ভার্সিটিতে পড়ার সময় আমাদের কারো কাছে সিগারেট থাকুক আর না থাকুক মেহেদীর কাছে কনফার্ম থাকতো । যে-ই যখন সিগারেট চাইতো তার কাছে পাওয়া যেতো। মেহেদী আর শফিক ছিলো সিগারেট-খাওয়া রোজদার পার্টি!! সারাদিন রোজা রাখতো তবে সিগারেট খেয়ে !! মেহেদী তো এক কাঠি সরেস। আযানের পর পর সিগারেট খেয়ে ফেলতো, দেরি করতো না পাছে আবার দুপুরে ঘুম থেকে উঠে যদি সিগারেট খেতে ইচ্ছে করতো কিন্তু যদি আবার রোযাও রাখতে ইচ্ছে করতো !!এক রোযায় আমরা ছিলাম ইশরাকের বাসায় (ইশরাকের খালার বাসায়, খালার পুরো পরিবার নিয়ে ইউ,এস,এ - বাসা আমাদের দখলে.)। সারারাত কার্ড খেলা, আড্ডা, গেম খেলা, মারামারি-ধস্তাধস্তি-র পরে সবাই মিলে সেহেরী করতাম। সেহেরীর পরে কিছু জিনিষ কমন থাকতো। আযানের পর পর মেহেদীর সিগারেট ধরানো অন্যতম - শফিকের মতো কেউ কেউ সন্গী হতো। আমরা ঘুমুতে যেতাম আর ইশরাক পানির বোতল নিয়ে গেম খেলতে বসতো। আমরা ইফতারের আগে আগে ঘুম থেকে উঠতাম, ইশরাক ঘুমুতে যেতো !! ওর এই ধরনের আরও অনেক সিক্নেস ছিলো, সে গল্পো করা যাবে আরেকদিন। আজাদ অবশ্য যা করার সেহেরীর আগেই করে ফেলতো !! সেহেরীর পর থেকে ইফতারের আগ পর্যন্ত সাচ্চা মুসলমান !! যাই হোক ফিরে আসি মেহেদীর কথায়। সেই মেহেদী দেখলাম সিগারেট ছেড়ে দিয়েছে !! প্রথমে শুনে বিশ্বাস করি নি, নিজ চোখে দেখলাম ঘটনা সত্যি !!শুধু তাই না , গম্ভীর মুখে দেখলাম গ্যান বিতরণও করে যাচ্ছে !! "ইচ্ছা থাকলে সবই সম্ভব, খুব বেশি কষ্ট হয় না !!!"। শফিক গম্ভীর মুখে বলে ফেললো, "প্রেম করলেই হয়তো সিগারেট ছাড়া যায় তবে প্রেমটা কোরিয়াতেই হওয়া লাগবে!!, এই দেশে পসিবল না !!" । সুমন শুনে বল্লো, "ছাড়ার কি আছে ? আমি তো খাই-ই না !! (যদিও ৫ বছর ধরেই সে সিগারেট খায়,রিতু জানে না !!), পোলাপান স্মার্ট হইলো না ....."(সাথে দীর্ঘশ্বাস, মেহেদীর আনস্মার্টনেস দেখে সে হতাশ)। আমি বল্লাম, আরে বাবা অন্তত আজাদের স্ট্র্যাটেজিতো ধরতে পারতি। "সিগারেট খাই না, বিশ্বাস করো !! - দাঁত কেলিয়ে আমাদের বলতো আমি তো পান করি, খাই না !!! অথবা পাশার স্ট্র্যাটেজি, সিগারেট খাওয়া অবস্হাতেই গার্লফ্রেন্ডের ফোন, টুপ করে হাত থেকে সিগারেট ফেলে দিয়ে, "আমি তো সিগারেট ছেড়েই দিছি !!!!" অথবা জামীর মতো অনুমতি নিয়ে নিয়ে খাওয়া !! কিন্তু একদম ছেড়ে দেয়া !!! আমিও হতাশ................
