এই সিরিজের নতুন পাঠকদের অনুরোধ করবো একবার প্রথম পর্বটা চোখ বুলিয়ে নিতে ।
প্রথম পর্বে দু'জন নারী'কে নিয়ে লেখা হয়েছিল । এই পর্বে থাকছে ৪জন নারী বিপ্লবীর সংক্ষিপ্ত পরিচয়। আশা করবো এদের জানতে পেরে আপনাদের মধ্যেও ভালোলাগা কাজ করবে ।
অপ্রয়োজনীয় কিছু তথ্য স্বেচ্ছায় এড়িয়ে গেছি । কোথাও গড়মিল কিংবা ভুল চোখে পড়লে কমেন্টে জানাতে অনুরোধ রইলো । কৃতজ্ঞ থাকবো ।
৩. Constance Markievicz / Countess Markievicz
১৮৬৮ তে আয়ারল্যান্ডের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম । তার বাবা ইংল্যান্ডের রাজসভার সদস্য ছিলেন (লর্ড ) । সেই সুত্রে তার জন্ম হয় লন্ডনে । শিল্পের প্রতি দূর্দান্ত ঝোঁক থাকায় শুরুতে লন্ডনের এক স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা নেন । পরবর্তীতে প্যারিসের এক বিখ্যাত স্কুলে ভর্তি হন । সেখানে পোল্যান্ড বংশদ্ভূত এক কাউন্টের সাথে পরিচয় হয় (Count Casimir Dunin Markievicz. ) । ১৯৯১ সালে তাদের বিয়ের ফলে তিনি হয়ে যান Countess Markievicz ।
১৯০৩ সালে উভয়েই ডাবলিনে (আয়ারল্যান্ডের রাজধানী) স্থায়ী হন এবং Markievicz গভীরভাবে চিত্রাঙ্কনের দিকে ঝুঁকে পড়েন । চিত্রশিল্পী হিসেবে তার সুনাম ছড়াতে থাকে ।
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে আয়ারল্যান্ডে স্বাধীনতার স্বপক্ষে আবহাওয়া ক্রমেই উত্তপ্ত হতে থাকে । ১৯০৮ সালে তিনি সক্রিয়ভাবে জাতীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন । তিনি Inghinidhe na hEerann নামে একটি নারী আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন। এ বছরই তিনি পার্লামেন্টের ভোটে অংশ নেন, সেই আসনে তার শক্ত প্রতিদ্বন্দী ছিলেন উইন্সটন চার্চিল !! তিনি নির্বাচনে হেরে যান তবে পরবর্তী দু’বছরে তিনি স্বাধীনতার চেতনা এবং রাজনীতিতে বেশ পরিপক্ক হয়ে ওঠেন ।
১৯০৯ সালে সেই সময়ের এক প্রথম সারির বিপ্লবী বালমার হবসন এর সাথে মিলে একটি দল গঠন করেন ( Fianna Éireann – যার একটি নিজস্ব মিলিটারী ইউনিট ছিল ) । পরবর্তীতে আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতায় এই দলের প্রভূত ভূমিকা ছিল । ১৯১১ সালে ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জ আয়ারল্যান্ড সফরে এলে বিপ্লবীরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে । এই প্রথম Markievicz পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন । ১৯১৩ তে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বিশ্বযুদ্ধে হতাহত সৈনিক ও উদ্বাস্তুদের সহায়তা করেন।
ডাবলিনে বৃটিশ আর্মির সাথে যুদ্ধে Markievicz জেমস কনোলী’র সিটিজেন আর্মির সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে যোগ দেন । ৬ দিন যুদ্ধ করার পর সারেন্ডার করতে বাধ্য হন । আরো অজস্র বিপ্লবীদের সাথে তাদের যখন ডাবলিনের রাস্তা দিয়ে টেন হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো ডাবলিনের অনেক মানুষ তাদের নিয়ে রসিকতা করতে থাকে । ঘৃণা প্রকাশ করে তাদের শহরকে প্রায় ধ্বংস করার জন্য ।
Markievicz এর সাথে আরও ৭০জন নারীকে গ্রেফতার করা হয় কিন্তু কাউন্টেসকে আলাদা এক জেলে বন্দী রাখা হয় এই ভয়ে যে যদি তিনি বন্দীদের জেলে বিক্ষোভে উৎসাহিত করেন । এক কোর্ট মার্শালের রায়ে তার মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিল কিন্তু হঠাৎ করেই তা আমৃত্যু কারাদন্ডে পাল্টে যায় । এটা শোনার পর তিনি বলেন ....
