রহিমাচাচিমাকে মুকুল ঝর্নাকে ভালো লাগে জানাতে , পরেরদিন সকালে প্রথমে মুকুলের আব্বার সঙ্গে কথা বললো । তৌফিকসাহেবের এই সম্বন্ধে কোনও আপত্তি ছিলনা । আর থাকবেই বা কেন , ঝর্না অত্যন্ত ভদ্রমেয়ে। পরহেজগার, সুর করে কোরান পড়তে পারে । তৌফিকসাহেবের সম্মতি পেয়ে রহিমাচাচিমা যখন ঝর্নাদের বাড়িতে গেল , তখন হাবিবুরচাচা বাড়িতে ছিলেননা। ঝর্নার মা সবশুনে বললেন ,
- মুকুল ভালো ছেলে । তবে একটা জায়গায় কথা দেওয়া হয়েছে । আর তাছাড়া মুকুলের আব্বামাও ভালোবেসে বিয়ে করেছিল । সেজন্য ওর মা সারাজীবন বাপেরবাড়ি যেতে পারেনি । তবুও তুমি বলছো যখন আমাদের লোক বাড়ি আসুক , বলে দেখি ।
এসব সময় এরকম মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত বাঙালী মুসলিমদের মধ্যে পাত্রীর মতামত নেওয়াটা অভিভাবকরা ধর্তব্যের মধ্যে আনতেন না । তাছারা তের চৌদ্দ বছরের কোনও মেয়ের বিয়েতে নাকগলানো পুরুষ শাসিত সমাজের চোখে অত্যন্ত বেয়াদবি বা বেয়ারা বলে মনে করা হত । স্বভাবতই ঝর্নার মতামতের কারো প্রয়োজন পড়লো না ।
সেদিন বিকালে হাবিবুরচাচা ঝর্নার মেজোবোন অর্নাকে দিয়ে রহিমাচাচিমাকে ডাকালেন । চাচিমা সম্পর্কে হাবিবুরচাচার ভ্রাতৃবধু হওয়ায়, বৌমা বলে ডাকতেন । চাচিমা হাবিবুরচাচাকে আবার ঘটনাটা বললো । দরজার আড়ালে চাচিমার সঙ্গে ঝর্নার একবার চোখাচুখি হওয়ায় লজ্জা পেয়ে ভিতরে ঢুকে গেল । সবশোনার পর চাচা একবার চারপাশটা দেখে নিয়ে বললেন ,
- দেখো বৌমা, কথাটা যেন পাঁচকান না হয় । এমনিতে আমাদের সঙ্গে তৌফিকভায়ের কোনও শত্রুতা নেই । তারপরে মুকুল আমার ভালো ছেলে । ওদের জমিজায়গাও যথেষ্ট । বাড়ির পাশে মেয়ে দিলে রাতদিন দেখতেও পেতাম । তবে তৌফিকভাই ভাবিকে যেভাবে বিয়ে করেছিল , তাতে ঐ বংশে মেয়ে দিতে আমার আপত্তি আছে । আর আমার ঝর্নামায়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে । ছেলে শিক্ষিত , মাওলানা পাশ । পাশের গ্রাম ঘোষালাটি মসজিদে ইমামতি করে । দেবহাটে ওদের বাড়ি । ওখানে ওদের অনেক জমি বাড়ি ও পুকুর আছে । বনেদী পরিবার । ওরা এসেছিল , আমরাও গিয়েছিলাম । পাকাদেখা হয়ে গেছে । তুমি তৌফিকভাইকে বরং বোঝাবে পারলে আমাকে যেন ক্ষমা করে দেন ।
সেদিন সন্ধ্যাবেলায় মুকুল রহিমাচাচিমার বাড়িতে গিয়ে সব জানতে পারলো । তার হাতপা যেন অবশ হয়ে গেল । গলা শুকিয়ে এল । এক অসহ্য যন্ত্রনায় সে মুখে বিকট শব্দ করে উঠলো । চাচিমা তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কত কথা বোঝাতে লাগলো । সে বেশ কয়েকবার বাড়ি আসার কথা বললেও চাচিমা তাকে আটকে রেখে সান্ত্বনা দিতে লাগলো । এটা ওটা খাওয়ার কথা বললে, কোনও কিছু খেতে মুকুল অস্বীকার করলো ।
