পঞ্চম পর্ব Click This Link
চতুর্থ পর্ব Click This Link
তৃতীয় পর্ব Click This Link
দ্বিতীয় পর্ব Click This Link
প্রথম পর্ব Click This Link
ষষ্ঠ পর্ব:
আইএমএফ নিয়ে পপুলার ধারণায়, এটা টাকা লগ্নিকরে খাটিয়ে মুনাফা কামিয়ে আমাদের ঋণগ্রস্হ করে গেল বলে ভাবনাটা যতটা সবল কী কী শর্ত এই ঋণগুলো বিতরণ করা হয় সেদিকে নজর, খবর ততটাই কম - আড়ালে। পাঠককে সেদিকে নিয়ে যাবার সুযোগ নিব। আগে বলেছিলাম বিশ্বব্যাঙ্কের বেলায় তার ঋণের সুদ সাধারণত ০.৭৫% হয়। আইএমএফের বেলায় এই সুদ আরও কম ০.৫০%। কাজেই সংগঠনদুটোকে বুঝতে চাইলে আমার সবসময় পরামর্শ ঋণ-শর্তের দিকে নজর দিতে। ওখানেই ওর মরণকাঠি-জীয়নকাঠি লুকিয়ে আছে। কাজেই শর্তগুলো কী, কোথা থেকে উদ্গত হচ্ছে সেদিকে আমাদের যেতে হবে।
আইএমএফের কেতাবি কর্মপরিধিতে বিভিন্ন খাতক দেশের "আর্থিক খাতের" নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারবারি প্রতিষ্ঠান অবশ্যই। "আর্থিক খাত" মানে কাজকাম মূলত আমাদের মত দেশের বাণিজ্য ঘাটতিতে আমদানি মূল্য পরিশোধের জন্য শর্তযুক্ত করে ঋণ দেয়া। এই শর্ত মানা মানে আমাদের মত দেশের আর্থিক নিয়ম-শৃঙ্খলা বিষয়ক, রাজস্ব আদায়, বাজেট পর্যন্ত যত নীতি আছে - সবই আইএমএফ যেভাবে ঠিক মনে করে সেভাবে তাকে নির্ধারণ করতে দেওয়ার দেশের সার্বভৌম ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া। ১৯৯৯ সাল থেকে চলে আসা চলতি PRGF ঋণ ০.৫% সুদে "আর্থিক খাত সংস্কার" নামে শর্তে এখন হাজির আছে। এর হুকুম ছাড়া দেশের গাছের পাতাও নড়ে না। আবার, "আর্থিক খাত সংস্কার" এর বাস্তব সংজ্ঞা কেবল "আর্থিকে" সীমাবদ্ধ নয়, ব্যাপক। জনগণ কীভাবে প্রতিদিন সকালে প্রাতঃক্রিয়াদি সম্পন্ন করবে, না কী আদৌ আর করবে না - থেকে শুরু করে সবই; এমনকি শেষ বিচারে আইএমএফ বলপ্রয়োগে সরকারই বদল করে দিবে কী না তা পর্যন্ত।
আইএমএফ যদি মনে করে গ্লোবাল অর্থনীতির (গ্লোবাল পুঁজির) স্বার্থের বিচারে গ্লোবাল অর্থনীতির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ অংশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক কাঠমো সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় - এ' যথেষ্ট পুঁজি ধারণ, কারবার ও কাঙ্খিত দক্ষতার সাথে তা ব্যবহার করে মুনাফা তোলার উপযুক্ত নয় - তবে একে উপযুক্ত করতে যত গভীর স্তরের "সংস্কার" দরকার মনে করুক তা সে করে ছাড়বে। এটা আর তখন ঋণ-শর্ত দিয়ে ছোটখাট "সংস্কার" নয়। এছাড়া হয়ত যাকে এই শর্ত দিবে সেই সরকারের উপর আইএমএফের ভরসা, আস্হা নাই; আবার কাজটা আইএমএফের গ্লোবাল অর্থনীতিক কর্মসূচি বলে তা বিরাট এলাহি কারবার, খাতক দেশটার পুরা