বছর চারেক আগের কথা, সুবর্ণ এক্সপ্রেসে করে ঢাকা আসছিলাম। পাশের সিটে হিন্দু ধর্মালম্বী একজন বয়োবৃদ্ধ মহিলা। কিছুক্ষণ পরপর ফরমায়েশ খাটাচ্ছিলেন। ব্যাগটা একটু নামিয়ে দেবে বাবা, পেপারটা একটু পড়া যাবে, গ্রামীণফোনে চাকরী করি শুনে তাঁর মোবাইলের যাবতীয় সমস্যা সবিস্তারে বর্ণনা আর সেই সাথে গ্রামীণফোনের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার - বিরক্তও লাগছিলো চরম পর্যায়ে কিন্তু কিছু বলতে পারছিলাম না। চট্টগ্রামের সেইন্ট প্লাসিড্স স্কুলের টিচার ছিলেন, এখন অবসরপ্রাপ্ত। দেখতে অনেকটা আমাদের স্কুলের বড় আপার মতো। বড় আপার মতো তিনিও অবিবাহিত। ঘুমাতে দিলেন না একটা ফোটা। আমি গুলশানের দিকে থাকি শুনে আরজি করলেন আমি কি তাকে ইন্দিরা রোডে তাঁর ভাইয়ের বাসায় নামিয়ে দিতে পারবো কিনা।আসার পথে তাঁকে নামিয়ে দিয়ে আসলাম বাসায়। কথার ফাকে জিগ্গেস করেছিলাম কে কে আছে তাঁর পরিবারে। বল্লেন একটা চাচাতো ভাই ( যিনি কিনা ইন্দিরা রোডে থাকেন) ছাড়া আর কেউ নেই।
এরপর মাঝে মাঝেই আমার মোবাইলে কল দিতেন মাসিমা। ঢাকায় আসলেই আমার জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসতেন । বাসায় গিয়ে দেখা করে আসতাম আর পরম মমতা নিয়ে খাওয়াতেন। অনেক সময় গভীর রাতেও কল দিতেন। বলতেন, "সাঈদ, আমি তো বড় একা, সাঈদ এই পৃথিবীতে আমার আপন কেউ নাই, বাবা আমার অনেক কষ্ট হয়....."। একবার ফোন করলে আর রাখতে চাইতেন না, মাঝে মাঝে ইগনোর করতাম আবার মিথ্যাও বলতাম এড়িয়ে যাবার জন্যে । বলতাম ঢাকার বাইরে বা অসুস্হ বা ফোন ধরতাম না। আবার মাঝে মাঝে অনেক কথাও বলতাম, টুকটাক কাজ করে দিতাম। একটা জিনিষ বুঝতাম জীবনের শেষ পর্যায়ে একটা চরম একাকিত্ব তাঁকে গ্রাস করে আছে। ছেলেমানুষের মতো ফোন করে মাঝে মাঝে বলতেন ভুল করে কল চলে এসেছে, একটু কথা বলা যাবে কিনা....। নি:সন্গতা, গুমোট কষ্ট, অপ্রকাশিত বেদনা, কিসের যেন অপ্রাপ্তি তাঁর একমাত্র সন্গী। নিজের এই দুর্দশার জন্য নিজেকেও দুষতে পারেননা, নিয়তিকেও মানতে পারেননা আবার কাকে যে দুষবেন তাও যেন বুঝতে পারেননা।
জিগ্গেস করেছিলাম কেনো তিনি বিয়ে করেননি। একবার বলেছিলেন তখন ইচ্ছে করে নি - একাই তো ভালো। তাঁর বাসায় গেলেই আমার সাথে মুক্তিযুদ্ধের গল্প করতেন। যুদ্ধের সময় (৭১ সালে) অনেক কষ্ট নেমে এসেছিলো (তখন তাঁর বয়স ১৮ থাকতেন চট্টগ্রামের নন্দন কাননে) তাঁর ও তাঁর পরিবারের লোকদের জীবনে। ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া তার বড় ভাই আর বাবাকে বিহারীরা ধরে গিয়েছিলো, ভয়ে আতংকে তিনি ও তাঁর মা আশ্রয় চেয়েছিলেন পাশেরই এক মুসলিম প্রতিবেশির বাড়ীতে, কিন্তু আশ্রয় পাননি। তাঁর মা যুদ্ধের কিছুদিন পরেই মারা গিয়েছিলেন ঐ শোকে। তাঁকে বিয়ে করতে বলেছিলেন অনেকেই, ঘেন্নায়-আতংকে করতে পারেননি। ইন্ডিয়াতে মামারা চলে যেতে বলেছিলো - লজ্জায় কোনো আত্মীয় স্বজনের সাথেই যোগাযোগ রাখেননি। একা একাই থেকেছেন সেই চাপিয়ে দেয়া নিয়তি, গুমোট অভিমান আর অভিশাপ নিয়ে।
গত চার বছর প্রতিটা ১৬ই ডিসেম্বরে তিনি আমাকে কল দিয়েছিলেন, কিছুই না শুধু দু-চারটা কথা বলতেন। কেমন আছি , কি করছি, বিয়ে করেছি কিনা, কখন চট্টগ্রামে যাব, বিজয় দিবসে কি করছি এসব । অনেকদিন হলো ফোন করেননা আমিও দেশে ছিলাম না। আজকে হুট করে তাঁর কথা মনে পড়লো - কল দিয়েছিলাম, দেখলাম তাঁর নাম্বার বন্ধ। আরেকটা নাম্বার সেইভ করা ছিলো 'মাসিমা - ২' নামে, তাঁর ভাইয়ের নাম্বার। ওপাশ থেকে জিগ্গেস করলো কে, বল্লাম - 'কাকা আমি সাঈদ। আপনার বাসায় কয়েকবার গিয়েছিলাম মাসিমার সাথে দেখা করার জন্য।'
ওপাশ থেকে বল্লেন - 'তোমার মাসিমা তো গত হয়েছেন মাস চারেক হলো'
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:১৭