-উঠে পড়ুন, ম্যাডাম!
মেয়েটা উঠে পড়ে আমার পাশে। আমি বোতাম চেপে জানালার কাঁচ এঁটে তাপনিয়ন্ত্রককে কাজ শুরু করার আদেশে দেই। তারপর ছুটে চলার সূচনা করি। সোজা দক্ষিণে। গাড়ির গতি মাঝারি রাখলেই হবে। সময়ের ঠিক আগেই পৌঁছে যাবো। এখন মধ্যরাত। শহর থেকে বেরিয়ে যাব অতি দ্রুত। আমি হাত বাড়িয়ে চালিয়ে দিলাম রবীন্দ্র সঙ্গীত!
'যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন...'
-দয়া করে বন্ধ করুন গানটা।
আমি চমকে উঠলাম। হাত বাড়িয়ে ঘুমোতে পাঠালাম সাদী মুহম্মদকে। দুঃখিত, সাদী ভাই, আপনাকে এই প্রথম থামিয়ে দিলাম শুরু না হতেই।
-আমি এই সময়ে রবীন্দ্র শুনতে চাচ্ছি না।
-আপনি কী অন্য কোনো গান শুনতে চান? অন্য কারো?
-না।
সে বাইরে তাকিয়ে থাকে। বাইরে একরাশ অন্ধকার। দেখার চোখ থাকলে অন্ধকারে অনেক কিছু দেখা যায়। আমি মনে করি, সব সত্য লুকিয়ে থাকে অন্ধকারে। আলোতে সব মিথ্যা ঘুরে ফেরে। আপনি জানেন, আপনার বন্ধুরা কতটা সহমর্মিতা নিয়ে আপনার পাশে আছে। অথচ অন্ধকারে চাপা পড়া সত্য হল, ওরা আড়ালে আপনাকে হাসির উপলক্ষ্য বানায়। অস্বীকার করে লাভ নেই আপনিও তা করেন।
দিনের আলোয় আপনার যে প্রেমিকা আপনাকে নিজ হাতে খিচুড়ি রান্না করে ডিমের ওমলেট দিয়ে খাওয়ায়, রাতের আঁধারে সে হয়তো অন্য কারো হয়ে ঘুমায়, সে কী আপনি জানেন!
অন্ধকারেই লুকিয়ে থাকে সত্য। দেখার চোখ থাকলে দেখা যায়। অবশ্য এই মেয়ের সেই দেখার চোখ আছে কী না আমি জানি না। আমি মেয়েটার কিছুই জানি না। নাম ঠিকানা বয়স কিছুই না। সে বিবাহিত না অবিবাহিত, তার ফুটফুটে একটা বাচ্চা আছে কি নেই, তাও জানি না।
ব্যপারটা হচ্ছে, অফিস থেকে আজ ফিরতে গিয়ে থেমে গিয়েছিলাম বারের বারান্দায়। মাঝে মাঝে কয়েক পেগ ঢালি। আর বাদাম চিবাই। ধনে পাতা, কুচি পেয়াজ মরিচ মাখা। সাথে ছোট চুমুকে লালজল।
ওখান থেকে বেরিয়ে গাড়ির হলদে আলো মোড় ঘুরিয়ে দিতেই দেখি উনি হাত তুলে দাঁড়িয়ে। গতিনিরোধ করলাম। আহ! অনেক দিন পর কেউ হাত তুলল আমার জন্য। জানালায় কাঁচ নামিয়ে দিতেই বুঝলাম, আমি তার গন্তব্য জানি।
-অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছেন, সুরপা?
মেয়েটা চমকে উঠে। কিন্তু হুট করে মাথা ঘুরিয়ে দেয় না আমার দিকে। এ ব্যপারটা ভালো লাগে আমার। এর মানে, মেয়েটা তার সিদ্ধান্তের ব্যপারে সুস্থির। শেষ সময়ে ফিরে আসতে চাইবে না।
-আপনি আমার নাম জানেন কীভাবে! আপনি কী আমাকে চিনেন আগে থেকেই!