১৯১৪ সালের আগষ্টে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান । ২বছর পর ১৯১৬ তে আইরিশদের সবচেয়ে বড় এবং কার্যকরী বিপ্লব Easter Uprising সংঘটিত হয় ( এটি ঘটার আগে খুব কম সংখক মানুষই বিপ্লবীদের পক্ষে ছিলো । আপরাইজিং এর পর বিপ্লবীরা সাধারণ মানুষদের চোখে বিশেষভাবে সম্মানিত হতে থাকে । ইস্টার মানডেতে প্রায় ১২৫০জন বিদ্রোহী যুদ্ধ শুরু করে যা ছিল একটি সুইসাইডাল মিশন । তারা ডাবলিনের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ ভবন দখল করে নেয় । )
আপরাইজিং ও সফল না হওয়ায় অনেকেই সরকারের হাতে বন্দী হয় । 1917 সালে সরকারের সিদ্ধান্তে আপরাইজিং এ জড়িত বন্দীদের প্রায় সকলকেই মুক্ত করে দেয়া হয় । পরবর্তীতে ১৯২১ সালে কিছু শর্তে আয়ারল্যান্ডকে ব্রিটিশ রাজসভায় বিশেষ সদস্যপদ দেবার প্রস্তাব করা হলে তিনি তা নাকচ করেন তবে অপর কিছু নেতা তাতে সম্মতি দেন ।
তিনি সংসদে পুনঃনির্বাচিত হন এবং শ্রমমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি ছিলেন প্রথম আইরিশ নারী মন্ত্রী এবং ইউরোপে দ্বিতীয় !! তবে তার রিপাবলিকান দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে আবারো জেলে যেতে হয় । জেলখানায় আরো ৯২ জন নারীসহ তিনি অনশন শুরু করেন । একমাস পরই আবার মুক্তি পান ।
১৯২৭ সালে তিনি ডাবলিনে মারা যান । প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষ তার শেষকৃত্যে অংশ নিয়েছিলো ।
৪. Nwanyeruwa
১৯২৯ সালের ১৮ নভেম্বর, ব্রিটিশ শাসিত নাইজেরিয়াতে ঘটেছিল ইতিহাসের সবচাইতে বড় নারী বিপ্লবের একটি । হাজারো উপজাতী নারী বিপ্লবে ফেটে পড়ে সেদিন বৃটিশ রাজকে যে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছিল তাতে হার হয়েছিল বৃটিশদের । ইতিহাসে তা “Aba Women’s War” নামে পরিচিত । নারীবিপ্লব কিংবা কলোনী বিরোধী বিক্ষোভ হিসেবে তা উদাহরণ হয়ে আছে। আফ্রিকান যে কোন উপজাতীদের বৃটিশদের বিরুদ্ধে সেটাই ছিল প্রথম কোন বিদ্রোহ ।
এমনিতেই বৃটিশদের শোষণে অন্যান্য কলোনীগুলোর মতই তারাও জেরবার হচ্ছিলো। বিশেষত কয়েকটি বিষয়ে তাদের ক্ষোভ ছিল প্রচন্ড । প্রথমত, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত নানা পণ্যের কম বিক্রয়মূল্য এবং বাইরে থেকে আমদানীকৃত পণ্যের অধিক ক্রয়মূল্য । দ্বিতীয়ত, ব্রিটিশ পুলিশ অফিসারদের নির্যাতন এবং স্থানীয় বিচার বিভাগের দূর্নিতী ও অন্যায়ের প্রতি তীব্র ঘৃণা ।
বৃটিশদের শোষণ নীতি অনুযায়ী সে সময়ে নারীদের কোন কর দিতে হতোনা .. কিন্তু হঠাৎ করেই তা পরিবর্তন করা হয় । এতে করে এতোদিন ধরে যে ক্ষোভের বুদবুদ তাদের মধ্যে তৈরী হচ্ছিলো তা বিষ্ফোরণে রুপ নিল।
সেই বিষ্ফোরণের শুরুটা হয় Nwanyeruwa নামে এক উপজাতী নারীকে কর দিতে নির্যাতন করা এবং এর বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ করলে ব্রিটিশ পুলিশ অফিসারদের পক্ষালম্বন করে দেয়া রায় ।
