চতুর্থ পর্ব Click This Link
তৃতীয় পর্ব Click This Link
দ্বিতীয় পর্ব Click This Link
প্রথম পর্ব Click This Link
পঞ্চম পর্ব:
আইএমএফ কেন গঠন করা হয়েছিল এর উত্তরে ওর ওয়েব সাইটে দেয়া তথ্যের অফিসিয়াল বয়ান হল -
sought to build a framework for economic cooperation that would avoid a repetition of the vicious circle of competitive devaluations that had contributed to the Great Depression of the 1930s.
বাংলায় এর ভাবের অনুবাদে বললে - বিভিন্ন দেশের পরস্পরের মধ্যে একটা অর্থনৈতিক সহযোগিতার যোগসূত্রের স্বপক্ষে একটা কার্য-কাঠামো দাঁড় করতে চাওয়া যাতে, প্রত্যেক দেশ নিজের মুদ্রার অবমুল্যায়ন প্রতিযোগিতার এক দুষ্ট চক্রাবর্তে আবার জড়িয়ে না যায়, যেটা ১৯৩০ সালের বিশ্ব-মহামন্দার পিছনের কারণ।
মুলকথা হল, বিশ্বব্যাপী মন্দা দেখা দেওয়ার প্রেক্ষিতে ইউরোপের প্রত্যেক দেশ এর আঁচ থেকে বাঁচতে নিজের অর্থনীতিকে এক অগ্নিবর্ম জ্যাকেট (insulation) লাগিয়ে আলাদা করার চেষ্টা করেছিল; যাতে বিশ্বমন্দার প্রভাব নিজের অর্থনীতিতে না আসে। নিজ মুদ্রার অবমূল্যায়নের এক প্রতিযোগিতা ছিল এই insulation জ্যাকেটমূলক পদক্ষেপ। অবমূল্যায়ন - মানে অন্যের মুদ্রার তুলনায় নিজ মুদ্রার মূল্য নীচে নামানো। ফলাফলে অন্যদেশের থেকে আমদানির চেয়ে রপ্তানি করা লাভজনক -এমন একটা পরিস্হিতি তৈরি করা; নিজ অর্থনীতিতে বাইরের পণ্যের ঢুকে পড়া (inward flow) কে নিরুৎসাহিত করা ও পণ্যের outward flow কে উৎসাহিত করা। এতও গেল বাহিরের দিক। কিন্তু আভ্যন্তরীণভাবে দেশের অর্থনৈতিক জীবনযাপন মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব, কারবার বন্ধ, চাকরি হারানোর এক সীমাহীন কষ্ট, আগের আয়ে সংসার চালানোর কঠিন করে ফেলা, ইত্যাদি।
পুঁজিতান্ত্রিক পণ্য উৎপাদন ব্যবস্হার আদি সঙ্কটের দিক থেকে দিক উপরের কথাগুলোকে এখন আর একভাবে বলব। পণ্যের খাতক দেশের বা বিদেশের যাই হোক, পণ্য উৎপাদন করে লাভ মুনাফা কামিয়ে সম্পদ বাড়াতে, গড়তে হবে; পুঁজির আত্মস্ফীতি ঘটাতে হবে - এই হল পুঁজি বিকাশের মূল কথা। কিন্তু এতে যে বাড়তি সম্পদ লাভ ঘটবে সেই বাড়তি সম্পদ নিজ দখলে ধরে রাখার উপায়ই কী? আর, সম্পদ যে তাতে বেড়েছে তা বুঝার উপায় কী? কারণ, সম্পদ কেবল কাগুজে মুদ্রায় বা ব্যাঙ্ক নোটে (প্রতিশ্রুতি) ধরে রেখে নিশ্চিত হওয়া যায় না যে আসলে সম্পদ আমার হাতে, দখলে আছে - যদি না, নিশ্চিত হওয়া যায় যে