খোলনলচে বদলাবার মত; ওর মধ্যে আবার একমাত্র জবরদস্তিতেই করা সম্ভব বা করলেই একমাত্র ফল দিবে - এমন কিছু দিকও আছে। এই ধরণের পরিস্হিতিতে, আইএমএফের মরিয়া সিদ্ধান্ত হয়, যে কোন মূল্যে Regime Change করা; অর্থাৎ মার্শাল ল, সামরিক আইন জারির ব্যবস্হাও সে করবে; কিন্তু নিজে অফ লাইনে, আড়ালে অপ্রত্যক্ষে। তার জন্য আলাদা মেকানিজম, লোক আছে; সেক্ষেত্রে সে কেবল বলে দিবে সে কাদের দিয়ে কীভাবে কী করতে চায়। Regime Change মানে রক্তারক্তির ব্যাপার আছে ওতে। যতই আগেভাগে প্ল্যান করে নেক না কেন - রক্তপাত ঘটে যেতে পারে। সেই রক্তের দাগ আইএমএফের গায়ে লেগে যাবে। বলপ্রয়োগে ক্ষমতা বদলের মারামারির দিন আইএমএফ-সদরে ট্যাঙ্ক গিয়ে হাজির হোক এটা ভাবা যায় না। রক্তের দাগ লাগার সম্ভবনা থেকে বাঁচতে আইএমএফ সংগঠনের কাজের নীতি হলো - কাজের রক্তপাতের অংশ, সরাসরি রাজনৈতিক ক্ষমতা, বলপ্রয়োগমূলক অংশটা নিজে না করা, দূরে থাকা। এ্যামবেসি বা আরও দূরের কোন আলাদা মেকানিজমে এটা ঘটুক। বাংলাদেশের ভাগ্যে ১৯৮২ সালে এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থান Regime Change - এধরণের একটা ভাল উদাহরণ।
কথা বিমূর্তে ভারী না করে তাই ঘরের উদাহরণে এখন কথা বলব।
১৯৮২ সালের আগে আমাদের আমদানি ব্যয়ের ঘাটতি মেটাতে আইএমএফ যে ঋণ দিত তাতে এটা আর তাঁর কাঙ্খিত মত ফল দিচ্ছেনা বলে আইএমএফের তত্ত্ব ও খাতাপত্রের হিসাবে মনে হয়েছিল। আমাদের আমদানি ব্যয়ের ঘাটতি নিজেরা মিটাতে পারছি না - এই কথাটার বাইরের জবানী; আইএএমএফের অন্দরের জবান-ভাষ্য না। গ্লোবাল অর্থনীতির (গ্লোবাল পুঁজির) স্বার্থের বিচার প্রসুত ধারণায় দাঁড়িয়ে দেখে আইএমএফের কাছে এর মানে হলো, আমরা উন্নত দেশের পণ্য কিনতে পারছি না, তাদের প্রাইভেট বিনিয়োগকে যথেষ্ট কাজে খাটিয়ে মুনাফা উসুল করে দেবার মত যোগ্য নই, যথেষ্ট পুঁজি ধারণ করতে পারি না। আমরা তাদের পণ্যের বা বিনিয়োগের বড় খাতক নই। গ্লোবাল অর্থনীতির (গ্লোবাল পুঁজির) আত্মস্ফীতি বিকাশের পথে এএক বিরাট বাধা।
আইএমএফের কাছে এর সমাধান হলো, একটা ব্যাপক প্রশাসনিক সংস্কার করতে হবে। প্রশাসনিক সংস্কার - এই খটমটে শব্দটার নেকাব খুলে আমাদের চলতি পরিচিত ভাষায় বললে এটা হলো, "উপজেলা করতে হবে"। পুরানো ২১ জেলা ভেঙ্গে ৬৪ জেলা ও ৪৬০ উপজেলা করতে হবে। প্রত্যেক উপজেলাকে রাজধানী সঙ্গে সংযুক্ত করে দিতে রাস্তাঘাট করতে হবে। তাহলে উপজেলার প্রশাসনকে কেন্দ্র করে নতুন ব্যপ্তিতে বাজার ব্যবস্হায় বাংলাদেশ বিশাল বাজার হয়ে উঠবে। উন্নত দেশের পণ্যের বা বিনিয়োগের বড় খাতক হয়ে উঠব আমরা।