এদিকে ঝর্নার বিয়ের দিন ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগলো । আশেপাশে অন্যান্য বাড়িগুলির মত মুকুলেরাও এই বিয়েতে আমন্ত্রিত । তবে ওরা যাবে কিনা ঠিক নেই । গোয়ালহাটিতে তার মামার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক না থাকার কারনটি সেদিন রহিমাচাচির মুখে প্রথম শুনেছে । বারে বারে তার মনে প্রশ্ন জাগছে, আব্বা যদি মাকে পালিয়ে নিয়ে বিয়ে করে তাহলে সে দায় তাকে কেন নিতে হবে? তাহলে আগামীতেও এরকম খবরে সব সম্বন্ধ ভেঙে যাবে ? নানান প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো । সে মানসিকভাবে একেবারে ভেঙে পড়েছে । নাওয়া খাওয়া বাড়ির কাজ সব একপ্রকার বন্ধ করে দিয়েছে ।
ওদিকে তৌফিকসাহেব ছেলের মনের অবস্থা বুঝে তাকে বেশি করে সময় দিচ্ছেন । মাঠের কাজকর্ম আপাতত বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন । সারাক্ষণ বাড়ি রান্নাবাড়া গোয়ালঘর নিয়ে ব্যস্ত থাকেন । মুকুলও সারাক্ষণ বাড়িতে বসে- শুয়ে থাকে । রহিমাচাচিমার সঙ্গে তাদের সখ্যতা এসময়টা অত্যন্ত বেড়ে গেছে । প্রত্যেকদিন দুপুরে এসে রান্নাকরে দেওয়া, সময় পেলে যখন তখন এসে খোঁজখবর নেবার ফলে রহিমাচাচিমা এলে তৌফিকসাহেব অনেকটা নিরাপত্তাবোধ করেন । মনেমনে ঠিক করেও নিয়েছেন, ঝর্নার বিয়েটা হয়ে গেলে মুকুলের জন্য পাত্রী খোঁজ করবেন ।
এদিকে একটি মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেল । বিয়ের দিন পাঁচেক আগের বিকালে ঝর্নার বিয়ের দরকারে ওর আব্বামা বাইরে ছিলেন । দাদীমা বৃদ্ধ মানুষ ,এক হিসাবে শয্যাশায়ী । দুইবোন অর্না ও ময়না মুকুলদের বাড়ির পাশে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে ব্যস্ত । এরকম একটি সময়ে ঝর্না সরাসরি মুকুলদের বাড়িতে হাজির । ঝর্নাকে দেখে মুকুল যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না । এমন সময় ঝর্না,
- মুকুলভাই কথা আছে ।
ঝর্নার কথা শুনে মুকুল যেন সম্বিত ফিরে পেল । ঝর্নাকে মুকুল দাওয়াই বসতে বললো । ঝর্না মাথা নেড়ে আপত্তি জানিয়ে বললো,
- ভিতরে বসবো, কেউ না কেউ হয়তো দেখে ফেলবে।
বাধ্যছেলের মত মুকুল ঝর্নাকে ঘরের ভিতরে নিয়ে গেল । অত্যন্ত ভয়ে শঙ্কিত হয়ে কাঁপা গলায় ঝর্না বললো,
- মুকুলভাই আমাকে বাঁচাও ! রহিমাচাচিমা যখন আব্বার সঙ্গে কথা বলছিল তখন আমি দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনেছি । আমিও তোমাকে খুব - ই ভালোবাসি । কোই তুমিতো কোনও দিন আমাকে কিছু বলোনি । তুমি সারাদিন কী পরিশ্রমই করতে । আমি আমাদের বাড়ির গাছের ফাঁক দিয়ে সারাক্ষণ তোমাকে লক্ষ্য করতাম । সব সময় যে দেখতে পেতামনা ঠিকই, তবে আমি এদিকেই চেয়ে থাকতাম । তোমার এত কষ্ট দেখে আমার ভিতরটা যেন ফেঁটে যেত । বাড়িতে কিছু ভালো রান্না হলে আমার মুখে উঠতোনা । মাকে দেখিয়ে একটু খেয়ে মাছ মাংস পছন্দ করিনা বলে উঠে যেতাম । চাচিমার কাছ থেকে শুনেছি , তৌফিকচাচা একদিন ভাত পুঁড়িয়ে ফেললে তোমরা বাবাছেলে সে রাতে কীভাবে সেই ভাত খেতে বাধ্য হয়েছিলে । একদিন রাতে কুকুর ঢুকে তোমাদের খাবার নষ্ট করায় সারারাত পানি খেয়ে কাটিয়েছিলে । চাচা রান্না না জানায় কীভাবে দিনের পর দিন তোমরা ডাল আলু সিদ্ধ খেয়ে কাটিয়েছ । তাও আবার এক খাবার খেতে তিনবেলা । এসব দেখেশুনেই রহিমাচাচিমা তোমাদের বাড়িতে একবেলা রান্না করে দেয় । চাচিমার রান্না করার খবরে আমার আনন্দে চোখে পানি এসেছিল।