মেহেদীকে আমরা বলতাম ইয়েস-ম্যান ! কোনো কিছুতেই তার 'না' ছিলো না। কেউ কোনো কিছুতে ফোন করলেই তার উত্তর, "থাক, আসতেছি !!!"। মনে আছে ডিপার্টমেন্টের ইন্ডিয়া-নেপাল ট্যুরে প্রথমে আমাদের সার্কেলের কেউ যেতে রাজি না(এক মেহেদী ছাড়া)। কারণও আমাদের মতোই উদ্ভট!! পাসপোর্ট আর ভিসার জন্যে কেউ লাইনে দাড়াঁতে রাজি না। কারো ওতো ঝোল নেই। ইশরাক বুদ্ধি দিলো, "চল ময়মনসিং যাই, পাসপোর্ট, ভিসা লাগবে না!!" পোলাপান দেখলাম খুব উতসাহীও হলো !!পাশার যুক্তি ছিলো মনে হয় , একটা বন্ধ পাওয়া যাবে, জোরসে পড়া দেয়া যাবে(যদিও এক ওয়ার্ডও ও পড়েছে বলে মনে হয় না)। শুধু পাশা না, লিখাপড়ার ব্যাপারে ৫ টা বছর আমরা সবাই-ই নিজেদের ব্যাপারে ভুল মেসারমেন্টই করে গেলাম !! মুখে খুব সিরিয়াস, পড়তে হবে , পড়ার টাইমে নির্বিকারভাবে সব ভুলে যেতাম। শুধু ইশরাকই ছিলো ব্যতিক্রম, মুখেও বলতো, "পড়াম না", পড়তোও না !! আজাদও অবশ্য হালকা ব্যতিক্রম ছিলো, মুখে বলতো পড়বে এবং পড়তো ও। যদিও সে স্বীকার করতো না !! আমরা মাঝে মাঝে পচানোর চেষ্টাও করতাম!! আজাদ মুখ কালো করে বলতো, "সব মাছই গু(গোবর) খায়, ঘাওড়া(শোল) মাছের দোষ হয় !!!"। মানে সবাই-ই পড়তো শুধু আজাদকেই পচানো হতো !!! একদিন পাশাও উত্তরে বলে ফেল্লো, "ঘাওড়া(শোল) মাছই গু(গোবড়) খায়, সব মাছের দোষ হয় !!!"। আজাদ এরপর আর খুব বেশি বলেনি ওকথা !! যাই হোক কেউ যাবে না ট্যুরে, মেহেদী অনেক ঝুলাঝুলি করলো আমাদের নিয়ে। লাভ হলো না, আবার আমাদের ছাড়া যাওয়ার ব্যাপারেও মনস্থির করতে পারছিলো না। আমার নিমরাজী ভাব দেখে শেষ মূহুর্তে ডিসিশান নিলো যাবে, একদিনের মধ্যে লালমনিরহাট গিয়ে পাসপোর্ট করলো আবং একদিনের মধ্যে আমার আর তার ভিসার জন্যে দাঁড়ালো !! সে না হলে জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় অভিগ্গতা টা হতো না আমার। সে মেহেদী দেখি এবার এসে প্রথমবার বল্লো, "দোস্ত কাল পারবো না, কাজ আছে !!!" থার্ড ইয়ারের জাভা ইম্প্রুভমেন্ট চলে। মেহেদী আমার রুমে বসে পড়ছে। আমার ইম্প্রুভ ছিলো না ।বল্লাম তুই পড়, আমি বুয়েট থেকে আসি, শফিক কল দিছে , পোলাপান কার্ড খেলতেছে। সেও খুব সিরিয়াস ভন্গিতে বল্লো, "হুম..... যা, আমি পড়ি"। এক ঘন্টা পরেই দেখি বুয়েটে উপস্হিত !! চোখে উত্তেজনা, মুখে হাসি। টুপ করে আমার পাশে বসে পড়লো, "পরের দান থেকে আমাকেও দিস!!" । আমি অবাক হয়ে তাকালাম তার দিকে, "জাভা বাচ্চা পোলাপানের জিনিষ, গতবার কেনো ইম্প্রুভ রাখছিলাম তাই ভাবতেছি" - বলেই কার্ড সাজাতে ব্যস্ত হয়ে গেলো !!! এবার আসলো, সবাই বসলাম অনেকদিন পরে কার্ড খেলতে । অর্ধেক খেলা শেষ হওয়ার পরেই উঠার তাড়া !! স্যারের কাজ আছে আর আমরা হতাশ .............