কাগুজে মুদ্রা বা ব্যাঙ্ক নোটের পিছনে সোনা মজুদ রাখা আছে, চাইলে সোনায় একে বদলে নেয়া সম্ভব। কাজেই শেষ বিচারে কাগুজে বন্ড বা নোট নয়, সোনা দখলে আছে কী না তাতেই একমাত্র নিশ্চিত হওয়া যায় যে হ্যাঁ লাভ মুনাফা কামিয়ে বাড়তি সম্পদ হয়ে তা আমার দখলে আছে। তাই, যদি উৎপাদিত পণ্য অন্য পণ্যের সাথে হাত বদল হতে হতে শেষ বদলটা সোনা-পণ্যের (বা স্বর্ণমুদ্রা) সাথে সমাপ্ত হয় তবেই ওটা তখনও সত্যিকারের সম্পদ তা নিশ্চিত হবার একমাত্র উপায়।
পণ্যের শেষ বদলটা যেন সোনা-পণ্যের সাথে হয় এটা নিশ্চিত করতে, বিদেশে কোন পণ্য বিক্রি হলেই চলবে না, তা যদি একশ টাকার হয় তবে ঐ একশ টাকা দিয়ে ঐ দেশ থেকে আবার সোনা কিনে সেই সোনা দেশে ফিরতে হবে। এর মানে দাঁড়াল, তাহলে বৈদেশিক বাণিজ্য মানে সোনার চলাচল, আসা-যাওয়া বিচলন বা circulation - এটা ঘটলে তবেই কোন দেশের পণ্য উৎপাদনকারী বিদেশে পণ্য বেচে সোনা নিয়ে দেশে ফেরা সম্ভব। এভাবে কোন দেশের হাতে সোনা বেশি জমা হয়ে গেলে সে দেশে পণ্য আমদানি প্রবাহ বেড়ে এক পর্যায়ে তার সোনা কমবে, ফলাফলে অন্যের সোনা বাড়বে আর শেষ বিচারে সবসময়ই তা পেন্ডুলামের মত একটা স্হির ভারসাম্যের যায়গায় ফিরতে চাইবে বা এর আশেপাশে থেকে দোল খাবে। আইএমএফ জন্মানোর আগে এই বাজার ব্যবস্হাতেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সোনার চলাচল, আসা -যাওয়া বিচলন বা circulation চলত, বাণিজ্যকে সম্ভব করে তুলত। তবে এই বাজার ব্যবস্হা কারও কোন ম্যনেজমেন্ট নিয়ন্ত্রণ ছাড়া ফাংশনাল ছিল তা নয়, বরং ম্যনেজমেন্ট নিয়ন্ত্রণ করাটা আবার নিজেই এক ধরণের মুনাফা-ব্যবসা ছিল। আগের পর্বের পোষ্টে ইংল্যান্ডের Amschel Mayer Rothschild (1773-1855) ও তাঁর পাঁচ ছেলের Rothschild House মুদ্রাব্যবসা চালানো, প্রতিদিন সকালে ঐদিনের সোনার মূল্য ঠিক করে দেওয়া, ইংলিশ পাউন্ডের সাথে বিভিন্ন মুদ্রার হার ঠিক করার কথা উল্লেখ করেছিলাম। এটা এরই আদর্শ উদাহরণ।
[পাঠককে একটা নোট নিতে বলব, সাথে আমিও নিব। পণ্য বিদেশ থেকে ফিরতি-পণ্য সোনা হয়ে ফেরৎ আসা খুবই গুরুত্ত্বপূর্ণ। পণ্য উৎপাদন ব্যবস্হায় সম্পদ আসলে হাতে ফেরত এসেছে কীনা, সোনা বা সোনার মত পণ্য হয়ে দখলে রাখা গেছে কী না - নাকি সবই দেউলিয়া কাগুজে নোট প্রতিশ্রুতি - এই বিচার, তফাৎ ধরতে পারা পণ্য মালিক ব্যবস্হাপনায় খুবই গুরুত্ত্বপূর্ণ। এর প্রাসঙ্গিক উদাহরণ হলো - আমেরিকাকে তিন ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য খাইয়ে ফাঁকা কাগজ হাতে বসে চীন আজকের সময়ে বড়ই পেরেসান, অস্হির। একদিকে সে ডলার হটিয়ে নতুন মুদ্রা ব্যবস্হা কী করা যায় ভেবে আমেরিকাকে শাসাচ্ছে আবার এতে আটকে যাওয়া সম্পদ উদ্ধার, লোভনীয় আমেরিকান বাজারের হাতছানির কী হবে তা ভেবেও একসার - এক উভয় সঙ্কট।]