মেয়েটার নাম সুরপা তাহলে! কাকতাল ব্যপার। আমি জানি না। সুরপা নামে কেউ পরিচিত নেই আমার। নামটা এমনকি আমি ভেবেও বলি নি।
- আমি আপনার নাম জানতাম না। তবে আপনার নাম সুন্দর। মনে হচ্ছে, চর্যাপদ থেকে উঠে আসছেন। চর্যার নায়িকা আপনি। আপনার জন্যই কাহ্নপা লিখে গেছেন,
"নগরবাহিরি রে ডোম্বি তোহোরি কুড়িআ।
ছোই ছোই জাহ সো বাহ্মনাড়িয়া॥"
-থামুন! আমি চর্যার কেউ নই। পদ বুঝিও না। আপনি গাড়ী চালান।
সে অন্ধকারে ফিরে চায়। আমি হলদে আলোর রাস্তায়। সাঁই! পাশ দিয়ে ছুটে যায় আরেকটা কার। সাঁইইই! ছুটে যায় একটা বাস। শোঁওওওৎ! এবারে একটা ট্রাক!
সুরপা নামের মেয়ে। কাহ্নপাকে চিনে না। সুরপা নামের মেয়ে। অন্ধকারে তাকিয়ে থাকে।
-আমার নাম সুরপা না। আমার কোনো নাম নেই। আমার অতীত নেই। আপনি মদ খেয়েছেন। আমাকে একটু মদ দেবেন?
-আমার কাছে তো নেই! অবশ্য ভেতরে আছে। ঠোঁটে লেগে থাকতে পারে দু'এক ফোঁটা! আপনি চাইলে চুষে নিতে পারেন, আমার আপত্তি নেই।
-আমার আছে। তাতে চুম্বনের সৃষ্টি হবে।
-আপনার আপত্তি তবে চুম্বনে! অথচ এটা মৌলিক ও নিষ্পাপ!
-আমি জানি। কিন্তু আমি করবো না। আপনি বুঝতে ভুল করবেন। আপনারা চুম্বনকে প্রেম ভাবেন। অথচ চুম্বনেই প্রেম হয় না, আবার চুম্বন ছাড়াও প্রেম হতে পারে! আমি চাই না আপনি ভুল বুঝুন।
সুরপা হাঁপিয়ে উঠে। আমি আর কথা বাড়াই না। সে অন্ধকারে ফিরে চায়।
-সুরপা, ঠিক কখন আপনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? কেন নিয়েছেন? যদি বলতে সমস্যা না থাকে।
-সমস্যা নেই। আজ সন্ধ্যায়। আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। প্রথমে ভেবেছিলাম, ছাদ থেকেই হবে। কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারছিলাম না। পরে আপনার কথা মনে পড়লো।
-কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন?
- সন্ধ্যা থেকেই। আপনার সাথে মধ্যরাতে দেখা হয়।
-আমি ক্ষমাপ্রার্থী। প্রথমত, আমি বারে থেমেছিলাম, মদ্যপান করতে। দ্বিতীয়ত, আপনি যখন মদ খেতে চেয়েছিলেন, আমি মিথ্যা বলেছি। আমার কাছে কিছু পরিমাণ অবশিষ্ট আছে।
-ধন্যবাদ। এখন লাগবে না। তার চেয়ে বলুন, আর কতক্ষণ লাগবে আপনার সেই ঘরে পৌঁছাতে? রাত শেষ হয়ে আসছে!
-আমরা কাছাকাছিই আছি। খুব শ্রীঘ্রই পৌঁছাবো।
সুরপা ফিরে যায় অন্ধকারে চোখ রেখে। আমি হলুদ আলোতে।
-সুরপা। পদ্ধতিটার একটা ব্যপার আপনাকে আগে বলা হয় নি। আপনাকে ভালবাসতে হবে, এবং ভালোবাসতে দিতেও হবে। ভালোবাসায় উষ্ণতা জাগে। আপনার ভেতর সুন্দর কিছু উষ্ণতার সৃষ্টি হতে হবে।
-ভালোবাসাটা মদের মত। আমি মদ অপছন্দ করি। তবে একাজটা করবো। আপনার পদ্ধতিটার সম্মানে। যদিও আমি মনে করি, আপনার পূর্বেই জানানো উচিত ছিলো। সেক্ষেত্রে আমি এই পদ্ধতি গ্রহণ করতাম না।
-না জেনে অনেক কিছুই করি আমরা, সুরপা। মেনেও নিই।
রাত ফুরিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। আমি ঋদ্ধ হচ্ছি। সুরপা রাতের সাথে ফুরিয়ে আসছে। আমরা কালচে অন্ধকার আর হলদে আলোয় চোখ ভাসিয়ে ভাসিয়ে পৌঁছে যাই বিজ্ঞাপিত বাড়িতে। সুরপা গাড়ি থেকে নেমে সোজা ঢুকে পড়ে। আমি তার পিছু নিই। ঘরের একটাই দরজা। একটাই জানালা। পূর্বমুখী। এখন ওপাশে অন্ধকার। অন্ধকারের ভেতর সাপের মত শুয়ে আছে এক চিলতে জলাধার। পাড়ে তার চেনা অচেনা বৃক্ষরাজি, যাদের শেকড়ে সাপ ও ডালে পাখি ঘুমায়।
জানালার এপাশে একটা চেয়ার। নরম গদি ও হাতলযুক্ত। তার পেছনে সাধারণ খাট, সুরপার জীবনের মত সাধারণ। পাতলা বিছানা আর এক জোড়া বালিশ। এখানে যারা আসে, তারা হয় জোড়া বালিশে অভ্যস্থ অথবা এক বালিশে অভ্যস্থ হলেও এখানে এসে জোড়া বালিশ খোঁজে। আর দেয়াল ঘেঁষে আধা ডজন বড় বড় বৈদ্যুতিক পাখা, নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে।
-আপনি শুয়ে পড়ুন, সুরপা।
-আমাকে কী নগ্ন হতে হবে? পদ্ধতিটা কী আমার নগ্নতা চায়?
