১৯৭২ সনের ১০ জানুয়ারী যে মাটিতে বঙ্গবন্ধু পা রাখলেন সেটা আর পাকিস্তান নয়, এটার নাম বাংলাদেশ। তাজ, কাদের, ওসমানী, জিয়া প্রমুখ মিলিটারী, অ-মিলিটারী, আ-লীগ ও অ আ-লীগ তরুন, যুবা, প্রৌঢ় মিলে আস্ত একটা দেশই বানিয়ে ফেলেছে। অনুপস্থিত মহান নেতার জন্য এটা বিরাট সফলতা যে, তার আদর্শিক সাকসেসররা পুরোপুরি সফল।
তবে তার সাকসেসররা সফল হলেও তিনি নিজে হন ব্যর্থ। তাঁর ব্যর্থতার ঘানি এখনও আমাকে, আপনাকে, জাতিকে টানতে হচ্ছে। ২০১৩ সালে এসেও...........।
বৈষম্যের অবসান, সকল মতের নির্ভীক প্রকাশ তথা গণতন্ত্র, কর্মসংস্থান, উন্নয়ন ও আত্নসম্মান নিয়ে সাদামাটা ব্যক্তিজীবন যাপনের 'উষ্ণ' মৌলিক মানবিক আকাংখা নিয়ে যে রক্তিম বাংলাদেশের জন্ম মুজিব, তার সরকার, দল আওয়ামীলীগ তাতে 'পানি' ঢেলে দেয়। রাজনৈতিক মত, ধর্ম, নির্বিশেষে সকল বাংলাদেশীর নেতা হওয়ার পরিবর্তে তিনি বামধারার আওয়ামীকোটারী গোস্টির নেতায় পরিণত হন। এমনকি টোটাল আওয়ামীলীগকেও মুজিব ধারন করেননি। ত্যাগী তাজউদ্দিনদের স্থলে ধান্ধাবাজ মোশতাকরা তার সভাসদে স্থান পায়! যেমনটি তার কন্যা এখন বামধারার নব্যলীগার ও গোপালগন্জিকার খপ্পড়ে পড়েছেন।
যাহোক মুজিব ১৯৭০ সনের পাকিস্তান পার্লামেন্টের জন্য নির্বাচীত এ প্রদেশের এমপিদের নিয়ে বাংলাদেশের সরকার গঠন করেন। অথচ দেশ পাকিস্তান, তার সংবিধান ও নির্বাচন তখন সবকিছুই আমাদের কাছে ইনভেলিড। বরং এ সময় দেশে সর্বদলীয় জাতীয় সরকার গঠন করে তাদের অধীনে দ্রুত নির্বাচন, সংবিধান প্রণয়ন, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ গঠনের কাজে নেমে পড়া যথোচিত ছিল। যুদ্ধবিস্তত্ব একটি দেশে এমনটাই হয় (সর্বশেষ উদাহরন- পূর্ব তিমুর)। তা না করে বাংলাদেশের জন্মেই মুজিব একটি শাসনতান্ত্রিক অবৈধতা জুড়ে দেন।
৭ মার্চ ১৯৭৩ সালে আ'লীগের অধীনে ১ম সংসদ নির্বাচন হয় ও প্রয়োজন না থাকলেও আ'লীগ তাতে ব্যাপক মাস্তানি ও কারচুপি করে। সম্ভবত: অন্তরের গহীনে 'হেরে' যাবার ভয় ছিল! তার ব্রুট মেজরিটি নিয়ে নেয় এবং বাংলাদেশের শাসনতান্ত্রিক ধারাবাহিকতায় কল্যানকর কিছু যোগ করার পরিবর্তে এটাকে সাংবিধানিক মগের মুল্লুকে পরিণত করে। ৪র্থ সংশোধনির মাধ্যমে এককথায় সকল দল মত বিলুপ্ত (এমনকি আ'লীগও!), মুজিবকে অনন্তকালের প্রধানমন্ত্রী, ঐ সংসদকে প্রায় আ'জীবন বহালরাখার অনুরূপ বিধানাবলী যোগ করে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের কবর রচনা করা হয়। যে ১৫ টি সংশোধনির মধ্যদিয়ে আজকের বাংলাদেশের সংবিধান; ৪র্থ সংশোধনীর মত অন্যায্য, অনুচিত, ন্যক্কারজনক সংশোধন তাতে কখনো করা হয়নি। খায়রুল হক ও অন্যান্য এহেন 'ন্যায়বান' বিচারকদের মগজ ব্যাকগিয়ারে ৫ম সংশোধনিতে গিয়ে কোন 'আবেগ' বা 'অনুরাগের' বশীভুত হয়ে থেমে গেল- তা আমাদের বোধগম্য নয়! এত বড় মহান রায়ে ৪র্থ সংশোধনীর 'হরিলুট' নিয়ে কিছুই বলা হল না। যাহোক, এভাবে মুজিব তথা শেখ পরিবার ও বাঁ-লীগরা প্রথম শাসনতান্ত্রিক সংকটের জন্ম দেন। ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায় যে- জনগন ভোট কম দিয়ে 'শেখ মুজিবকে' কে যে বিরোধীদলে নিরাপদে বসাবেন সে রাস্তা তিনিই রুদ্ধ করেছেন! ইতিহাসের কি পুন:পাঠ- আজ তার কন্যা ঠিক তাই করছেন!