সে সময় নাইজেরিয়ায় অজস্র গোত্র-উপজাতী ছিল । সেগুলোর মধ্যে সবচাইতে বড় ছয়টি গোত্রের নারীরা Nwanyeruwa এর উপর নির্যাতনের ঘটনায় বিক্ষোভে উদ্বুদ্ধ হয় । প্রায় ২৫০০০ নারী একত্রিত হয়ে বৃটিশদের সকল স্থাপনা, দোকানপাটে হামলা শুরু করে । বৃটিশ সেনাদের সাথে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে প্রায় ৫০ জন নারী মারা পড়লো , শ' খানেকের মত বন্দী হলো ।
এই যুদ্ধে স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশরা জয়ী হয় তবে উপজাতী নারীদের সকল দাবী মেনে নেয়া হয় । সুতরাং এই বিদ্রোহ অনেকাংশেই সফল ছিল এবং তা ইংরেজ সরকারের নিতী নির্ধারণে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত করে ।
৫. Celia Sanchez
ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন নারী চরিত্র । কেবল বিপ্লবেই নয়, ব্যাক্তিত্ব কিংবা প্রশাসন চালাবার সক্ষমতায় সানচেজ ছিলেন অসম্ভব গুণবতী এক নারী ।
সানচেজ হলেন কিউবান রেভোল্যুশন (জুলাই ১৯৫৩-১৯৫৯) এর হারিয়ে যাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র । ইতিহাসে ফিদেল কাস্ত্রো, রাউল এবং চে গুয়েভারাই সমস্ত ক্রেডিট পেয়ে এসেছেন অথচ সানচেজ ছিলেন তাদের প্রায় সব কাজেরই কারিগর ।
কিউবায় তখন বাতিস্তা সরকারের একনায়কতন্ত্র চলছে । তার বিরুদ্ধে প্রথম সবচেয়ে বড় যে আঘাতটা তারা হেনেছিলেন ( ইতিহাসে এটি 26th of July Movement নামে পিরিচিত ) তার প্লানিং এবং সহযোগীতা এসেছিল সানচেজের মাথা থেকেই । তার ভূমিকা ছিল আক্রমণের স্থান নির্বাচন এবং একটা মিশনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনা করা । এ থেকে তার বুদ্ধিমত্তা ও বিশ্বস্বতা প্রমাণিত হয় ।
তার সাহস এবং শক্তিমত্তার জন্য ফিদেল তাকে যা খুশি করার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন ।
রেভোল্যুশন চলাকালীন সময়ে ছোট ছোট উপদলে ভাগ হওয়া গ্রুপগুলোর সাথে যোগাযোগ রক্ষার্থে তিনি মেসেঞ্জারের ভূমিকা পালন করেন । এছাড়া যুদ্ধাস্ত্র, রসদ সরবরাহের কাজও তাকে করতে হতো । পাতলা শরীরে বয়ে বেরাতেন ভারী মেশিনগান ও নানা কাগজপত্র ।
তিনি ভীষণ পড়ুয়া ছিলেন । রেভোল্যুশন পরবর্তী কাস্ত্রো সরকারে তিনি সেক্রেটারী অফ দ্যা মিনিষ্ট্রি হন । বলা হয়ে থাকে সরকারের সমস্ত সিদ্ধান্তই নিতেন সানচেজ । কাস্ত্রো ইজি চেয়ারে বসে আরাম করতেন । তার সিদ্ধান্তের বাইরে কাস্ত্রো কোনদিনও যাননি । অনেকে ধারণা করেন তিনি ছিলেন কাস্ত্রোর গোপন প্রেমিকা । তবে বিশ্বাসযোগ্য কোন যুক্তি ছিলনা ।
ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৮০ সালে মারা যাবার আগ পর্যন্ত তিনি সততা এবং নিষ্ঠার সাথে কাজ করে গেছেন ।
৬. Petra Herrera
