অদ্ভুৎ এক ঘোরের জগত
ওকে ওখানে কতগুলো কসাইয়ের হাতে ছেড়ে কিভাবে দেশে ফিরে আসলাম তা আমার কিছুই মনে নেই। শুধু মাঝখানের একটু কথা মনে আসে- আমি প্লেনে জানালার পাশে বসে আসি, স্টুয়ার্ডেস এসে জানতে চাইছে আমি কিছু খাব কিনা।
যখন পুরোপুরি হুশ ফিরল তখন দেখি আমি ঢাকা এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছি। ইমিগ্রেশন চেক করে বাইরে বেরিয়ে দেখি কতগুলো সিএনজি, এর মধ্যে একটাকে বললাম-“ভাই, নারিন্দা যাবেন”?
- হ, যামু।
- কত?
- ৪০০ টাকা দিয়েন,
- ঠিক আছে চলেন।
কোনমতে শরীরটাকে সাথে নিয়ে হ্যান্ডব্যাগ সহ সি এন জিতে উঠে পড়ি। আবার ঘোরের মধ্যে চলে যাই। মাঝে মাঝে কিছু সময়ের জন্য ঘোর ভাঙে। খেয়াল করি মাঝ রাতে ঠান্ডা বাতাসের সাথে বৃস্টির ছিটা এসে গায়ে লাগছে, জন মানবশুন্য রাস্তায় আমার সি এন জি গোঁ গোঁ শব্দ করে একা ছুটে চলেছে। আবার ঘোরের ভেতর চলে যাই।
হঠাৎ খেয়াল করি সি এন জি থেমে আছে। ড্রাইভার আমার দিকে বিরক্তি নিয়ে বলছে “ভাই, কোনদিকে যামু বলেন না ক্যান”? ভালোভাবে খেয়াল করে দেখি নারিন্দা পুলিশ ফাঁড়ির সামনে সি এন জি দাঁড়িয়ে। “এইতো ভাই, সামনে হাতের বাম দিকে দ্বিতীয় গলি”।
বাসার সামনে পৌঁছে সি এন জি থেকে যখন নামি তখন ভোর চারট বাজে। কারও দিকে চোখ তুলে তাকানোর সামর্থ্য নেই আমার। ঘরে ঢুকেই হ্যান্ডব্যাগটা সাথে নিয়ে সোজা বিছানায় চলে যাই। আমার এখন ঘুম দরকার, খুব গভীর ঘুম। হ্যান্ডব্যাগটা হাতছাড়া করা যাবে না, ওখানে তিনটা জিনিস আছে, ওগুলো আমার কাছে খুবই মূল্যবান। হ্যান্ডব্যগটা বুকে জড়িয়ে ঠিক ঘুমিয়ে পড়ার আগেই শুনতে পেলাম আযান দিচ্ছে– “আল্লা-হু আকবার”। হে আল্লাহ্ আমাকে সাহায্য কর আল্লাহ্, আমাকে সাহায্য কর।
এর মধ্যে মাঝে মাঝে ঘুম পাতলা হয়, বিভিন্ন কথা শুনতে পাই,
- থাক ওকে জাগানোর দরকার নাই, ঘুমাক
- লিলি খালা, ও বাসায় আসার পর থেকে এই পর্যন্ত কিছুই খায় নাই
- হালিমা আপু, এই ঘর ঝাড়ু দেবার দরকার নাই
এক সময় পাশের বাড়িতে জোরে গান বাজায়- বাহির বলে দূরে থাকুক, ভিতর বলে আসুক না। আমার ছোট বোন চিল্লাচিল্লি করে-“এই ইয়াসমিনের মা, একটু গানটা বন্ধ করেন না, প্লাবন ভাইয়ার শরীর খুব খারাপ, আপনারা জানেন না”? আমার মনে হয় একটু জোর করে উঠি, ছোট বোনটাকে বলি- “ও মোর ময়না গো, গানটা ছাড়তে বল”। বলতে পারিনা, আবার ঘুমিয়ে পড়ি।
আমার ছেলেটা কেমন আছে?
“ভাইয়া ওঠো, ওঠোনা, আর কত ঘুমাবা? আজকে ৫ তারিখ, ওঠো।” ছোট বোনটার ডাকে এবার ঘুম ভাঙে। চোখ মেলে দেখি জানালা দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে, মেঘলা আকাশটাকে কেন যেন ভীষণ মনমরা মনে হয়।
উঠতে গিয়ে দেখি মাথা অসম্ভব ফাঁকা। কোন মতে বলি “ভাইয়া খিদা লেগেছে, কিছু খাওয়ার আছে”?
