মাস্টার ডিগ্রী অর্জন করে সবে বেশ কয়েকটি চাকরীর পরীক্ষা দিয়েছি । কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের চাকরী - এসব বাছবিচার করতাম না । এই দুর্মূল্যের বাজারে একটি চাকরীর দরকার। কাজেই যেকোন একটা চাকরী হলেই চলবে। কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে প্রত্যাহিক সংবাদপত্রের যেকোনো চাকরীর খবর দেখলে, উপযোগী মনে করলে আবেদন করতাম । বরাবরই স্কুল শিক্ষকতার প্রতি একটু ঝোঁক ছিল । তুলনামূলকভাবে পাওয়াও সহজ ছিল । এখানে সরাসরি বিভিন্ন স্কুলে স্কুলে সাক্ষাৎকার দিয়ে চাকুরী পাওয়ার সুযোগ ছিল । ইতিমধ্যে আমি বেশ কয়েকটি স্কুলে সাক্ষাৎকারও দিয়েছি । মাত্র ক'দিনেই একটি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি যে স্কুলগুলিতে আগে থেকে প্রার্থী ঠিক করা থাকে। বেশ কিছু জায়গায় গিয়ে বুঝেছি, এর সঙ্গে প্রচুর টাকার লেনদেন জড়িত । আমি একজন নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। এত টাকা দেবার সামর্থ্য আমার নেই । কাজেই প্রায় সব স্থানে নিরাশ হয়ে ফিরে আসতাম । দেখতে দেখতে প্রায় ডজন খানেক স্কুলে ইন্টারভিউ দিয়ে বুঝেছি যে স্কুলের চাকরী আমার পক্ষে অধরাই থেকে যাবে।
উল্লেখ্য যে বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেল তখনও আমি ছাড়িনি । আজ ছাড়ি কাল ছাড়ি করে তখনও ধরে রেখেছি । সকালে বাসিমুখে পেপার বা খবরের কাগজের কোনও একটি বিষয় নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে এঁড়ে তর্ক করা হোস্টেলের একটি অলিখিত কালচারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম । সেদিন ঠিক এরকম ভাবে ব্রাশ করা অবস্থায় পেপার পড়তে পড়তে চতুর্থ পাতার কর্মখালি পেজে মেদিনীপুরের একটি আবাসিক স্কুলে একসঙ্গে ইংরেজি, বাংলা, অঙ্ক, ভৌত বিজ্ঞান ও ভূগোলের শিক্ষক পদের বিজ্ঞাপন দেখে হোস্টেলের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে আমিও হৈ হৈ করে উঠলাম । ভাবটা ছিল এমন যে সবাই যেন চাকরীটা পেয়েই গেছি । আমার বিষয় বাংলা। আমার রুমমেট পরিমলের ইংরেজি, সাবিরের ফিজিক্স, সৌম্যজিতের ভূগোল, অর্নবের অঙ্ক হওয়াতে ধরে নিয়েছিলাম বেশ কয়েকজন একসঙ্গে চাকরী করলে দারুণ হবে । বেতন যাই হোক, একসঙ্গে ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার আনন্দে আমরা তখন রীতিমত দিন গোনা শুরু করলাম । ঐদিন হোস্টলে আমাদের জুনিয়ররা সন্ধ্যেবেলা মাংস - রুটির দাবি করলো । পরে কী হবে না ভেবে আমরা আমাদের ভাইদের দাবিমত সন্ধ্যেবেলা রুটি - মাংসের ব্যবস্থা করেছিলাম । কয়েকজন আবার লালজল সেবনের বায়না করেছিল । ব্যক্তিগত ভাবে আমি ওসবের বিরোধী হলেও পরিমলের কথামত ভাগের টাকাটা তৎক্ষনাক দিয়ে দিই। ফলে চাকরী আদৌ হবে কি না হবে - তা না ভেবে আমরা উৎসবে মেতে উঠি ।