[ উপরে "প্রাইভেট" বিনিয়োগ বলেছি বলে এটা ব্যক্তি না সরকারি মালিকানা ভাল বলে যে পপুলার ধারণা বাজারে আছে সে অর্থে বিচারে যাবার দরকার নাই। "ব্যক্তি মালিকানা খারাপ জিনিষ"- এই মালিকানার ঢং বিচার এখানে উদ্দেশ্য নয়। সে উদ্দেশ্যে "প্রাইভেট" বলিনি। বলার কারণ অন্যখানে। লগ্নি, বিনিয়োগ করে মুনাফা কামানোর কারবার জমানো আইএমএফের কাজ নয়, অনেক আগে বলেছি। বরং যারা লগ্নি, বিনিয়োগ করবে তাদের কারবারের ক্ষেত্র তৈরি করা, infrastructure কাঠামো তৈরি করে বিদেশী পণ্যের ভাল খাতক বা বিনিয়োগের স্বর্গ বানিয়ে দেয়া, গ্লোবাল পুঁজির স্বার্থে সমন্বিতভাবে তা সাজিয়ে দেয়া ওর কাজ। বিদেশী লগ্নি বিনিয়োগ - আইএমএফের নিজ দায়িত্ত্বের বা ম্যানেজের কাজ নয় - বরং ওটা ওর বাইরের, প্রাইভেট। আইএমএফের ম্যানেজের দায়দায়িত্ত্বের সীমার বাইরের সে আছে - এই অর্থে এটা প্রাইভেট বলছি। এছাড়া পণ্যউৎপাদক বা লগ্নবিনিয়োগকারী কোম্পানীর সাথে সামান্য প্রতিযোগী হয়ে উঠতে পারে এমন কোন কাজে সরকারের না জড়ানো, সম্পর্ক না রাখা পশ্চিমের প্রায় সব সরকারের ঘোষিত ও কঠোরভাবে মেনে চলা নীতি - একথাটাও মনে রাখতে হবে। ]
আইএমএফের সংস্কারের প্রয়োজনে দরকার হলে Regime Change এর উদাহরণে এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনায় ফিরে যাই।
এই কাজটা একটা রাজনৈতিক কাজ। বাংলাদেশের জনগণকে এতে তাদেরও লাভ আমারও মাখন - এভাবে বুঝিয়ে করা যেত না। যদি বুঝানোও যায় তবে এতে যে রাজনৈতিক শক্তি সংগঠন তৈরি হবে ব্যাপক গণজাগরণের সেই পার্টি ও ক্ষমতা যে রূপ নেবার সম্ভবনা তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে, আইএমএফের কথা আর শুনবেই না হয়ত। কাজেই ঐ পথ কোন অপশন নয়। তাই কাজ রাজনৈতিক হলেও তা করতে হবে গোপনে, সামরিক কায়দায় গায়ের জোড়ে; ক্ষমতার কেন্দ্র নিজের হাতে থাকা নিশ্চিত করে। এমনকি এই এ্যাসাইমেন্টে ১৯৮১ সালে তখনকার প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জনগণের সাথে নড়বড়ে সীমিত সংযোগের দলও যথেষ্ট সক্ষম বিবেচিত হয়নি।
সক্ষম বিবেচিত করে নেয়া হয়েছিল এরশাদকে, কারণ ১৯৮২ সালে এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থান নতুন বলপ্রয়োগের ক্ষমতা শক্তহাতে প্রয়োগের সুযোগ কায়েম করা গিয়েছিল। আমাদের পেটিচিন্তা, পেটিস্বার্থের রাজনৈতিকতা, সামাজিক polity, রাজনৈতিক ভাবনা, রাজনৈতিক দল - যারা দুনিয়াদারি কেমনে চলে খবর করার ক্ষমতা নাই তারা কাছে বড় জোড় এটা সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা আর অমুক্তিযোদ্ধা বিতর্ক, লড়াই মারামারি বা কামড়াকামড়ি বলেই বিবেচিত হয়েছিল। ফলে পপুলার পারসেপশনে এটা মার্শাল ল, মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী এরশাদের উত্থান, ক্ষমতা দখল - এখানেই সীমাবদ্ধ ছিল।
