করে দিয়েছে আইএমএফ। আইএমএফ আমাদের বেলায় বলছে, আমাদের আমদানি নীতিতে সুরক্ষা (protectionist) কোন নীতি থাকতে পারবে না, অবাধ আমদানির সুযোগ রাখতে হবে। আর Multi-Fibre Agreement যেটা আসলে আমেরিকার একটা protectionist পদক্ষেপ; এর আওতায় আমাদের মাথা পেতে দিতে বাধ্য করা হয়েছে। সারকথায় protectionism নিয়ে আইএমএফ একটা নৈতিক অসততায় আছে।
৭. আইএমএফের "রপ্তানিমুখী উৎপাদনের" নীতি আমাদেরকে পাটের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করেছে। এটা আর এখন আমাদের রপ্তানির Thrust সেক্টর নয়। পাট থেকে মুখ ফেরানোর পক্ষে আইএমএফের হাতে যে যুক্তি লেগে যায় তা হলো, আমাদের পাটকলগুলো লোকসানী, অদক্ষ ব্যবস্হাপনা ইত্যাদি ফলে এর ব্যয়, দায় মিটাতে সরকারী রাজস্ব আয়ের উপর মারাত্মক চাপ পড়ছে; সরকার চালানোর খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে এগুলো বিক্রি করে দেবার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, জুট স্পিনিং মিল যেগুলোর সবই প্রাইভেট কোম্পানী এগুলোকে সরকারী ভর্তুকি দেবার বন্দোবস্ত করা হয়। এই ভর্তুকির টাকা পাটখাত সংস্কার কর্মসূচির নামে সরকারকে ঋণ দেয়া হয়। সরকার সেই ঋণ নিয়ে প্রাইভেট কোম্পানীকে নগদ ভর্তুকি দেয়া হয়।
পাটের বিষয়টা নিয়ে আরও বিস্তারে এখানে যাব না। যেতে পারলে নিশ্চয় ভাল হত। কিন্তু আপাতত যেতে পারছি না।
এখানেই আইএমএফের (SAF, ১৯৮৫) বা (ESAF, ১৯৮৬) কর্মসুচির চালুর আগের পরিস্হিতির সাথে পরের মুল বিষয়ের দিক থেকে তুলনামূলক আলোচনার ইতি টানব। আগে বলেছিলাম এটা আইএমএফের তত্ত্ব-ভাবনায় মৌলিক বদল। এর পরে যে দুটো "Facility" বা ঋণসুবিধা নিয়ে কথা বলতে চাই সে দুটো SAF বা ESAF "Facility" থেকে মৌলিকভাবে আলাদা নয়।
তাই সংক্ষেপে উল্লেখযোগ্য অংশটুটক বলে পোষ্ট শেষ করব।
এনজিও উন্নয়ন পাড়ায় অংশগ্রহণমূলক (participatory) বলে মুখরোচক কিন্তু গারবেজ জাতীয় একটা কথা চালু আছে। ESAF কে সরিয়ে ১৯৯৯ সাল চালু হওয়া নতুন ঋণ-সুবিধা The Poverty Reduction and Growth Facility (PRGF) তফাৎ এখানে। ESAF জাতীয় কর্মসূচি তৈরিতে প্রয়োগ হবে এমন দেশের বিনা অংশগ্রহনে তৈরি করা হয়েছে। এই অভিযোগ ঢাকতে PRGF তৈরিতে দুইটা অংশে সম্পন্ন করা হয়। আইএমএফের PRGF এর মোটা দাগের গাইড লাইনের মধ্যে Poverty Reduction Strategic Paper (PRSP) বলে ঋণ-খাতক দেশের দারিদ্র দূর করার (Poverty Reduction) একটা কৌশলপত্র (Strategic Paper) আগে তৈরি করিয়ে নেয়া হয়। বাংলাদেশের কারা এই PRSP তৈরির কনসালটেন্সি ব্যবসায় জড়িত? এদের শিরোমনি হলো হোসেন জিল্লুর রহমান, প্রাক্তন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ বছরে ("যৌক্তিক" মুদ্রাদোষে কথা বলা) বাণিজ্য উপদেষ্টা; আর সাধারণভাবে যাদেরকে আমরা একালের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় আমরা "সুশীল" বলে চিনে গেছি - এরা সকলে। চিন্তা-ভাবনার দিক থেকে যাদের মাথা বন্ধক পড়ে গেছে, আইএমএফকে নূন্যতম ক্রিটিক্যালী দেখার ক্ষমতা যাদের লোপ পেয়েছে, এরাই এসব কাজ ধরে সরকারের পক্ষ থেকে PRSP তৈরি করে দেয় বলে কাগজপত্রে দেখানো হয়। এই PRSP এবার সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে আইএমএফের কাছে জমা দিয়ে দাবি করা হয় জনগণের অংশগ্রহণ ঘটে গেছে। এরপর এই PRSP এর ভিত্তিতেই নাকি আইএমএফ তার PRGF দিয়েছে বলে দাবি করা হয়। একটু ঘুরিয়ে খাওয়া আর কি। লাভের লাভ হয়েছে আইএমএফ এখন "সুশীল সমাজ" বলতে বিস্তর পয়দা করা এসব পোষা প্রাণী আমাদের সমাজ থেকেই হাজির করে দেখাতে পারে।
Extended Credit Facility (ECF):
এটা এখনও আইএমএফের ঋণ-সুবিধার "প্রডাক্ট" আকারে সাজানো-গুছানোর পর্যায়ে আছে। আশা করা হচ্ছে আগামি বছর থেকে এটা চলতি PRGF কে সরিয়ে তার জায়গা নিবে। এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে এর বিশেষত্ত্ব আমাদের দেশের পর্যায়ে হয়ত তেমন টের পাওয়া যাবে না, PRGF ই মনে হতে পারে। কারণ এর বিশেষত্ত্ব ডোনারদের কাছে অর্থ সংগ্রহের পদ্ধতিতে।
এর আগে একএকবার দাতাদের কাছে থেকে তিন-চার বছরের কমিটমেন্ট/অর্থ সংগ্রহ করে PRGF জাতীয় Facilities চালানো হত। এবারে নতুন পদ্ধতি। অর্থ সংগ্রহ করা হবে বাজার থেকে; মানে আন্তর্জাতিক বাজারে যারা লগ্নিপুঁজির বিনিয়োগের ব্যবসা করে যেমন, BNP Paribas - জর্জ সোরেসও হতে পারে, এদের থেকে। স্বভাবতই এদের সুদের হার হবে অনেক বেশি, বাণিজ্যিক ব্যবসার লোনের মত। এই অর্থ ঋণ নিয়ে আইএমএফ আবার ০.৫% সুদে ঋণসুবিধা আকারে বিতরণ করবে - এতে যে লোকশান হবে; অর্থাৎ দুই সুদের হারের যে ফারাক এই সুদ দাতাদেশগুলো দিয়ে দেবে। এতে নিট যা ফারাক, তা হলো, আগে পুরা অর্থ ছিল সরাসরি দাতা রাষ্ট্রের কোষাগারের এখন সে অর্থ আসবে টাকার বাজার থেকে, প্রাইভেট লগ্নিবিনিয়োগকারী ব্যবসায়ীর কাছে থেকে আর কেবল এর সুদটা কেল দাতাদেশের রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে। আইএমএফের কনসেশনাল লোন বড় কোন ধরণের পরিমাণ নয়, এপর্যন্ত বছরে সর্বোচ্চ ৮ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।
আজ এখানেই শেষ করছি। পরের পর্বে দেখা হবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০০৯ রাত ১২:৪৬