-নগ্ন হতে আপত্তি আছে আপনার?
সুরপা চুপ থাকে। তার নির্বাক অনাপত্তি আমাকে খুশি করে। সে আসলেই স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছে। এ পারবে। পুরো ব্যপারটার উত্তেজনাপূর্ণ ও আনন্দদায়ক সমাপ্তি হবে। পূর্ণ তৃপ্তি নিয়ে আমরা ফিরে যেতে পারবো যে যার গন্তব্যে।
-আপনাকে নগ্ন হতে হবে না, সুরপা। ভালোবাসায় নগ্নতা অনাবশ্যক। আপনি শুয়ে পড়ুন। পাঁচ মিনিট। শীতল ও শিথিল হোন। উষ্ণ হয়ে উঠার আগে শীতলতা ও শিথিলতা আবশ্যক।
সুরপা শুয়ে পড়ে। আমি বাইরে যাই একটা সুতি পরিষ্কার কাপড় ও এক বাটি ঠান্ডা জলের সন্ধানে। আমি জানি, এসব কোথায় পাওয়া যাবে।
ঠিক পাঁচ মিনিট পর আমি তাকে বসিয়ে দেই চেয়ারটাই। জানালার ওপাশের অন্ধকারের মুখোমুখি। তাকে নির্মোহ ও নিরুত্তাপ দেখাচ্ছে। ঠিক যেমনটা এ সময়ে প্রয়োজন। আমি হাতলে আটকে দেই তার হাত। নরম রাবারে।
-তাহলে আপনি বলছেন আপনার নাম সুরপা না।
-জানি না আমি।
- আলতো করে চোখের দরজা বন্ধ করে দিন। আপনি আর ফিরে যেতে চান না। অথবা আপনি ফিরতেই চাচ্ছেন নিজস্ব গন্তব্যে। আমি আপনার যাত্রা শংকামুক্ত ও নিশ্চিত করছি মাত্র।
আমি সুরপার চুল এলোমেলো করে দেই। দুই হাতের তালু রাখি তার পায়ের পাতায়। তারপর আমার হাতজোড়াকে উঠে যেতে দেই। পায়ের তালু থেকে দীর্ঘ পা বেয়ে কোমর। তলপেট ছুঁয়ে উদ্ধত পেলবতার পাশ ঘেঁষে দুই বাহু। গলা বেয়ে চিবুক। তারপর চেপে রাখি তার দুই গালে। এবং সবশেষে একটা আঙুল তার ঠোঁটে। সুরপার কম্পাংক বেড়েছে। নিঃশ্বাস কিছু গাঢ় ও প্রলম্বিত হচ্ছে। গহীনে জেগে উঠছে উষ্ণতা।
-সুরপা, অথবা আপনি সুরপা না। আপনার সামনে আমি। পেছনে কেউ নেই। এ ঘরে একটা দরজা আছে। সেটা রুদ্ধ। সামনে জানালা। তার ওপাশে অন্ধকার। আপনি অন্ধকারে যাবেন। আমি সহযোগিতা করবো মাত্র। আপনার ঠোঁটে আমার আঙুল । অনুভব করুন। অথবা কল্পনা। আঙুলের উষ্ণতা মিশে যাচ্ছে আপনার ঠোঁটে। সুরপা, আপনার ঠোঁটজোড়া সুন্দর। আপনি সুন্দর। অপেক্ষমান অন্ধকার সুন্দর। সুন্দরে সুন্দর মিলিয়ে যাবে।
আমি সুরপার ঠোঁটে আঙুল বুলিয়ে যাই। বায়ে থেকে ডানে। ডান থেকে বায়ে। ক্রমাগত। তার নিঃশ্বাস গভীর, ধীর ও প্রলম্বিত হয়। অন্য হাতে ছুঁয়ে দেই তার আঙুল। ক্রমাগত।
-ভাবুন সুরপা। অথবা কল্পনা করুন। আপনি উষ্ণতা পাচ্ছেন। আপনার ঠোঁট আমার আঙুলকে ভালোবাসে। আমার আঙুল আপনার ঠোঁটকে ভালোবাসে। তারা পরস্পর উষ্ণতা বিনিময় করছে। সেই উষ্ণতা জমা হচ্ছে আপনার গহীনে।
