মাথার উপরে একটা সূর্য বিনাকাজে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে দেখে আমরা প্রস্তাব তুললাম সিনেমা বানানোর। সূর্যের সাথে সিনেমার সম্পর্ক নিয়ে কয়েকজন সন্দিহান হয়ে উঠলে আমরা অন্য কয়েকজন আসর ছাড়ি। সম্পর্কটা আসলে কী, সে আমরাও জানি না। কিন্তু যাদের না জানলেই চলছে না আর, তাদের সাথে সিনেমা প্রকল্প হতে পারে না। জানার চেয়ে সৃষ্টি করে নেয়া সহজ, আমরা সম্পর্ক সৃষ্টি করব।
আমরা চারজন। কিংবা সাতজন। কিংবা আরো কয়েকজন। আমরা আসলে কয়জন, কয়জন মিলে একটা সিনেমা হয়, সেটা জানা নেই। তবে আমাদের সাথে একটা সূর্য আছে। একটা চাঁদ আছে। বিশ্রী দিন ও সুশ্রী রাত আছে। অতএব, অতকিছু ভাবতে কেউই আর রাজি ছিলো না। আমরা কাঁধে কাপড় ও দু'চারটে দরকারী বই, কিছু কবিতা ও গল্প, গোটা দুই উপন্যাস নিয়ে হাজির হই রেলস্টেশান। এখানেই সিনেমার শুভ উদ্বোধন হবে। শুভ মহরত! এখানেই শুরু হবে নির্মাণ।
আমরা চার জন। চার জনেই সিনেমার প্রথম দৃশ্য। চেনা শহরে চেনা রেলস্টেশানে চেনা চারজোড়া চোখ এক অচেনা সিনেমার দিকে তাকিয়ে থাকে মধ্যরাতে।
মধ্যরাত এক প্রবল নেশা। সব মোহ ও মায়া, স্বপ্ন ও বিভ্রাট একাকার হয়ে হাতের নাগালে ভীড় করে! সিনেমার চার নায়ক, অথবা খলনায়ক, অথবা কিছুই না। এখন পর্যন্ত নায়িকা নেই। অবশ্য নায়িকা হতে পারত এমন একজন এসে একবার জেনে গেছে, কি বন্ধু আইবা নাকি। আমরা যাই নি।
আমরা কেরুদারু পান করি।
-জোছনা দেখলে আমার জ্বলে রে! চান্দের দেশে যাইয়া মুইতা দিতে ইচ্ছা করে!
প্রথম দৃশ্যের প্রথম ডায়ালগ। শুরু হিসেবে খারাপ না। জোছনা কাওকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে, এই দৃশ্য যেমন সুন্দর, তেমনি কেউ চাঁদের দেশে প্রস্রাব করে দিচ্ছে, এই কল্পনাও সুখকর।
দর্শক মজা পাবে। আগ্রহী হবে পরের দৃশ্যের জন্যে। এই আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে দর্শককে ট্রেনে উঠিয়ে ফেলতে হবে। কারণ, আমাদের সিনেমা পরের দৃশ্যে উঠে যাবে এক কুশ্রী কু ঝিক ঝিক আন্তঃনগরে। সিনেমা হয়ে যাবে নগরান্তরিত। প্রতিবেশ পালটে যাবে। দর্শক অচেনা পরিবেশে একটু নিঃশ্বাস চেপে রাখবে।
সিনেমা উঠে গেছে আন্তঃনগরে। অন্য নগরের পানে ছুটে চলছে সিনেমা। চারজোড়া চোখ ঢুলছে। আন্তঃনগর দুলছে।
-চা! লাগবে কারো!
