মেয়েটা রোজ সকালবেলা রাস্তার মোড়ে এসে দাড়ায় । হাতে বই-খাতা, ক্যাজুয়াল সাজগোজ...রিকশার অপেক্ষায় কিছুক্ষণ সেখানে দাড়াতেই হয় ।
...এবং রোজই সে ছেলেটিকে দেখতে পায়, নিয়ম করে এ সময়টাতেই সে চা দোকানটায় বসে থাকে । হুট করে চোখে চোখ পড়লেই সে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বিজ্ঞের মত আকাশ-বাতাস দেখতে থাকে । মেয়েটির হাসি পায়, অবজ্ঞার হাসি নয়-ক্ষাণিকটা অন্যরকম !!
ছেলেটির বাসায় নিয়ম করে দু'বেলা চা রান্না হয়, কেউ যেচে না দিলে ইচ্ছে করে খাওয়া হয়না । কিন্তু এই সময়টাতে সে এই দোকানে বসে কয়েক কাপ চা সাবাড় করে । অপেক্ষার প্রহরগুলো বড্ড তেতো, তাতে কিছুটা মিষ্টি তো যোগ করতেই হয় ।
মেয়েটি আসে, ক্ষাণিকক্ষণ দাড়ায় । তারপর রিকশা এলে চলে যায় । মাঝে মাঝে সাইকেলে করে সে রিকশার পিছু নেয় । অতঃপর..... এক সমুদ্র শূন্যতা !!
গত এক মাস ধরে সে মেয়েটিকে দেখছে । এই এক মাসে তার ভেতর উথাল-পাথাল পরিবর্তন হয়ে গেছে । দৈনিক রুটিন, কলেজ-টিউশন, খেলা, বন্ধুদের সাথে বিকেলের আড্ডা ..... প্রিয় সে মুহূর্তগুলোও এখন পানসে লাগে । কি এক অদ্ভূত,ব্যাখ্যাতীত আকর্ষণে সে সম্মোহিতের মত মেয়েটির জন্য ছুটে আসে !!
বিকেল বেলা সাইকেলে চেপে সে এ পাড়ার গলিতে উদ্দেশ্য নিয়েই ঘোরে । ছাদের দিকে অপলক দৃষ্টি, কখনো রাজকন্যা দেখা দেন । খোলাচুলের উদাসী রাজকণ্যাকে এ সময়টায় বড্ড একা লাগে । চোখ ফিরিয়ে নেয়া যায়না, যেন ফিরিয়ে নিলেই হারিয়ে যাবে । বুকে কষ্টের ঘূনপোকারা দাপিয়ে বেড়ায় । এক ছুটে সে মায়াবতীর সামনে গিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, "ভা-লো-বা-সি".....
....বুকপকেটের গোলাপগুলো স্পর্শের অভাবে শুকিয়ে যায় । বইয়ের ভাঁজের কফিনে মোড়ানো থাকে । প্রতিদিন একটি করে 'চিরকুট' জন্ম নেয়, প্রাপকের হাতে পৌঁছায় না ।
ক্যালকুলাসের খাতায়, ইংরেজী নোটস-এ, 'হৈমন্তী' গল্পের পৃষ্ঠার নিচে আনমনে তার 'নাম' লিখে ফেলা । দু'চার লাইনের কাঁচা কবিতা রাফখাতার কালো-মোটা অক্ষরেই পড়ে থাকে ।
.....এভাবে সময় কাটে । একদিন বন্ধুরা জেনে যায় । উপহাস করে,হাসে, ট্রিট চায় কিন্তু ঠিকই সাহায্য করতে এগিয়ে আসে । কতরকম উপদেশ, যেন সবাই এক একজন তুখোড় প্রেমিক ।
পরিকল্পনা চলে, তাতে আবার কাটাকুটি । অতঃপর একটা উপায় ঠিকই বেরিয়ে আসে.........
রোজকার মতই মেয়েটি মোড়ে এসে দাড়ায় । আড়চোখে তাকিয়েও সে ছেলেটিকে দেখতে পায়না । বুকে আশঙ্কা জাগে । মাথা নিচু করে তাকিয়ে থাকা রাস্তার নোংরাগুলো ঝাপসা হয়ে আসে ।
ছেলেটি সাইকেল থেকে নেমে মেয়েটির পাশে দাড়ায় । বুকপকেট থেকে গোলাপটা বের করে হাতে নেয় । মেয়েটি বিষ্ফোরিত চোখে হাঁ করে তাকায় । পকেটের চিরকুটটা বের করে ....
"প্রিয় রাজকণ্যা,
আমি জানি, আমি খুব বোকা । তোমার পাশে বড্ড বেমানানও । পৃথিবীর সমস্ত সুদর্শন রাজপুত্রদের ভীড়ে আমি এক সামান্য কোটালপুত্র । সব জেনেও বলছি, আমি তোমার ছায়া হতে চাই । বিকেলবেলা তোমার সাথে ছাদে বসে আকাশের সাদা ক্যানভাসে আঁকিবুঁকি করতে চাই । তোমার একলা পথের বিশ্বস্ত হাত হতে চাই । তোমার হাসির 'কারন' হতে চাই ।
আমার না একা একা চা খেতে ইচ্ছে করেনা । প্রিয় কোন গান শুনলে আমার খুব একা লাগে । কবিতার দু'লাইন লেখার পর আরও দু'লাইন লিখে দেবার জন্য আমার তোমাকে দরকার । তোমাকে পূর্ণতা দেবো বলে তোমাকে "ভালোবাসী' ।
একটি বোকা ছেলে "
.......... মেয়েটির দু'চোখ উপচে জল নামে ।
.
.
পুনশ্চ-১ : এটা কোন রুপকথার গল্প নয় । অনেকের জীবনেই বাস্তব হয়ে ধরা দেয়া এক অদ্ভূত শিহরনের গল্প ।
এবার এটা লেখার কারণটা বলি, আজকাল ''ফেসবুক প্রেম/ভার্চুয়াল লাভ'' নামে এক ভাইরাসে অনেকে আক্রান্ত হচ্ছে । জানাজানি নেই, চেনা নেই- কাউকে পছন্দ হলেই জানিয়ে দিচ্ছি 'ভালোবাসী' । অনেকের হয়তো সাময়িক একটা সম্পর্ক হচ্ছে-খুব দ্রুতই আবার তা ভেঙ্গেও যাচ্ছে । ফেসবুকের বাইরে যোগাযোগ থাকলেও সম্পর্কটা অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক পথ ধরে নিয়ম মেনে হচ্ছেনা । ফলে এক্ষেত্রেও অকালেই তা পরিণতির দিকে গড়াচ্ছে ।
ভালোবাসা কিছুটা ত্যাগ চায়-কিছু কান্না চায় । এক চিমটে প্রত্যাশা-এক মুঠো স্বপ্ন আর এক গ্লাস কষ্টের বিনিময়ে যে ভালোবাসা তা এতো ঠুনকো নয় ।
পুনশ্চ-২ : আমাদের জেনারেশনের অনেকেরই এভাবে প্রেম হয়েছে । এক একটা গল্প উপন্যাসের চেয়েও রোমাঞ্চকর ।
.....এবং এই গল্পটির সাথে আমার গল্পটির খুবই সামান্য মিল রয়েছে ।