স্বভাবতই সে এটুক চুপ চাপ থাকার নয়। হৈ-হুল্লুড় না করলে তার শান্তি বা নিস্তার নাই ভাবখানা যেন এমনই। অমিতের সাথেই তার যত কথা যত রাগ যত ঝগড়া। আজ অন্যান্য দিনের মতো নয় বলে আদিকে চেনার উপায় নাই। অমিতেরও অচেনা মনে হচ্ছিল।
কিরে বাচ্ছা হাতি তোর হলো কি আবার?
নাহ্ কিছু হয়নি।
তাহলে মুখ বানিয়ে বসে কেন?
এমনি।
মন খারাপ?
নাহ্ ।
মেজাজ খারপ?
নাহ্ ।
কথা বলতে ইচ্ছে করছে নাহ?
হুম। (অমিত চলে যাচ্ছি ঠিক তখন -) শুনো, একটা কথা রাখবে?
বল।
তুমি আর কখনও আমার সাথে দেখা করতে এসো না। আর আমার সাথে কথা বলারও দরকার নাই।
আচ্ছা ঠিক আছে।
- এমন পরিস্থিতি বা এইসব অমিতের জন্যে মোটেও নুতন নয়। আদির মন খারাপ হলেই এমন করে। আবার যখন ঠিক হয়ে যাবে ঠিকই অমিতের জন্য কোন ম্যাসেজ রেখে যাবে অগোচরে। পুরানো একটা ডায়েরীর পাতা উল্টাচ্ছে তখন চোখ আটকে গেল অমিতের একটা লেখায় -
“ নাহ্ কোন সম্বোধন নয়, আজ একটা গল্প বলব তোকে। আমার নিজের গল্প যা ঠিক গল্পের’ই মতো। হঠাৎ হঠাৎ দেখবি মানুষের ব্রেইন কাজ করে না। হ্যাঙ্গ হয়ে যায়। অবশ্য অটো-রিকাভারি সাথে ডিফ্যল্ট রিসেটের আর রির্স্টা টের ব্যবস্থা আছে। যদি বিধাতা এই ব্যবস্থা করে না দিতেন কেমন হতো একবার ভেবে দেখ তো। যাই হোক, যা বলছি। খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছি কক্সবাজার যাব তাই। শীতে মোটামুটি হাড্ডি সহ কাঁপছে, কুয়াশায় দু’হাত দূরে দেখা যায় না এমন অবস্থা। রাতে বাবা’ই আমার ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিল। কারণ বাবা জানতই আমার দূর যাত্রায় সাথে কি কি নিতে হয়। শীতকাল তবুও এসি বাসের টিকেট করা ছিল তাও ছিল বাবার কাজ, কারণ হিসাবে ব্যাখ্যা দিলেন রাস্তায় ধুলো বালি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। কাক-ডাকা ভোরে যাত্রা শুরু করলাম। দামপাড়ার বাস কাউন্টারে যখন পৌছায় তখন সকাল সাত’টা। বাস ছাড়বে আট’টায়, এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন কাজ নাই। হকারের হাক-ডাক, ভিক্ষুকের আহজারী, যান্ত্রিক শহরের জাগরণ দেখছি বসে কালো কাঁচে ঘেরা বাস কাউন্টার থেকে। সবকটা বসার জায়গাতেই মানুষ। কি জানি কে কোথায় যাবে। আর আমার জানার’ই বা কি দরকার। ঠিক তখন’ই একটু নড়ে বসতে হলো যখন মায়াবতী দৃষ্টি নিয়ে আমার অবাক হয়ে শহুরে জাগরণ দেখায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে বলল একটু জায়গা দিন বসি। আমি কিছু না বলে একটু সরে বসলাম এবং আবার মগ্ন হলাম যান্ত্রিক জাগরণের মুগ্ধতায়। আবারও নড়ে বসতে হলো -
আপনি কি কক্সবাজার যাবেন?
হুম।
একা নাকি সাথে কেউ আছে?
নাহ একা নাহ্ সাথে আপনি আছেন।
কি আর্শ্চয আপনি কি করে বুঝলেন আমিও কক্সবাজার যাচ্ছি?
আপনি’ই বলেছেন।
কবে?
কাউন্টারে ঢুকে কি কি বলেছেন মনে করুন টের পেয়ে যাবেন।
আমি যখন ঢুকলাম কাউন্টারে তখন তো দেখলাম আপনি হা করে বাইরে তাকিয়ে আছেন।
জ্বি ঐ হা দিয়ে আপনি কি কি বলেছেন সব ঢুকে গেছে।
তাহলে খুব অবাক হওয়ার ভান করলেন কেন?