“হু, আছে। তোমার জন্য কাচ্চি আনিয়ে রেখেছি, ওঠো। হাত মুখ ধোও, আমি খাওয়া এনে দিচ্ছি”।
আমার উঠতে ইচ্ছা করেনা, ওভাবেই বসে থাকি মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে। চোখগুলো আকাশের দিকে কি যেন খুঁজে, আমি বুঝতে পারিনা।
খাওয়া নিয়ে আসে বোনটা। প্লেটের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি কত ক্ষুধা পেটে। গত ২ তারিখ থেকে কিছুই খাইনি। গোগ্রাসে গিলতে থাকি কাচ্চি। “হঠাৎ কাচ্চি কেন?” জিজ্ঞাসা করি ওকে। আমাদের এই অভাবের সময়ে কাচ্চি বিরিয়ানী খাওয়া বিশাল বিলাসিতা।
“আজকে ৫ তারিখ, তোমার জন্মদিন। দিপালী আপু থাকলে তো......”, আর বলতে পারে না বোনটা। চুপচাপ তাকিয়ে থাকে প্লেটের দিকে। হঠাৎ আমার মনে পড়ে যায় সব কিছু। খাওয়াটা খুব বিস্বাদ লাগতে থাকে।
খাওয়াটা কোন মতে শেষ করে বিছানায় আবার গা এলিয়ে দেই। কি করব না করব কিছু মাথায় আসে না। হঠাৎ ছোট বোনের কথায় হুশ ফিরে। “ভাইয়া আজকে একটু কাজীম কে দেখতে যা, মা ছাড়া বাচ্চাটা কতদিন ধরে আছে! তুইও অনেকদিন যাসনা। আজকে কষ্ট করে হলেও যা, এমন একটা দিনে ওকে আর কষ্ট দিসনা, যা, ওঠ”। “ঠিক আছে সন্ধ্যার সময় যাব” বলে আবার ঘুমিয়ে পড়ি।
সন্ধ্যা ৭:২৫। দিপালীর বড় বোনের ফ্ল্যাটের নীচ তলায় দাঁড়িয়ে আছি। গেটের দারোয়ানকে আমার পরিচয় আর ফ্ল্যাটের নাম্বার বলেছি, ও ইন্টারকমে খবর দিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কেউ না কেউ কাজীমকে নিয়ে নীচে নামবে। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। কেমন দেখব আমার বাবাটাকে? আহারে কতদিন ধরে কষ্ট দিচ্ছি ওকে! ও কেমন আছে তাও জানিনা, কেমন দেখব ওকে? ও কি কিছু বুঝতে পেরেছে?
আমাদের ছেলেটা
১৯শে জানুয়ারী ২০১২, সকাল আটটা। এ্যাপোলো হসপিটালের ও টি’র সামনে আমি হাঁটাহাঁটি করছি। মাথায় রাজ্যের ভয়, মনে দুশ্চিন্তা, কি হবে? এখন কি হবে? ওর কি কোন সমস্যা হবে? বাচ্চাটা বাঁচবে তো?
দিপালী তখন সাত মাসের প্রেগন্যান্ট। গতকাল আমরা খুলনা থেকে ঢাকা ফিরেছি। একটা বিজনেস ট্যুরে তিনদিন আগে খুলনা যেতে হয়েছিল আমাকে। বরাবরের মতই দিপালীও আমার সাথে। বিয়ের পর থেকে ও কখনই আমাকে কোথাও একা ছাড়ত না। কারণ বলতে, ও আমাকে ছেড়ে একা থাকতে পারত না। সেই আমি গত বছর অক্টোবর থেকে ওকে একা একা হাসপাতালে রেখে আসছিলাম, জানিনা এর জন্য ওর কাছ থেকে কোন ক্ষমা পাব কিনা।
আগের দিন খুলনা থেকে ঢাকায় আসার সময় আরিচা ফেরিতে যখন গাড়ি থেকে নামি ওকে বললাম কিছু খাবে কিনা। “না” বলে ও চুপচাপ গাড়িতে বসে থাকে। এদিকে সকালে রওনা দেবার পর থেকে আমিও কিছু খাইনি। আমার অন্ততঃ কিছু খাওয়া দরকার, কারণ গাড়ি আমিই চালাচ্ছি আর মা ও বাচ্চা দুজনের জীবনই আমার হাতে। “ঠিক আছে, গাড়ির এসি ছেড়ে দিয়ে দরজা লক করে যাচ্ছি, হুট করে কেউ এসে দরজা খুলতে বললে দরজা খুলবানা কিন্তু, বুঝছ?” বলে ওর দিকে তাকাই। “হ্যাঁ ঠিক আছে, খুলব না। তুমি আসলেও খুলব না, তুমি যাও এবার”। ওর কথায় মোটামুটি নিশ্চিন্ত হয়ে ওপরে গেলাম এবার। এক কাপ চা আর দুই পিছ কেক নিয়ে মাত্র খেতে বসেছি এমন সময় মনে হোল আচ্ছা ওর চোখে পানি দেখলাম মনে হয়?