আইএমএফের দরকার ছিল একজন এরশাদের যে অবিচল থাকবে, প্রশ্ন না তুলে বা বাগড়া না দিয়ে আইএমএফের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক খোলনলচে বদলাবার কর্মসূচি বাস্তবায়নের কেবল হাতিয়ার হবে। ওদিকে আওয়ামী লীগও প্রতিযোগিতা করেছিল বটে, এরশাদের চেয়ে আর্মির চেয়ে আইএমএফের কাছে নিজেকে আরও ভাল বিশ্বস্ত পলিটিক্যাল এজেন্ট হিসাবে হাজির করাতে। কিন্তু আইএমএফের কাছে বেটার, যোগ্য বলে বিবেচিত হয় নাই। আওয়ামি লীগ বাধ্যও করতে পারে নাই। মনে রাখতে হবে এই বিশ্বস্ত পলিটিক্যাল এজেন্ট হওয়া মানে জনগণের ক্ষমতা বা তার স্বার্থ ইচ্ছার সমন্বিত প্রকাশ রূপ হওয়া নয়, বরং আইএমএফের এজেন্ডার লোকাল রাজনৈতিক টুল ও এজেন্ট হওয়া। কোন রাজনৈতিক দলের সামনে দুটো অপশনই খোলা থাকে। একটা কষ্টকর অন্যটা সহজ পথ। আওয়ামি লীগ সহজ পথে চেষ্টা করেছিল। বিএনপির পতন হয়েছে তাহলে আমি ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী - এই সহজ অথচ নাদান ভাবনায় থেকে আগানোর প্রচেষ্টা। টের পায়নি আইএমএফ একটা গ্লোবাল স্বার্থ নিয়ে কারবারে বসে আছে; দুনিয়াকে ঢেলে সাজানো যার লক্ষ্য; শক্তহাতে এর বাস্তবায়নে সে বদ্ধপরিকর।
এখানে আর একটা দিক বলে রাখা দরকার। ঐ সময়টা আইএমএফের এজেন্ডা কেবল বাংলাদেশকে ঘিরে কাজকারবারে কাজের ধরণের বিষয় ছিল না। বরং কেবল বাংলাদেশ নয়, আইএমএফের গ্লোবাল ভাবনায় আমুল বদলের সময় ওটা। আইএমএফের জন্ম হয়েছিল জন্মের পর থেকেই যুদ্ধোত্তর ইউরোপের reconstruction নিয়ে মেতে উঠার জন্য। কিন্তু ১৯৬০ সালের দিকে টের পেতে শুরু করে এটা একটা স্যাচুরেশনের বা পূর্ণতা দশা প্রাপ্তির দিকে যাচ্ছে - বাজার আর বাড়ছিল না। ফলে মনোযোগ অন্য কোথাও, এশিয়ার দিকে ফেলতে বাধ্য হয়। কিন্তু সমস্যা ছিল এশিয়া তুলনামূলক অর্থে পুঁজি বিকাশের দিক থেকে অনেক পশ্চাদপদ অবস্হায়। ফলে ইউরোপের মত একই কায়দায়, চিন্তার, কাজের ধরণে আগানো যেত না। ইউরোপ মানে বিশ্বযুদ্ধ দুটোর বহু আগে থেকে একটা শিল্পবিপ্লব করে উঠে আসা ইউরোপ; দক্ষ শ্রম, কারিগরি বিদ্যা, দক্ষ ও বিকশিত উৎপাদন আয়োজনের সক্ষমতা, বিজ্ঞান -সবতেই সে অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। কেবল যুদ্ধে সব সম্পর্ক ভেঙ্গে পড়েছিল। উৎপাদন সংঘঠনের সক্ষমতা, সংগঠিত করার ক্ষমতা, অভ্যস্ত সম্পর্ক ইত্যাদিই কেবল টুটা ফাটা টুকরো টাকরা হয়ে এলোমেলো হয়ে ছিল। ভোগ্যপণ্যে অভ্যস্ত আকাঙ্খা - কেবল আকাঙ্খা হয়েই টিকে ছিল, কারণ ভোগ্যপণ্যের সমৃদ্ধ বাজার ছিল না, পণ্য-উৎপাদন ছিল না, ভোগের সক্ষমতাও ছিল