somewhere in... blog

ঝড়ের খোঁজে, স্রষ্টার খোঁজে...! ০১

২৫ শে অক্টোবর, ২০০৭ রাত ১১:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দেশে থাকতে স্রষ্টা সম্পর্কিত দুই ধরনের মানুষ হয় জানতাম- স্রষ্টায় বিশ্বাসী-আস্তিক এবং স্রষ্টায় অবিশ্বাসী-নাস্তিক। আমেরিকায় এসে আরও এক ধরনের মানুষের সাথে পরিচয় হল, যারা প্রমাণসাপেক্ষে স্রষ্টায় বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করতে চায় এবং এদের সংখ্যাই আমেরিকায় মনে হল বেশী। নিজেদের এরা বলে agnostic.

এগনস্টিক-এর বাংলা কি, নিশ্চিত জানি না, সংশয়বাদী? বাংলা চেয়ার, টেবিল-এর মত ইংরেজীর সাথে মিলিয়ে আমি এদের বাংলায় ডাকি অগনাস্তিক । আমার তো ধারণা বাংলাদেশের বেশীরভাগ মানুষই এই ক্যাটাগরির (অন্য অর্থে-আস্তিকও না, নাস্তিকও না টাইপের)। স্রষ্টা আছে বলে সত্যিই যদি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করত, তবে কি দেশে এত দুর্নীতি হত! স্রষ্টা থাকলেও থাকতে পারে এইভেবে বেহেশতটা যেন ফস্কে না যায়, সেজন্যই মনে হয় দুর্নীতির পাশাপাশি জোর-কদমে নামাজ-রোজাও চলে।

তা যাই হোক, বিগত চার বছর আমার অফিসমেট যে ছিল, সেই জেফ-ও একজন অগনাস্তিক। জেফের মা ইহুদি, বাপ প্রটেস্টট্যান্ট। আর সে কোন কিছুর ধার না ধেরে সবকিছু যুক্তি আর প্রমাণের উপরেই ছেড়ে দিয়েছে। তার কথা হল- আমি একজন বিজ্ঞানী, প্রমাণ ছাড়া আমি কিছু বিশ্বাস করতে পারি না, বিজ্ঞান আমাকে এটাই শিখিয়েছে। তুমি ঈশ্বর নাই প্রমাণ দাও, আমি নাস্তিক হব; তুমি ঈশ্বর আছে, প্রমাণ দাও, আস্তিক হব। যে পর্যন্ত না দিতে পারছ, আমি এর কোনটাই বিশ্বাস করব না।

জেফের সাথে আমার বন্ধুত্ব এবং এসব খেজুড়ে টাইপ আলাপ জমে ওঠে। এমনিতে আমেরিকার দক্ষিণের এই অংশ ‘বাইবেল বেল্ট’ নামে পরিচিত। তার ওপর আমি যে এলাকায় থাকতাম সেটা পরিচিত ছিল ‘বাকল অব দ্য বাইবেল বেল্ট’ নামে। এই বেল্ট-বাকলের মধ্যে বসে স্রষ্টার অস্তিত্ব নিয়ে আলাপ করা রীতিমত অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। এসব আলাপের সময় তাই আস্তে করে দরজাটা বন্ধ করে দিতাম।

জেফ আবহাওয়া বিজ্ঞানের ছাত্র। ক্যাম্পাসের সবচেয়ে উঁচু ভবনের ১২ তলার এই পুরো ফ্লোরটাই আবহাওয়া বিজ্ঞান গ্রুপের। আমি অন্য ডিপার্টমেন্ট-এর হলেও আমাকে এই গ্রুপের সাথে অফিস দেয়া হয়েছে, যেহেতু ঘূর্ণিঝড় নিয়ে কাজ করব এবং আমার এডভাইজার এই গ্রুপের বস। এখানে কাজ শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম এদের মধ্যে দুটো গ্রুপ রয়েছে। একটা আস্তিক এবং রক্ষণশীল- এদের বাইবেল স্টাডি হয়, এরা ক্যাম্পাস মিনিস্ট্রর সদস্য এবং নাস্তিক বা অন্য ধর্মাবলম্বীদের এরা তেমন পছন্দ করে না। আর বাকীদের নিয়ে অন্য গ্রুপ- এরা খোলামেলা, ধর্ম নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নাই এবং বেশীরভাগই অগনাস্তিক । আমি একে বাদামী চামড়া (আমি ছাড়া আর কোন বাদামী নাই , তার ওপর মুসলিম, তারও ওপর অন্য ডিপার্টমেন্ট থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা- আমাকে প্রথম গ্রুপটা ভাল চোখে নিল না। তাই স্বাভাবিকভাবে আমি দ্বিতীয় গ্রুপে ভিড়ে গেলাম।