কিসের চা! কোন মতে হাতে কেক দুটা ধরেই দৌড় দিলাম নীচে। গাড়ির কাছে পৌঁছে দেখি ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সাথে সাথে জানালায় থাপ্পড় মারি দরজা খোলার জন্য। কিন্তু ও দরজা আর খুলে না, এদিকে তাকায়ও না। আমি রীতিমত ভয় পেয়ে যাই, জানালায় থাপ্পড় মারতেই থাকি। এর মধ্যে গাড়ির আশেপাশে লোকজন জড় হয়ে যায়, “কি হইছে ভাই, কি হইছে”? প্রশ্ন করতে থাকে। কি বলব আমি?
কিছুক্ষণ পর ও এদিকে তাকায়, আমার এ অবস্থা দেখেই বোধ হয় কিনা দরজাটা খুলে দেয়। সাথে সাথে ভেতরে ঢুকি আমি, ঢুকেই দরজা লক করে দেই। “কি হয়েছে পরী, তুমি কাদতেছ কেন? কি সমস্যা হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে?” হঠাৎ করে হাউমাউ করে আমাকে জড়িয়ে ধরে ও, “আমাকে মাফ করে দাও। শুনছ? আমাকে মাফ করে দাও। আমি মনে হয় তোমার বাচ্চাকে বাঁচাতে পারলাম না”। হঠাৎ ওর পাজামার দিকে চোখ পড়তেই দেখি রক্তে পুরো পাজমা ভিজে যাচ্ছে।
“কি ভাবে হয়েছে এটা, কখন হয়েছে”? আমার মাথায় একটাই চিন্তা, বাচ্চার কিছু হোক, ওর যাতে কিছু না হয়। এমনিতেই ও অসুস্থ।
“খুলনা ছাড়ার পরপরই” কাঁদতে কাঁদতে ততক্ষণে হেঁচকি তুলছে ও। “তাহলে আমাকে বলনি কেন”? এবার চিৎকার করে উঠি আমি “ওখানে কতগুলি হাসপাতাল আছে জান তুমি?”
“বললে তুমি আবার কষ্ট পাবা”। লে হালুয়া (ওটা আমাদের পুরান ঢাকার ভাষা) “তো এখন কি নাচব আমি? খুশীতে নাচব?”
আর কি বলব আমি? বেকুব মহিলা বিয়ে করার কষ্ট হাতেনাতে টের পাচ্ছি। হতাশ হয়ে বাইরের দিকে তাকাই। কিন্তু একি? এটা কি? সমস্ত ফেরীর মানুষ জন দেখি গাড়ির চারপাশ ঘিরে ফেলেছে! বিভিন্ন ভাবে উঁকিঝুঁকি মারছে! আমি যেন এই মাত্র আমার বউকে গাড়ির ভেতর খুন করলাম।
এত যন্ত্রণা সহ্য হয়? মাথাটা আস্তে আস্তে ঠান্ডা করলাম, বাইরে বেরিয়ে জোর গলায় সবাইকে শুনিয়ে বললাম, “দেখেন ভাই, গাড়ির ভেতরে ওটা আমার বউ, এই মাত্র ওর বাচ্চাটা মনে হয় নষ্ট হয়ে গেছে। এর মধ্যে যদি আপনাদের আর কাউকে আমার গাড়ির কাছে আসতে দেখি আমি কিন্তু একেবার তুলে পানিতে ফেলে দিব”।
ব্যাটারা কি বুঝল জানি না, তবে গাড়ির কাছ থেকে দূরে সরে গেল, প্রত্যেকেই রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আমাকে আরও অস্বস্তিতে ফেলে দিল। গত ১৯ বছরের ট্যুরে আমি মোটামুটি কয়েকশত বার এই আরিচায় ফেরীতে পারাপার করেছি, প্রত্যেকবার দেখেছি মানুষজন রেলিং ধরে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। এইবার দেখলাম সব্বাই রেলিং ধরে আমার গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। এত অত্যাচার সহ্য হয়?
