ও আমাকে ডাকতো মি: হুমম....আমাদের পরিচয় মার্কেটিং ডে তে।জুনিয়রদের রেগ দিতে গিয়ে তাকে একটু বেশিই দিয়ে ফেলেছিলাম, ভ্যা করে কেঁদে দিয়েছিলো.....আমি তো ভ্যাবাচ্যাকা !!!!সরি বলারও সুযোগ দিলো না - এক দৌড়ে রিকসায় উঠে চলে গিয়েছিলো। পরে অনেকবারই সরি বলতে চাইলাম, আমাকে দেখলেই মুখ কঠিন করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতো - সাহস হতো না কাছে গিয়ে সরি বলার। তারপর ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাই আর সে ইগনোর করে।
সরি বলার সুযোগ পেলাম পরের মার্কেটিং ডে তে.....যখন আমার কাছে সে সহ তাদের ব্যাচের কয়েকজন আসলো আইডিয়া নিতে। এরপর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট আর রাতভর চ্যাটিং......
তার সব কথার উত্তরে আমি নাকি শুধু হুমম হুমম করতাম..তাই আমি মি: হুমমমমমমমম।
আমি তাকে ডাকতাম মিস্ প্যান প্যান। কিছু থেকে কিছু হলেই শুরু হতো প্যান প্যান......
কতো চিমটি যে তার খেয়েছি, কোনো মেয়ের দিকে চোখ পড়লেই খামচে আমার রক্ত বের করে দিতো। আমিও তাকে রাগানোর জন্য ইচ্ছে করেই তাকাতাম আর চিমটি খেতাম। কখনো কখনো ব্যাথায় চিৎকার করে বলে উঠতাম, তুমি একটা অসহ্য,পেইন। তার ছিলো কোকরানো চুল - আমি তাই তাকে ডাকতাম সজারু। সজারু ডাকলেই অভিমানে বলে উঠতো, যাও না খুজে নাও তোমার বনলতা সেনকে - আমার কাছে কি ?
একটা কথা হাজার বার বলার অদ্ভুত এক ক্ষমতা ছিলো তার, যতোক্ষণ না আমি তার কথামতো কাজ করতাম কানের কাছে প্যান প্যান। রিকশায় সে আমাকে কখনই ডানপাশে বসতে দিতো না, ওপাশটা তার জন্য বরাদ্দ - কেনো কে জানে .....। "তুমি আমাকে প্রতিদিন একটা করে বেলি ফুল দিবে আর প্রতি সপ্তাহে একটা করে চিঠি "। শাহবাগ থেকে ৫ টাকার বেলি ফুল কিনি নি এমন দিন খুব কমই গেছে, বেলি ফুল না পেলে সাদা গোলাপ, তা না পেলে অন্য সাদা যেকোনো ফুল। দেখা হলে প্রথমেই হাত বাড়িয়েই "আমার ফুল কই ???" না আনলে অভিমান করে বসে থাকবে....কি যণ্ত্রণা !!!" আমি তো শাহবাগ দিয়ে আসি নি - ফুল কই পাবো ?" "এখনই চলো, আগে ফুল কিনে দেবে তারপর অন্যকথা।"
নিউমার্কেটের চটপটি,ফুসকা আর হাকিম চত্তরের পাকুড়া, চা দিয়ে দিনের পর দিন লাঞ করেছি। তার পছন্দ ভ্যানিলা আমার পছন্দ স্ট্রবেরী, তার পছন্দ কোলা আর আমার পছন্দ মাউন্টেন ডিউ, তার পছন্দ চিকেন ফ্রাই আর আমার পছন্দ বীফ ভুনা ....."তোমার আবার পছন্দ কি ? তোমার পছন্দ আমি আর বাকি সব আমার পছন্দ !!!!" আমি পছন্দ করতাম এনরিক-লিনকিন পার্ক-আর্টসেল, সে পছন্দ করতো বাপ্পা-শ্রীকান্ত-এ আর রাহমান।প্রতিদিন তাকে একটা করে গান দিতে হতো - "পচা হলে ৩ টা জরিমানা !!!!" একসময় সেও আমার দেয়া গানই শুনতো শুধু।"তুমি গিটার শিখবে - আমাকে গান শোনাবে", জোর করে ভর্তি করে দিলো টি,এস,সি র মিউজিক ক্লাবে ...প্রতিদিন আবার আপডেট ও জানতে চাওয়া হতো.."শেখা কতোদূর????"আমাকে চুল কাটাতে দিতো না , চুল কাটালে নাকি আমাকে চোর চোর লাগে..!!