আসার দু’এক সপ্তাহ পরেই আমাদের অফিস সেক্রেটারী, যে আবার প্রথম গ্রুপের চ্যালা, আমাকে কিছু খ্রীস্টান ধর্মীয় বই পড়তে দিল। তার ধারণা, আমি যেহেতু বাংলাদেশ নামক একটি গরীব দেশ থেকে এসেছি, তাই আমার ধর্মও (ইসলাম ধর্ম) গরীব। আমেরিকা যেহেতু পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশ, তাই এর ধর্মও (খ্রীস্টান ধর্ম) উন্নত ও আধুনিক এবং এর চাইতে ভাল কোন ধর্ম পৃথিবীর আর কোথাও হতে পারে না। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য বাইবেল বেল্টের এসব ডাম্ব আমেরিকান এই রকমই বিশ্বাস করে। বুড়ি (সেক্রেটারী) অবশ্য দুইদিন পরেই বুঝতে পারল, ওর চাইতে আমি ওর ধর্ম সম্পর্কে বেশী জ্ঞান রাখি, তাই আর কখনো ঘাঁটাতে চেষ্টা করে নি। বরং, ২য় গ্রুপের কারো সাথে বুড়ির ভালো সম্পর্ক না থাকলেও আমার সাথে একটা ভালো রিলেশন গড়ে উঠল।

এইসব আভ্যন্তরীণ ব্যাপারগুলো বাদ দিলে আবহাওয়া বিজ্ঞান গ্রুপের বাকী কর্মকান্ডগুলো খুব মজার। সকাল থেকেই সবাই রাডার খুলে বসে থাকে কখন কোন ঝড় বা টর্নেডো দেখা যায়। রাডারে কিছু ধরা পড়লেই সবাই দল বেঁধে চেজ করতে বেরিয়ে পড়ে। সে এক দারুন উত্বেজনা- ঝড়ের পিছে ছুটে চলা। সবার মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকে কে কত ভালো ঝড়ের ছবি/ভিডিও তুলতে পারে। এদের আবার নিয়ম হল ঝড় দেখা গেলে চেজ করার জন্য অটোমেটিক সব ক্লাস বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আমার সব ক্লাস তো আর এদের সাথে না। তাই যখন আমার কোন কাজ থাকে না, তখন এদের সাথে আমিও যাই। যদিও দুর্গম রাস্তায় বেশীরভাগ সময় ভয়ে ভয়েই থাকি, পাগলদের পাল্লায় পড়ে কোন সময় ঝড়ের মধ্যে বেঘোরে প্রাণ হারাই। একবার তো শিলা-ঝড়ের কবলে পড়ে কোন রকমে বেঁচে গিয়েছিলাম।