চা কী লাগবে? সিনেমায় চায়ের প্রয়োজন কতখানি? তবে লাগুক চা। লাগাও। চায়ের মধ্যে আয়েসি ভাব আছে। চা না থাকলে আমাদের মধ্যবিত্তদের জন্য নিজেদেরকে সৌখিন হিসেবে উপস্থাপিত হতে দিতে অনেক বেগ পেতে হত।
আমাদের সিনেমার চার চরিত্রই এখন পর্যন্ত আয়েসী। এরা চা খায়, হুটহাট সিগারেট ধরায়, চকচকে টি শার্ট আর ময়লা স্নিকারের মাঝখানে রঙচটা জিন্স ঝুলিয়ে হনহন হেঁটে যায় আর ভাবে, প্রতিমাসে বেতনের ৫ শতাংশ দিয়ে হবে দারুপান। কী আছে জীবনে! তবে বেতন হতে হবে কত! ধুর! ভেবে কী হবে! আমাদের না হলে কোন শালাদের হবে!
দর্শক চা পান আর অবিরাম কু ঝিক ঝিকে বিরক্ত হয়ে উঠতে পারে। যেহেতু এটা সিনেমা, সেহেতু তাদের কথাও ভাবতে হচ্ছে। নইলে কে যায় ভাবতে! কবে কে ভেবেছে!
উস্কোখুস্কো চুল, একটানা এক সপ্তাহ পরে থাকা জিন্স দেখে কোন মেয়ে কবে মাস্তান ভেবে ভুল করেছে, কে খোঁজ নিয়েছে! দুম করে একটা ঘুষি খেয়ে কার নাক কয়দিন হাসপাতালে পড়েছিলো, সে খবর নেয়ার ইচ্ছে কি হয়েছিলো কারো!
অথচ এখন নিতে হচ্ছে। কারণ, সিনেমা বানাচ্ছি আমরা। দর্শক না দেখলে পুরোটাই ব্যর্থ।
অতএব, দর্শকের কথা ভেবেই একটু উত্তেজনা আনা যাক।
-এইযে ভাই, চারজন মিলে সিগারেট টেনে তো পুরো ট্রেনটাই অন্ধকার করে দিচ্ছেন!
-ভাই দয়াকরে এদিকে আসবেন?
-কেন ভাই?
- সিগারেট টেনে ট্রেন অন্ধকার করে ফেলার অপরাধে আপনার পা ধরে মাফ চাইতাম।
-আমি তো সেটা বলি নাই।
-আমিও তো বলি নাই যে, আর একটা কথা বললে ফেলে দেব আপনাকে ট্রেনের বাইরে। সেখানে সিগারেট নেই। শীতল বাতাস খেতে খেতে যাবেন।
নাহ! জমল না। উত্তেজনা অতি সামান্য। আরো উত্তেজনা আনতে হবে। এখন মধ্যরাত। মধ্যরাতে উত্তেজনা দর্শককে অধিক আলোড়িত করবে।
-একটু জায়গা দিন।
-এখানেই ম্যাডাম? এত লোকের সামনে?
-ভালো হচ্ছে না। আমি ওয়াশরুমে যাব। যেতে দিন।
-এখানে ওয়াশরুম নেই ম্যাডাম, আছে লোকাল টয়লেট। যান। ট্রেনের দুলুনিতে স্থির থাকতে পারবেন? না পারলে ডাক দেবেন।
নাহ! এটাও হচ্ছে না। অশ্লীলতা চলে আসছে। একটু অবমাননাও।
তবে দর্শক অশ্লীলতা পছন্দ করে। তারা পছন্দ করবে। তাদের জন্যই মেয়েটার সাথে সিনেমাকেও একই টয়লেটে ঢুকিয়ে দিতে পারলে জমত। কিন্তু মেয়েটা যে রাজি হবে না, তা তার ক্রোধান্বিত চোখ দেখেই বোঝা গেছে। আচ্ছা এই মেয়ে কী আমাদের সিনেমার নায়িকা হবে?
