বসুমতী কটেজ পর্ব ১
ঝড় মনেহয় বেড়েছে। বিদ্যুৎ চমকের শব্দ কানের তালা ভাঙছে। মেঝেতে হালকা পানি। দরজা খোলা ছিলো, তখন ঢুকেছে। তোফায়েল খাবারের ঢাকনা গুলো সরিয়ে দেখল। ঠান্ডা হয়ে গেছে। অবশ্য এতে ওর কোন সমস্যা নেই। খাবার নিয়ে ওর বাছ-বিচার নেই। যা কিছু সামনে পেলেই হল। এমনিতেই ওর মনেহয় খাবার খাওয়া আর এটা নিয়ে ভাবা, সময় নষ্ট। পেটটা মোচড় দিয়ে উঠছে, এতক্ষণ পর ক্ষুধা জানান দিচ্ছে। বেঁচে থাকার জন্যই খাওয়া, নয়তো তোফায়েল খাবার ছুঁয়েও দেখতো না। প্লেটে খাবার নিয়ে গো-গ্রাসে গিলছে। ঠিক সেসময় দেখলো মেয়েটা চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বেরিয়ে আসছে। সর্টস আর টি-শার্টে মেয়েটাকে ভালোয় মানিয়েছে। আজ মনে হচ্ছে ওর সর্টসটা কেনা স্বার্থক। সঠিক স্থান পেয়েছে। তোফায়েল মেয়েটার মুখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখল- শ্যামা মেয়ে, এমন মেয়ে চোখে কাজল দিলে ভালো লাগে। মুখটা একটু লম্বাটে। চোখ গুলো স্বচ্ছ। তোফায়েল ঐ স্বচ্ছ চোখের ভেতর নিজেকে দেখতে পেল কি?
তোফায়েল মৃদু হেসে বলল- "আপনাকে ছাড়াই শুরু করেছি। খাবার নিয়ে আমার তেমন কোন সমস্যা নেই। যা কিছু সামনে পেলেই হলো। ক্ষুধা লাগলে মাথা ঠিক থাকে না। "
মেয়েটা মৃদু হেসে তোফায়েলের দিকে এগোতে এগোতে বলল- "সমস্যা নেই, আপনি খান। "
তোফায়েল একটা প্লেট এগিয়ে গিয়ে বলল- "আপনি চাইলে জয়েন করতে পারেন।"
ঠিক সেই মুহূর্তে কারেন্ট গেল। তোফায়েল বলে উঠলো- "এই যা।"
মেয়েটা বলল "এতক্ষন যায়নি কেন সেই চিন্তা করছিলাম। "
"এখানে কি সবসময় কারেন্ট যায়?"
"আকাশের কোণায় মেঘ দেখলেই। "
তোফায়েল চেয়ার ছেড়ে উঠলো। মেয়েটা উঠতে গেলে তোফায়েল নিষেধ করলো- "এই আপনি উঠবেন না, হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে দুর্নাম হবে আমার। "
মেয়েটা আবার বসে পড়ল।
"আপনার দুর্নাম দেই কীকরে! এই রকম ঝড়ের রাতে একা একটা মেয়েকে আশ্রয় দিয়েছেন, পরতে দিয়েছেন, আবার খেতেও বলছেন।"
"কিন্তু আপনি খাচ্ছেন না। "
"আমি তো খেয়েছি, বললাম না। এপাশের গ্রামে একটা বিয়ে ছিলো, খেয়ে ফিরতেই দেরী হয়ে গেল। গাড়িটা খাদে পড়ে গেল। তার উপর এমন ঝড় বৃষ্টি। আপনার বাড়িই ভরসা। দুর্নাম দেই কীকরে, যদি তাড়িয়ে দেন। "
"তাড়িয়ে দেব কেন? এমন ঝড়ের রাতে একজন সঙ্গী পেয়ে আমারও ভালো লাগছে।" তোফায়েল কিচেনে লাইটার খুঁজতে খুঁজতে বলল। ও সুতং কে দেখেছে, লাইটার রাখতে। লাইটারটা পেলে একটা ব্যবস্থা করা যাবে।
"এমনটা শুধু আপনাদের গল্প/উপন্যাসেই হয়।"
"এখন আপনার আমার গল্প চলছে।"
"তখন থেকে কী খুঁজছেন?"
