কষ্টের পাথরটা কোথা থেকে এসে বুকের ওপর চেপে বসে
ব্যংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতাল এর ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ঘড়ির কাটায় সকাল ৯:১২। এখানে আসার উদ্দেশ্য গত ১৫ই জুলাই এই হাসপাতালের ক্যান্সার ডিপার্টমেন্ট এর ডাঃ নারিন এর কাছ থেকে পাওয়া একটা ই-মেইল। বিষয়বস্তু মোটামুটি এরকম –
Dear Mr. Rakib,
Hope you are fine with all your beings. We hereby request you to meet us at 10:00 am on next 2nd Aug. There are critical issues regarding your wife’s Life Support System and which to be settled at an earliest.
Thank you in anticipation.
মেইলটা দেখার পর প্রথম কিছুক্ষণ মাথা কাজ করছিল না। বার বার মনে হচ্ছিল আমার স্ত্রীর লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমের মেশিনে বোধহয় কোন রকম সমস্যা হয়েছে, আমাকে তাড়াতাড়ি ডেকে পাঠিয়েছে মেশিনটার ব্যপারে কোন জটিল সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাই। হয়ত মেশিনটা সারতে হবে, অথবা হয়ত মেশিনটা বদলে অন্য মেশিন লাগাতে হবে। কিন্তু এ জন্য আমাকে কেন? আমিতো কোন ইঞ্জিনিয়ার না!
আবার মেইলের শেষে আমাকে ধন্যবাদ কেন? ধন্যবাদ জানানোর তো কিছু হয় নাই। গত ৬ই মার্চ থেকে হাসপাতালের খরচও আমি দিতে পারছি না, ওটা এখন ওর ভাই বোনরাই দিচ্ছে। তাহলে কি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোন ভুল করছে? ওরা কি ভাবছে আমি এখনও আমার স্ত্রীর চিকিৎসা খরচ চালাচ্ছি? নাহ্, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। ওদের এই ভুলটাও ভাঙানো দরকার।
সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দিল আমার কাছে কোন টাকা পয়সা নেই। গত এক বছর ধরে আমার ব্যবসাপাতি সব বন্ধ। আর মাত্র ত্রিশ হাজার টাকার অভাবে নতুন ব্যবসাটাও চালু করতে পারছিনা। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কেউ আর বাকি নেই টাকা পয়সা ধার করা থেকে। মা মারা যাবার সময় ছোট বোনটার বিয়ের জন্য যে কিছু গয়নাগাটি রেখে গিয়েছিলেন তার থেকে শেষ চারটা বালা বিক্রী করা হয়ে গেছে গত জুন মাসেই। এই অবস্থায় ছোট বোন আর আমি সারাদিন চিন্তা করতে থাকি- কি করা যায়, কি করা যায়।
এমন সময় হঠাৎ করে ছোট বোনের মাথায় একটা অদ্ভুৎ আইডিয়া আসল- “প্লাবন ভাইয়া, ষ্টিলের আলমিরা দুইটা, কাঠের আলমিরাটা, সোফা সেট, একটা খাট, এই সব বিক্রী করে দে”।
“তাহলে কাপড় রাখব কোথায়? মানুষ আসলে বসবে কোথায়? আর খাট বিক্রী করলে শুবোইবা কোথায়, মাটিতে?” বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করি আমি।