কারণ মায়াবতীরা অবাক হতে পছন্দ করে, তাই।
বুঝলাম না।
সাধারণ একটা ধারণা আপনাকে যে কেউ দেখলেই বলে আপনাকে দেখতে খুবই মায়বতী মনে হয়, যদিওবা কথাটা মোটেও আপনার কাছে নুতন নয় তাও আপনি অবাক হয়ে যান। আমি কি সত্যি বললাম?
ভেরি ফানি। বুঝলেন কি করে?
- কথা থামিয়ে দিতে হলো কারণ বাস কন্ট্রাক্টর ডাক দিয়েছে আট’টার প্যাসেন্জাররা চলে আসুন। ৩৬ আসনের বাস হলেও দেখা গেল যাত্রি সব মিলায়ে ১৪ কি ১৫ জন। হয়তো সামনে আরো স্টপিস আছে। বাস জিইসি’র মোড় পার হওয়ার পর দেখি মায়াবতী এসে আমার পাশের আসনে বসল। মুখ যদ্দুর চওড়া করা যায় এমন একটা হাসি দিলাম যেন আমি অনেক খুশি সে আসায় আমিও এমন কিছুর জন্যে অপেক্ষা করছিলাম ভাবখানা ছিল তখন এমন।
কিছু মনে করেননি তো আবার?
কেন?
এইযে আবার এলাম আপনাকে বিরক্ত করতে?
মায়াবতীরা চাইলেও বিরক্ত করতে পারে না। তারা পারে মায়াতে বেঁধে ফেলতে।
আপনি অনেক মজা করেই কথা বলেন। যাই হোক, আমি ইরা - (হাত বাড়িয়ে দেয়)
(হাত মিলায়ে বললাম) আমি অমিত। নিশ্চয় বেড়াতে যাচ্ছেন না?
- কথাটা শুনতেই চুপ হয়ে গেল। মুখের রং ও খানিটা মনে হচ্ছে বদলে গেল। ততক্ষণে ছোট ছোট জ্যাম পাড় হয়ে এসে পড়েছি নুতন ব্রীজের কাছে। হঠাৎ এমন ভাবে আমার নাম ধরে ডাকল যেন অামার অনেক দিনের চেনা।
অমিত। একটা কথা বলি? ( না খেমেই বলল) যদি তুমি করে বলি কিছু মনে করবে না তো?
ইরা, মায়া’র কোন ব্যাকরণ নেই। তাই তুই করে বললেও আমি কিছু মনে করবো না। - মনে হলো ইরা কিছুটা সহজ হতে চেষ্টা করছে, তাই আরো সহজ হতে একটু সাহায্য করলাম আমিও ‘তুমি’ তে নেমে গিয়ে - কই বললে না তো তুমি কোথায় যাচ্ছ।
যাচ্ছি আমার এক দুসম্পর্কের বড় বোন আছে তার কাছে। আমি আসলে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।
কেন ? পালিয়ে বেড়াচ্ছ কেন?
সে অনেক বিশাল গল্প। অত ধৈর্য্য তোমার হবে না শুনার জন্যে।
গাড়ী যতক্ষণ চলছে ততক্ষণতো শুনতে পারবো বলে ফেল - ( আমি অবাক হয়ে ইরা’কে দেখছি, মনে হচ্ছে না তার কোন কথাই শুনতে পাচ্ছি) তার পুরো জীবনের ছোট গল্পটা তোকে সংক্ষেপেই লিখি -
“তার প্রথম ঠিকানা ছিল রাজবাড়ী জেলায়। ইরার বয়স তখন তিন কি চার হবে তার বাবা রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। তাকে কোলে করে তার মা ফিরে আসে ইরার মামার বাড়ী। খুব সম্ভব একই বছরই হবে আবার নুতন একটা বিয়ে হয় ইরার মা’র। বুঝাপড়ায় ইরারও ঠিকানা হয় নুতন বাবার সাথে। সেখানেই তার বেড়ে উঠা। ইস্কুলে গন্ডি পেরুবার সময় কি যেন হলো এক ঝড় বৃষ্টির সন্ধ্যা তার মা’ও চলে যায় তাকে একা করে। ইরার সৎ বাবা ছাড়া আর কেউ রইল না। নানা-নানী না থাকায় তিন মামার কেউ’ই ইরার দায়িত্ব নিতে সরাসরি অপারগতা দেখায়। সৎ বাবা মানুষ ভাল, তার লেখাপড়া যেন থেমে না যায় সে দিকে কড়া নজর। উৎসাহের কমতি নাই। ইরার মা মারা যাওয়ার পর পারিবারিক প্রয়োজনে সৎবাবাকে আবার বিয়ে করতে হয়। সেই সৎমা ভাল ছিলেন না। ইরা’কে তিনি সহ্য করতে পারতেন না। কেন এমন হতো তার কোন কারণ জানা নাই। সেই সৎমার দু’টা জমজ বাচ্ছা হলো। ইরা্’ই বলতে গেলে তাদের সব দায়িত্ব পালন করছিল। ইরা তখন ইউনির্ভাসিটি’র ছাত্রী, সাংবাদিকতা এবং যোগাযোগ- এ পড়াশুনা করছে। সে স্বপ্ন দেখতো সৎ মা’টা যেমনই হোক সৎবাবার সব কষ্ট সে নিজের কাঁধে তুলে নিবে। এই মানুষটাকে বিশ্রাম দিবে, তার যখন যাই দরকার হয় তা যেন হাতের কাছে পায় এমন ব্যবস্থা করবে।