"লাইটার, সুতং কে দেখেছিলাম এখানেই কোথাও রাখতে।" তোফায়েলের হাতে মুক্ত লেগে গেল যেন। লাইটার খুঁজতে গিয়ে মোম খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু লাইটারটা গেল কোথায়? এখানেই তো রেখেছিলো সুতং।
"সুতং! সেই পাহাড়ি বাঙালি লোকটা? ওর ওয়াইফ তো প্রেগনেন্ট।"
"হ্যা, সেখানেই তো গেছে।"
"বেচারা, চারটা বাচ্চা হয়ে মারা গেছে জানেন?"
লাইটার দিয়ে মোমটা জ্বালিয়ে তোফায়েল বলল- "আপনি এখানে কত দিন ধরে আছেন?"
"চার বছর। "
মোমটা টেবিলে রেখে আবার খেতে বসল তোফায়েল। বাহিরে তখনও ঝড়ের শো শো শব্দ শোনা যাচ্ছে আর বিদ্যুৎ চমকের ঝলকানি। মৃদু হেসে তোফায়েল বলল" চাইলে জয়েন করতে পারেন, সাথে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার হয়ে গেল। "
মৃদু হাসলো মেয়েটাও। হেসে বলল- সরি, আপনাকে একাই খেতে হচ্ছে। পেটে একদম জায়গা নেই বিশ্বাস করেন, থাকলে খেতাম। "
"ঠিক আছে, জোর করবো না। জোর করলে তো আবার বলবেন পুরুষতন্ত্র। নারীর মতের কোন মূল্য নেই।" একটু বিদ্রুপ হাসলো যেন তোফায়েল।
মেয়েটা তার থেকে বেশি হেসে বলল-
"আপনি কি নারী বিদ্বেষি?"
"তা নই, আমি নারীদের ঘর থেকে বেড়োতে নিষেধ করছি না। আমি বলছি যে নারীদের ঘরে বাঁধতে শিখো। "
মেয়েটা আর একটু বেশি হেসে-
"তা পুরুষ কে ঘরে বাধবে কীভাবে ?"
"যেভাবে পুরুষ বেধেছে। দেখুন- সমাধিকারে আসতে গেলে সমান সমান থাকতে হবে। ব্যংক থেকে বাস কোথাও রিজার্ভ সিট্ থাকবে না।"
"থাকলে সমস্যা কী?"
"সমস্যা কিছুই না। একজন নারীর সিটে একজন পুরুষ বসলে তাকে হেয়, প্রতিপন্ন হতে হয়। কোন মেয়ে বসে উঠলে তাকে সেই সিট ছেড়ে দিতেই হবে। কিন্তু কোন পুরুষ সিটে মানে মেয়েদের রিজার্ভ সিট ছাড়া অন্য কোন সিটে কোন মেয়ে বসলে তখন যদি কোন পুরুষ বসে ওঠে মেয়েটা কিন্তু সিট ছেড়ে দেয় না। এতে ছেলেরা ভাগে কম পাচ্ছে আর নারীরা অধিকারের নাম অগ্রাধিকার নিচ্ছে। সমতা থাকছে না।"
"বাসের সিট ছেড়ে দিলেই হবে? আর যে মেয়েরা লাঞ্চিত হচ্ছে, স্বামীর হাতে মার খাচ্ছে, ধর্ষিত হচ্ছে তার বেলা?"
"ক্রাইম আগেও হয়েছে, এখনও হচ্ছে। মার্ডার আগেও হয়েছে এখনো হচ্ছে। ধর্ষণ, লাঞ্চনা, বৌ পেটানো এসব ক্রাইম। একে নারীবাদিতায় টেনে লাভ নেই। নারীবাদিতায় থাকবে শুধুই নারীর অধিকার। একজন নারীর হাতে একজন পুরুষ খুন হলে কিংবা একজন পুরুষেদের হাতে পুরুষ খুন সেটা কিন্তু পুরুষবাদী হয় না। ওটা ক্রাইম। "
"তা নারীর অধিকারে গুলো কী কী? মানে নারীবাদিতায় কী কী থাকবে?"
"এই ধরুন- বিয়ের পর স্বামীর নাম কেন লাগাতে হবে? সে যদি না চায় লাগবে না। তার অনুমতি ব্যাতিত কেউ তার শরীরে হাত দিতে পারবে না, সে উলঙ্গ থাকলেও না। আবার ধরুণ- একটা সন্তান মানুষ করতে বাবার নাম কেন লাগবেই? একজন মায় তো সন্তান কে বড় করে। মোট কথা একজন পুরুষের যা রাইট আছে নারীর ও তাই থাকবে। সমান সমান। "
"বুলশিট। "মেয়েটা ব্যাঙ হেসে কণ্ঠে জোর দিয়ে বলল।
তোফায়েল হাসি ফেরত দিয়ে বলল-
"আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন?"