“আরে সে সব দেখা যাবে, এগুলো ছাড়া কি মানুষ চলতে পারেনা? এটা কোন সমস্যাই না। আমি কালকেই কাষ্টমার দেখি। তোর যে করেই হোক যাওয়া দরকার। ওরা কি কারণে ডেকেছে আল্লাহ্ই জানে। হয়ত কোন সুসংবাদও থাকতে পারে।” “সুসংবাদ” শব্দটা শরীরে যেন নতুন প্রাণ নিয়ে আসে আমার। পরদিনই দুই ভাইবোন কাষ্টমার খুজতে লেগে যাই। ফলাফল- এক সপ্তাহেই সব বিক্রী! প্রাপ্তিও খুব একটা কম না, মোটামুটি উনপঞ্চাশ হাজার টাকা! খরচের জন্য যথেষ্ট।
২রা আগষ্ট সকালে হাসপাতালে ঢুকেই ইনফর্মেশন ডেস্কে ডাঃ নারিনের ই-মেইল কপিটা দেখালাম। বললাম, আমাকে উনি আসতে বলেছেন, কাইন্ডলি সকাল দশটার সময় উনাকে যাতে একটু মনে করিয়ে দেয়া হয়, আমি উনার ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করব।
হাতে এখনও মোটামুটি এক ঘন্টা সময় আছে। ওকে একপলক দেখার জন্য আই সি ইউর দিকে হাঁটা শুরু করলাম। গেটের সামনে পৌঁছে একবার ঘড়ির দিকে তাকাই, দেখি সকাল ৯:১২।
এবার তাকিয়ে থাকি আই সি ইউর দরজার হাতলের দিকে, দরজা খোলার আর সাহস হয়না আমার। আমি জানি দরজা খুললে কি হবে। ওকে দেখার সাথে সাথে কষ্টের পাথরটা কোথা থেকে এসে বুকের ওপর চেপে বসবে, এ শুধু একজন প্রিয়জনকে হারানোর কষ্ট না, এ কষ্ট বোঝানো যায় না।
হাতলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আমার স্ত্রীর নার্স বের হয়ে আসল। “তুমি এসেছো তাহলে? জানো, আমি জানতাম তুমি আজকে আসবেই। আমি ভোর থেকেই পনের মিনিট পর পর বের হয়ে দেখে যাচ্ছিলাম তুমি এসেছো কিনা।”
আমি বুঝে উঠতে পারিনা কি বলব। অনেক কষ্টে বললাম “নার্স, ওকে কি আজকে একটু দেখতে পারব? প্লিজ তুমি না বোল না, শুধু দূর থেকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ দেখেই চলে যাব।”
নার্স কিছুক্ষণ চিন্তা করল, হয়ত কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না। “দেখ, আমি তোমার কষ্টটা বুঝি। আমি এটাও বুঝি গত ছয় মাসের বেশী আমি তোমার স্ত্রীর সাথে আছি, ও তোমাকে কতখানি ভালোবাসত তা আমি বলে বোঝাতে পারব না। সারাক্ষণ ও আমার সাথে তোমার বিষয় নিয়ে কথা বলত, এমনকি মাথার যন্ত্রণায় ও যখন চিৎকার করে উঠত তখনও ও তোমার নাম নিয়ে চিৎকার করত, আমরা যখন ওকে ঘুমের ইঞ্জেকশন পুশ করতাম তখনও ও তোমার নাম নিতে নিতেই ঘুমিয়ে পড়ত। তুমি হয়ত ওর কাছে শুধু স্বামী ছিলে না, তুমি হয়ত ওর গড’ই ছিলে। ও সারাক্ষণ চাইত তুমি ওর পাশে বসে থাক। কিন্তু তুমি পারতে না। আমরা জানতাম তুমি কেন সবসময় ওর পাশে থাকতে না। তোমার আর্থিক সমস্যার বিষয়টা আমরা সবাই বুঝতাম। নিজ দেশ ছেড়ে এত দূরে এত কঠিন রোগের চিকিৎসা করানো আসলেই খুব কষ্টসাধ্য ব্যপার। আমি একটা সময় সহ্য করতে না পেরে আমার হাজব্যান্ড এর সাথে তোমাদের বিষয়টা নিয়ে আলাপ করেছিলাম। ও