অনেক, অনেকক্ষণ পর যেন ফেরী কিনারায় ভিড়ল। মানুষজন সব যে যার গাড়িতে গিয়ে উঠল। এই ফাঁকে ওকে বললাম “দিপালী, পেছনের সিটে চলে যাও, আমি গাড়ি জোরে টান দিব”।
-না, আমি পেছনে যাবনা, আমি তোমার সাথে থাকব।
-দেখ দিপালী, বিয়ের পর থেকেই তুমি শুধু আমাকে জ্বালিয়েই যাচ্ছ। আমি সত্যিই আর তোমার যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না। তুমি এখনই পেছনে না গেলে কিন্তু আমি গাড়ি সোজা নদীতে নামিয়ে দিব, যাও এখনি! – ধমক দিয়ে বলি আমি।
আমার ধমকে কাজ হয়। এবার পেছনে যায় ও, অতি দূঃখে, অতি কষ্টে।
কোনমতে গাড়িটাকে ফেরী থেকে তাড়াতাড়ি নামিয়ে যেই পাকা রাস্তায় উঠেছি গাড়ি জোরে টান দিব বলে, ঠিক তখনি শুনি ও পেছন থেকে বলছে “এ্যাই শুনছ? একটু গাড়িটা থামাও না, একটু থামাও। তোমার সাথে জরুরী কথা আছে”।
আবার ভয় পেয়ে যাই আমি। তাড়াতাড়ি রাস্তার পাশে গাড়ি পার্ক করি। গাড়ি থেকে নেমেই দৌড়ে যাই পেছনে, “আবার কি হয়েছে? কোন সমস্যা?”
কাঁদতে কাঁদতে ও বলে “শুন, তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছ”?
“আরে না বাবা, আমি রাগ করব কেন? এটা কি রাগ করার কিছু? তুমি সমস্যায় পড়েছ, এমন সময় রাগ করা কি কোন সমাধান? আর সমস্যা তো শুধু তোমার না, আমারও এমন কি আমাদের বাচ্চারও, ঠিক না?” ওকে আশ্বস্ত করার জন্য বলি আমি।
-তাহলে যে, তুমি বললে আমি বিয়ের পর থেকে তোমাকে শুধু জ্বালিয়েই যাচ্ছি?
-আরে না বাবা, ওটা কি আমার মনের কথা? ওটাতো রাগের কথা। রাগের মধ্যে আমরা অনেক কথা বলে ফেলি না? ওগুলো ধরতে হয়? বোকা মেয়ে!
-সত্যি?
-হ্যাঁ সত্যি।
-তাহলে আমি সামনের সিটে আসি?
আর সহ্য করা সম্ভব হয় না আমার। দাঁত কিড়মিড় করে ঠাস করে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে স্টিয়ারিঙয়ে এসে বসি। সারাটা রাস্তা শুনি ও পেছনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর বলছে, “আল্লাহ্ আমি নাকি আমার স্বামীকে বিয়ের পর থেকে শুধু জ্বালিয়ে আসছি, তুমি আমাকে তুলে নাও আল্লাহ্, তুমি আমাকে তুলে নাও”।
এ্যাপোলোতে যখন পৌঁছাই তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। পৌছেই এমারজেন্সি তে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাই ওকে। ওর ডাক্তার গুলশান আরা হাসপাতালেই ছিলেন। গাড়িতে থাকতেই ওনাকে ফোন করে সমস্ত সিচুয়েশন বলে দিয়েছিলাম।
ঘণ্টা খানেক চেক করার পর, ডাক্তার এসে হাসিমুখে বললেন, “রাকিব তোমাদের ভাগ্য ভাল, বাচ্চার কিছু হয় নি। আমিতো খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম”।
-তাহলে ডাক্তার ব্লিডিং হোল যে?