প্রসঙ্গে ফিরে যাই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধ খরচ, সঞ্চিত সম্পদের ড্রেনেজ, আগের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্হা, মুদ্রা ব্যবস্হাপনাকে একেবারে তছনছ করে দেয়। প্রথম দিকে কাগুজে মুদ্রা ছাপিয়ে যুদ্ধের খরচ যোগানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। এই মুদ্রাস্ফীতি আবার মুদ্রার ঘোষিত অবমূল্যায়নে নতুন আরও একধাপ সঙ্কটে পড়ে। আসলে, ১৯৩০ সালের বিশ্বমন্দায় মুদ্রার অবমূল্যায়নের প্রতিযোগিতা করে বহির্মুখি পণ্য প্রবাহকে (outward flow) উৎসাহিত করাটা ছিল স্বাভাবিক বাজার ব্যবস্হার বদলে জবরদস্তি জোড় খাটিয়ে বহির্মুখি পণ্য প্রবাহ বাড়ানোর চেষ্টা। এই প্রচেষ্টা যতটা না বহির্মুখি পণ্য প্রবাহ বাড়ানোর তাগিদে তার চেয়ে বেশি বাইরের সর্বত্র পতনশীল অর্থনীতি থেকে নিজের অর্থনীতিকে বিচ্ছিন্ন করার মরিয়া চেষ্টা অথবা নিজের অর্থনীতিকে অগ্নিবর্ম জ্যাকেট (insulation) পড়ানোর অক্ষম প্রচেষ্টা। অক্ষম এজন্য যে এক দেশের সিদ্ধান্তে আস্ত আস্তে অন্য সবদেশই একই অবমূল্যায়নের পদক্ষেপ নেয়াতে এর মোট ফলাফল দাঁড়ায় নেগেটিভ, উল্টা হতে বাধ্য এবং তাই হয়েছিল। ইউরোপ দিয়ে শুরু হওয়া ঐ অবমূল্যায়নের পথে সর্বশেষ এসে যোগ দেয় আমেরিকা। রুজভেল্ট ১৯৩৪ সালের জানুয়ারিতে মজুদ প্রতি আউন্স সোনার মূল্য ২০.৬৭ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ ডলার বলে ঘোষণা দেন। আর সবাই নিজের অর্থনীতিকে হঠাৎ করে ব্যাকগেয়ারে insulate করে আলাদা করে নিতে চাইলেও বাস্তবে তা সম্ভব কী না তা ভাববার দশায় কেউ ছিল না। কারণ ইতোমধ্যে সব অর্থনীতি পরস্পরের সাথে জড়াজড়ি নির্ভরশীলতার পথ ধরেই উপস্হিত বিকাশের জায়গায় এসেছিল। কোন নদী পার হবার পর নৌকা ডুবিয়ে দিলে যেমন পিছনে ফেরার পথ বন্ধ হয়ে যায় সেরকম এক irreversible পথ। ফলে যার যার অর্থনীতি আলাদা করার কোন সুযোগ তখন ছিল না, এখনও নাই, আগামিতেও কোন সম্ভবনা নাই।
তাহলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, ১৯৩০ এর বিশ্বমন্দার স্মৃতি থেকে শিক্ষা নিয়ে আক্রান্ত দেশগুলোকে (প্রধানত ইউরোপ ও তাকে ধারদেনা দিয়ে আটকে যাওয়া আমেরিকা) উদ্ধারের লক্ষ্যে সব অর্থনীতিগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতা (build a framework for economic cooperation) বলে ডাক পেরে আইএমএফ জন্ম দেয়ার উছিলা তৈরি হয়েছিল।
১৯৩০ এর বিশ্বমন্দার স্মৃতি - যেখান থেকে আইএমএফের শিক্ষা নেয়া ও জন্ম বলা হচ্ছে। কিন্তু এই শিক্ষা যে যথেষ্ট ছিল না তার প্রমাণ ২০০৮ সালের পুণর্বার চলতি বিশ্বমন্দা। (যদিও এর অনেক আগে ১৯৬৮ সালে gold standard ডলার ব্যবস্হা ভেঙ্গে পরার সময় থেকেই আইএমএফ সংগঠন হিসাবে ইতোমধ্যে একদফা বৈধতা হারিয়েছিল। সে প্রসঙ্গে বিস্তারিত পরে কোন পর্বে আসব।) ১৯৪৪ সালে জন্মের সময় বলা হয়েছিল avoid a repetition, বিশ্বমন্দা যেন আর না হয়, এড়ানো যায় সেই লক্ষ্যে আইএমএফের জন্ম হচ্ছে। সেই লক্ষ্যও অবশ্যই ব্যর্থ বিশেষত, যখন তুলনা করে বলা হচ্ছে এবারের চলতি মন্দা ১৯৩০ এর চেয়েও ভয়াবহ। ইতোমধ্যে ২০০৬ সালে সিঙ্গাপুরে নেয়া আইএমএফের এক নীতিনির্ধারণী সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমাদের মত দেশের খোলনলচে বদলে দেবার, "সংস্কারের" গুরু, মহাওস্তাদ খোদ আইএমএফেরই সংস্কারের এক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। এক আমেরিকান লগ্নিব্যঙ্কার প্রেসিডেন্ট Andrew Crockett, President of JP Morgan Chase International - তাঁকে প্রধান করে এক কমিটি দুবছর ধরে কাজে করেছিল। বর্তমানে এর সুপারিশ আইএমএফের এক্সিকিউটিভ বোর্ডের অনুমোদনের পর বোর্ড অফ গভর্নরসে উত্থাপনের অপেক্ষায় আছে। আশা করা হচ্ছে ২০১০ থেকে এর বাস্তবায়ন শুরু হবে। আইএমএফে গরীব দেশের "প্রতিনিধিত্ত্ব ও আওয়াজ" বাড়ানো নাকি এর লক্ষ্য বলে প্রচার করা হচ্ছে। সংস্কার কমিটির সুপারিশ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ডাকা এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর বোর্ড মিটিংয়ের পর Managing Director Dominique Strauss-Kahn, ২৮ মার্চ ২০০৯ প্রেসের কাছে বলছেন: "Without this step it would have been totally impossible to go on rebuilding the legitimacy of a multilateral institution like the Fund" - বাংলা করলে, "সংস্কার কমিটির সুপারিশ নিয়ে বোর্ড মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত পদক্ষেপ না নিতে পারলে আইএমএফের মত বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানের ন্যায্যতা পুনর্গঠন করা একেবারেই অসম্ভব হত"। সম্ভবত জন্মের সময়কার দেয়া প্রতিশ্রুতি ধরে রাখতে না পারা ও একের পর এক সঙ্কটে পরে সংগঠন টিকে থাকার ন্যায্যতা নড়বড়ে হওয়ার কথা মনে রেখে এমডি Strauss-Kahn একথা বলছেন। আইএমএফের গঠনতন্ত্র বলা হয় যাকে, সেই Articles of Agreement, এপর্যন্ত তিনবার (১৯৬৯, ১৯৭৮ ও ১৯৯৭) বদল করা হয়েছে। এর প্রথম দুটো বদল মৌলিক। আইএমএফের মুদ্রা, ডলার আর gold standard ডলার নয় মেনে নিয়ে ডলার নিজেই নিজের standard - এটা স্বীকার করে নিয়ে এর ভিত্তিতে ১৯৬৯ সালে সংগঠনের নিয়ম কানুন নতুন করে Articles of Agreement লেখা হয়ে গিয়েছিল এতে। সোনাবিহীন এক কাগুজে নোট - প্রতিশ্রুতির রাজত্ত্ব কায়েম করা হয় এতে। আর ১৯৭৮ সালের দ্বিতীয় বার Articles of Agreement বদল করে, মুদ্রার কোন স্হির বিনিময় হার না রেখে ভাসমান (Floating) বিনিময় হার চালু করা হয়।
চলতি সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে চাইলে চতুর্থ বার Articles of Agreement বদলের প্রয়োজন হবে। এরপরও কী সংগঠনটা টিকে থাকতে বৈধতা ন্যায্যতা জোগাড় করতে পারবে? এএক বিরাট প্রশ্ন।
এই প্রশ্নটা আমার কাছে আরও বিরাট মনে হয় যখন চিন্তা করি, ১৯৪৪ সালে আইএমএফের জন্মের সময়কার গ্লোবাল অর্থনৈতিক পরিস্হিতির সঙ্গে আজকের সময়কে মিলিয়ে পড়ার চেষ্টা করি। পাঠককে সে চিন্তায় সামিল করতে চাই। এখানে এই দুই সময়ের পরিস্হিতিতে মিলগুলো সংক্ষেপে তুলে করব যাতে পাঠক নিজের বিবেচনাবোধ প্রসারিত করে নিতে পারেন। ১৯৪৪-৪৫ ও ২০০৯ বলে পাশাপাশি দিতে পারিনি। মাফ করবেন, উপর নীচে করে লিখতে হয়েছে। পাঠক কষ্ট করে তুলনা করে পড়বেন আশা করি।
১৯৪৪-৪৫
১. প্রথম বিশ্বযুদ্ধ - ১৯৩০ সালের বিশ্বমন্দা - দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ [এরপর নীচে ২০০৯ এর এক নম্বরটা পড়ে আসুন। তুলনা করুন। এরপর দুই নম্বর পয়েন্টে যান। এভাবে পড়তে পাঠকে পরামর্শ দিব।]
২. মূলত যুদ্ধ ও যুদ্ধের খরচ যোগানকে কেন্দ্র করে ইউরোপের মুদ্রাগুলোর পতন
৩. আমেরিকার Lend-Lease Act of March 11, 1941 আইনের মাধ্যমে "মিত্রশক্তি" - সোভিয়েত ইউনিয়নসহ ইউরোপের প্রায় সবাইকে ধার দেয়া; পোষাক, রসদ, যুদ্ধাস্ত্র থেকে শুরু করে জাহাজ রিপেয়ার এমনকি যুদ্ধ বিমান, আস্ত যুদ্ধজাহাজ পর্যন্ত আমেরিকান দানের সবখরচ - এই ধার-অর্থের অন্তর্ভুক্ত। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এর মোট পরিমাণ 270 বিলিয়ন তৎকালীন মানের ডলার।
