ঝর্না চলে গেলে মুকুল শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইল । কতক্ষণ এভাবে ছিল তার কোনও হিসাব ছিল না । সন্ধ্যের একটু আগে রহিমাচাচিমা যখন তার সামনে এসে জিজ্ঞাসা করলো,
- তুমি এভাবে বসে আছ কেন? মুকুল তোমার কী হয়েছে ?
তখন সে থতমত খেয়ে,
- কোই না তো ! আমি এমনি বসে আছি । আমার কিচ্ছু হয়নি ।
চাচিমা যেহেতু বিষয়টা জানেন তাই তার মনের অবস্থা অনুমান করে প্রসঙ্গ বদল করলো।
- রান্নাঘরে কাজ আছে, বলে চলে গেল । রান্নাঘরের খাবার- দাবার সব ঠিক ঠাক দেখে,চোখ মোটামোটা করে ,
- একি ! তোমরা দুপুরে কিছু খাওনি ? যে ভাবের ভাত - তরকারি সেভাবেই পড়ে আছে। হায়! পোড়া কপাল, কিচ্ছু খাওনি । তা যাক, আব্বাকে বলে রাতে খাওয়ার আগে সব গরম করে নিও । আমি এখন আসছি ।
- আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি এসো ।
কয়েকপা গিয়ে আবার কী মনে করে চাচিমা ফিরে এসে মুকুলের পাশে দাঁড়িয়ে ,
- আচ্ছা মুকুল! এভাবে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করলে শরীর বাঁচবে বাবা?
- না না! আমি ঠিক খেয়েছি। তুমি চিন্তা করোনা । রাতেও ঠিক সময়ে খেয়ে নেবো ।
এবার চাচিমা মুকুলের মাথায় হাতবুলিয়ে,
- ঠিক আছে বাবা, সময়মত খেয়ে নিও কিন্তু ।
মুকুল মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো ।
এদিকে ঝর্নার বিয়েরদিন ক্রমশ উপস্থিত হল । হাবিবুরচাচা যথেষ্ট ধুমধামকরে মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন । বাড়িতে লোকজন থিকথিক করছে । গোটা পাড়া আমন্ত্রিত হওয়াতে যেন সবাই একপ্রকার উৎসবে মেতে উঠেছে । বাড়ির সামনে বিরাট প্যান্ডেল যেন সে উৎসবের সাক্ষ্য বহন করছে । পাড়ার আাট থেকে আশি সবাই সে উৎসবে মেতে উঠেছে । শুধু একটি বাড়িতে সে আনন্দ বা উৎসবের ছিঁটেফোঁটা স্পর্শ করেনি । সমুদ্রে নিমজ্জিত দ্বীপ যেমন নিজের নিমজ্জনের মাধ্যমে সমুদ্রের প্রবল জলোচ্ছ্বাসকে অভ্যুত্থনা জানাতে বাধ্য হয় । মুকুলের আব্বাও তেমনি ঝর্নার বিয়ের রোশনাইতে সামিল হয়েছিলেন । একটা বড় পেতলের ঘড়া নিয়ে নির্দিষ্ট দিন একটু আগেভাগে বিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন । মুকুলের যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠেনা । যাওয়ার আগে বাড়িতে রান্নাকরা খাবার সময়মত খাওয়ার কথা মুকুলকে
তিনি স্মরণ করিয়ে গেলেন ।
আব্বা চলে যেতেই মুকুল চাচিমাদের বাড়িতে গেল । জোরেজোরে চাচিমা চাচিমা বলে চিৎকার করাতে ,
- আসছি । একটু দাঁড়া ।
- না, তোমাকে বাইরে আসতে হবেনা । একটু জরুরি কাজ আছে চাচিমা । তুমি আব্বাকে একটু লক্ষ্য রেখো ।
বলে মুকুল বেড়িয়ে গেল ।
এদিকে সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত এল , মুকুলের আর দেখা নেই । তৌফিকসাহেব অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন । পথচলতি মানুষের কাছে কাতরভাবে জিজ্ঞাসা করলেন , তারা কেউ মুকুলকে দেখেছে কিনা । একদিন দুইদিন করে দিন যেতে লাগলো কিন্তু কোথাও মুকুলের কোনও সন্ধান পাওয়া গেলনা । একবছরের একটু বেশি হয়েছে স্ত্রীবিয়োগ হয়েছে, সম্বল ছিল ছেলেটা । কিন্তু এখন সেও নিরুদ্দেশ । কাজেই তৌফিকসাহেবের এখন জীবন্মৃত অবস্থা । উপরওয়ালার কাছে তাঁর একটাই প্রশ্ন,