না। প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক মফস্বলের গন্ধ ছাড়েনি এমন এশিয়ার তুলনায় ইউরোপের কাজ, কাজের পরিকল্পনা, তত্ত্ব বের করা সাজানো সবই তুলনায় সহজ ছিল। ফলে কিভাবে পূঁজি গুছিয়ে এশিয়ায় প্রবেশ নিবে তা ঠিক করতে বিস্তর মাঠের তথ্য, গবেষণা করে সিদ্ধান্তে আসতে সময় লেগে যায়। এর বাইরে ইতোমধ্যে গুরুত্ত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা ঘটে যায়। Gold standard ডলার, ডলারের হেফাজত আমেরিকার আর ডলারের সাথে অন্য মুদ্রার বিনিময় হার স্হির থাকবে এসব ধরে নিয়ে - যে আইএমএফের জন্ম হয়েছিল ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে আইএমএফের ভিত্তিমূলক সে ভাবনাগুলো মৃতপ্রায়, অকেজো হয়ে যায়। সংগঠন হিসাবে আইএমএফের অস্তিত্ত্ব, ন্যায্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। এক হিসাবে দেখা যায়, ১৯৬০ সাল থেকেই বিভিন্ন দেশকে দেয়া আমেরিকার মোট ঋণ (ডলারে হিসাব করে দেয়া) তার ঘরে মজুদ সোনার মুল্যের চেয়ে বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে; অথচ ঐ ডলারের সোনায় বদল (convertible) যোগ্যতা থাকার কথা। আমেরিকা ডলার বদল করে সোনা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এককথায়, আইএমএফ দাঁড়িয়ে থাকার ভিত্তিমূলক ভাবনাগুলো সব ধসে পড়ে। জুলাই ১৯৬৯ আইএমএফ তার গঠনতন্ত্র Articles of Agreement সংশোধন করে Gold standard ডলার থেকে প্রস্হান ঘোষণা করে। এর জায়গায় আইএমএফ নিজের এক গায়েবি মুদ্রা (নাম SDR) ঘোষণা করে যেটা কাগুজে মুদ্রার মতও দেখাও যায় না, ছোঁয়া যায় না; কেবল আইএমএফে কিতাবে এর দেখা মেলে। প্রত্যেক সদস্য দেশের হিসাব কিতাবে SDR মুল্যে রাখা হয়। শুরুর দিনের হিসাবে, ০.৮৮৮৬৭১ গ্রাম সোনা সমান এক SDR ধরা হয়েছিল। কারণ এক ডলারে ঐদিন সোনা পাওয়ার পরিমাণ ছিল ওটা।
অর্থাৎ ১ SDR = ১ ডলার = ০.৮৮৮৬৭১ গ্রাম সোনা ছিল। এখন দাঁড়ালো সোনার সাথে কোন সম্পর্ক নাই একেবারেই কাগুজে মুদ্রা; প্রতিদিনের মুদ্রার খোলা বাজারে চারটি কাগুজে মুদ্রার (ডলার, পাউন্ড, ইয়েন ও [পরে অন্তর্ভুক্ত] ইউরো) দাম গড় করে আবার ডলারে তা প্রকাশ করলে যা দাঁড়ায় ওটাই ঐদিনে SDR এর মুল্য। সোজা মানে হল, SDR মানে তেমন নতুন কিছু না কাগুজে মুদ্রা চারটার এক গড় দাম। যেমন আজ ২৭ অক্টোবর তারিখের এক ডলার= ০.৬২৬৭ SDR । তবে মূল কথা, এতে কাগুজে মুদ্রার পিছনে সোনা রাখার আর কোন বালাই থাকল না। SDR এর পিছনেও কোন সোনা রাখা নাই; কেবল হিসাব রাখার এক ধরণের অঙ্ক। এটা যেন কোন পণ্যে বা সোনার সাথে তুল্য কোন পণ্য-বিনিময় সম্পর্ক ছাড়াই কাগুজে মুদ্রা নিজেই নিজেকে রাজা ঘোষণা করেছিল। আর কাগুজে মুদ্রা হয়ে গিয়েছিল সোনা থেকে দায়মুক্ত বিহঙ্গ। এই সোনা-দায়মুক্ত বিহঙ্গই আইএমএফের গুণে ও বিচারে সেই থেকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা; SDR ভিত্তিক আইএমএফের নতুন করে জন্ম নেয়।