৪. নিজেদের মুদ্রা মান হারিয়ে, পুনরায় একটা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্হা দাঁড় করানোর মরিয়া তাগিদে সারা ইউরোপ একটা Gold standard মুদ্রা খুঁজছিল। শেষে উপায়হীন পেয়েছিল ডলারকে।
৫. Lend-Lease Act এর অধীনে দেয়া 270 বিলিয়ন ডলার কে আমেরিকা বিদেশে বিনিয়োগ হিসাবে দেখতে পেরেছিল হয়ত কিন্তু একথাও বুঝেছিল এই বিনিয়োগ খাতা কলমে। বাস্তবে একে জীবিত করে আমেরিকার ঘরে ফিরিয়ে আনতে গেলে একমাত্র পথ মৃতপ্রায় ইউরোপে নতুন বিনিয়োগ (reconstruction?) লাগবে। যেটা আমেরিকা সমাধান করেছিল বিশ্বব্যাঙ্ক (International Bank for Reconstruction and Development) করতে রাজি হয়ে, পুণরায় আরও বিনিয়োগের পথে গিয়ে।
৬. ১৯৪০ এর দশকটা ছিল ঐ সময় পর্যন্ত বিকশিত গ্লোবাল অর্থনীতি ও তার কেন্দ্রের পাশ- ফিরে মোচড় দেবার ক্ষণ - ইউরোপের কলোনী সাম্রাজ্য থেকে আমেরিকায়, কলোনী রুলের সেকেন্ড জেনারেশনের হাতে গড়া আমেরিকায়।
৭. ইউরোপের শার্দুল কলোনী মাষ্টার বৃটিশ, এর প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের ১৯৪১ সালের আগষ্টে মিউমিউ স্বরে আমেরিকার কাছে যুদ্ধসহায়তা পাবার দেনদরবার করতে আটলান্টিকের উপকুলে ভেড়ানো এক যুদ্ধ জাহাজে মিটিংয়ে বসেছিল। এসব লজ্জার কথা লুকিয়ে যেটাকে গর্বের প্রলেপ দিয়ে (চার্চিলের) গণতন্ত্রের জন্য "আটলান্টিক চার্টার" বলা হয়। ওখানে আটটা বাক্যের পয়েন্ট ছিল। মনে রাখতে হবে আমরা তখনও কলোনী; চার্চিলের পেটে কলোনী-শাসনের অন্ন। তখনও সর্ববৃহৎ কলোনী মাষ্টার নিজেই নাকেখত দেবার মত করে প্রথম চারটা পয়েন্টে বলছে - পররাজ্য টেরিটরি দখল অন্যায়, বাসিন্দা জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে টেরিটরি গাব করে ফেলা যায় না, জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা, পছন্দের রাষ্ট্র সরকার গঠনের ইচ্ছাই সুপ্রীম - ইত্যাদি স্বীকার কর হয় ঐ চার্টার ঘোষণায়। না এটা ভাবার কোন কারণ নাই আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট আমাদের কলোনীমুক্ত করতে মাষ্টারের মুচলেকা নিচ্ছিলেন। তিনি শুনতে, বুঝতে চাচ্ছিলেন যুদ্ধে সহায়তা করে জিতে গেলে যুদ্ধোত্তর আগামি দুনিয়ায় ছায়াচিত্রটা কেমন হবে, ভু-গোলকে নিজ দেশের অবস্হান কেমন হবে?
২০০৯
১. ১১ সেপ্টেম্বর ২০০১ - এক প্রলম্বিত যুদ্ধ - ২০০৭-৮ চলতি বিশ্বমন্দা - আগামি কোন বিশ্বযুদ্ধ(?)