আদর্শ মেনে চলতে গেলে সেনাপতি জিয়া একটি ভোটের ব্যবস্থা করে ব্যারাকে ফিরে যেতে পারতেন। কিন্তু সে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তিনি পাননি। বরং তার ভাগ্যে একটি নিদারুন সামরিক ও বেসামরিক ডামাডোল পড়েছে। এমতাবস্থায় সুশীল সেনাপতি হয়ে বড়জোর তিনি অকালে প্রাণ দেয়ার ফাঁদে পড়তে পারতেন!! জিয়ার সব কাজ জাস্টিফাই করা যাবেনা। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত সকল অন্যায্য ও অগণতান্ত্রিক কর্মের মূলকারণ- ৪র্থ সংশোধনী, বাঁ-লীগ বেস্টিত মুজিবের জুলুমে ভরা শাসন তথা শিশু বাংলাদেশে সুস্থ, স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক সমাজ, মত, মতবাদ বিকাশে বাধাদান।
তবে ৪র্থ সংশোধনীর ৬ বছর পর নানান ঘাটে পানি খাওয়ার পরও বাঁলীগের চেতনা শুদ্ধ হয়নি। বৃদ্ধ বিচারপতি সাত্তারের 'প্রায় গণতান্ত্রিক' সরকারকে ভারতের একনিস্ট দালাল লেজেহুমু এরশাদ বন্ধুকের মুখে উচ্ছেদ করলে- আজকের লীগ নেত্রী হাসিনা তার নিন্দা করেননি, নীরবও থাকেননি, সাধুবাদ জানিয়েছেন! সর্বদলীয় জোট স্বৈরাচারের পাতানো নির্বাচনে অংশ না নেয়ার প্রতিজ্ঞার সাথে তিনি ও জামাত বেঈমানী করে এরশাদকে জাতির ঘাড়ে আরো ২-৩ বছর প্রলম্বিত করেন! প্রসংগত: ১৯৯৬ সালে জেনারেল নাসিমের ব্যর্থ অভ্যুল্থানে গোপনে ও ২০০৭ সালে জেনারেল মঈনের অভ্যুল্থানে প্রকাশ্যে শেখ হাসিনা সমর্থন দেন!! তবে চান্স পেলেই তিনি ও তার পেয়াদারা বিএনপিকে 'ক্যান্টনমেন্ট' বর্ন গালি দেন! পাঠকরা ১৯৮১-২০০৭ সালের পত্রপত্রিকা আর্কাইভ থেকে পড়ে এ ব্যাপার পরিস্কার হতে পারেন।
১৯৯১ এ মূলত একটি ইনফর্মাল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে এরশাদ রিজাইন করেন। বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের সে সরকার স্মরণকালের সুস্ঠ:তম ৫ম সাধারন নির্বাচন করেন ও বিচারবিভাগে ফিরে যান। বিএনপি ১৪০, আলীগ ৮৮, জাপা ৩৫, জামাত ১৮, বাকশাল ৫, সিপিবি ৫ ও বাকিরা অন্যান্য আসন পান। জামাতের দরবারে ঘুরাঘুরি করলেও আলীগ 'টাফ' ক্যালকুলেটেড মেজরিটি পায়নি, বরং বিএনপিকে তারা 'আল্লাহর ওয়াস্তে' সমর্থন দান করে। এ রকম আহাম্মক রাজনৈতিক দল ভূ-পৃস্ঠে আর আছে কি না সন্দেহ! শুধু তাই নয়, সংরক্ষিত আসন তারা এমনভাবে ছেড়ে দেয় যে, পরবর্তীতে বিএনপিকে টাইট দেয়ার মত পার্লামেন্টারী উইপন তাদের ছিলনা।
