১৯৭২ সালের জুলাই-আগস্ট মাসের দিকে ঢাকা সদর উত্তর সাবডিভিশনের (বর্তমান গাজীপুর জেলা) এসডিও নিযুক্ত হন শাহরিয়ার ইকবাল। প্রথম দেখায় নানা প্রসঙ্গে কথার পর তাজউদ্দীন আহমদ তাঁকে বলেন, ‘আমার কোনো আত্মীয়স্বজন পরিচয়ে কেউ যদি কোনো কাজের তদবির নিয়ে আপনার কাছে আসে এবং আপনি যদি মনে করেন কাজটি সঠিক, তারপরও কাজটি করবেন না। প্রয়োজনে আপনি আমাকে যেকোনো সময় ফোন করবেন, কিন্তু আমাকে না জানিয়ে আমার আত্মীয় পরিচয়ের কারও কোনো কাজ করবেন না।’
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভায় তাজউদ্দীন আহমদ যখন অর্থমন্ত্রী, তখন তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হামিদুল্লাহ সাহেবকে বলে দিয়েছিলেন, ‘দেশের অর্থনীতির ব্যাপারে প্রতিদিনের রিপোর্ট আমাকে এক দেড় পৃষ্ঠার মধ্যে টাইপ করে পাঠাবেন। যেন আমি পুরো চিত্র পাই। এখানে কোনো কিছু লুকানোর চেষ্টা করবেন না। কখনো আমার সন্তুষ্টির জন্য চেষ্টা করবেন না। সঠিক চিত্র পেলে আমি সংশোধন করার চেষ্টা করতে পারব।’
আবুল মাল আবদুল মুহিত (বর্তমান অর্থমন্ত্রী) সাহেবের একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে ঘনিষ্ঠভাবে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে দেখেছেন প্রচণ্ড রকমের আত্মসমালোচনায় বিশ্বাসী একজন মানুষ হিসেবে। তাজউদ্দীন আহমদ বলতেন, ‘আমরা দেশ শাসন করছি, দেশের মঙ্গল চাই, কাজেই আমাদের দুর্বলতা আছে, এগুলো মানা উচিত। স্বীকার করা উচিত। আমরা তো সব জানি না, তাই শিখতে হবে।’
তাজউদ্দীন আহমদ মন্ত্রী ছিলেন যত দিন, সাধারণত প্রতিদিনের ফাইল সে দিনই প্রয়োজনীয় নিদের্শনা দিয়ে ছেড়ে দিতেন। অর্থসচিব কফিলউদ্দীন মাহমুদ একবার লক্ষ করলেন, তিন-চার দিনের বেশি হয়ে যাচ্ছে একটি প্রমোশনের ফাইল ফিরে আসছে না। এমন সময় তাজউদ্দীন আহমদ কফিলউদ্দীন মাহমুদকে ডেকে পাঠালেন। টেবিলের ওপর সেই ফাইলটি রাখা। তিনি ফাইলটি দেখিয়ে বললেন, ‘আপনি নিশ্চয়ই এই ফাইলটির বিষয়ে ভেবেছেন।’
হ্যাঁ-সূচক উত্তর শুনে তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, ‘২৫ মার্চ রাতে আমার স্ত্রী ছোট ছেলে আর মেয়েটিকে নিয়ে ভাড়াটিয়া সেজে পাকিস্তান আর্মির হাত থেকে রক্ষা পায়। ২৬ তারিখ আমাদের বাসার দেয়াল টপকে এদিক-সেদিক দুই রাত থেকে একপর্যায়ে এক ভদ্রলোকের বাড়িতে যান। তিনি বিষয়টিকে সহজভাবে নিতে পারেন না। তিনি আমার স্ত্রীকে আরও নিরাপদ বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে রাস্তার সামনে গিয়ে বলেন, আপনি একটু দাঁড়ান, আমি চাবি ফেলে এসেছি। চাবিটা নিয়ে এক মিনিটের মধ্যেই আসছি। তিনি যে ভেতরে গেলেন আর দরজা খুললেন না। আমার স্ত্রী নিরুপায় হয়ে রাস্তার পাশে রাখা ইটের পাঁজার পেছনে ছোট বাচ্চা দুটিকে নিয়ে লুকিয়ে রইলেন বাইরে, তখন কারফিউ।’ ‘সেই ভদ্রলোকের প্রমোশনের ফাইল এটি। আমি কয়েক দিন চিন্তা করলাম। আমার ব্যক্তিগত বিষয় তাঁর সারা জীবনের এই চাকরির প্রমোশনের বিষয়ের সঙ্গে জড়ানো ন্যায়সংগত কাজ হবে না। আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার একান্তই আমার।’ তিনি তাঁর প্রমোশনের সুপারিশ অনুমোদন করে দিয়েছেন।
কফিলউদ্দীনের মনে হলো, আমরা গল্পে-ইতিহাসে অত্যন্ত মহত্ এবং মহান মানুষদের যেসব উদাহরণ পড়ি, এটি তারই একটি। ব্যক্তিগত সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, ক্রোধ, প্রতিশোধ—এগুলোর ঊর্ধ্বে উঠে নৈর্ব্যক্তিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার যে ক্ষমতা, এটি সেই ক্ষমতা।
(সিমিন হোসেন রিমি: প্রয়াত তাজউদ্দীন আহমদের কন্যার লেখা থেকে)