somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাহরাইন ও ওমানে বিদেশী শ্রমিকদের জীবন

২২ শে জুলাই, ২০০৯ সকাল ১১:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মধ্যপ্রাচ্যের জনসংখ্যার বিশাল এক অংশ হচ্ছে মূলত: দক্ষিণ এশিয়া থেকে আগত অভিবাসী শ্রমিকরা। এই পোস্টে আমরা তেমন দুই ব্যক্তির কথা শুনব যারা দক্ষিন এশিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করার জন্য এসেছেন।

মোহাম্মদ ইকবাল হচ্ছেন ইন্দোনেশিয়ার একজন নাগরিক যিনি বাহরাইনে থাকেন। তিনি বাংলাদেশী একজন শ্রমিকের গল্প বলেছেন (মূল ইংরেজী থেকে অনুবাদ):

আমি সম্প্রতি একজন বাঙ্গালীকে (বাংলাদেশী) দেখেছি যে একটা হোটেলে সাময়িক রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে। সে আসলে হোটেলের পাবলিক এলাকাতে কাজ করে, যেমন কাচের জানালা পরিষ্কার করা, বা লবির মেঝে পরিষ্কার করা। সে অতিথি কক্ষের দায়িত্বে নেই বা কামরা ঠিক করে না। এখানে কোন বিষয়টি ঠিক না? তাকে ১৫০০ বাহরাইনি ডিনার (৩৯৮০ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ৩ লাখ টাকা) ব্যয় করতে হয়েছে বাহরাইনে কাজের ভিসা পাওয়ার জন্য। তার ২ বছর কাজ করার অনুমতি আছে। প্রতিদিন ১০ বাহরাইনি ডিনার (২৬ আমেরিকান ডলার) বেতন দেয়া হয় তাকে, তার মানে সে প্রতিমাসে ২৪০ বাহরাইনি ডিনার (৬৩৬ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ৪৫ হাজার টাকা) আয় করে। এটা কি বেশ ভালো বেতন? দাড়ান...! তাকে তার ফ্লাট, পানি, বিদ্যুত, খাওয়ার জন্য টাকা দিতে হয় আর এরপর অবশ্যই দেশে টাকা পাঠাতে হয়।

আমরা হিসাব করি। বাড়ির জন্য সে অনেকের সাথে একটা ফ্লাটে থাকে যেটার জন্যে ব্যয় মাসে ধরা যাক ৫০ বাহরাইনি ডিনার (১৩২ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ১০ হাজার টাকা)। এরপরে পানি আর বিদ্যুত আরো ১০ বাহরাইনি ডিনার (২৬ আমেরিকান ডলার), আর এরপরে খাওয়া ৪০ বাহরাইনি ডিনার (৬৬ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ৫ হাজার টাকা)। তাহলে বাড়ীতে নেওয়ার জন্যে পুরো অর্থ বাঁচবে বাংলাদেশী টাকায় ১১৫ (৩০৫ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ২১ হাজার টাকা) প্রতি মাসে। এক বছরে (১২ মাসে) সে বাঁচাতে পারবে ১৩৮০ বাহরাইনি ডিনার (৩৬৬০ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় আড়াই লাখ টাকা)। এই অর্থ ভিসা বা ঢোকার ফি হিসাবে দেয়া ১৫০০ বাহরাইনি ডিনার (৩৯৮০ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ৩ লাখ টাকা) শোধ করার জন্যে যথেষ্ট না। আমার কোন ধারণা নেই এই অর্থ সরকার নির্ধারিত কিনা, কিন্তু একটা জিনিষ আমার কাছে পরিষ্কার না যে ২ বছরে সে মাত্র ১২৬০ বাহরাইনি ডিনার (৩৩৪০ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ২ লাখ ৩৩ হাজার টাকা) বাঁচাতে পারে। পরিশেষে সে তার ১৫০০ বাহরাইনি ডিনার (৩৯৮০ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ৩ লাখ টাকা) বিসর্জন দিয়ে আর দুই বছর কঠোর পরিশ্রম করেছে কেবলমাত্র ১২৬০ বাহরাইনি ডিনার (৩৩৪০ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ২ লাখ ৩৩ হাজার টাকা) এর জন্য। আরো দুই বছরের কাজের ভিসা বাড়াতে তাকে আবার ১০০০ বাহরাইনি ডিনার (২৬৫২ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা ) বিনিয়োগ করতে হবে। তার মানে দুই বছর পরে, সে পারবে বাঁচাতে ২৬০ বাহরাইনি ডিনার (৬৯০ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ৪৮ হাজার টাকা) মাত্র আর আমি এখনও জানিনা সে কিভাবে এরপর তার বিমান ভাড়া দেয়। আমি আসলেই বুঝতে পারি না যেহেতু এটা যুক্তিযুক্ত না!


