‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে বৈশাখ মাসে তার হাটু জল থাকে’। নদীর প্রতি আমাদের ভালবাসা অনন্ত কালের। নদীমাতৃক আমাদের এই বাংলাদেশের বিশাল জনসংখ্যাকে বাঁচিয়ে রেখেছে নদীগুলি। এই নদীগুলিকে উপর নির্ভর করে নানান পেশার মানুষ বেচে আছে। অর্থনৈতিক দূরবস্থা কিংবা প্রকৃত মুল্যবোধের অভাবের কারনে আমরা আমাদের এই নদীগুলির পরিচর্য্যা করতে ব্যার্থ হয়েছি। এই অবস্থা থেকে যে আমরা সহজে মুক্তি পাব তারও কোন ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছি না। কলকারখানা বেড়েছে – তার বর্জ্য ফেল কোথায়(?)- নদীতে, শহরের ময়লা আবর্জনা ফেল কোথায়(?) – নদীতে। এত কিছুর পরেও আমরা চুপ করে কেন থাকি জানি না। হয়ত অনিয়ম নিয়ম দেখতে দেখতে আমরা অভ্যস্থ হয়ে গেছি। এই লাইনটা লিখতে গিয়ে মনে আশংকা হচ্ছে – তবে কি তিতাসের ফাঁসির পর অন্যসব নদীর গলায় দড়ি দেখতে দেখতে আমরা অভ্যস্থ হয়ে যাব!
ব্লগে কিছুদিন আগে তিতাস নিয়ে একটি চমৎকার পোষ্টের পর আর বেশি কিছু বলার থাকে না। কিন্তু নদী ও নৌকার প্রতি আমার ভালবাসার কারনে সামান্য খোজ খবর নেবার তাগিদ অনুভব করলাম। অজানা কিছু চমৎকার তথ্যও পেলাম। যেমন মেঘনা থেকেই তিতাসের উৎপত্তি আবার মেঘনাতেই এসে শেষ হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর থানার চাতলপুরে মেঘনার কোলে জন্ম নিয়েছে তিতাস। এর পর পূর্ব মুখে প্রবাহিত হয়ে চান্দোরা গ্রামের উত্তরে-পশ্চিমে-দক্ষিণ মুখে অগ্রসর হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের দক্ষিণ-পূর্ব মুখে প্রবাহিত হয়ে আখাউড়া রেল জংশনের দক্ষিণে পশ্চিম-উত্তর মুখে গিয়ে নবীনগরের পশ্চিমে লালপুরের কাছে আবার মেঘনায় কোলেই ফিরে গেছে সে। নদীটি ইংরেজী বর্ণ এম (m) আকার প্রবাহিত হচ্ছে। চাতলপুর থেকে লালপুরের দূরত্ব ১৬ মাইল হলেও সমগ্র নদীটি প্রায় ১২৫ মাইল দীর্ঘ।
আবহমান গ্রামবাংলার শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে রয়েছে নদীর নিবিড় প্রভাব। ভাটি অঞ্চল খ্যাত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নানান লোকজ ক্রীড়ার মধ্যে বেশীর ভাগই এই নদীকে ঘিরে। এমনই একটি লোকজ ক্রীড়ার নাম নৌকাবাইচ। ঐতিহ্যবাহি তিতাস নদীতে প্রতি বছর নৌকা বাইচ উৎসবে মেতে উঠে এলাকার প্রায় লাখো মানুষ। বাদ্য যন্ত্রের তালে তালে মাঝিদের ভাটিয়ালী গান আর পানিতে বৈঠার ফেলার শব্দ যেন একাকার হয়ে উঠে তিতাস নদীর পাড়ের মানুষেরা। নীরব নিস্তব্দ তিতাস পাড় হয়ে উঠে হাজার হাজার মানুষের কোলাহলে মুখরিত।
অতি প্রাচীন এই তিতাস নদীর নামে ‘তিতাস গ্যাস’ নামকরণ করা হয়। মানুষের জীবন যাত্রা ও ভূমি গঠনে এ নদীর বিশেষ প্রভাব রয়েছে। তিতাস নদীর ধারা যদিও পরিবর্তিত হয়েছে একাধিকাবার। তথাপি এর বিভিন্ন উপ-শাখা নদী সহজেই মানুষের চোখে পড়ে। জেলার নদী-তীরবর্তী এলাকাগুলোর মাঝে মাঝেই জেলে সম্প্রদায়ের বাস। তাদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন মৎস্য শিকার করা। তাছাড়া কৃষকেরাও নিজেদের খাদ্যের জন্য তিতাস থেকে মাছ ধরেন। এই নদীএ বাধের কারনে মাছেদের স্বাভাবিক উৎপাদন ব্যাহত হবারই কথা। লিখতে লিখতে চোখের সামনে ভেসে আসছে জেলে পাড়ার মাঝিদের ব্যথিত মুখমন্ডল। তাদের দুঃখিত পরিবারের ছবিসব।
কেন এই বাঁধ (??)। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক ও জনপথের তথ্য অনুযায়ি বাংলাদেশ ও ভারতের চুক্তি মতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে পালাটানা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের এই ভারী যন্ত্রাংশ নৌপথে বাংলাদেশের আশুগঞ্জ নৌবন্দরে আনা হয়। সেখান থেকে সড়ক পথে আখাউড়া হয়ে ত্রিপুরার পালাটায় যায়। ভারতের আসাম বেঙ্গল কেরিয়ার (এবিসি) পালাটানা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভারী যন্ত্রাংশ পরিবহন করছে। এই পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশের কোন সেতু ব্যবহার করতে পারবে না বলে চুক্তিতে উল্লেখ আছে। এই কারণে ভারতের তত্ত্ববধানে সেতুর পাশে নদীর উপর বিকল্প সড়ক তৈরী করা হয়। পানির প্রবাহ ঠিক রাখার জন্য রাস্তার নীচ দিয়ে কংক্রীটের পাইপ বসানো হয় যাদের ব্যাস ৩ ফুট। নদীর মধ্যে দিয়ে বানানো রাস্তার নীচে ৩ ফুট ব্যাসের কয়েকটি কংক্রীটের পাইপ কখনওই নদীর স্বাভাবিক চ্যানেলের বিকল্প হতে পারেনা’।
তিতাস এখন একটি খুন হয়ে যাওয়া নদীর নাম। মাসির দেশকে ট্রানজিট দিতে গিয়ে বাংলাদেশের নতজানু শাসকশ্রেণী বহু আগেই তাকে হত্যা কার্য্য শুরু করেছে। ট্রানজিটের শুরুতেই নদী হত্যা, কৃষি জমি ধ্বংস, কৃষিকাজ, মৎস চাষ সহ গোটা এলাকার জনগণের জীবন ও পরিবেশ ধ্বংসকে আমরা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছি না। প্রতিবেশিদের সাথে আমরা সুসম্পর্ক বজায়া রাখার পক্ষে। তাই বলে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে নিশ্চয়ই নয়! তাছাড়া ভারতইবা কেমন রাষ্ট্র যে কিনা বন্ধু প্রতিবেশি রাষ্ট্রের এত বড় ক্ষতিকে সমর্থন করছে! প্রকৃতিকে আঘাত করলে তা সইবে না। তাই এর আশু সমাধান চাই। এই বাঁধ তুলে আমার তিতাসকে মুক্ত করা হোক। এক্ষুনই।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১১ সকাল ১০:৩৪