-ওটা অনেক কারণেই হতে পারে। যাই হোক ওটা এখন বড় সমস্যা না, সমস্যা যেটা হয়েছে তোমার বউয়ের পেটে এক ফোঁটা পানি নেই। আমরা সারা রাত ওকে অবজার্ভেশনে রাখব, আর কোন নতুন সমস্যা না হলে কালকে সকালে ওর সিজার করে ফেলব।
-কিন্তু আপা, বাচ্চার তো মাত্র সাত মাস?
-তো? সমস্যা কি? তোমাদের বয়স তো আরও কম। শারীরিক বয়স না, মানসিক বয়সের কথা বলছি। তোমাদের কোন সমস্যা হয়? আর তা ছাড়া তোমার বউয়ের পেটে বাচ্চা রাখা আরও রিস্কি। বাচ্চাটা হাসপাতালেই থাক, তোমরা বরং ঘুরে বেড়াও।
এর পর ডাক্তারের সাথে আর তর্ক করা সাজে না। একদম পেটের ভেতরে হাত দিয়ে দিয়েছে! আরও কিছুক্ষণ থাকলে আর কত কি বের করে ফেলবে আল্লাহ্ই জানে! “ঠিক আছে আপা, আপনি যেটা ভালো মনে করেন” বলেই তাড়াতাড়ি উনার সামনে থেকে দূরে সরে যাই আমি। এখন আমি মোটামুটি নিশ্চিন্ত। উনি গাইনীর খুব ভালো ডাক্তার, ওনার ওপর ভরসা করা যায়।
কাজীম। আমাদের ভালোবাসার সাক্ষী
পরদিন সকালে এ্যাপোলো হসপিটালের ও টি’র সামনে আমি হাঁটাহাঁটি করছি। মাথায় রাজ্যের ভয়, মনে দুশ্চিন্তা, কি হবে? এখন কি হবে? ওর কি কোন সমস্যা হবে? বাচ্চাটা বাঁচবে তো?
কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তার গুলশান আরা হাসতে হাসতে ও টি থেকে বের হয়ে আসল। কংগ্রাচুলেশন রাকিব, তোমার ছেলে হয়েছে। সুস্থ আছে ও। তবে ওজন অনেক কম, মাত্র ৬৫০ গ্রাম। বেশ কয়েকদিন ওকে হাসপাতালে থাকতে হবে।
“ডাক্তার, আর বাচ্চার মা? ও কেমন আছে”? ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করি আমি।
-আর বোল না, তোমার বউ না? ও কি খারাপ থাকতে পারে? খারাপ তো ছিলাম আমরা। শুনো, এর পরের বাচ্চা আর আমার কাছে না, বুঝেছ আমার কথা? আমার কাছে না। এমনকি এই হাসপাতালেও না। অন্য কোন হাসপাতালে নিয়ে যাবা তোমার বউকে, বলে দিলাম”।
-কেন ডাক্তার, কি করেছে ও”?
-কি করেছে না। বল কি করে নাই? কিছুক্ষণ পরেই বের করে আনছে ওকে। ওকেই জিজ্ঞাসা করে নিও।
যাক বাবা, বউ তাহলে আমার স্বাভাবিকই আছে! ডাক্তারের কথায় আশ্বস্ত হই আমি। এই না হলে আর আমার বউ?
কিছুক্ষণ পরে একজন নার্স এসে ডাক দেয় আমাকে, “আপনিই কি তাস্মিনের (দিপালীর আসল নাম) হাজব্যান্ড? “জ্বি” বলি আমি। “আমার সাথে আসেন। ডাক্তার ইকবাল ডাকছেন আপনাকে”।
নার্স আমাকে ও টি’র পাশের রুমে নিয়ে যায়। ওখানে দেখি শুকনো মতন ফর্সা একজন একজন বয়স্ক লোক হাতে কি একটা ছোট পোটলা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কৌতুহল নিয়ে সামনে দাড়াতেই বল্লেন- “এই যে, আপনার ছেলে, ওকে দেখে নিন। ওর কম ওজন আর প্রিম্যাচিউরিটির কারণে ওকে এখন এন আই সি ইউ তে নিয়ে যাওয়া হবে”।
কাছে যাওয়ার সাথে সাথে ছেলে আমার গগন বিদারী চিৎকার দিয়ে উঠল। আমি মনে মনে বল্লাম- মাশা আল্লাহ্, বাপ কা বেটা!