সুরপার কপাল চিকচিক করে ঘামে। উষ্ণতার লক্ষণ। আমি মাত্রা বাড়িয়ে দেই। সময় হয়ে আসছে। সুরপা হঠাৎ দম হারায়। চোখ মেলে ধরে। লালচে চোখ।
-স্বাগতম অজানা যাত্রায়। দেখুন। পূবাকাশে একরাশ হালকা আলোর পোচ। দেখা যায় কি যায় না। আপনি ঐ আলোর দিকে তাকিয়ে থাকুন। ওখানেই আপনার যাত্রা। নিচের অন্ধকারে চোখ রাখবেন। ওখানে জলাধার আছে। জলের গায়ে গায়ে কুয়াশা আছে। এখন দেখা যাচ্ছে না। আলো নেমে এসে কুয়াশার ফোকর বেয়ে জলে গা ভেজালে দেখা যাবে। আপনি সেই অপার্থিব দৃশ্য দেখতে দেখতে যাবেন। আমরা উষ্ণতাপ্রাপ্তির পর এখন উষ্ণতা হারাবো। আপনি প্রস্তুত।
আলো ফুটছে। ভোরের দিকে হাঁটছে রাত। সুরপা তার সমস্ত উষ্ণতা নিয়ে স্থির চেয়ে আছে। আমি একে একে চালু করে দেই সবগুলো পাখা। ক্রমাগত তাদের ঘূর্ণন বাড়বে। বাতাসে জোর ঘূর্ণি হবে। প্রচন্ড বেগে সুরপার দুই কাঁধ ছুঁয়ে ধেয়ে যাবে খোলা জানালার পথে।
বাতাসের প্রবাহ বাড়ে। আরো এক ঝলক আলো ছড়িয়ে পড়ে। বাতাস কেড়ে নিতে থাকে সুরপার উষ্ণতা। আমি ভেজা কাপড় জড়িয়ে দেই তার মুখে। তীব্র বাতাস। শরীরে তাপ, ক্রমাগত হারাচ্ছে। গহীনে কামনা। ঘুমে চোখ ঢুলু ঢুলু। বাইরে একটা পাখি ডাকছে। একরাশ লাল আলো আকাশে। জলাধার দৃশ্যমান। জলের সাথে কুয়াশার সাথে আলোর মিশ্রণ। রাত আর ভোরের অপার্থিব সঙ্গম। সুরপার পৃথিবী শীতল হয়ে আসছে। প্রবল বাতাস আর ভেজা কাপড়ের দেয়াল আটকে দিচ্ছে শ্বাসের বাতাস। ফুসফুস কাজ হারাচ্ছে। হারাতে হারাতে থেমে যাবে। সুরপা ভোরের মদে বিভোর হয়ে টের পাবে কি পাবে না। পারবে মেয়েটা। অবচেতনে সচেতন মৃত্যুকে সহজেই গ্রহণ করতে পারবে। চমকে উঠবে না।
-আহ!
হাঁসফাঁস করে উঠে সুরপা। আলো বাড়ে। আমি চমকে উঠি না। খুশীবোধ করি। পেরেছে মেয়েটা। বোতাম চেপে বন্ধ করে দেই কৃত্রিম ঝড়। তুলে ফেলি ভেজা কাপড়ের দেয়াল।
-আমি! আমি ভোর হতে দেখতে চাই!
সুরপার চোখে কাতরতা।
-অবশ্যই।
আমি তাকে দাঁড় করিয়ে দেই জানালায়। তার চোখ জলে। সেখানে কুয়াশা আলোর মিলন ভেঙে ভেসে যায় একটা নাম না জানা সাপ।
সুরপা ভোর দেখছে। ভোর মদের মত। আর চোখ জলে চিক চিক করে। এই জলও মদের মত। প্রবল নেশা। প্রবল ঘোর।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই নভেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৩:৫৮