একপ্লেটে দুজনে বসে ফুচকা খেতাম...শেষটা দুজনেই রেখে দিতাম, ও বলতো "তুমি" আমি বলতাম, না তুমি....শেষে ভাগ করা হতো শেষ ফুচকাটা !!!আমাকে ডাকতো জিলিপির হোলসেলার, আমি নাকি যে কোনো জিনিষ পেচিয়ে জিলিপি বানাতে পারতাম..আমি বলতাম আমি তো জিলিপি বানাই আর তুমি নিজেই হচ্ছো একটা জিলিপি....প্রতিদিন ক্লাস শেষে সিটি বাসে করে শাহবাগ থেকে মোহাম্মদপুর। প্রতিদিনই সে বলতো আজকে আমি তোমাকে দিয়ে আসি, আবার তরঙ্গ বাসে মোহাম্মদপুর থেকে গুলশান, বিদায় নেয়ার সময় আমি বলতাম, আচ্ছা আজকে আমিই দিয়ে আসি, তুমি আরেকদিন....আবার সেই বাসেই মোহাম্মদপুর। এভাবে যে কতোদিন কতোবার হয়েছে তার হিসাব নেই। তার একটা হাত দিয়ে সবসময়ই আমাকে ধরে রাখতো, একদিন পাশের রিকশার কিছু ছেলে তাকে দেখে বলে উঠলো "ফেবিকল!!"। এরপর থেকেই ফেবিকল বল্লে তার সে কি রাগ !!!!আমিও সারাক্ষণ ফেবিকল ফেবিকল ই করতাম.....।আমি বলতাম তুমি হচ্ছো আমার আপার বাচ্চার মতো.....ঘুমের মধ্যেও আমার শার্টের এক কোনা ধরে রাখবে , "ভালো হয়েছে, আমার যা ইচ্ছা তাই করবো"। খাওয়া মুখে নিয়ে গাল ফুলিয়ে বসে থাকতো, গিলতো না যতোক্ষণ না আমি দুই গালে দুটো গুঁতো দেই.....।আমার রুমের সাথের বারান্দাটার ছবি দেখে
বলেছিলো, একদিন রাতের আকাশ আর পূর্ণিমা দেখবে আমার বারান্দা দিয়ে।
তার সাথে আমার শেষ দেখা স্কয়ার হসপিটালে, আমি অনেকগুলো বেলি ফুল নিয়ে গিয়েছিলাম, আর তার ফেভোরিট চকোলেট আর চিকেন ফ্রাই....ডাক্তাররা খেতে দেয়নি কিছুই, তার নাকি ওগুলো হজম করারই ক্ষমতা নেই। বেলিফুলগুলো দুহাতে জরিয়ে ফোঁপাচ্ছিলো আর ফ্যাকাসে দুচোখ দিয়ে পানি পড়ছিলো.....কথা হয়নি কোনো, হয়তো ছিলো অনেক কিছু বলার, বলতে পারেনি।
গিটারটা পড়ে আছে রুমের এককোনে, ফিরেও তাকাই না আর, রিকশায় এখনও ডানপাশটা খালিই থাকে, জোর করে খেতে খেতে এখন ভ্যানিলা আর কোলাই ভাল্লাগে.....ফুচকা খাওয়া হয়না অনেকদিন,শেষটা কে খাবে? এই ডিসিশান যে নেয়ার সাহস নেই.......... মেইলে গান এটাচ করা হয়, দুএকটা হয়তো পাঠানো ও হয়, কেউ শোনে কিনা কে জানে .....তরঙ্গ বাসে করে গুলশানেই নামি, কেউ বলে না আজকে না হয় তুমিই একটু কষ্ট করো।চিমটির ক্ষতগুলো শুকিয়েছে অনেকদিন,মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে অসহ্য চিমটির ব্যথাটা যদি আরেকটিবার পেতাম।আমার বারান্দাটা আর দেখানো হলোনা তাকে.........শার্টের কোনাটাও আর কেউ টেনে ধরে থাকে না।
কোনো অভিমান নেই কারো উপর, নিয়তিকে মেনে নিয়েছি, তা না হলে বেঁচে আছি কিভাবে ?শুধু একটা প্রশ্নই করতাম তাকে, যদি পেতাম আরেকটি মূহুর্তের জন্য, এতটা ভালোবাসা না দিলেই কি হতো না.................................
পূর্বে "প্রশ্ন" শিরোনামে প্রকাশিত।