"রাগছি না। আপনার বুলশিট কথা আমার পছন্দ হচ্ছে না। "
"দেখুন- আপনারা যাদের কথা বলছেন, তাদের কানে কি আপনাদের আওয়াজ পৌঁছাচ্ছে? আপনি কোন নিম্নবিত্ত ঘরে গিয়ে দেখবেন বৌ পেটাচ্ছে। আপনি প্রতিবাদ করে রুখে দাঁড়াবেন তখন মেয়েটাই বলবে 'আমার স্বামী আমাকে মারছে আপনি কেন বাধা দিতে আসছেন। ' অর্থের মুক্তি না হলে বোধেরও মুক্তি হয় না।"
"আপনি যাদের কথা বলছেন আমি কিন্তু চার বছর ধরে তাদের সাথেই কাজ করছি। আর নারীর অর্থের মুক্তিই আমরা প্রথম চাই।"
"আমি তো নিষেধ করছি না।"
"আপনি নিষেধ করলেই যেন শুনবে? তবে যে বললেন পুরুষ কে ঘরে বাঁধতে শিখতে হবে। "
" না আমি নিষেধ করল শুনবে না। পুরুষদের ঘরে বাধা শিখতে হবে বলতে আমি বুঝিয়েছি…. দেখুন- একটা মেয়ে ২০ হাজার টাকা স্যালারি পেলেই স্বাবলম্বী হয় কিন্তু বিয়ে করার সময় সেই পঞ্চাশ হাজার টাকা সেলারি পাওয়া ছেলেই খোঁজে, 10000 টাকা বা 15000 টাকা সেলারি পাওয়া ছেলে না, আর বেকার হলে তো কথাই নেই। আবার একটা ছেলে 20000 টাকা স্যালারি পেলেই আপনাদের ভাষায় যাকে বলে 1 টা গৃহপালিত মেয়েকে নির্দ্বিধায় বিয়ে করে ফেলে।
" তসলিমা নাসরিন রুদ্রকে বিয়ে করার সময় বেকার জেনেই করেছিল, আজকাল অনেক মেয়েরাই করে।"
" এক্সেপশন কে এক্সাম্পল হিসাবে ধরতে পারেন না।"
তোফায়েলের খাওয়া অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে, তর্ক চালিয়ে যাওয়ার জন্যই বসে আছে। এসব তর্ক কেবল করার জন্যই করা। তোফায়েল নিজেও জানেনা সে যা ভাবছে আসলেই তা সঠিক কিনা। আসলে বাস্তবায়ন করার আগে প্লানের ভুল চোখে পড়েনা, বাস্তবায়নের সময় দেখা যায় প্লানে কত ভুল ছিল। আর এটা তো সমাজতান্ত্রিক বিষয় আরও জটিল, তার সাথে জটিলতর মনস্তাত্ত্বিক ও জড়িয়ে আছে।
" এক্সেপশন কে এক্সাম্পল ধরেই তো আমরা এগোয়। একটা মেয়ে এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছে এক্সেপশন, কিন্তু ঐটাই তো মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার এক্সাম্পল।"
" আমার খাওয়া কিন্তু শেষ। এক্সেপশন হিসেবে এতক্ষণ বসে ছিলাম আপনার সাথে কথা বলার জন্য, এক্সাম্পলস হিসাবে এই কথা আপনার হাজবেন্ড কে বলতে পারেন। "
" ভালো কথা, ভুলেই গেছিলাম। আপনার ফোন টা পাওয়া যাবে! একটা ফোন করতে হবে"
"কেউ অপেক্ষায় আছে নাকি?" চোখের পাতা বাঁকা করে তোফায়েল জানতে চায়।
" না তা নয়। আসলে অফিসে ফোন করে বলতে হবে কাল দেরিতে যাব, আমার ফোনটা গাড়িতেই ফেলে এসেছি।"
তোফায়েল মোমটা নিয়ে বলে- "তার জন্যতো রুমে যেতে হবে, ফোনটা রুমে আছে।"
বল তোফায়েল রুমের দিকে এগোয়, পেছনে পেছনে মেয়েটা।