একদিকে মুদ্রার গায়েবি রূপ চিরস্হায়ী দেয়ার এই কারবার আর ওদিকে এশিয়ায় পূঁজি সম্পর্কের ব্যাপক প্রবেশের পথ পদ্ধতি কি হবে তা নিয়ে গবেষণা - এসব মাতামাতি শেষ করতে করতে ১৯৮১ সাল এসে যায়। এই মাঝের সময়ে গরীব দেশে আমদানির ব্যয় মেটানোর জন্য ঋণ দিতে হবে - এই সাধারণ ভাবনায় কর্মসূচি নিয়ে আইএমএফ চলেছিল। এরপর গুছিয়ে কর্মসূচি আকারে আইএমএফের গবেষণালব্দ ডিজাইনকে দেশে দেশে হাজির করতে ১৯৮৬ সাল এসে যায়। এটাই Structural Adjustment Facility (SAF) নামে পরিচিত। নতুন নামের এই ঋণ কর্মসূচি সারা দুনিয়ায় তার ঋণ-খাতকদের জন্য প্রযোজ্য করা হয়। আগের তুলনায় এর বিশেষত্ত্ব হলো, এবার ঋণের শর্ত কি হবে, শর্তগুলো কেন কী রকম হবে আইএমএফের দিক থেকে তার পিছনের যুক্তি ন্যায্যতা (rationale) কী - এই বিষয়ে একটা uniformity হাজির হলো। হাজির করা গেল এজন্য যে SAF গ্লোবাল পুঁজির স্বার্থের দিক থেকে ভেবে তৈরি একটা গ্লোবাল কর্মসূচি। ফলে ন্যায্যতার যুক্তিও একটাই। পুঁজির গ্লোবাল স্বার্থ কী তা বুঝে নিয়ে এটা সবার জন্য প্রযোজ্য এভাবে ডিজাইন করা; তবে কর্মসূচির মধ্যে মূল ভাবনাটা ঠিক রেখে সুনির্দিষ্ট দেশে কিছু টেলারিংয়ের স্কোপ ওখানে রেখে দেয়া ছিল।
[আমার চলতি সিরিজ নিয়ে অনেকের অভিযোগ হলো কোথায় কোন কালে কী যুদ্ধ হয়েছে তার তথ্য নিয়ে বেশি মাতামাতি; বাংলাদেশের মাটিতে টেনে নামিয়ে এনে প্রাসঙ্গিক করে এখানে কথাবার্তা নাই বা একেবারেই কম। বিশেষ করে নিক প্লাটোর অভিযোগ আমি অবজ্ঞা করি না। অভিযোগ অনেকটাই সত্যি; তবে আমি না-চার, নিরুপায় ছিলাম। গ্লোবাল অর্থনীতি বিষয়টা এমনই যে পাঠককে আগে একটা গ্লোবাল ধারণার মধ্যে টেনে নিয়ে তবেই বাংলাদেশের মাটিতে নামিয়ে এঁকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। এতকাল আগের পর্বগুলোতে সেই কসরতেই দিন গেছে। এই পর্বে এসে কিছুটা দেশের মাটিতে একে টেনে নামাবার সুযোগ দেখছি। নীচে যত বেশি সম্ভব সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করব।]