নারীর নাড়ী ছেঁড়া ধন
৫ই অগাষ্ট ২০১৫ইং। সন্ধ্যা ৭:২৫। আমি দিপালীর বড় বোনের ফ্ল্যাটের নীচ তলায় দাঁড়িয়ে আছি। গেটের দারোয়ানকে আমার পরিচয় আর ফ্ল্যাটের নাম্বার বলেছি, ও ইন্টারকমে খবর দিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কেউ না কেউ কাজীমকে নিয়ে নীচে নামবে। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। কেমন দেখব আমার বাবাটাকে? আহারে কতদিন ধরে কষ্ট দিচ্ছি ওকে! ও কেমন আছে তাও জানিনা, কেমন দেখব ওকে? ও কি কিছু বুঝতে পেরেছে?
কিছুক্ষণের মধ্যেই দিপালীর বড় ভাগ্নি আর তার জামাই নেমে আসে নীচে। সাথে কাজীম নেই। ব্যপার কি? কাজীমকে তো সাথে আনার কথা, ওকে আনল না কেন? কোন সমস্যা নাকি?
-আস্সালামু অলাইকুম, খালু আব্বু, কেমন আছ তুমি?
-অয়ালাইকুম আস্ সালাম, ভালো আছি মা, তুমি ভালো?
-ভালো আর কি খালু আব্বু, কি আর বলব? তোমার দিকে তো তাকানোই যায়না। এই অবস্থা কেন তোমার?
-বাদ দাও মা, একটু কাজীমের সাথে দেখা করতে এসেছি। দেখা করেই চলে যাব।
-হ্যাঁ, দেখাতো করবেই খালু আব্বু, তোমার ছেলে তুমি যখন ইচ্ছা দেখা করবে। আর চলে যাবার কথা বলছ কেন? তোমার যতদিন ইচ্ছা তোমার ছেলেকে নিয়ে থাক, এতে কারও কোন আপত্তি আছে? তুমি চল, ওপরে চল।
আমার অস্বস্তিটা শুরু হয়। গত পাঁচ বছরে আমি এদের কারও বাসায় যাইনি কখনো। এরাও আসতে বলেনি। দিপালী সবসময় বলত তুমি কখনও আমার ভাইবোনদের বাসায় যাবে না। ওরা ডাকলেও না।
প্রবল অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি আমি। কি করা উচিত, কি বলা উচিত, মাথায় কিছুই ঢুকেনা আমার। আমি এরকম সমস্যাগুলি কখনও সামাল দিতে পারতাম না, তখন দিপালীই আমাকে উদ্ধার করত। কিন্তু এখন ও নেই, খুব অসহায় বোধ করতে থাকি আমি।
আমার অস্বস্তি ভাবটা ভাগ্নিটাই ভাঙ্গিয়ে দিল, “খালু আব্বু, চল না ওপরে। এখন আর এসব মনে রাখার কোন অবস্থা আছে? যেখানে দীপু খালামনিই নেই!
ভাবলাম, ঠিকই। এখন আর এসব মনে রাখার কোন দরকার নেই। সারাজীবনের মুখচোরা স্বভাবের আমি দিপালীর হাতে পড়ে কিছুদিনের জন্য সামাজিক হয়ে গিয়েছিলাম। এখন ও নেই, আমার আবার পুরানো স্বভাবে ফিরে যাওয়া ছাড়া কোন উপায়ও নেই। “ঠিক আছে চল” কোনমতে বলতে পারি আমি।
ওপরে নিয়ে ড্রইং রুমে বসতে দিল আমাকে। “আপা কই?” ভাগ্নিকে জিজ্ঞাসা করলাম। “এই তো খালু আব্বু, শুয়ে ছিল। এখনি চলে আসবে, তুমি একটু বস, আমি ডাকছি।
“আম্মু, খালু আব্বু এসেছে, কই আস?” বলতে বলতে ভেতরে চলে গেল ও। আমি বসে বসে নখ কামড়াতে থাকি। ছেলেটাকে এখনো দেখতে পাইনি। ও কি ঘুমিয়ে পড়েছে? রাত আটটা বাজে প্রায়।
আমার মাথা আবার ফাঁকা ফাঁকা লাগে। মৃত্যুর পর মানুষ কি আবার ফিরে আসে? আপনজনদের আশে পাশে কি ঘুর ঘুর করে? ওরা কি করছে, না করছে দেখে? যদি তাই হয়, তাহলে ও কি আমার ওপর এখন রাগ করছে? বেশীক্ষণ চিন্তা করতে পারি না। ভাগ্নি এসে হাজির হয় সামনে।
খালু আব্বু, তুমি কাজীমের রুমে যাও। ও বিছানায় শুয়ে আছে, ওকে বল্লাম তোমার কথা, কিন্তু ও বিছানা থেকে নামতে চাইল না। ভালো হয় তুমিই যাও, আসো আমার সাথে।
-আচ্ছা ওকে কি তোমরা কিছু জানিয়েছ?