আর আমি খুশী মনেই প্ল্যান করেছিলাম তোমাকে আমাদের বাসায় নিয়ে রাখব, এতে অন্তত তোমার হোটেল আর খাওয়া দাওয়ার খরচ বেঁচে যাবে, তুমি আরও কিছুদিন ওর সাথে থাকতে পারবে। কিন্তু এর আগেই তোমার স্ত্রী তোমাকে এখানে ঢুকতে দিতে নিষেধ করে দিল। জানো? ও যখন প্রথম বলেছিল তোমাকে যাতে এখানে আর ঢুকতে না দেয়া হয়, তখন আমি খুব অবাক হয়েছিলাম, এমনকি এ্যাডমিনিষ্ট্রেটরও তার প্রফেশনাল ক্যারিয়ারের মুখোশ খুলে বলে ফেলেছিলেন যে, প্লিজ এরকম অমানবিক আচরণ করবেন না। তোমার স্ত্রী তখন বলেছিল তুমি আসলে নাকি তার মাথার যন্ত্রণাটা বেড়ে যায়। তোমার স্ত্রীর মুখে এ কথা শুনে ওর চোখের দিকে তাকাতেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম ও মিথ্যা কথা বলছে। ও আসলে ওর নিজের না, তোমার কষ্টটা সহ্য করতে পারছিল না। কিন্তু তুমিই বল, এরপর এ্যাডমিনিষ্ট্রেটর আর কি করতে পারে? তাই তোমার এখানে ঢোকা নিষেধ হয়ে গেল। আমি আরও বুঝি গতবার যখন তোমাকে এখানে ঢুকতে দেয়া হোল না, তুমি দুইদিন চেষ্টা করার পর কি কষ্ট নিয়ে দেশে ফিরে গেলে। এই দুইদিন তুমি গেটের পাশে চুপচাপ বসে থাকতে আর তোমার স্ত্রী আমাদের কাছে বারবার খবর নিত তুমি কি করছ। তৃতীয় দিন যখন সারাদিন তোমাকে আর দেখলাম না, তখন তোমার স্ত্রীকে বললাম তুমি হয়ত দেশে ফিরে গেছ। এর পরদিন তোমার স্ত্রীও কোমায় চলে গেল। ও চাইছিল না তুমি আর কষ্ট পাও, সে জন্যেই হয়ত কোমায় চলে গেল। যাই হোক তুমি পারলে আমাকে ক্ষমা কোর, আমি তোমাকে ওর কাছে যেতে দিতে পারব না।”
“কিন্তু নার্স, ও তো এখন লাইফ সাপোর্টে আছে! ও কি আসলেই জীবিত? আমি ওর কাছে গেলে ও কি বুঝতে পারবে? আর এত কাছে এসে ওকে না দেখতে পাওয়াটা কত কষ্টের তা কি তুমি বোঝ?”- আমি আর সহ্য করতে পারিনা।
এবার নার্সের চোখ ছল ছল করে উঠল। কি মনে করে হঠাৎ বলে উঠে- “ঠিক আছে যাও, শুধু তোমার জন্য আমি আমার চাকরীর রিস্ক নিচ্ছি। আর এছাড়াও আমি তোমার স্ত্রীর কাছে কমিটমেন্ট করেছিলাম তার অনুরোধ রক্ষা করব, এর জন্য হয়ত গড আমাকে মাফ করবে না। তারপরও, তুমি যাও। আরেকটা কথা, বেশী কাছে যাবে না আর ওর শরীরে টাচ্ করবে না। লাইফ সাপোর্টে থাকলেও অনেক সময় রোগী এসব অনুভব করতে পারে। তখন ওর অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়।”
আমি পা বাড়াই ভেতরের দিকে। ঐ যে ওর কেবিন দেখা যাচ্ছে, আরেকটু আগাই সামনের দিকে। ঐ তো দেখা যাচ্ছে, হঠাৎ অনুভব করি আমার ভেতরের শুন্যতাগুলো যেন আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। ভালোবাসার শক্তি কত অসীম তা অনুভব করতে পারছি। এ শক্তি দিয়ে শুধু বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নয়, সৃষ্টিকর্তাকেও জয় করা যায়!