এক কথায় বললে SAF কর্মসূচির মূল তত্ত্বীয় ভাবনাটা হলো, গরীব দেশের ইকোনমি export oriented economy করে ঢেলে সাজাতে হবে, আমূল সংস্কার করতে হবে। কে কী আগে রপ্তানি করত (পাট না খনির তামা), আর একটা ন্যশনাল ইকনমি চালাত তা আর নয় - এখন থেকে উৎপাদন করতে হবে রপ্তানির জন্য - রপ্তানিমুখী হতে হবে সব কিছু। এই লক্ষ্যের অধীনস্ত হয়ে খাতক দেশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক এক ব্যাপক সংস্কার ঘটাতে হবে। কোনটা কোন দেশ চায়, কীভাবে চায়, নিজের স্বার্থ কী বা নিজের স্হানীয় স্বার্থের সাথে তা অনুকুলে কী না - সেটা নয় পুঁজির এক গ্লোবাল স্বার্থের মধ্যে সকলকে বেধে ফেলতে হবে। গ্লোবাল স্বার্থ কোনটা - আইএমএফ যেভাবে বুঝেছে সেই বুঝের স্বার্থের মধ্যে সকলকে বেধে ফেলতে হবে।
বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় এর প্রতিফলন আমরা তাই দেখেছিলাম - অকস্মাৎ রপ্তানিমুখী নারী মেশিন - গার্মেন্টস, পাট রপ্তানি থেকে মুখ ফেরানো, জুট স্পিনিং মিলকে ঋণ নিয়ে ভর্তুকি আর পাটকল জাহান্নামে পাঠানো - বিক্রি হোক না হোক পাটের উৎপাদন দাম যেখানে খুশি যাক, পাটচাষী, পাটকল শ্রমিক না খেয়ে মরুক। আর ওদিকে রাষ্ট্রের ভিতরে রাষ্ট্র - Export Processing Zone (EPZ) খুলতে হবে। এই লক্ষ্যে সবকিছু ঝেটিয়ে "সংস্কার" করে ফেলতে হবে।
আর রাজনৈতিক, প্রশাসনিক খাতে - যেকথা থেকে শুরু করেছিলাম - উপজেলা, এরশাদ।
সাধারণভাবে কোন সংস্কারের বিরোধী হবার আমাদের কোন কারণ নাই। দেশের জন্য গণস্বার্থে, জনগোষ্ঠীর স্বার্থে যেকোন ধরণের সংস্কার হতেই পারে, তা দরকারও বটে। তবে জনগোষ্ঠীর সকল অংশের স্বার্থের দিকে, বিশেষত গরীব জনগোষ্ঠী (শুধু গরীব বলে নয়) প্রতিনিধিত্ত্বের দিক থেকে যারা সবচেয়ে উপেক্ষিত অথচ কোন সিদ্ধান্তের চাপ যার উপর সবচেয়ে বেশি - এদের দিকে অবশ্যই নজর রেখে একমাত্র তা করা যেতে পারে। আর তা করতে চাওয়া মানে, ব্যাপক জনগণকে সংশ্লিষ্ট করে এক নতুন রাজনৈতিক ক্ষমতা তৈরি করতে হবে আগে এরপর সে ক্ষমতা দিয়ে পপুলারলি যা কিছু করা হবে তা আপনাতেই র্যাডিক্যাল সংস্কার, বদল। কারণ সেক্ষেত্রে ইতোমধ্যে গণক্ষমতার এক উন্মেষ (তুলনার জন্য ৬৯ এর গণঅভুত্থান স্বর্তব্য) নতুন রাষ্ট্রক্ষমতা, ক্ষমতার র্যাডিক্যাল বদল ঘটিয়ে, আসীন হয়ে আসল জায়গা, ক্ষমতায় "সংস্কার" ঘটিয়ে ফেলে। ফলে কার জন্য, কোন রাষ্ট্রের স্বার্থে "সংস্কার" এসব প্রশ্ন-বিবাদ সমাধানে মিটিয়ে তাতে নিজের বিজয় টিকা লাগিয়ে ফেলা হয়। এর বাইরে অন্য কোন "সংস্কারের" মানে অবশ্যই প্রাসাদে বসে তৈরি করা ক্ষমতা। আইএমএফও সংস্কারের আগে প্রাসাদে বসে তৈরি করা ক্ষমতা আগেই তৈরি ও নিজের নিয়ন্ত্রণের এনে তবেই আগিয়েছে। একাজে সামরিক কায়দায় সেনাবাহিনী ব্যবহার করে কোটারি (oligarchy) ক্ষমতায় একাজ করতেও সে পিছপা হয়নি। এটাই তার কাজের সবচেয়ে সুবিধাজনক ধরণ। ফলে Structural Adjustment Facility (SAF) (১৯৮৫) ও পরে নতুন ভার্সানে Enhanced Structural Adjustment Facility (ESAF) (১৯৮৬) - এগুলো