টুং টাং টুং টাং ...... উইন্ড চাইমটা দুলছে ।
শুভ অফিসের জন্য বেরিয়ে যায় সেই ৯টার মধ্যেই । তারপর সংসারের টুকটাক কাজ করতে করতেই সকাল গড়িয়ে দুপুর । এরপর নন্দিতার হাতে অফুরন্ত অবসর । গোটা বাড়িটা খাঁ খাঁ করে । কখনো টিভি ছেড়ে দেয়, কোন গল্পের বই হাতে নেয়- শেষ করা হয়না ।
উইন্ডচাইমের টুং টাং শব্দের সাথে নন্দিতার দীর্ঘশ্বাস মিশে হারিয়ে যায় ....
অভ্যেসবশতঃ ফেসবুকে লগ ইন করে । একটা মেসেজ । অন্যসময় কারো মেসেজই চেক করা হয়না । আজ কি মনে হতে সেটাতে ক্লিক করে ।
"কেমন আছো ?? অনেকদিন পর ..!!!!"
..... ছোট্ট একটা লাইন । সেন্ডার 'অন্যরকম একজন" ।
অদ্ভূত তো !! এ আইডি তো তার লিস্টে অ্যাড করা নেই । প্রোফাইলও অচেনা !!!
ডোরবেল বেজে ওঠে । কুরিয়ারের লোক । শুভ'র নামে একটা পার্সেল । কাগজে সই করে বক্সটা ঘরে এনে রাখে ।
'অনেকদিন পর !!' .. শব্দগুলো মাথায় ঘোরে ।
কে হতে পারে ? মনে হয় পরিচিত । নিজেকে লুকোতে চাইছে । তিতাস ?!! তার সাথে তো ৫ বছর আগেই সব চুকে গেছে । নাহ ! এতোদিন বাদে সে খোঁজ নিতে চাইবে কেন ? অনার্সে তার ক্লাশমেট বিজয়ের সাথে কিছুদিন ভাব হয়েছিল । সে তো কবেই বিয়ে করে বিদেশে সেটেল্ড !!
কৌতুহল আরও বাড়ে । সম্মোহিতের মত ল্যাপটপটা হাতে নেয় ।
টাইপ করে " স্যরি, আপনাকে তো চিনলাম না !!"
কয়েক সেকেন্ডের স্তব্ধতা । মেসেজ 'সিন' হয় । ওপাশ থেকে রিপ্লাই আসে...
: চেনার কথা । একটা সময় আরো অনেক কিছুর সাথে চেনাজানাটুকু আমাদের মধ্যে ছিল ।
: হেঁয়ালি রেখে নিজের পরিচয়টা দিন ।
: আড়ালে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি । তাই ভয় হয়, ধাক্কাটা সামলাতে পারবে তো ?
: মানে ??
: খুব সহজ । আমাকে চিনতে হলে অযত্নে ফেলে রাখা 'স্মৃতি' নামক বদ্ধভূমির অনেকটা দূর হাঁটতে হবে । অবহেলায় ভুলে যাওয়া একটা মুখের ওপর আলো ফেলতে হবে ।
: কথা প্যাঁচাচ্ছেন কেন ? আর আপনি আমাকে তুমি করেই বা বলছেন কেন ?? আজব ?!!
: হা হা .. রেগে গেলে তোমাকে একসময় 'দেবী'র মত লাগতো । ফর্সা কান দুটো লাল হতো । অনেক বর্জনের ভীড়ে এই 'তুমি'টুকুই আমার অর্জণ । এতোদিন ধরে আগলে রাখার ফলে মায়া পড়ে গেছে । হারাতে ইচ্ছে করছে না ।
: আপনি নিজের পরিচয় না দিলে আমি আর কোন রিপ্লাই দেবোনা ।
: হা হা... । ভেবেছিলাম ঠিকই চিনে ফেলবে । আর রিপ্লাই তো তুমি আমার লাস্ট চিঠিরও দাওনি । আজও সেটা পাওনা আছে ।
: কে আপনি ? অনিক ?!
: হা হা ...
গোটা শরীরের প্রদেশজুড়ে ভূমিকম্প ঘটে যায় । বিছানা ছেড়ে এক লাফে নেমে ড্রয়িং এ এসে বসে ।
অনিক !! ১০ বছর পর !! কেন ?!!
একটা একটা করে স্মৃতির অ্যালবাম চোখের সামনে খুলে যায় ।
এইচএসসিতে অনিক ছিল তার ক্লাশমেট । সহজ-সরল-ভদ্র ছেলেটির প্রতি সব মেয়েদের আলাদা একটা উইকনেস ছিল । নন্দিতাও তার সাথে মিশতে চাইতো, এক সময় সম্পর্কটা সহজও হয় । তবে লাজুক ছেলেটি কখনোই নন্দিতার প্রতি তার দূর্বলতা প্রকাশ করতে চাইতোনা । অনেক নাটকীয়তার পর তাদের মধ্যে একটা হৃদ্যতার সম্পর্ক তৈরী হয় । খেয়ালী, ভাবুক অথচ মেধাবী ছেলেটি হয়ে ওঠে নন্দিতার প্রথম ভালোবাসা ।
বন্ধুরা এমনকি গোটা শহর সে সম্পর্কের কথা জানতো । একসময় পরিবারও জেনে যায় । ধর্ম আলাদা বলে বাসা থেকে প্রচন্ড চাপ আসে । সে চাপে আবেগের বাঁধ ভাঙ্গে ..কঠোর হতে হয় ।
নন্দিতাই অনিক কে ডেকেছিল । সব শুনে অনিক কেবল একটা চিরকুট দিয়ে বলেছিল "ভালো থেকো" । চিরকুুটে লেখা ছিল, " তোমাকে কোনদিন হারাতে পারবোনা । হয়তো নিজেই হারিয়ে যাবো । তবুও ..... "
সেই তুমি এতোদিন বাদে !!?? কেন ? কেন ? ঘরের দেয়ালে লেগে সে প্রশ্ন প্রতিফলিত হয় । দু'চোখ প্লাবিত হতে থাকে ।
উইন্ডচাইমটা দুলছে । টুং টাং টুং টাং .......
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই অক্টোবর, ২০১৪ রাত ৮:০৩