একদিন হঠাৎ তৃতীয় মাত্রা দেখতে দেখতে জিল্লুর রহমানকে তাঁর নির্বাচিত অথিতিকে একটা প্রশ্ন করতে দেখি। তিনি খুব নির্দোষ ভাবে জিজ্ঞেস করেন, আচ্ছা, আমার ঠিক জানা নেই “ধর্মনিরপেক্ষতা” এই শব্দটা মুক্তিযুদ্ধের আগে কোন ঐতিহাসিক ডকুমেন্টে উল্লেখিত হয়েছিলো কিনা? যদি এ বিষয়ে বলতেন? যাকে প্রশ্ন করা হয় তিনি বেশ জোরের সাথেই বলেন, হ্যাঁ ছিল, অবশ্যই ছিল। তখন জিল্লুর রহমান খুব বোকার মত বলেন, ও, তাই ছিল, আচ্ছা বলবেন, কোন ডকুমেন্টে ছিল, ছয় দফা নাকি ১১ দফায়? এবার যাকে প্রশ্ন করা হয় তিনি ঘামতে থাকেন, আর জিল্লুর রহমানের ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা দেখা যায়। যাকে প্রশ্ন করা হয়েছে তিনি তখন বলেন, আচ্ছা, আমার এখন মনে পড়ছে না, আমি আপনাকে পরে জানাবো।
এরপর, আরেকদিন; তৃতীয় মাত্রা দেখছি, আবার সেই প্রশ্ন, আচ্ছা, আমার ঠিক জানা নেই “ধর্মনিরপেক্ষতা” এই শব্দটা মুক্তিযুদ্ধের আগে কোন ঐতিহাসিক ডকুমেন্টে উল্লেখিত হয়েছিলো......। সেই একই প্রশ্ন, একই ধরণের উত্তর আর জিল্লুর রহমানের মুচকি হাসি।
সঙ্গত কারনেই প্রশ্ন জাগে জিল্লুর রহমান সাহেব কেন এটা দেখে নিলেন না? একই প্রশ্ন বারবার করতে হচ্ছে কেন? আসল উত্তর হচ্ছে উনি খুব ভালো করে দেখেছেন এবং নিশ্চিত হয়েছেন “ধর্মনিরপেক্ষতা” শব্দটি মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী কোন ডকুমেন্টে ছিল না। উনার এই প্রাজ্ঞতা দিয়ে উনি উনার মেধাহীন অতিথিদের ন্যাংটা করে দিয়ে মজা নেন আর মুচকি মুচকি হাসেন। উনার অতিথিদের জ্ঞানের বহর এমন যে এতদিনেও কেউ উনার মজা নেয়াটা বন্ধ করতে পারলো না। বন্ধুবর মাসুদ রানার সাথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে আলোচনার একটা পর্যায়ে, এই বিষয়ে আলোচনা হয়। সেই আলোচনা মাসুদ রানার অসাম্প্রদায়িকতা শিরোনামের একটি লেখায় গ্রথিত ছিল। এবার সেই লেখা থেকেই জবাবটা দিচ্ছি।
মুক্তিযুদ্ধ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়টি ব্যাখ্যার জন্যে ‘প্রিন্সিপল অফ ইনভেলিডেশন এ্যাণ্ড জাস্টিফিকেশন' - অর্থাৎ বাতিলায়ণ ও ন্যায্যায়ণ নীতির দ্বান্দ্বিক ক্রিয়া বুঝা প্রয়োজন।
ঐতিহাসিকভাবে প্রতিটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার ‘আণ্ডারপিনিং' বা টিকিয়ে রাখার সমর্থনে ক্রিয়াশীল থাকে একটি আদর্শবাদ। প্রতিষ্ঠিত সেই রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিস্থাপনের জন্য প্রয়োজন হয় তার পক্ষের আদর্শবাদটির ‘ইনভেলিডেশন' বা বাতিলায়ণ। কিন্তু এই বাতিলায়ণ সম্ভব হয় না, যদি-না একটি বিকল্প প্রস্তাবিত ব্যবস্থার ‘জাস্টিফিকেশন' বা ন্যায্যায়ণ প্রতিষ্ঠা করা যায়।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো হিন্দু-মুসলিম দ্বিজাতি তত্ত্বের দ্বারা অভিন্ন ভারতীয় জাতি তত্ত্বের বাতিলায়ণের মাধ্যমে। মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ্র দ্বিজাতি তত্ত্ব অভিন্ন ভারত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বৈধতাকে বাতিল করে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ন্যায্যতা এনে দিয়েছিলো। দ্বিজাতি তত্ত্বের আদর্শ ছাড়া ভারত বিভাগ সম্ভব ছিলো না।
আমরা পরবর্তীতে দেখি, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য পূর্ব-বাংলার প্রয়োজন ছিলো দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবিকৃত তথাকথিত মুসলিম সাম্যের বৈধতার বাতিলায়ণ। বাঙালীকে তাই পাকিস্তানের আদর্শিক ভিত্তিমূলে - অর্থাৎ, ধর্মবাদের উপর -আঘাত করতে হয়েছিলো ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ দিয়ে। সেখানে ‘ধর্মনিরপেক্ষ' শব্দটি উচ্চারিত হয়েছিলো কি-না সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়।
আমাদের বুঝার জন্য প্রয়োজন যে, পূর্ব-বাংলার মানুষ তাঁদের ধর্মীয় পরিচয়কে রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি হিসেবে বাতিল করে জনজাতিক পরিচয়ের ন্যায্যতাদায়ী যে-আদর্শবাদের জন্ম দিয়েছিলেন, তা ছিলো ধর্মনিরপেক্ষ। যেহেতু ২৪ বছর আগে ধর্মীয় পক্ষপাতের ভিত্তিতে বাঙালী পাকিস্তান গড়েছিলো, তাই পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার জন্ম ছিলো অনিবার্য। ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা ছাড়া পাকিস্তান ভাঙ্গা সম্ভব ছিলো না।
আশা করি মুক্তিযুদ্ধ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার অবিচ্ছিন্নতার বিষয়টি এরপর কেউ জিল্লুর রহমান সাহেবকে বুঝিয়ে দেবেন এবং উনার স্যাডিস্টিক মুচকি হাসা বন্ধ হবে।