-না খালু আব্বু, মাথা খারাপ? ওকে এখনি কিছু জানানো যাবে না। তুমিও ওকে কিছু বোল না। আমরা কিছুই বুঝতে দেইনি ওকে। আম্মু আম্মু করলে বাইরে নিয়ে যাই ঘুরতে।
বলতে বলতে ওর রুমের সামনে এসে দাড়াই আমরা। ভাগ্নি কোন একটা বিষয় নিয়ে একটু ইতস্ততঃ করতে থাকে। “কিছু বলবে?” ওর ইতস্তত ভাব দেখে আমিই জিজ্ঞাসা করি।
-তেমন কিছু না খালু আব্বু, শুধু একটা রিকোয়েষ্ট ছিল।
-হ্যাঁ বল মা।
মনে মনে ভাবি আমার কাছে আবার কি রিকোয়েষ্ট থাকতে পারে?
-না, মানে, খালু আব্বু, ওর কাছে গিয়ে কান্নাকাটি কোর না। এমনিতেই ও রাতে অনেক কান্নাকাটি করে, আম্মু আমু করে। ওকে থামাতে খুব কষ্ট হয়।
-ঠিক আছে মা, তুমি এখানেই থাক, আমি কান্নাকাটি করব না।
এ কথা বলে ঘরে ঢুকি আমি, ও বাইরে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘরে ঢুকে দেখি আমার বাবা বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে আনমনে একটা পুতুল নিয়ে কে যেন দেখছে। আমি ওর পাশে গিয়ে বসে ওর মাথায় হাতটা রাখি।
-কাজীম, বাবা, কেমন আছ?
এবার আমার দিকে চোখ তুলে তাকায় ও, তাকিয়েই লাফিয়ে উঠে জড়িয়ে ধরে আমাকে। “বাবা তুমি আসছ”?
“হ্যাঁ বাবা এইযে আমি আসছি”, বুকের সাথে জড়িয়ে রাখি ওকে।
-বাবা আম্মুকে আনছ?
-না বাবা, আজকে আনি নাই। আরেক দিন আনব বাবা। তুমি কি খেলতেছ?
এবার অভিমান করে আবার শুয়ে পড়ে ও।
-তুমি না সেদিন বলে গেলা আম্মুকে আনবা?
-হ্যাঁ তো বাবা, বলেছি তো আনব। কিন্তু আম্মুর অনেক জ্বর তো, তাই হাটতে পারে না যে! আম্মুর কষ্ট হবে না? তুমিই বল আম্মুকে এখন নিয়ে আসলে আম্মুর কত কষ্ট হবে না?
-হু
-তুমি খাওয়া দাওয়া করতো বাবা ঠিক মত?
-হু খাই, কিন্তু ফারাহ্ আপু আমাকে কোক খেতে দেয়না বাবা! তুমি একটু বলে দাওনা বাবা, আমাকে যেন কোক দেয়
-ঠিক আছে বাবা বলে দিব, কিন্তু সাদা কোক দিতে বলব, ঠিক আছে? আর তোমার ফিডারে দিতে বলব ঠিক আছে বাবা?
-হু ঠিক আছে
-তুমি আজকে দুপুরে কি খেয়েছ বাবা?
-মুগগী ভাত
-অনেক খেয়েছ বাবা?
-হু অনেক
-আম্মুর কথা মনে হয় তোমার বাবা?
-হু হয়
-আম্মুকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে?
-হু করে
-দাঁড়াও আমি একদিন ঠিকই নিয়ে আসব তোমার আম্মুকে
-হু ঠিক আছে
হঠাৎ কি মনে করে শোয়া থেকে আবার লাফিয়ে ওঠে ও, আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে “বাবা”
-হ্যাঁ বল বাবা
-আমি জানি, তুমি কোনদিন আম্মুকে আনবা না
-আনব বাবা, আম্মুর জ্বর সেরে উঠলেই নিয়ে আসব
-না বাবা তুমি আনবা না
-কে বলেছে বাবা আমি আনব না?