চকরিয়ার কিছু পর গাড়ি যাত্রা বিরতি করল। সবাই নামল যে যার মত একটু কিছু খাবে বা বিশ্রাম করবে। খুব সাধারণত আমি যা করি ফ্রেশ হয়ে একটা চা নিই সাথে সিগারেট। আজ তার ব্যতিক্রম হলো। সৌজন্যতায় বা অকারণে ইরা’কে বলে বসলাম -
তোমায় দেখে মনে হচ্ছে রাতে কিছু খাওনি। কিছু খাওয়া যাক চলো। - প্রথম না না করলেও অগত্য গেল। তারই পছন্দের পরটা আর কলিজ্বা ভুনা নেওয়া হলো। ইরা খাচ্ছে আর আমি মোহ মুগ্ধ হয়ে দেখছি। কেন জানি আমার খুব খুশি হচ্ছে তার খাওয়া দেখে। বিল দিয়ে বেরিয়ে এলাম। বাইরে দু’টা দোলনা আছে বসার মতো। একটায় গিয়ে বসতে বসতে বললাম -
ইরা তুমি গাড়িতে যাও, আমি সিগারেট খাব এখানে।
নাহ। আমি তোমার পাশে বসবো। আচ্ছ আমায় বিল দিতে দিলেনা কেন?
কোন কাজ কার সেটা আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে থাকে বলেই মানুষ ইচ্ছে করলে সবকিছু করতে পারে না। হুম এ কাজটা ধরে নিতে পার তোমার জন্যে কোন গিফট।
কি উপলক্ষে গিফট?
এই ধর তোমার জন্মদিন উপলক্ষে।
- ফিরে যাই এখন আবার তার গল্পে।
ইরার মা’র মতো কোন কারণ ছাড়াই একদিন তাকে একা করে চলে যায় তার সৎবাবা। দুর্যোগের মেঘ ইরার আকাশে জমতে থাকে। সৎমা আর তার দুই বাচ্ছা’কে নিয়ে শুরু হয় ইরার নুতন সংগ্রাম। তারপরও সৎমা তার কিছুই সহ্য করতে পারে না। নানান সময় জঘন্য সব কথা বলে। একদিন সেই সৎমা’র এক ভাই এলো। তার নজর কেমন জানি ছিল ইরার প্রতি। সেই ভাই’ই একদিন এমন এক প্রস্থাব দেয় যা শুনে ইরার ঘা ঘুলিয়ে যায়্। সেই থেকেই শুরু ইরার পলাতক জীবনের।”
ওহ তোকে তো বলিনি কক্সবাজার আমার সাথে যুক্ত হয়েছিল আরও চার বন্ধু। একজন ছিল টাঙ্গাইল থেকে, দুজন ঢাকা থেকে, একজন সাতকানিয়া’র। ছয়দিন ছিলাম। একদির ইরার বোনের বাড়িতে দাওয়াতেও গিয়েছিলাম সবাই। ঢাকার এক বন্ধু তার জন্যে একটা নিরাপদ আশ্রয় আর কাজের ব্যবস্থা করেছিল আমার পীড়াপিড়িতে।
একদিন কুরিয়ার অফিস থেকে ফোন এলো আমার কি ডকুমেন্ট এসছে। ইরার লেখা -
“অমিত, ইরার কথা মনে আছে? নিশ্চয় ভূলে গিয়েছো। আমি যখন দিনরাত্রি আমার জীবন নিয়ে অন্ধকারে হাতরে হাতরে পথ চলছিলাম ঠিক এক সকালে তুমি এসেছিলে আলো হয়ে। না না জোনাকির আলো হয়ে। আজ আমার সেই জোনাকি চাই। যে আমারই থাকবে, সব সময় আমায় পথ দেখাবে তার আলোতে। সে জোনাকি দিও আমায়। মনে আছে তোমার আমায় জন্মদিনের উপহার দিয়েছিলে খাবারের বিল দিয়ে। সেদিন বা আর আগে আমার জন্মদিন ছিল না। আজ আমার জন্মদিন তাই আজ আমার জোনাকি উপহার চাই।”
চারদিন আগে ছিল ইরার জন্মদিন। নিশ্চয় তোর এখন জানতে ইচ্ছে করছে তাকে কি আমি জোনাকি উপহার দিয়েছিলাম কি না।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুন, ২০১৬ সকাল ৯:২৪