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ছিলেন পরফিরিয়ো দিয়াজ । প্রায় তিন যুগ ধরে তিনি মেক্সিকো শাসন করেছেন ..এবং ইতিহাসে দেখা যায় একসময় এ ধরণের শাসকেরা ডিক্টেটরশীপের দিকে ঝুঁকে পড়েন । এক্ষেত্রেও তার ব্যাত্যয় হয়নি । ইতিহাসের ধারা মেনে তাকে উৎখাতের জন্য বিপ্লবও তাই আসন্ন ছিল । ইতিহাসে যা মেক্সিকান রেভোল্যুশন নামে পরিচিত ।
১৯১০-১৯২০ সাল পর্যন্ত চলা এ যুদ্ধে রেভোল্যুশনের নেতৃত্ব দেন ফ্রান্সেসকো মাদেরো । অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সমর্থনপুষ্ট দিয়াজ সরকার ।
একসময় স্পেনিয়ার্ডরা মেক্সিকো শাসণ করতো । লড়াই কিংবা প্রতিবাদ মেক্সিকোর শতাব্দী পুরোনো ঐতিহ্য । জাতে ইন্ডিয়ান এই মানুষগুলো নারী-পুরুষ নির্বিশেষে লড়াইয়ে অংশ নিত । সংস্কৃতি অনুযায়ী নারীরা পুরুষকে নানাভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে সহযোগীতা করতো । একত্রে এই নারীদের দলকে বলা হতো Soldaderas, যারা ছিল মূলত নারী যোদ্ধা ।
মেক্সিকান রেভোল্যুশন চলাকালে এই Soldaderas এর গুরুত্বপূর্ণ একজন যোদ্ধা ছিলেন petra Herrera . পরবর্তীতে তিনি পুরুষের ছদ্মবেশে Pedro Herrera নাম ধারণ করে পুরষযোদ্ধাদের দলে ঢুকে পড়েন । বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নিয়ে বীরত্বের স্বীকৃতি স্বরুপ তিনি প্রায় ২০০ জন যোদ্ধার একটি দলের নেতা নির্বাচিত হন । তার বিশেষত্ব ছিল এক্সপ্লোসিভ ব্যাবহার করে ব্রীজ,স্থাপনা ধ্বংস করায় এবং তার উপর অর্পিত দায়িত্ব তিনি বেশ সফলতার সাথে পালন করেন ।
১৯১৪ সালে তার ট্রুপ নিয়ে তিনি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর দখল করেন । এতে করে তার বীরত্বের খবর বিপ্লবীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে । একসময় তিনি তার আসল পরিচয় প্রকাশ করলে তাকে খুব হেয় করা হয় । ফলে তিনি ট্রুপ থেকে বেরিয়ে নারীদের নিয়ে নিজস্ব একটি আর্মিবাহিনী গঠন করেন । ধারণা করা হয় তার কমান্ডে প্রায় হাজারখানেক নারীযোদ্ধা ছিলেন । কেবলমাত্র নারী হবার কারণে সমস্ত যোগ্যতা থাকা সত্বেও তাকে কখনো জেনারেল পদবী দেয়া হয়নি ।
মেক্সিকো রেভোল্যুশন শেষে বিপ্লবী সরকার গঠিত হলে তিনি দেশের হয়ে স্পাই এর কাজ পান । একটি মাদকশালায় পুরুষের ছদ্মবেশে থাকাকালীন তিনি কিছু মাদকসেবীর গুলিতে নিহত হন ।
কেবলমাত্র সাহসীকতা, দেশপ্রেম, নেতৃত্ব দেয়ার গুণাবলীর জন্যই হেরেরা মেক্সিকান রেভোল্যুশন এর ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন । তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে ‘নারী’ হয়েও পুরুষদের মত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেয়া যায় ।
.... (পরের পর্বে সমাপ্ত )
বি.দ্র. .. প্রয়োজনীয় সকল লিংক গুগল থেকে সংগৃহিত এবং লেখার মধ্যে যুক্ত করা হয়েছে ।