এদিকে, শেখ হাসিনা খালেদাকে 'গণতন্ত্র শিখিয়ে ছাড়বেন' বলে সরকার বিরোধী মিশনে নেমে গেলেন। ইন বিটুইন বিএনপির খুছরা কুকর্ম ও জামাতের দুর্বোধ্য রাজনৈতিক অবস্থানে কেয়ারটেকার সরকার নামক একটি বস্তুর দাবিতে ধীরে ধীরে আন্দোলন জমতে থাকে। ১৯৯৫ এর শেষ নাগাদ তা ভয়াবহ আকার ধারন করে। সরকারের বিরুদ্ধে ইস্যুভিত্তিক নয় বরং শাসনতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় আ'লীগ (ও জাপা/জামাত)। তবে ৫ম সংসদের বিএনপি তাতে নতি স্বীকার করেনি। বরং, কেয়ারটেকার পাস করে ৬স্ট সংসদ, যাকে অবৈধ বলে প্রায়শ: গালমন্দ শুনতে হয়! যাহোক এভাবে, বাংলাদেশের শাসনতান্ত্রিক ধারাবাহিকতায় ১৯৯১ এর ইনফর্মাল ব্যবস্থাটি স্থায়ী রূপ লাভ করে। ২০০১ সালে বড় ধরনের কোন ট্রানজিশনাল কেওয়াচ হয়নি। কিন্তু ২০০৬ সালে এসে একেবারেই শিশুসুলভ আচরন করতে শুরু করে শেখ হাসিনা, লীগ ও তদীয় অনুগতজনরা। নিজের আদায়কৃত শুধু তত্ত্বাবধায়ক ফর্মুলার উপর উনার ভরসা নেই (যদিও এ লেখকের অভিমত কে এম হাসানের অধীনে ভোটে অংশগ্রহন করলেও আ'লীগ কম বেশী বর্তমান কালের সমান আসনই পেতেন)! কে.এম. হাসান খ্রিস্টপূর্ব কোন এক সালে বিএনপির অমুক জেলার তমুক সম্পাদক ছিলেন, ছুতা-১। সরকার বদ নিয়তে বিচারপতিদের রিটায়ারমেন্ট এজ ২ বছর বাড়িয়েছে, ছুতা-২। আচ্ছা, বিচারপতিদের বাড়ানো বয়স কি তবে আ'লীগ এখন কমিয়ে দিয়েছে? সংবিধান সংবিধান বলে অধুনা মুখে ফেনারত শেখ বংশ ও তার বশংবদরা মাত্র ক'দিন আগেই আস্ত সংবিধানসম্মত 'কে. এম. হাসান কে' গায়ের জোরে ও ভারতের মদদে মানিনা, মানব না বলে পাড়া মাতিয়েছেন। ৩য় বারের মত দেশের শাসনতান্ত্রিকতায় শেখ হাসিনা, তার উপদেস্টা ও অনুগতরা ফাটল সৃস্টি করেছেন।
নানান মচ্ছবের পর ২০১৩ সালের শেষ নাগাদ ভালোয় ভালোয় পরবর্তী তত্তাবধায়ক সরকারের কাছে বিনা ঝামেলায় ক্ষমতা হস্তান্তর না করার আগাম ফন্দি ফিকিরের পার্ট হিসেবে মামলা মোকদ্দমা, রায়, সংবিধান সংশোধন ইত্যাদি কাহিনীর জন্ম দিয়েছেন। এমিকাস কিউরিদের প্রায় সবাই বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে ট্রানজিশনাল এ সিস্টেম বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন, কোর্টও আরো ১০ বছর তা রেখে দীর্ঘমেয়াদে ভিন্ন চিন্তার এডভাইস দিয়েছে, কনসার্ন পার্লামেন্টারী কমিটি বলেছে, সিস্টেম বহাল রেখে বিচারপতির স্থলে অন্যদেরকে ঢুকাতে- আর মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা নিছক একক জেদে অথবা কতিপয় বাঁলীগ কুলাঙ্গারের ফুসলানিতে গভীর মতলবে তা এক কথায় বাদ দিয়েছেন। ১৫ তম সংশোধনীর মাধ্যমে আননেসেসারিলী বাংলাদেশের শাসনতান্ত্রিক ধারাবাহিকতাকে খাদে নিক্ষেপ করা হয়েছে। ১৬ তম সংশোধনী ছাড়া এ দেশ এখন কোমর সোজা করে দাড়াতে পারবেনা।
নানান দোষে দুস্ঠ হলেও বাংলাদেশের আর কোন রাজনৈতিক দল এ দেশ ও উহার সংবিধানকে এতবার দলিত মথিত করেনি, আর কোন পরিবার নয়, আর কোন ব্যক্তিও নয় যতটা করেছে আওয়ামীলীগ, শেখ পরিবার ও তাদের প্রধানরা। যেসব সৎ শিক্ষিত আওয়ামীলীগ সমর্থক এসব ইতিহাস জেনেও 'গোঁ' ধরে আছেন আপনাদের জন্য একটাই শুভ কামনা- ভাল থাকুন, চুপ থাকুন, পড়ুন ও বুঝুন!!