বাহরাইনে অবস্থিত একজন ফরাসী লেখক ফ্রান্সিন বারলেট গত মে মাসে ওমানের মাস্কাট থেকে বাহরাইনে আসার সময়ে ইয়াসমিনা নামে ভারতীয় একজন মহিলার সাথে কথা বলেছেন। এটা ইয়াসমিনার গল্প (মূল ফরাসী থেকে অনুবাদ):

আমার চেন্নাইয়ের (ভারতে) জীবন খুব সহজ ছিল না, জানেন। কলেজে আমার দুই মেয়ে আছে। একদিন তারা ডাক্তার হবে। কিন্তু প্রথমে আমাকে তার ব্যয়ভার বহন করতে হবে, আরো অনেক কিছুর জন্যে টাকার যোগাড় করতে হবে। আপনি জানেন, আমি কেবলমাত্র ওমানের সালালাহতে দুই মাস কাটিয়ে আসলাম। আমি গতকাল সেখানে আমার কাজ ছেড়েছি। আমি একটা ওমানি পরিবারের সাথে ছিলাম। ম্যাডামের দশটা বাচ্চা ছিল- আটটা মেয়ে আর দুইটা ছেলে- আর মে মাসের শেষে তিনি এগারোতম সন্তানের জন্ম দেবেন। আপনি বুঝতে পারছেন? এগারোটা বাচ্চা...সেটা চমৎকার। কিন্তু আমি সেখানে থাকবো না দেখার জন্য যে সেটা ছেলে না মেয়ে। আমাকে যেতে হবে। এটা কঠিন তাকে একা রেখে আসা, জন্মের এতো কাছে কোন সাহায্য ছাড়া রেখে আসা, কিন্তু আমি থাকতে পারবো না।

প্রত্যেকদিন সন্ধ্যায়, তার স্বামী আমার শোয়ার ঘরে আসত। প্রত্যেক সন্ধ্যায় আমি তাকে বলতাম, “আমি আপনার কর্মী, স্ত্রী নই। ফিরে যান, আপনার স্ত্রীর আপনাকে প্রয়োজন। নিজের বিছানায় ফিরে যান। আপনার অধিকার নেই আমার সাথে এমন করার। আমাকে বিশ্রাম নিতে দেন, আমি ক্লান্ত...”। আপনি কল্পনা করতে পারেন? দশটা বাচ্চা, বাড়ির কাজ, রান্না, কাপড় ধোয়া আর কয়েক টন ডিশডাশা আর আবায়া পোশাক ইস্ত্রী করা প্রত্যেক দিন যার সাথে ছিল চাদর, ডায়াপার আর তোয়ালে। কিন্তু আপনি জানেন, আমার কাজ করতে আপত্তি নেই। আমি অন্য কিছু কিভাবে করতে হয় জানিনা। আমি নিবেদিত। আমি কঠিন কাজকে ভয় পাইনা। কিন্তু রাত্রে আমার সাথে এমন করার অধিকার তার ছিল না। আমাকে ছোঁয়া, বিরক্ত করা। আমি তাকে থামাতে পারতাম না। জোর ছিল না... আমাকে কিছু করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। দ্রুত।