-আম্মু বলেছে
-আম্মু বলেছে?
-হু
-আম্মু আর কি কি বলেছে?
-আম্মু বলেছে তুমি আম্মুকে হপিতালে রেখে চলে আসছ
-কবে বলেছে আম্মু?
-কালকে
-কালকে?
-হু কালকে
-আম্মু কালকে তোমার কাছে এসেছিল বাবা?
-হু এসেছিল
-আর কবে এসেছিল?
-আম্মু সবসময় আসে, যখন সবাই ঘুমায় যায় তখন আসে
-তারপর কি বলে?
-কিছু বলে না বাবা, শুধু আমাকে কোলে নিয়ে কাঁদে
-কেন কাঁদে, জিজ্ঞাসা করনি?
-করেছি তো, আমি বলেছি “আম্মু তুমি কাঁদো কেন”?
-আম্মু কি বলল?
-তুমি আম্মুকে হপিতালে রেখে চলে আসছ এজন্য কাঁদে
-তুমিও এজন্য কাঁদ বাবা?
-নাহ্, আমিতো কাদিনা
-তাহলে সবাই যে বলল তুমি রাতে কাঁদ? আম্মুর জন্য কাঁদ?
-না বাবা, আমিতো এ জন্য কাদিনা! আম্মু আসার একটু পর ওরা আবার আম্মুকে নিয়ে চলে যায়
-কারা নিয়ে চলে যায়?
আমার পক্ষে আর সহ্য করা সম্ভব হয় না।
-ঐ যে সাদা সাদা মানুষগুলি, ওরা আবার আম্মুকে নিয়ে চলে যায়। জানো বাবা, আম্মু না যেতে চায় না। ওরা আম্মুকে জোর করে নিয়ে চলে যায়। আমি তখন কাঁদি।
হঠাৎ খেয়াল করি, আমার কাঁধ ভিজে গেছে। ও আমার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদছে, ঠিক যেভাবে ওর মা কাঁদত।
-বাবা ওদেরকে একটু বল না, আম্মুকে যেন না নিয়ে যায়, আম্মু কত কাঁদে! ওরা শুনে না।
আর সহ্য করতে পারি না আমি। “হ্যাঁ বাবা তুমি শোও আমি ওদেরকে বলে আসছি, তুমি শোও”। কোন মতে ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বের হয়ে আসি আমি। ও কাঁদছে, কাঁদুক ও। আল্লাহ্ তার নিস্পাপ বান্দার কান্না দেখুক।
বাইরে বেরিয়েই দেখি ভাগ্নি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছে। আমি অনেক কষ্ট করে শুধু এটুকু বলতে পারলাম “মা, আমি আজকে যাই, আরেকদিন এসে তোমার আম্মুর সাথে দেখা করব”।
আমাকে খুব তাড়াতাড়ি বের হয়ে যেতে হবে, আমার এখন কোন একটা নির্জন স্থান খুব দরকার, খুব দরকার।
সি এন জিতে উঠে আর নিজেকে সামলাতে পারি না। বাঁধ ভাঙা জলোচ্ছ্বাসের মত আমার চোখ থেকে পানি বের হতে থাকে, আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠি। এই প্রথম আমার কান্না বেরুলো।
বাসায় ফিরে তাড়াতাড়ি ল্যাপটপ অন করে লিখতে বসে যাই। আমার সব কিছু লিখতে হবে। কাজীম সব কিছু ভুলে যাবার আগেই, ও জানুক ওর মা ওকে কত ভালোবাসত।
পুনশ্চঃ
কাজীমের বয়স যখন মাত্র এক বছর, তখন ওর মায়ের কঠিন চিকিৎসাগুলি শুরু হয়। ও সারাক্ষণ ছেলেটার জন্য কাঁদত, ওকে একটু কাছে এনে দেবার জন্য বলত। আমি নিয়ে আসতাম, কিন্তু উচ্চ মাত্রার রেডিয়েশন ওর শরীর দিয়ে পাস করানো হোত বলে বাচ্চাটাকে ওর বুকে দিতে পারতাম না। বাচ্চাটাও মায়ের বুকে যাবার জন্য আকুল হয়ে কাঁদত, ওকেও থামানো যেত না। প্রথম এক বছরই ও বাচ্চাটাকে বুকে নিতে পেরেছিল, এরপর আর পারেনি।
চলবে-