রচনা – কামরুন্নাহার রুনু।
অলংকরণ, অনুলিখন ও পরিমার্জন – শ্রাবণ আহমেদ হিমু।
পায়ের চাপে শুকনো পাতাগুলো এতই শব্দ করছে মড়মড় করে নীরা’র মনে হলো এতো ভয়ঙ্কর শব্দ সে আর কখনও শুনেনি। ঘুটঘুটে অন্ধকার, অমানিশার তিথি। তারপরও দুরূদুরূ মনে ঘরের দিকে পা বাড়ায়।
-সন্ধ্যা ঘনিয়ে গেল, এখনো ঘরে ফেরার নাম নাই। তোমার মেয়ে বলেই এমন। - একা একা গজগজ করতে করতে নীরা’র বাবা আমজাদ রহমান স্ত্রী’র উদ্দ্যেশে বলে যায়। রৌশনারা মানে নীরা’র মা রোজই শুনে এমন সব কথা আর এটাও জানে এসব কথায় নীরা’র কোন পরিবর্তন হওয়ার নয়। তাই চুপ থাকাই বুদ্ধির কাজ।
-নীরা’র মা একটু শুনে যাও তো। - রৌশনারা চুপ করে এসে দাড়ায়।
-হুম। বলো কি কথা।
-এতো ব্যস্ত হচ্ছো কেন?
-ঠিক আছে ব্যস্ত হবো না, এসো একসাথে বাকি কাজ সারতে সারতে তোমার কথা শুনি। - স্ত্রীর কথায় আমজাদ রহমান কিছুটা বিচলিত হলো বটে হাল ছাড়লো না।
-যে জন্যে তোমায় ডাকলাম, চিন্তা করছি মেয়েটা একটা ব্যবস্থা করতে হয়। মানে দেখে শুনে যদি কোন ভালো সম্বন্ধ করে ফেলা যায় খারাপ কি? তোমার কি অভিমত?
-তোমার কথা শুনে মন হচ্ছে কি তোমার মাথায় গণ্ডগোল হয়েছে। মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলো শুনলে গায়ে কাঁটা দেয়। বছর পনের বয়েসের মেয়ে এটা কি কোন বিয়ের বয়েস? আর কোন কথা আছে? আমার কাজ পড়ে আছে গেলাম। -আমজাদ রহমান অসহায় দৃষ্টিতে স্ত্রীর যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইলো।
দরজায় পা রাখতেই নীরা দেখলো তার বাবা বৈঠকঘরে, কি যেন দেখছে ক্যালেন্ডারে। একদৌড়ে পিছন থেকেই বাবা’কে জড়িয়ে ধরলো।
-আরে হলো’টা কি? ছাড় তো দেখি।
-নাহ্ ছাড়বো না। আগে বলো তুমি আমার উপর রেগে নাই।
-আচ্ছা বাবা যা রাগ নাই এখন তো ছাড়। শুন্ মা’ তুই এখন আর সেই ছোট্টটি নেই। যাদের সাথে খেলাধুলা করছিস তারা তোর অনেক ছোট। তোর কি এখন আর সেই খেলাধুলার বয়েস আছে, বল মা? তুই এখন বড় হয়েছিস। ক’দিন পর তোর একটা ব্যবস্থা করতে হবে ধুমধাম করে। আর তুই যদি এমন চলাফেরা করিস তো মানুষজন কি বলবে, বল?