বুঝেছেন, আমাদের মতো কাজের লোক যারা ভারত, শ্রীলঙ্কা, সোমালিয়া বা ফিলিপাইন্স থেকে আসে, তাদের দুই মাসের অর্ন্তবতীকালীন সময় থাকে, আর তার পরে তারা চুক্তি বাতিল করে ফিরে যেতে পারেনা। আমাদের পাসপোর্ট মালিকের হাতে আটক থাকে, আর তারা না চাইলে আমরা যেতে পারি না। আপনাকে আপনার দুই বছরের চুক্তি শেষ করতে হবে, বাড়িতে যেতে পারার আগে। এটাই আইন। আমি তাদেরকে বলেছিলাম আমি আমার অর্ন্তবতীকালীন সময় শেষ হওয়ার আগেই চলে যেতে চাই, এটা আমার অধিকার। তা সত্ত্বেও ওই গৃহস্বামী চায়নি যে আমি যাই।

এর পরে আমি খাওয়া বন্ধ করে দেই। পাঁচ দিন আমি আমার কামরা থেকে বের হইনি, আমি কিছু খাইনি, আমি স্নান করিনি। তারা ডাক্তার ডেকেছিল, আর সে পুলিশ ডেকেছিল। ওই! তারা আমাকে বিমানবন্দরে নিয়ে গেল। স্বামীকে আমার বাড়ী ফেরার প্লেনের টিকিট কিনে দিতে হলো, আর আমার পাসপোর্ট ফেরত দিল। এটা আইন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে খারাপ ছিল, জানেন। আমি পড়তে পারিনা। আমি বুঝতে পারিনি আমার প্লেনের টিকিটে কি লেখা আছে। বোর্ডিং এর সময়ে গালফ এয়ারের এটেন্ডেন্ট বলল যে আমার টিকিট রামানাথাপুরামের , আমার বাড়ী চেন্নাইএর না। আপনি বিশ্বাস করতে পারেন? আমি প্লেনে উঠতে অস্বীকৃতি জানাই। কোথায় যাবো? রামানাথাপুরাম এমন একটা শহর যেটা আমি চিনি না। সাথে কোন টাকাকড়ি নেই, কোনো সাহায্য ছাড়া, আমার বাড়ি থেকে ৬০০ কিমি দুরে কি করব? ভাগ্যক্রমে, রামানাথাপুরাম থেকে চেন্নাই পর্যন্ত পুলিশ আমার টিকিটের টাকা দিয়েছে। সেই স্বামীটা তাদেরকে ফিরত দেবে। পুলিশরা ঠিক কাজ করেছে, জানেন। এটার খরচ পরেছে ৬০ রিয়াল (আমেরিকান ডলার ১৫৫)... আমার জন্য এক মাসের বেতন!

আমি দুবাইতে এর আগে পাঁচ বছর ছিলাম যেখানে আমি ‘লাফ’ দিয়েছিলাম (লাফ দেয়া মানে: মালিককে ছেড়ে দিয়ে, পাসপোর্ট ছেড়ে দিয়ে, অন্য কোথাও ভালো বেতনের একটা কাজ নেয়া, কিন্তু আইনসঙ্গতভাবে নয়)। আগে সৌদি আরবে আমি দুই বছর কাজ করেছি, দুই বছর ওমানে। আমি আবার আসব। এই দেশকে আমার আসলেই ভালো লেগেছে। কিন্তু এখনই না। প্রথমে আমি আমার মেয়েদেরকে দেখতে চাই আর একটু বিশ্রাম নিতে চাই।

প্রথম প্রকাশ: গ্লোবাল ভয়েসেস বাংলায়আয়েশা সালদানহার রচনা থেকে অনুবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০০৯ সকাল ১১:৩৮
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পার্বত্য চট্টগ্রাম- মিয়ানমার-মিজোরাম ও মনিপুর রাজ্য মিলে খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনের চক্রান্ত চলছে?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:০১


মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকা ভ্রমণ করেছেন । সেখানে তিনি ইন্ডিয়ানা তে বক্তব্য প্রদান কালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী chin-kuki-zo দের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনে আমেরিকার সাহায্য চেয়েছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×