জীবনে হার মানতে হবেই, একবার হলেও হার মনতে হবে। অন্ততঃ তোমার মৃত্যুর সময় হলেও।
সকাল ১০:১৫ বাজে। ডাক্তারদের মিটিঙ রুমে বসে আছি। ডাঃ নারিনের চেম্বার থেকে আমাকে এখানে বসতে বলা হয়েছে। মিটিং রুমে ঢুকে আমার স্ত্রীর ভাই আর বড় বোনকেও দেখতে পেলাম। ওরা যে ব্যাংকক এসেছে বা এই মিটিঙয়ে থাকবে তা আমাকে জানায়নি। এমনিতেও ওদের সাথে আমার কখনোই কোন সম্পর্ক ছিলোনা, আর কোনদিন হবেওনা। ওদের আমি প্রচন্ড ঘৃণা করি। তবে এখন আমি ওদের ওপর কৃতজ্ঞ, কারণ গত মার্চ মাস থেকে ওরাই আমার স্ত্রীর সব চিকিৎসা খরচ দিচ্ছে।
ওদের সাথে অস্বস্তি নিয়ে মিটিং রুমে বসে আছি। কোনটা আমার জন্য বেশী কষ্টকর বুঝতে পারছি না। আমার স্ত্রীর এই অবস্থা, না ওদের সাথে একই টেবিলে বসে থাকা, কোনটা? বেশিক্ষণ এই অস্বস্তিভাব নিয়ে থাকতে হোলনা, ডাঃ নারিন সাথে আরও তিনজন ডাক্তার নিয়ে ঢুকল মিটিং রুমে।
রাকিব, “কেমন আছ তুমি”? “ভালো”। আর কোন ভান ভনিতার মধ্য দিয়ে যায় না ডাক্তার। “রাকিব, তোমাকে খুব দুঃখিত হয়ে জানাচ্ছি যে, তোমার স্ত্রীর অবস্থা খুব খারাপ। ওর আর সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবার কোন সুযোগই নেই। ওর যে অবস্থা, যেখানে টিউমারগুলো হয়েছে সেখানে অপারেশন করারও কোন সুযোগ নেই। এ শুধু আমাদের হাসপাতালে না, পৃথিবীর কোন হাসপাতালেই সম্ভব না। বিশ্বাস কর, বিন্দুমাত্র সুযোগ থাকলেও আমরা চেষ্টার কোন কমতি করতাম না। আমরা আরও দুঃখিত আর বিস্মিত হয়ে জানাচ্ছি যে, তুমি তোমার স্ত্রীর যে ভাই আর বোনের সাথে বসে আছ, তারা গত ১৩ই জুলাই আমাদের অফিসে এসেছিল। তারা বলেছিল যে, তারা তোমার স্ত্রীর এই অসুখ হবার পর থেকেই তার সমস্ত খরচ দিয়ে যাচ্ছে। এ খরচের ভারে তারা আজ আর্থিক ভাবে পথে বসতে চলেছে। তুমি তার স্বামী হিসাবে তোমার স্ত্রীর প্রতি কোন দায়িত্বই পালন কর নাই। তাই তারা আর পনের দিনের মত তাদের বোনের এই খরচ চালাতে পারবে, এর মধ্যে যদি ওর অবস্থা ভালোর দিকে না যায় তাহলে যেন লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলা হয়। আর আগামীকাল এই পনের দিন শেষ হতে চলেছে। এখন তুমি যদি তোমার স্ত্রীর লাইফ সাপোর্টের খরচ দিতে পার তাহলে আমাদের কোন আপত্তি নেই, আমরা ওকে এভাবেই রাখব, হয়ত এর মধ্যে কোন মিরাকল্ ঘটতে পারে। তুমি হয়ত জানোনা, আমরা ডাক্তাররাও রোগীর একটা পর্যায়ে গিয়ে এই মিরাকল্ আশা করি, কোন কোন সময়ে যে মিরাকল্ ঘটে না, তা না। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘটে না। আমরা হতাশ হই। এখন তুমি যদি চাও তোমার স্ত্রী এভাবেই থাকুক তাহলে কালকের ভেতর তোমাকে আরও ২০,০০০ বাথ জমা করতে হবে, আর যদি তা না পার তাহলে আমাদের আর কিছু করার নেই তার লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলা ছাড়া। তোমরা তার লাশ দেশে নিয়ে যাবার যে খরচ তা আমরা হাসপাতাল থেকে বহন করব, কিন্তু এর বেশী আর কিছু করতে পারব না, এখন তুমি ডিশিসন দাও। কারণ তার স্বামী হিসাবে তোমার লিখিত অনুমতি লাগবে”।