কথা বলতে বলতে ঝর্না একটু থেমে গেল। দুজনেই কিছুক্ষণ নিরব থাকলো । ঝর্না আবার বলতে লাগলো ,
- আমি প্রায়ই চাচিমার কাছে খবর নিতাম তোমাদের কি কি রান্না হয়েছে বা কত বেগুন এবং অন্যান্য সব্জি উঠেছে ইত্যাদি। চাচিমা একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল যে আমি তোমাকে ভালবাসি কিনা । আমি না বলতেই, ও বুঝেছি বলে মুচকি হেসে চলে গিয়েছিল । বাড়িতে মাকেও টুকটাক তোমাদের কথা জিজ্ঞাসা করতাম । একদিন কী একটা প্রসঙ্গে তোমাদের কথা বলতেই, মা আমাকে পাল্টা জিজ্ঞেস করেছিল যে তোমার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক আছে কিনা । লআমার মনে হয়েছিল, মা ভালোমুখে জিজ্ঞেস করায় তোমাকে ভালো লাগে - একথা আর এমন দোষের কী । তবুও আমি প্রথমে অস্বীকার করি । মা খুশি হয়নি । মায়ের কথায়,
- মা ঝর্না, তোমাকে যদি মুকুল ভালোবাসে তাহলে নির্ভয়ে আমাদের বলতে পারো । তোমার ভালো মন্দ আমরা ছাড়া কে বুঝবে মা ।
- মায়ের এই মধুর বাক্যে আমি গলে যাই । তোমাকে ভালো লাগে একথা বলতে ; মুহূর্তের মধ্যে মা সে এক ভয়ানক অগ্নিমূর্তি ধারন করে । রাগে ফোস ফোস করে বলতে থাকে ,
- তোর আব্বাকে বলে তোকে আজ কেটে ফেলবো । মনে মনে তুই এই তৈরী হয়েছিস ?
- আমি প্রচন্ড ভয়ে কাঁদতে থাকি । এরপর থেকে আমাকে মক্তবে পাঠানো বন্ধ হল । আব্বা আমাদের বাড়ির চারপাশে উঁচু করে পাঁচিল তুলে দিল, যাতে আর তোমাদের বাড়ির দিকে কিছু দেখা না যায় । এখন মুকুলভাই তুমি আমার বাঁচাও । দেবহাটির ছেলের মুখভর্ত্তি দাড়ি, মাথায় সারাক্ষণ টুপি পরে থাকে এবং বেশ নাটা ।
ঝর্নার মুখ থেকে একনাগাড়ে কথাগুলি শুনে মুকুল এবার একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঝর্নার থুতনিতে হাত দিতেই, এক হাত পিঁছিয়ে গিয়ে,
- ছি! ছি! মুকুলভাই, বিয়ের আগে গায়ে হাত দেওয়া পাপ ।
এবার মুকুল কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে ঝর্নাকে বোঝায় ,
- দেখ ঝর্না, তুই আমি পরস্পরকে ভালো বাসি ঠিকই । কিন্তু তোর বাড়ির লোক যখন আমাদের সম্পর্ক মানতে চাইছে না , তাহলে আমরা আর কী করে আগাই বল । আব্বা সুদূর গোয়ালহাটির মেয়ে বিয়ে করে দূরে থাকায় তবুও বাঁচতে পেরেছে । আর আমি তোকে বিয়ে করলে এত কাছাকাছি যে তোর আব্বার মত রাগি লোক আমাদের মেরেই ফেলবে । কী আর করবো বল। আজ তোকে পেয়েও আমি নিতে পারলাম না । তবে তোর আব্বা তোর ভালোর জন্যই এ সম্বন্ধ করেছেন । তুই মেনে নে । ওনারা খুশি হবেন ।
মুকুলের কথা তখনও শেষ হয়নি ,ঝর্না দৌড়ে একছুটে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল ।
( উজান হাওয়ার পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই প্রকাশিত হবে । পাঠকবন্ধুদেরকে একটু সময় দিতে অনুরোধ করছি ।)
বিঃদ্র - পোস্টটি আমার অত্যন্ত কাছের বন্ধু, ব্লগের অলিখিত হিরো মো নিজামউদ্দিন মন্ডলভাইকে উৎসর্গ করলাম । ব্লগের এমন হিরোকে কিছু দিতে পেরে আমি আনন্দিত ।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:১১