-উহু, বাবা তুমি তো জানোই না, আমরা সবাই মিলে নদীর ওপারের ঐ দূরের পাহাড়ের গায়ে লুকানো তিশি ক্ষেতে গিয়েছিলাম, তারই পাশে ছিল আখ ক্ষেত, ওফ্ বাবা তোমায় বলে বিশ্বাস করানো যাবে না, যা ভালো লাগে ঐখানে। কাল তুমিও যাবে আমাদের সাথে। - আমজাদ রহমান অবাক হয় মেয়ের এই ছেলেমিপণায়। অপলক নয়নে তাকিয়ে দেখে মেয়ের হইহুল্লোড় করে যাওয়া।
কালের পক্রিমায় একদিন বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় নীরা’কে। ডানপিটে নীরা’র আর খেলা হয় না লুকানো আপন ভাবনাগুলোকে নিয়ে ঐ দূর পাহাড়ের গায়ে, খোলা চুলে এলোমেলো হাওয়ায় ঐ নদীর ওপারের মনের রঙ মিশানো আপন বলয়ে হয়না আর দৌড়াদৌড়ি।লম্বা আখ হাতে খেতে খেতে জমির আইল ধরে আর হাটা হয়না। অমিতের সাথে বিয়ে হয় নীরার।
অমিত’রা শহুরে মানুষ হলেও সাম্যিক মানবিকতা থেকে অতটা দুরে নয় যে যার জন্যে মানুষের মনের আকুঁতি বুঝতে পারবেনা। নীরার কাছে এসে অমিত যেটুক বুঝলো হয়তো বিয়ে, সংসার এসব কিছুই নীরার স্বপ্নের দুনিয়ার বাইরের। কথাবার্তায় সময় কাটে। অমিত কোন কিছুতেই নীরাকে জোর-জবরদস্তী করে না। উন্মুখ হয়ে মুখোমুখি বসে নীরার গল্প শুনে অমিত।
নীরা কাউকে বুঝাতে পারে না তার কষ্ট। অচেনা শহুরে পরিবেশ যেন দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম, এই সংসার জীবন তার মনে হচ্ছে যেন কোন বন্দীশালা, কিছুই তার ভাল লাগে না। সবার অলক্ষ্যে একদিন ঠিক’ই নীরা ফিরে যায় তার চির চেনা সেই সবুজঘেরা ভূবনে, যেখানে পাহাড়ের কোল ঘেষে বয়ে গেছে নদী। মন থেকে বিদায় জানাতে উম্মুখ হয় সেই ইট-পাথরের দালান কোটার শহরকে, সেই পিচ্ ঢালা রাস্তাকে। অমিতের জন্যে এটুক লিখে একটা চিরকুট ছেড়ে আসে – “আমার বলয়ে ফিরে গেলাম। ভাল থেকো।”
কাজের ঝামেলায় অমিতের দু’চার দিন দেরী হয়ে যায় নীরা’দের বাড়ি যেতে। আমজাদ রহমান বুঝে পাচ্ছে না কি করে এই মুখ নিয়ে মেয়ে জামায়ের সামনে যাবে। মাথা’টা নিচু করে এসে দাড়ালো অমিতের সামনে।একরকম হাত জোড় করেই বলতে লাগলো,
-বাবা, আমায় ক্ষমা করে দিও। আমি বুঝতেই পারিনি আমার মেয়ে এমন একটা কান্ড করে বসবে।
-নাহ্ বাবা, আপনি কি বলছেন এসব। নীরা’ অনেক লক্ষী মেয়ে। ভূল হয়তো সে করেছে তবে এটাকে এত বড় করে দেখার কিছু নাই বাবা। আপনি অস্থির হবেন নাহ। সে কোথায় এখন?
-কি বলবো বাবা, লজ্জার কথা নদীর পাড়ে খেলছে।
-বাবা, এতে লজ্জার কি আছে। আমি গিয়ে দেখি, আপনি অস্থির হবেন না। - অমিত আঁকাবাঁকা মাটির পথ ধরে এগিয়ে যায় নদীর দিকে। নীরা আর দশ কি বারো জন শিশুকিশোর জটলা পাকিয়ে কি যেন কানে কানে বলছে। নীরা’কে মনে হচ্ছে দলে নেতা’র মত। অমিত কাছে আসতেই সবাই কেমন হকচকিয়ে যায়। নীরা একটু লজ্জা মেতো হলো।মুহুর্তেই অমিতের সাথে সবার ভাব হয়ে গেল, যেন কোন জাদু জানা জাদুকর। সবার সাথে কাটলো পুরো বিকেল।নীরা’কে সাথে নিয়ে’ই অমিত ফিরলো নীরাদের ঘরে। রাতের খাবারের পর আমজাদ রহমান বসলো অমিতের সাথে, -
-বাবা, মেয়ে’টা ক’টা দিন থেকে যাক না হয়?