-আমি ঘুমামু। ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া এই মাইয়ার লগে বিশেষ দৃশ্যের শ্যুটিং করমু।
-কিন্তু সিনেমায় কোনো অশ্লীল দৃশ্য দেখানো যাবে না।
-সিনেমার খ্যাতা পুড়ি। যে সিনেমায় সেক্স নাই, সেই সিনেমায় আমি নাই।
একজন ঘুমিয়ে পড়ে। তিনজন ঝিমায়। আন্তঃনগর ছুটে চলে। রাত বাড়ে। বাড়তে বাড়তে ভোর। আন্তঃনগর অন্য নগরে থামে।
আহ! ভোরের সতেজ রাজধানী। তোমার বুকেই তবে আসন্ন সুখ নিবাস!
দর্শক, চলুন নাস্তা সেরে ফেলি। পরটা। গরম গরম। সাথে ডিম মামলেট ও আলুভাজা। চাইলে নাস্তা শেষে একটা সিগারেটও টেনে নিতে পারেন আমাদের সাথে। পরে সময় পাবেন না। সিনেমা দৌড় শুরু করবে।
সিনেমা দৌড়ায়। আমরাও দৌড়াই । সিনেমাকে ধরতে পারি না। আজব শহর। সবকিছুই দৌড়াচ্ছে! এই শহরে তবে দৌড়ে যাওয়াটাই নিয়ম?
অবশেষে সিনেমা থামে শহরের উপকন্ঠে। ক্ষীণকায়া এক কক্ষে। সাথে আমরা হাঁফাতে থাকি। এই কক্ষে চার জন! ধুর, ভেবে কী হবে! ক'দিন পরেই শহরের নেত্রবিন্দুতে আয়েসী বাসস্থান খুঁজে নেয়া যাবে। সাধারণ মানুষ সিনেমায় রঙিন দালান দেখতে পছন্দ করে। সাধারণ মানুষের এই বিলাসিতা! অন্যের সুন্দরী বঊ দেখার স্মৃতি রোমন্থন করে এরা নিজেদের কুশ্রী বউকে ক্রমাগত চাষাবাদ করে অপরিকল্পিত ফসলে ভরিয়ে তোলে শহরের যান্ত্রিক জমিন।
আমাদের সেই বিলাসিতা নেই। কেবল মাঝে সাঝে একটু রংপানি, আর ভাড়ানারী যদি মেলে, না মিললেও ক্ষতি নেই।
-চল আমরা দাপ্তরিক পোষাক পরিচ্ছদ বানিয়ে ফেলি। সিনেমার দর্শক এটা পছন্দ করবে। হালারা নিজেরা পরবে লাল নীল ছেঁড়া খোঁড়া। আর সিনেমায় ফিটফাট না পেলে কইবো পইসা ফ্যারত দ্যাও।
সিনেমা এরপর দাপ্তরিক হয়ে উঠে না অচেনা দপ্তর সিনেমা হয়ে উঠে, সে ঠাহর হয় না। তবে আমরা দেখি, দর্শক হা হুতাশ করে উঠলে কিংবা অভিনেতাদের ঘিলু নিয়ে মন্তব্য ছুড়ে দিলে সিনেমা বাঁক খায়। আমরা আজ এসেছিলাম কর্পোরেট চাঁতালে, ফিরেও যাচ্ছি। আমরা জানতাম না হালচাল। আমাদের দাপ্তরিক পোশাক ও প্রতিজ্ঞ মুখ, অনভিজ্ঞতার বিপরীতে কোনো কাজেই আসে নি।
আমরা ফিরে যাই। আমাদের সাথে সিনেমাও ফেরে। দর্শকদের দিকে চোখ উঠছে না। আমাদের এই অপ্রতুল আবাস চেপে ধরে, মায়ায় বাঁধে। আমাদের মনে হয়, এই মায়া থেকে আর বের হতে পারবে না সিনেমা।
-বাল! চল মাল খাই। এইভাবে ফিরায় দিছে যে মাইনা নিতে পারতাছি না।
-কিন্তু এখন পানি খেলে পুরা মাস সকাল বিকালের নাস্তা বন্ধ থাকবে।
-বাল!