টিভিতে খেলা দেখা (সে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ হোক আর আই,পি,এল হোক) ছিলো তার হবি। আর বাংলাদেশ, পাকিস্হান, ব্রাজিল ,ম্যান ইউ, বার্সার খেলা হলে তো কথাই নেই। মনে আছে কোনো একটা ইয়ার ফাইনালের আগে আই,সি,এল চলছিলো। প্রতিটা দলের প্রতিটা খেলা খুব মনোযোগ দিয়ে একুশে হলের টিভি রুমে বসে বসে একজন দেখতো !!! তা হলো মেহেদী। এবার আসলো, বল্লাম, দেখসোস কি অবস্হা ? বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের ? জিম্বাবুয়ের কাছেই সিরিজ হারছে..... "তাই নাকি !!!, খেলা দেখার টাইম কই !!, প্রেম কইরা কুল পাই না !!!" - মেহেদীর উত্তর !! প্রতিটা ঈদে একজন লাইন ধরে সবাইকে কল বা এসএমএস করতো অথবা উইস করতো এবং যথারীতি সেটা ছিলো মেহেদী। এবার ঈদে দেশে আসলো , এসএমএস করলাম - উত্তর নাই, কল করলাম - ধরে না, ব্যাকও করে না, যাকেই জিগ্গেস করি, মেন্দীর কি খবর ? কেউ জানে না !!! বাঁধন বলতেছিলো, নিঝুম (মেহেদী) যাওয়ার পর প্রায়ই ফোন দিত, লাস্ট কথা হইছে তখন শুনলাম তার প্রেম হয় হয় অবস্হা। এরপর থেকে আর কোনো খবর নাই !! মেসেন্জারে অনেকদিন নক করলাম, কোনো রেপ্লাই নাই(দেখেও না মনে হয়, যদিও প্রতিরাতেই দেখি মেসেন্জারে স্ট্যাটাস দেখায়, "ভিউ মাই ওয়েবক্যাম !!!")। আসার কয়দিন আগে জিগ্গেস করলাম, কিরে দেখস না ? মেসেন্জারে নক করি ? "দোস্ত বুঝসই তো .....!!!" - মেহেদীর এনসার !!
উদ্ভট আর আজব কীর্তি-কাহিনী দেখে একবার আমি পাশাকে বলেছিলাম, "দোস্ত তুই তো ব্যাক্তি না রে, তুই একটা প্রতিষ্ঠান..."। এরপর থেকে আমাদের সার্কেলের নাম হয়ে গেলো "PROTISTHANZ" এবং মেহেদী ছিলো সবচেয়ে বড় ধরনের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম। প্রতিষ্ঠান হওয়ার সবগুলো গুণাবলীই ওর মধ্যে বিল্ট-ইন ছিলো। আমাদের ধারণা ছিলো যারা অরিজিনাল প্রতিষ্ঠান প্রেম ভালোবাসা তাদের খুব একটা পরিবর্তন করতে পারে না (আজাদ ছিলো বড় উদাহরণ)। মেহেদীর আগে অবশ্য অনেকেই এই থিওরীর ভুলও প্রমাণ করেছে। তবে আমরা সবাই মেহেদীর ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম বিয়ে করুক আর প্রেম , মেহেদী খুব বেশি চেন্জ হবে না। আমাদের ধারণা যে খুব একটা ভুল ছিলো তাও না। ও দেখি জোগাড়ও করে ফেলেছে ওর মতোই একটা প্রতিষ্ঠান টাইপ !! আসার পরদিন আমরা মিট করলাম তার গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আমাদের নিক ধরে টানাটানি আর পচানো শুরু করলো !! দেখে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাচলাম, যাক বাঁচা গেলো !!! খুব বেশি চেন্জ হওয়ার উপায়ই নেই..............
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১১ রাত ৯:৫৭