কোনটাই আমাদের সিদ্ধান্ত নয়। oligarchy ক্ষমতার ফসল। এরশাদের কাঁধে চড়ে এগুলো আমাদের উপর চড়িয়ে দেয়া। ফলে সংস্কারের সিদ্ধান্ত দূরে থাক, জিনিষটা কী কোথা থেকে এসেছে - সবই গায়েবি। আর বেকুব এরশাদ উপজেলা করার সিদ্ধান্ত তাঁর নিজের বলে দাবী করে আজও বাঁদর নাচ দেখিয়ে হাততালি কুঁড়াতে চায়। উনি হয়ত মনে ভেবেছেন সবাই তাঁর মত ভাঁড় ও বেকুব।
তাহলে এরশাদ হলো সেই প্রতীক আইএমএফের কর্মসূচির জন্য যা লোকাল রাজনৈতিক টুল ও এজেন্ট; সামরিক বাহিনীকে বগদদাবা করে দেশের ক্ষমতা আইএমএফের পায়ের কাছে রাখার হাতিয়ার, প্রতীক তিনি। এরশাদের যুগ তাই আসলে আইএমএফের Structural Adjustment Facility (SAF) এর অধীনে কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের খোলনলচে বদলে দেবার যুগ। সারা দুনিয়াকে রপ্তানিমুখী করে আকার দিতে Structural Adjustment Facility (SAF) চলেছিল ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ সারা দুনিয়া SAF বা ESAF এর যুগে কাটিয়েছে এই কালে। এরপর ১৯৯৯ সাল থেকে আবার আইএমএফের ভাবনায় গাঝাড়া দেয়া নতুন কর্মসূচি The Poverty Reduction and Growth Facility (PRGF) আগের ESAF এর জায়গা নেয়। সারা দুনিয়া এখন PRGF এর অধীনে দিনগুজরান করছে, এটাই শেষ বছর। আগামি বছর থেকে নতুন প্রোগ্রাম Extended Credit Facility (ECF) নামে যা হাজির হবে। "সংস্কারের" শর্ত দিয়ে ধার দেবার এই "Facility" গুলোকে বুঝবার জন্য একটা তুলনামূলক আলোচনা টানতে পারলে ভাল হত। তবে এখন সেদিকে যাচ্ছি না।
ESAF এর যুগ শেষ হবার আগেই গ্লোবাল রাজনীতিতে অন্য নতুন উপাদান হাজির হওয়াতে এরশাদের শাসন শেষ হয়ে যায়। এরশাদ কত ভাল শাসক ছিল সে বিচার, রাজনৈতিক আলোচনা করতে গিয়ে - এরশাদ কত সুন্দর সুন্দর রাস্তা বানিয়েছে, উপজেলা দালান বানিয়েছে - "উন্নয়নের" এই গল্প দিয়ে অনেককে কথা শুরু করতে দেখা যায়। এতে না এরশাদকে না বাংলাদেশকে - এর রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অবস্হা বুঝা যাবে না; যতক্ষণ না আইএমএফ বা এর তৎপরতাকে পিছনে পটভূমিতে না রাখা হবে আমরা কিছুই বুঝব না।
তাহলে G7, G8 বা ইদানিংয়ের G20 - এগুলো কী, কারা? এই পোষ্টের দৈর্ঘ্য বাড়ছে সেদিকে নজর রেখে এখন সেদিকে আগাচ্ছি না।
তবে, OECD (Organization for Economic Cooperation and Development) নামের সংগঠনটার খবর মানুষে খুব কম জানে। বিখ্যাত বা কুখ্যাত কোন ভাবেই এই নামটা পপুলার নয়। এর কাজকর্মের সংক্ষিপ্ত পরিচিতির মধ্য দিয়ে পরে সেটা বর্ণনা করার দিকে যাব।
এই পর্ব এখানেই শেষ করছি।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০০৯ রাত ২:০৯