আমাদের পাঁচবন্ধুর এভাবে দলবেঁধে ইন্টারভিউ দিতে যাওয়া প্রসঙ্গে নিজ নিজ বাড়িতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরী হয়েছিল । অন্যদের যাইহোক আমার বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। আমি হোস্টেলে থাকাকালীন বাবার পেনসনের টাকাতে খরচ চালিয়েছি । কাজেই যত কম বেতন হোক আমার তাগিদ ছিল অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি । উল্লেখ্য বিজ্ঞপ্তীতে বলা ছিল বেতন আলোচনা সাপেক্ষ । বন্ধুদের কয়েকজন জানালো যে ওদের বাবামায়েরা অতদূরে ইন্টারভিউ যেতে দিতে রাজি নন । আমি সাময়িকভাবে হতদ্যোম হলাম। তবে একটা বিষয়ে দৃঢ় ছিলাম যে কেউ রাজি না হলে আমি একাই যাবো । যদিও শেষ পর্যন্ত ঘুরতে যাওয়ার আনন্দে সকলেই রাজি হয়েছিল ।
নির্দিষ্ট দিনে আমরা হাওড়া স্টেশনের বড় ঘড়ির নীচে জমায়েত হলাম । দুপুর সোয়া বারোটা নাগাদ আমাদের ট্রেন থাকলেও আমরা সকলে এগারোটার মধ্যে যথাস্থানে পৌঁছে যাই । একেবারে সঠিক সময়ে ট্রেন যাত্রা শুরু করলো । তিন ঘন্টার অনেক বেশি সময় লাগলো মেদিনীপুর স্টেশনে পৌঁছাতে । স্টেশনে নেমে আমরা রিক্সা যোগে বাসস্ট্যান্ডে গেলাম । বাস ধরে আরও দেড় ঘন্টা গিয়ে আমরা শাখাচুঁকিয়া বাজারে যখন পৌঁছালাম তখন সন্ধ্যে হবো হবো । বাজারে নেমে স্কুলের নাম বলতেই গাঁয়ের লোকদের একটি আলাদা উন্মাদনা লক্ষ্য করলাম । কয়েকজন শুধু মুখে বলেই কর্তব্য সারলেন নয় , আমাদের নিয়ে একেবারে স্কুলবাড়ি পর্যন্ত চলে এলেন ।
আমরা স্কুলে পৌঁছে নিজেদের পরিচয় দেওয়াতে , বিদ্যালয়ের পরিচালন সমিতির সভাপতি মহাশয়কে খবর দেওয়া হল । কিছুক্ষণের মধ্যে বেশ কালো মোটাসোটা, মাথা ভর্তি টাক ওয়ালা হাসিখুশি মুখের একজন সামনে আসতেই উপস্থিত সকলকে একটু বেশি সমীহ করতে দেখলাম । বুঝলাম উনিই সভাপতি মহাশয় হবেন । হাসিহাসি মুখে তাকিয়ে নমস্কার করে নিজের পরিচয় দিলেন । আমরাও প্রতিনমস্কার করাতে, খুব আন্তরিকতার সঙ্গে উপস্থিত একজনকে উদ্দেশ্য করে আমাদের ব্যাগপত্র ঘরে নিয়ে যেতে বললেন । আমাদের স্নান, খাওয়ার পরে রাতে আবার কথা হবে বলতেই উপস্থিত কয়েকজন আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এল । উল্লেখ্য প্রথম দর্শনেই সভাপতি মহাশয়ের মধুর ব্যবহারে আমরা অত্যন্ত খুশি হলাম । একটা ফাঁকা রুমে আমাদেরকে থাকতে দেওয়া হল । সম্ভবত এটি গেস্ট রুম হবে । এখানে বাড়ির মত বিছানা ও অ্যাটাচড বাথরুম আছে । একে একে আমরা সবাই স্নান সেরে খাওয়ার ঘরের দিকে গেলাম । প্রেসিডেন্ট সাহেব তখনও স্কুলে ছিলেন ।আমাদের দেখে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সন্ধ্যেবেলা টিফিনের ব্যবস্থা করলেন । দেখতে দেখতে স্কুলের পড়ুয়ারা ভিড় করতে লাগলো । সবাই আমাদের দিকে কৌতুহলী দৃষ্টি দিয়ে ফিসফিসিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগলো । এমন একটি পরিবেশে আমি শিক্ষক হবো - এমন স্বপ্নে বেশ উপভোগ করতে লাগলাম। কয়েকটি বাচ্চা এগিয়ে এসে থমকে গেল। তার মধ্যে একটি আরও একটু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,
-আঙ্কেল, তোমরা কি আমাদের স্যার হবে?
আমি কাছে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-তোমার নাম কি?
-সমন্বয় সামন্ত ।
-কোন ক্লাসে পড়?
-আজ্ঞে, ক্লাস ফাইবে ।
একেএকে পাশের চার জনেরও নাম জানলাম । এবার আমি ওদের জিজ্ঞাসার উত্তর দিলাম ।
-হ্যাঁ বাবা,আমরা তোমাদের স্কুলে শিক্ষক হতে এসেছি । আগামীকাল ইন্টারভিউ আছে, পাশ করলে তবেই তোমাদের স্যার হতে পারবো ।
- উমা! তোমরা পাশ করবে না কেন ? কেন তোমরা পড়াশোনা করোনি?