২. যুদ্ধ করলে আমেরিকান অর্থনীতি বেগবান হবে - সেই ভরসায় দুবার ভোটে বুশের আগমন। কিন্তু যুদ্ধ প্রলম্বিত ও উল্টা ফল। যুদ্ধের খরচ যোগাতে হিমশিম আমেরিকার মুদ্রার পতন। তবে এবার আজব ঘটনা হলো - ডলার নয়, উল্টে জাপান ইউরোপ নিজেদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে ডলারকে টিকিয়ে রাখা। চীনের সরাসরি নিজের আয়ের ডলার যুদ্ধে আমেরিকাকে ধার হিসাবে দেয়া। জাপানের ১০৯ ইয়েনের এক ডলার নামিয়ে ৯০-৯৪ করা।
৩. কেবল চীনেরই তিন ট্রিলিয়ন ডলার আমেরিকার কাছে পাওনা হয়ে আছে। অন্যদেরগুলো আনুপাতিক অনুমান করা যেতে পারে।
৪. যুদ্ধে ডলারের মান আসলে পড়ে গেছে। কিন্তু অন্য মুদ্রাগুলো নিজের স্বার্থে নিজেদেরই অবমূল্যায়ন করিয়ে ডলারকে কৃত্রিমভাবে মান ঠিক রাখার কসরৎ করছে। ডলারের সাথে গাটছাড়া বাধা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নতুন মুদ্রা খুঁজে ফিরছে।
৫. চীন, জাপান (সাম্প্রতিক নির্বাচনে সরকারে আমুল বদলের অস্হিরতা লক্ষণীয়)
স্রেফ খাতাপত্রে কাগুজে নোট বা প্রতিশ্রুতির ভরসায় আমেরিকান সরকার জনগণকে নিজ পণ্যের ভোক্তা হিসাবে পেয়েছে বটে কিন্তু এই সম্পদ সোনা বা অন্য পণ্যে কিভাবে ফিরৎ পাবে বা realize করবে জানে না। ভেবে অস্হিরতায় মধ্যে আছে। ঐ সম্পদ ফিরিয়ে আনার তাগিদে নতুন কোন "বিশ্বব্যাঙ্ক" খুলে আরও বিনিয়োগ করবে (?) - আমরা জানি না। দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
৬. এবারের সময়টা কী একইভাবে এই সময় পর্যন্ত বিকশিত গ্লোবাল অর্থনীতি ও তার কেন্দ্রের পাশ-ফিরে মোচড় দেবার ক্ষণ? আমেরিকা থেকে এশিয়ায় - চীনকে ঘিরে এশিয়ায় সাথে মধ্যপ্রাচ্য, সাথে দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল? নাকি আরও খারাপ কিছু? কোন বিশ্বযুদ্ধের পরে সে ফয়সালা হবে? জানি না অপেক্ষা করতে হবে।
৭. বারাক ওবামার কায়রো মিশনে অপর দেশকে "লিবার্টি শিখানো বা এনে দেওয়ার মহান দায়িত্ত্ব নেয়া, সভ্যতা শেখানো, সভ্য করা" - অন্যায় বলে মানলেন। অথচ এসবের ছুতায় বুশের ইরাক আফগানিস্তান দখলের পক্ষে ন্যায্যতা ও Regime change এর পক্ষে বক্তৃতা দিয়ে বেরিয়েছিলেন। বুশের এসব কান্ডের বিপরীতে ওবামার কায়রো বক্তৃতার তাৎপর্য কী? চার্চিলের "আটলান্টিক চার্টার"এর একালে আমেরিকান ভার্সান?
পাঠক আর পয়েন্ট বাড়াবো না। চিন্তার খোরাক হিসাবে মিলাবেন, ভাববেন। এটা আমি কোন সিদ্ধান্ত পৌছে গেছি ঠিক তা নয় তবে আপনাদের চিন্তাকে উস্কে দেবার জন্য লেখা। আমার এই উস্কানো অনুমানগুলোর কিছুটাও যদি সত্যি হয়ে উঠে তবে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাঙ্ক কী এমন থাকবে? নাকি নতুন কোন কিছু এর জায়গা নিবে?
এইসব বিশাল প্রশ্নের উত্তর খুজতে, নিজের জন্য একটা এক্সসারসাইজ হোমওয়ার্ক করতেই "আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্ক: গ্লোবাল অর্থনীতি" নিয়ে সিরিজের ভাবনাটা মাথায় আসে। পাঠককে সে কথা বলা হয় নাই।
সিরিজ এবার শেষ করার কথা ভাবছি। আশা করি পাঠক বাকি কাজে আমাকে সহায়তা করবেন।