কথাগুলি আমি বুঝতে পারি না। খরচের জন্য ওর লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলা হবে? এ কিভাবে সম্ভব? ডাক্তারকে বলব?-ডাক্তার সাহেব, আপনি যা শুনেছেন আপনি যা জানেন তা সত্যি না। ওর ভাই বোনরা কত বড় মিথ্যাবাদী আপনি জানেন না, ওদের কি পরিমান লোভ আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। আমার স্ত্রী কি পরিমাণ পৈত্রিক সম্পত্তির মালিক আপনি জানেন? পৈত্রিক সম্পত্তিতে ওর ভাগে যতটুকু অংশ পড়ে তা শুধু ভাড়া দিলেই ওর আজীবন লাইফ সাপোর্টের খরচ উঠে চলে আসবে তা কি আপনি জানেন? আপনি জানেন না, ওর যেদিন এই অসুখ ধরা পড়ল সেদিনই ওর ভাই ওর উত্তরার গার্মেন্টস্ এর ভাড়া পাওয়া বন্ধ করিয়ে দিল? ওর চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে আমি আজকে মানুষজন থেকে পালিয়ে বেড়াই। টাকার অভাবে আমার ছোট বোনের বিয়ে মাসের পর মাস পেছাই। আর ওরা সব খরচ চালাচ্ছে? খরচ তো দিচ্ছে এই মার্চ মাস থেকে! আর এর আগের দুই বছরের খরচ কে দিল?
এসব কি বলা যায়? বলে তো শেষ করা যায় না। আমার কিডনি দুটা বেঁচে দিব? তাতে আর কত টাকাই পাওয়া যাবে? আর সেই টাকায় কত দিনই লাইফ সাপোর্ট চলবে? তারপরতো যা হবার তাই হবে। মাথায় কত ধরণের উত্তর আসতে থাকে।
আমি এসব কিছুই বলতে পারি না, এসব বলা যায় না। শুধু আস্তে আস্তে করে বলি, “ঠিক আছে কোথায় সাইন করতে হবে দিন, আমি সাইন করে দিচ্ছি”।
কাগজ পত্র এগিয়ে দিল ডাক্তার। একগাদা কাগজ। “এতগুলো কাগজ সাইন করতে হবে”? “না শুধু শেষের কাগজটা, উপরের কাগজ গুলো সব টার্মস, ওগুলো পড়ে দেখতে পার”-ডাক্তার বলে।
ওপরের কাগজগুলো পড়ার কোন প্রয়োজন অনুভব করি না। নীচের কাগজটা হাতে নেই। পরিস্কার বুঝতে পারি, আমি হেরে গেছি, হেরে গেছে আমার স্ত্রীও। কাগজটায় সাইন করি, দেখি আমার হাত কাঁপছে।
“ডাক্তার, আমার দুইটা অনুরোধ আছে। তুমি মানতে না চাইলেও বলব, কারণ আমি ভালো করেই জানি তোমার মানতে হবেই। প্রথমতঃ এই কলমটা আমি নিয়ে যাব। দ্বিতীয়তঃ আমি এখন আমার স্ত্রীর কাছে যাব। তুমি আই সি ইউ তে ফোন করে বলে দাও আমাকে যেন ঢুকতে দেয় আর একটা চেয়ার এনে দেয়। কারণ আমি সেখানে গিয়ে আমার স্ত্রীর বেডের পাশে বসব। ঠিক এখন থেকে কালকে ১২:০০ টা পর্যন্ত আমার স্ত্রীর হাত ধরে বসে থাকব। এ সময় পর্যন্ত আমি তার কাছ থেকে এক সেকেন্ডের জন্যও নড়ব না। তোমার হাসপাতালের কি নিয়ম আছে না আছে তা আমি মানব না। যদি আমাকে মানাতে চাও তাহলে জেনে রাখ আমাকে শুধুমাত্র মেরে ফেলা ছাড়া কোনভাবেই তা সম্ভব না। আর এটা আমি করবই- বাই ডাক্তার”।
সারা জীবনের ভালোবাসা, এক দিনেই সম্ভব?