জেফ একজন দারুণ স্টর্ম চেজার। ঝড় কোথায়, কোন দিক দিয়ে যাবে, সে ঠিক ঠিক অনুমান করতে পারে। তার খুব শখ বাংলাদেশে একদিন স্টর্ম চেইজ করবে। সে আমাকে একদিন হিসাব করে দেখাল, ঝড়ের সময় আমেরিকার আবহাওয়ায় যে পটেনশিয়াল এনার্জি (কেপ বলি আমরা- Convective Available Potential Energy (CAPE) থাকে, তারচেয়ে বাংলাদেশে ঝড়ের সময় আবহাওয়ার পটেনশিয়াল এনার্জি অনেক বেশি থাকে। বলতে গেলে বিস্ফোরণমুখ আবহাওয়া! এই এত এনার্জির ঝড়গুলো চেইজ করতে নিশ্চয়ই দারুণ এক্সাইটিং। জেফের চোখে-মুখে উত্বেজনা খেলা করে। তার খুব কৌতুহল- তোমাদের দেশে কি এখানকার মত গাড়ী নিয়ে ঝড় চেইজ করা যাবে? রাস্তাঘাট আছে? আমি বল্লাম, ভাল এসইউভি (জিপ গাড়ী) নিয়ে তো যে কোনখানেই যেত পার। তবে অনেক ধান ক্ষেত পাবা। ধান ক্ষেত দিয়ে গেলে পাবলিক ঠেঙ্গানি দেবে । সে বলল, ওকে। তুমি যখন তোমার দেশে হোমড়া-চোমড়া কেউ হয়ে যাবা, তখন আমাকে দাওয়াত দিও, আমি চেইজ করতে আসব বাংলাদেশে। তোমাদের ঝড়গুলা এখান থেকে দেখে মনে হচ্ছে অন্যরকম, আরো ভয়ংকর। আমি বল্লাম, হোমড়া-চোমড়া হব কি না জানি না, তবে একদিন তোমাকে নিয়ে যাব। আনমনা হয়ে বলি, ঝড় গুলো আসলেই অন্যরকম। অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাসও বের হয়ে আসে।

চিত্র-
ডানে টর্নেডো-র ছবি ক্রেস নামক একটা জায়গায়।
বামে- অত্যাধুনিক SMART-R মোবাইল রাডার। জেফ উপরে (নীল টি-শার্ট) রাডার এডজাস্ট করছে।
চিত্র সৌজন্য- ইয়ান জুমানকো।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০০৭ বিকাল ৪:২৮
২৮টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছাত্রদল - শিক্ষাঙ্গনের বর্তমান ত্রাস

লিখেছেন মেঠোপথ২৩, ১৪ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৪:৩৬

স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতনের পর কেবল ছাত্রলীগের রাজনীতি নিশিদ্ধ না করে দরকার ছিল শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতি নিশিদ্ধ করা। ইন্টারিম সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের কুফল ভোগ করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।ক্যম্পাসে ছাত্রলীগের অনুপস্থিতিতে সেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

গ্রামের গল্প অথবা মসজিদের হুজুর

লিখেছেন রাজীব নুর, ১৪ ই মে, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৬



আমাদের দেশের লোকজন মসজিদে খাবার দেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে থাকেন।
রমজান মাসে তো মসজিদে খাবার দেওয়ার জন্য পাল্লা-পাল্লি লেগে যায়। লম্বা লাইন। হুজুরদের সিডিউল পাওয়া যায় না। মসজিদে খাবার... ...বাকিটুকু পড়ুন

অন্ধ ভিখারি এবং রাজার গল্প....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ১৪ ই মে, ২০২৫ রাত ১০:২৬

অন্ধ ভিখারি এবং রাজার গল্প....

এক অন্ধ ভিখারি ভিক্ষা করতে করতে একদিন রাজপ্রাসাদে ঢুকে পড়লো। অন্ধ ভিখারিকে দেখে রাজার মনে দয়া হলো। রাজা মন্ত্রী-কে ডেকে বললেন-
"'এই ভিক্ষুক জন্মান্ধ নন, একে চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রক্তজবা ও গোলাপ

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ১৫ ই মে, ২০২৫ রাত ১২:৩৭

ভালোবাসার রূপান্তর

তোমার শহরে তুমি বসে আছো,
রক্তজবা হাতে…
আমার শহরে আমি,
একটি গোলাপের বাগান গড়ি—
লাল রঙে রাঙা, নিঃশব্দে ফুলে ভরে।

তুমি একদিন বলেছিলে,
রক্তজবা মানেই চিরন্তন ভালোবাসা,
তোমার অভিমানে লুকোনো ছিল রাগের আগুন,
তবু তার গভীরে ছিল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইহাকেই বলে আগবাড়িয়ে মাড়া খাওয়া

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৫ ই মে, ২০২৫ দুপুর ১২:৩৯


শিক্ষিত জঙ্গি মোদী ভোটের মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই হাসিনার মতো জঙ্গি নাটক সাজায়; দুজনের পার্থক্য হলো হাসিনা নিজদেশের জনগন হত্যা করে নিজদেশের জনগনকেই দোষ দেয় অপর দিকে মোদী নিজদেশের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×