-বাবা, আপনি শুনলে অবাক হবেন এই, নীরা তো বলে দিয়েছে সে আর কখনও যাবে না।
-বলো কি ? আমজাদ রহমানে চোখ যেন কপাল ছুলো।
-ঘাবড়ানোর কিছু নাই। আমি যখন’ই সময় হয় আসবো। আপনারা দয়া করে তাকে কিছু বলবেন নাহ। সে তার মতো করে আনন্দে থাকুক। এটা এক সময় এসে বদলে যাবে।
-তুমি কি বলছো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
-তাহলে পরিস্কার করেই বলি, যদি আপনাদের অসুবিধা না হয়, আর আপত্তি না থাকে নীরা’র যতদিন ইচ্ছা সে আপনাদের সাথেই থাকবে। আমি অপেক্ষা করব তার যেদিন যাওয়ার ইচ্ছা হবে সেদিনের জন্যে। আর আপনাদের আপত্তি বা অসুবিধা থাকলে আমি যে করেই হোক নিয়ে যাব।
অমিত যাওয়ার আগে নীরার জন্যে একটা চিরকুট লিখে যায়, -
“নাইবা হলো দেখা মোদের অপেক্ষার এই রথে-
আঁকিনি জীবন প্রচ্ছদ, যুগল স্বপ্নে সাজাবো বলে।
জীবনের ছোট ছোট ভূলগুলো রাখবো সাজিয়ে যুগল হাতে-
ছোট ছোট আনন্দগুলোয় ভরিয়ে রাখবো ফুলে ফুলে।”
নিশ্চুপ সময়ে যাত্রায় ক’টি বছর, ক’টি বসন্ত গেল হয়তো তার হিসাব অমিত বা নীরা কেউ রাখেনি। শরতের পালাবদলে এক বিকালে প্রচন্ড রকমের জ্বরে পড়লো নীরা। কতো ডাক্তার আর কতো ঔষধ জ্বর আর ছাড়ে না। একসময় নেওয়া হয় হাসপাতালে। অমিতের পরিজন আর নীরার পরিজন পিছনের সব ভূলেগিয়ে নীরা’র দ্রুত সুস্থতার জন্যে কি করণীয় তা নিয়ে অস্থির হয়ে পড়লো। চিকিৎসার কমতি হয়না। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে নীরা ভাবে, এই এক জীবনে সে কত বড় ভূলই না করেছে। দুই পরিবারের সবাই আসছে তার পাশে। তার চোখ যাকে দেখার জন্যে উদ্দেল হয়ে আছে সে কবে আসে টেরই পায় না। নাকি আদৌ আসে না বুঝতে পারছে না। সংকোচে কাউকে জিজ্ঞাসাও করতে পারছে না। তপ্ত কষ্টে অশ্রুধারা গড়ায় দু’চোখ জুড়ে। কত কিই ভাবছে মনে মনে – কাছে একবার পেলেই সব সংকোচ উৎরে ক্ষমা চেয়ে নিবে তার ভূলের জন্যে। অমিতের হাত সে আর কখনও ছাড়বে না। জীবনের এই নয়া নবান্নকে অমিতের নাম দিবে। পুরো জীবনের সম্পর্কটাকে সে ঊষ্ণ আলিঙ্গনের রূপকের মতোই করে রাখবে। ভাবতে যে কবে ঘুমিয়ে পড়ে টের পায়নি। হঠাৎ উষ্ণ নিঃশ্বাসের স্পর্শ কপালে লাগতেই নীরা চোখ খুলে দেখে তার চোখেরই সামনেই তার অমিত। কিছুটা হতবাক, কিছুটা বিহ্বল – তারপরও দ্রুত নিজেকে সামলে নেয়। ঝাপটে ধরে অমিত’কে – আমায় ক্ষমা করো। আমি খুব অন্যায় করেছি।
-এই পাগলী, কি অন্যায় করেছো? আমি তো জানি না কিছু? আচ্ছা সে না হয় পড়ে তোমার থেকে শুনবো। চলো এবার তো ঘরে যাবে? – নীরা শুধু অবাক’ই হচ্ছে এ মানুষটাকে দেখে। অপলক তাকিয়ে তাকে। মনে মনে নিজেই নিজের সাথে বলতে থাকে এ আমারই অমিত, আমারই অমিত।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৫৫