আচ্ছা, সারা জীবনের ভালোবাসা কি এক দিনেই সম্ভব? আমিতো বলব, সম্ভব। ২০১৫ইং সালের ২রা আগষ্ট দূপুর ১২টা থেকে ৩রা আগষ্ট দূপুর ১২টা পর্যন্ত আমি আমার স্ত্রীর হাত ধরেই বসে ছিলাম। এই এক দিন আমার কোন খাওয়া বা বাথরুমের প্রয়োজন হয়নি। ৩রা আগষ্ট দূপুর ১২:০০ টায় যখন ওরা লাইফ সাপোর্ট খুলে নিতে আসল, তখন আমি ওর হাত ছাড়লাম। ওর হাত তখনও গরম ছিল। আমার মনে হোল আমার মধ্যে আর কোন কষ্ট নেই। শুধু শেষবারের মত ও যেন আমাকে বলল, “আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি অনন্ত কাল তোমার সাথে থাকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারলাম না”।
ফিরে আসা
ওর হাত ছেড়ে আমি হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসি। এর পর কিভাবে দেশে ফিরে আসলাম তা আমার কিছুই মনে নেই। শুধু মাঝখানের একটু কথা মনে আসে- আমি প্লেনে জানালার পাশে বসে আসি, স্টুয়ার্ডেস এসে জানতে চাইছে আমি কিছু খাব কিনা। যখন পুরোপুরি হুশ ফিরল তখন দেখি আমি ঢাকা এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছি। ইমিগ্রেশন চেক করে বাইরে বেরিয়ে দেখি কতগুলো সিএনজি, এর মধ্যে একটাকে বললাম-“ভাই, নারিন্দা যাবেন”?
পুনশ্চঃ
আমার স্ত্রীর ডাক নাম দিপালী। ওর সাথে আমার বিয়ে হয় ২০১০ইং সালের ৮ই সেপ্টেম্বর। এর আড়াই বছর পর ওর ব্রেইন টিউমার ধরা পড়ে। তাও একটা না, তিনটা। এর মধ্যে শেষেরটা ব্রেইনের ঠিক মাঝখানে। ওগুলো আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। রাতের পর রাত ও কষ্টে চিৎকার করে উঠত। তখন ডাক্তাররা কষ্ট কমানোর জন্য ওকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিত। আমি রাত জেগে বসে থাকতাম, ঘুমাতে পারতাম না। একা একা রাত জেগে থাকতে আমার কষ্ট হোত বলে আমি ওর পাশে বসে ল্যাপটপে কাজ করতাম। সকালে ও ঘুম থেকে উঠে বলত “এখনও কাজ করছ”?