সিনেমায় অশ্লীল শব্দ ঢুকে পড়ছে। ঢুকুক। জীবনেও অশ্লীল ব্যপারস্যাপার ঢুকে পড়ছে। সিনেমা বরঙ জীবনমুখী হচ্ছে।
-পাতা খাই চল।
পাতায় বুঁদ হয়ে পড়ে সিনেমা। পত্রিকার পাতার যেসব স্থানে এতদিন অবজ্ঞায় তাকানো হয়নি, সেসব স্থানে, আন্তর্জালে যেসব সাইটে যেতে ইচ্ছে হয়নি একবারো, সেসব সাইটে স্থায়ী নিবাস হয়ে উঠে
তবু মেলে না। সিনেমার দৈর্ঘ্য বাড়ে কিন্তু দৃশ্যের হের ফের হয় না। দর্শক বিরক্ত হয়। অভিনেতারা নির্জীব হয়। দর্শকের বিরক্তি নিয়ে অভিনেতারা, সাথে আমরা ছিটকে পড়ি এখানে ওখানে।
আমাদের আয়েসী জীবনের অভিলাষ মিটে যায়। লালপানির রাতে কেবল পাতা পুড়ে, পানি আর আসে না। সকালের নাস্তায় কেবল সিগারেটের ধোঁয়া, বিকেলের নাস্তায় কেবল সিগারেটের ধোঁয়া। সিনেমাহল থেকে উঠে যাচ্ছে দর্শক। আমরা আটকে থাকি পর্দায়। আমাদের অভিনেতারা আটকে থাকে।
গল্প সৃষ্টি হয় না। অথচ সিনেমার জন্য নতুন নতুন গল্প দরকার। রোমান্স দরকার। নায়িকা দরকার। আমাদের একজনের অবশ্য একজন নায়িকা আছে বর্তমান। কিন্তু সে অভিনয় করতে রাজি না। পারশ্রমিক পাবে বলে তো গ্যারান্টি নেই। বাকিদের নায়িকা নেই। ছিলো অথবা কোনোকালেই ছিলো না। আসেই নি অথবা হারিয়ে গেছে।
-সিনেমার খ্যাতা পুড়ি!
রাত বাড়ে। নির্জীব হয় প্রেক্ষাগৃহ। আমরাও নির্জীব হই। পাতা পুড়ে যায়। পানি ফুরিয়ে যায়। ঘুম ছুটে যায়। তবুও গল্প আসে না।
তারপর রাত শেষে, এক কিংবা অনেক রাত শেষে, আমাদের একজন চিৎকার করে বলে, পেয়েছি, গল্প পেয়েছি, দাপ্তরিক পোষাকের গতি হবে এবার, সিনেমায় আবার আসবে বেগ, রোমান্স, চাই কি একটা গান, দুটো মারামারি!
কিন্তু আমাদের গল্প আর জমে না। সিনেমা দেখবে বলে দর্শক ভিড় করে, কিন্তু আমরা নির্জীব। দাপ্তরিক পোষাক জৌলুস হারায়।
আমাদের যখন গল্প ছিলো অনেক, চাইলেই একটা কিংবা কয়েকটা সিনেমা বানিয়ে ফেলতে পারতাম, আমরা তখন পারিনি কেবল একটা ক্যামেরা কেনার পয়সা ছিলো না বলে, আর এখন আমাদের নিজস্ব ক্যামেরা আছে, কিন্তু কোনো গল্প নেই বলে সিনেমা বানাতে পারছিনা। যে সিনেমা আমরা বানাতে চেয়েছিলাম, সে সিনেমা আমরা আর বানাবো না।
*********
উৎসর্গঃ দুই বন্ধু, বিনয় আর শামীম, যারা এই গল্পকে সবচেয়ে ভালো বুঝতে পারবে।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:৫১