-দেখো সমন্বয়, আমরা আগামীকাল যে পরীক্ষাটা দেবো, এটাকে ইন্টারভিউ বলে । সেটা ঠিক পাশ-ফেলের মত পরীক্ষা নয়। তোমাদের স্কুলে ধরো প্রতি বিষয়ে একটি করে পোস্ট আছে। আর ঐ একটি পোস্টে চাকরী করার আবেদন করেছেন আমাদের মত দশ /বারোজন করে ক্যান্ডিডেট । স্কুল তাদের মধ্যে বাঁছাই করে একজনকে চাকরী দেবে । বাকিরা আবার অন্য জায়গায় চেষ্টা করবে । এখানে যারা এসেছেন তাঁরা সবাই অনেক অনেক লেখাপড়া করে এসেছেন । সেখানে সবাই পাশ করে তবেই এখানে আসতে পেরেছেন ।
- ও বুঝেছি! বুঝেছি।
- কী বুঝলে?
- তোমরা সবাই অনেক পাশকরে এখানে এসেছ । তাঁর মধ্যে একজন আমাদের স্যার হতে পারবে ।
আমি সমন্বয়ের পিঠ চাপড়ে,
- একদম ঠিক বলেছ ।
-আসছি আঙ্কেল, বন্ধুরা ডাকছে ।
- আচ্ছা এসো ।
বাচ্ছাদের সঙ্গে আমার কথা বলার ধরন দেখে বা আমার ধৈর্য্য ধরে উত্তর দেওয়াতে আমার বন্ধুদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরী হল । পরিমল ও অর্নব হবু শিক্ষকের ছাত্র - শিক্ষক কথোপকথন বেশ উপভোগ করলেও সাবির ও সৌম্যজিতের চোখে - মুখে বিরক্তির ছাপ ফুঁটে উঠেছে । যাইহোক সারাদিনের জার্নিতে তখন আমরা বেশ ক্লান্ত হয়ে রুমে এসে শুয়ে পড়লাম । রাত নটার দিকে দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দে খুলে দেখি কিচেনরুমের একজন স্টাফ আমাদের রাতের খাবার খেতে ডাকছেন । আমরা ক্লান্ত শরীরে তন্দ্রালু চোখে অনিচ্ছাতেও টলতে টলতে ওনাকে অনুসরণ করতে লাগলাম ।
পরের দিন ইন্টারভিউ। আগেই বলেছি বেসরকারি আবাসিক স্কুল হওয়ায় সব বিষয়ে চার- পাঁচজনের বেশি ক্যান্ডিডেট আসেনি । কেবলমাত্র বাংলাতে ছিল সর্বাধিক; আমাকে ধরে এগারজন। ক্যান্ডিডেটের আধিক্যে শুরুতে একটু মুঁষড়ে পড়লেও পরে বিষয়টি সহজ ভাবে নিতে পেরেছিলাম। ইন্টারভিউ খুব খারাপ হয়নি । সেদিন বিকালে আমাদের রেজাল্টও জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল । বাংলার প্যানেলে দ্বিতীয় স্থানে আমার নাম থাকায় বেশ হতাশ হয়ে পড়েছিলাম । আমার বাকি বন্ধুরা প্রত্যেকে ইতিমধ্যে নিজেদের প্যানেলে শীর্ষে থেকেও চাকরী না করার অপশন দিয়েছে । আর আমি চাকরীটা করতে চেয়েও পেলাম না। নিজের বিষন্নতার সঙ্গে ভগ্নহৃদয়ে যখন ব্যাগ গোছাচ্ছিলাম এমন সময় অফিসের একজন স্টাফ আমাকে দেখা করতে বলে গেলেন । আমি এই জরুরী তলবে এক ঝলক আশার আলো দেখতে পেলাম । ছুটে গেলাম অফিসের উদ্দেশ্যে । প্রথম ব্যক্তি অনিচ্ছুক হওয়াতে আমাকে অপশন দিতে বলা হল । এক অকৃত্রিম আনন্দে চোখে জল চলে এল । সেদিন বিকালে স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আরও অনেক কথা হল । উনি পরের দিন স্কুলে জয়েন করতে বললেন । কিন্তু সেক্ষেত্রে আগামী এক সপ্তাহ বাড়ি যাওয়া যাবেনা। উপরন্তু আমার কাছে জামাকাপড় একেবারে না থাকায় বাড়ি ফেরাটা অত্যন্ত জরুরী মনে হল । সঙ্গে বন্ধুদের ছেড়ে একাকী থাকাটাও সুখকর বলে মনে হলো না । এমতাবস্থায় সবকিছু বিবেচনা করে পরেরদিন সকালেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম ।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ভোর ৬:৫৭