এভাবে রাতের পর রাত কাটতে থাকে। এক সময় আমার আর কোন কাজ ভালো লাগেনা। আমি বিভিন্ন ব্লগ পড়তে থাকি, সবচাইতে ভালো লাগে সামহোয়্যারইন ব্লগ। হতাশার এ সময়টাতে ব্লগটি আমার সঙ্গী হয়ে থাকত। ও যখন সুস্থ থাকত, আমি ব্লগ থেকে নানা মজাদার পোষ্ট ওকে পড়ে শোনাতাম। ও হাসতে হাসতে বিছানায় গড়িয়ে পড়ত। মাঝে মাঝে ব্লগারদের দুই একটা কষ্টের কথা পড়ে শোনাতাম, দেখতাম ওর চোখ দিয়ে অঝর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছে। এভাবে আমাদের সময়গুলো কোনমতে কেটে যাচ্ছিল।
একদিন ও আমাকে খুব সিরিয়াস ভঙ্গীতে বলল, “তোমাকে একটা অনুরোধ করব, তুমি রাখবে”? কথাটি শুনে আমি মোটেই আতংকিত হই না। ওর মত স্ত্রীর অনুরোধ রক্ষা করতে গেলে আতংকিত হওয়ার কিছু নাই। আপনারাই বলেন, যার এ পর্যন্ত আমার কাছে সবচাইতে বড় অনুরোধ ছিল- আমাকে দাঁড়ি রাখতে হবে, তাতে নাকি আমাকে হুজুর হুজুর লাগে আর এতে ওর খুব হাসি পায়। এমন মানুষের আর কি অনুরোধ থাকতে পারে? আমি হাসতে হাসতে বলি- “একশ বার রাখব, তুমি যদি সাত সমুদ্র তের নদী পারি দিতে বল তাও পারব, তুমি শুধু বল”।
“তুমি তাহলে ব্লগে লেখালিখি কর”। এ কথা শুনে রীতিমত ভিড়মি খাই আমি। এ কথা তো আমার সহজ সরল স্ত্রীর কথা হতে পারে না! নিশ্চয়ই এর মধ্যে অন্য কিছু আছে। “তা, এ অনুরোধ কেন পরী?” আমি জিজ্ঞাসা করি। ওর কোন কাজে বিস্মিত হলে ওকে আমি পরী বলে ডাকতাম।
“আমি চাই তুমি ব্লগার হও, খুব নামকরা ব্লগার। আমার এই কষ্টের সময় আমি যখন অন্য ব্লগারদের লেখা শুনে হাসি, যখন কাঁদি, তখন আমারো মনে হয় আহারে আজকে যদি আমার স্বামীর লেখা থাকত এখানে? আমার কাছে কত ভালো লাগত! আমার যে অসুখ তাতে তো আমি বেশিদিন বাঁচব না, আমি চাই আমার মতই আরেকজন তোমার লেখা পড়ে এভাবেই হাসুক, এভাবেই কাঁদুক। না না, কাঁদুক না, শুধু হাসুক এমন লেখা লিখ”।
-এই ছিল আমার ব্লগে আসার, লিখালিখি শুরু করার মূল কারণ।
ও এখন না ফেরার দেশে। এদিকে আমার আবার লেখা শুরু করতে হবে। সবচাইতে আগে যেটা শুরু করতে হবে সেটা হচ্ছে, আমার আর দিপালীর সব কথা লিখে ফেলতে হবে। আমাদের ছেলেটা যাতে বড় হয়ে সব জানতে পারে। ওর মা কেমন ছিল, আমাকে কতখানি ভালোবাসত, ওকে কতখানি ভালোবাসত, ভালোবাসা কেমন হয়, ভালোবাসা কেমন হওয়া উচিত। ও একদিন বড় হবে, বিয়ে করবে, হয়ত আমার লেখাগুলো পড়বে। আমি দোয়া করি বর্তমান ভালোবাসার কুৎসিত শিক্ষাগুলো থেকে যাতে ও মুক্ত থাকে। এ শুধুই আমাদের ভালোবাসার গল্প।
-চলবে
আরেকটা কথা, যেটা না বলা অন্যায় হবে। আমি হয়ত এ ধারাবাহিক গল্পটা শুরু করতে পারতাম না, যদি না সামহোয়্যারইন ব্লগের “বোকা মানুষ বলতে চায়” এর সাথে পরিচয় না ঘটত। উনার দুটি লেখা- মিরা'র মিরাকল (একটি অনুগল্প এবং বাস্তবের মিরার জন্য দোয়া প্রার্থনা) লিঙ্ক- view this link এবং মিরা'দের জীবনে মিরাকল ঘটেনা, লিঙ্ক- view this link আমার এই লেখাটা শুরু করার মূল উৎসাহয়ক। এ ছাড়াও আমার কষ্টের সময়গুলোতে উনার এবং অন্যান্য ব্লগারদের সহমর্মিতার জন্য আমি সারাজীবনের কৃতজ্ঞ।