- হে আল্লাহপাক! তুমি আমাকে আর কত পরীক্ষা নেবে ? রাতদিন নামাজের পাটিতে বিলাপ করেই এখন তাঁর দিন কাটছে ।
চাচিমার অবস্থাটা একটু বলা জরুরী । ঝর্নার বিয়ের দিন মুকুল যখন জরুরি কাজে বাইরে যাচ্ছি এবং আব্বাকে দেখার কথা বলেছিল তখন চাচিমা ঘরকুনো ছেলের বাইরে এমন কী জরুরি কাজ থাকতে পারে তা সন্দেহ করেনি । মাহারা ছেলেটাকে পেটে না ধরলেও তাকে নিজের সন্তানের মতই ভালো বাসে । তাই মুকুল নিরুদ্দেশ হবার পর চাচিমাও নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। চাচিমার দুইমেয়ের পর একটি ছেলে আছে। বয়সে ওরা মুকুলের চেয়ে বেশ ছোটো । তবে মুকুল ছিল যেন প্রথম সন্তান । এহেন সন্তানের খোঁজে একা তৌফিকসাহেব নন , চাচিমা ও তার স্বামী রহমানচাচা সহ পাড়ার অনেকেই সন্ধানে নেমে পড়েছেন । ইতিমধ্যে রহমানচাচা মানে রহিমাচাচিমার স্বামী একদিন একটি আশংকার কথা বললেন '
- আচ্ছা! তৌফিকভাই হাবিবুরভাই মুকুলকে কিছু করেনিতো?
- না না! রহমান, ওরা মানুষ ভালো । খামোকা ওদের নিয়ে এসব ভেবোনা ।
এদিকে গোটা পাড়ায় অবশ্য দুটি মত তৈরী হয়েছে । কারন বিষয়টি আস্তে আস্তে সবার কানে পৌঁছে গেছে । বেশিরভাগ কমবয়সীরা হাবিবুর চাচাকে ভিলেন বানিয়েছে । অনেকেইতো সন্দেহ করছে যে ছেলেটা এখনও বেঁচে আছে কিনা । অপরদিকে মুরুব্বীগোছের কয়েকজন হাবিবুরচাচার পাশে দাঁড়িয়েছেন । কোনও অবস্থাতেই পাড়ায় এসব বেয়াদবি বরদাস্ত করা যাবেনা । সুতরাং ঝর্নার বিয়ের বেশকিছু দিন আত্মগোপন করার পর হাবিবুরচাচা আবার প্রাকাশ্যে আসছেন। আর তখনই দৈবাৎ দেখা সাক্ষাতের সময় তৌফকসাহেবের কাছে মুকুলের খোঁজখবর নিচ্ছেন ।
তৌফিকসাহেব বাড়িতে উদাসভাবে বসে থাকেন । প্রায়ই বাড়িতে কেউনা কেউ এসে ওনাকে বোঝান যে মুকুল শীঘ্রই ফিরে আসবে, কিমবা তিনি যেন স্বাভাবিক কাজ কর্ম শুরু করেন । শূন্যে চেয়ে থেকে তিনি পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন ,
- কী আশায় আমি স্বাভাবিক হব? ওর মা ছিল , মা চলে গেল । ও ছিল, সেও নিরুদ্দেশ হল । আল্লা আমাকে কেনইবা আর রেখেছে ।
আগে রহিমাচাচিমা এবাড়িতে বেশি আসতো, মাঝে মাঝে ফজিলাচাচিমাও আসতো । এখন তাদের সঙ্গে এবাড়িতে প্রায় সারাক্ষণ থাকেন রহমানচাচাও ।
বিশেষ নোট - তৌফিকচাচা ও মুকুলের পরিনতি যেদিকে গড়াচ্ছে তাতে গল্পের নাম আর' উজান হাওয়া ' রাখা যুক্তিযুক্ত নয় বিবেচনা করে গল্পকার পরবর্তীতে নাম বদলের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন । সকল পাঠকবন্ধুদপরকে এই পরিবারের ভবিষৎ জানতে প্রকাশনার অপেক্ষায় থাকা নুতন নামে পরবর্তী দেখার অনুরোধ করা হচ্ছে।
বিঃদ্র - পোস্টটি শ্রদ্ধেয় ব্লগার সোনাবীজ ; অথবা ধুলোবালিছাই স্যারকে উৎসর্গ করলাম ।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:০৬