দ্রুতবেগে বাস ছুটে চলছে। গার্মেন্টস থেকে বের হয়ে আমি আর নিশাত এই বাসটাতে উঠে পড়লাম। ক‘জন ফরেন বায়ার আসায় গার্মেন্টস থেকে বের হতে একটু দেরি হয়ে গেল আজ। অনেক আগেই সন্ধ্যা নেমেছে। হাতে একটা ঘড়ি থাকলে হয়তো নির্দিষ্ট করে সময়ের মাপটা নিতে পারতাম।
আমি আর নিশাত চুপটি মেরে বসে আছি। ইতিমধ্যে বাসটি শহরের কোলাহল ফেলে নির্জনতায় প্রবেশ করেছে। বাসটি একেকটা স্টেশনে থামে আর দু–একজন যাত্রী সেখানে নেমে পড়ে। রাস্তার দুপাশে সবুজ চা বাগানে এখন বিদঘুটে অন্ধকার। বাগানের মধ্যদিয়ে চলে যাওয়া আঁকাবাঁকা মেঠো পথে টর্চের আলো দেখতে পাচ্ছি। হয়তো কর্মঠ মানুষ দিনান্তে তাদের ঘরে ফিরছে।
বাসের যাত্রী এখন আমরা দুজন। আর তিন স্টেশন পরেই গোপালপুর বাসস্টেশন। যেখানটায় আমি নামবো। নিশাত অবশ্য সামনের স্টেশনেই নেমে যাবে। তখন আমি একা হয়ে যাবো । পুরো বাসে বাসচালক, কন্ডাকটর আর আমি। ভাবতেই ভয়ে–আতংকে কেমন জানি গা‘টা শিউরে উঠল। শীতের রাতেও গায়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করলো।
নিশাত আমাকে একা রেখে নেমে গেল। নামার আগে অবশ্য আমাকে তার সাথে নেমে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে। কিন্তু আমি নামিনি। তখন সে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো– 'সাবধানে যাস নির্মলা। দিনকাল ভালো যাচ্ছে না।'
তা ঠিক। দিনকাল ভাল যাচ্ছে না। ক‘দিন আগে চলন্ত বাসে এক মেয়েকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলেছে শয়তানের দল। মেয়েটার নাম ছিল মুক্তা। অাহ ! কী সুন্দর চেহারা তার। খবরের কাগজে তার ছবি এসেছিল। আমরা সবাই মিলে ছবিটা দেখছিলাম। ছবিতে মুক্তোর মতো চিকচিক করছিল তার মুখ। হায়হুতাশ করছিলাম সবাই মিলে। মুক্তাও আমার মতো গার্মেন্টসে চাকরী করতো। একটা মেয়েকে একা পেয়ে শয়তানের দল একেবারে মেরেই ফেললো !
কন্ডাকটর আমার দিকে কেমন করে জানি তাকিয়ে আছে। আমি একা। শতকোটি মানুষের পৃথিবীতে এইমুহূর্তে আমি একা। বিদঘুটে অন্ধকার রাতে যেন দক্ষ শিকারির এক অসহায় শিকার আমি। ভয় আমাকে আঁকড়ে ধরেছে। আমার শিঁড়দাড়া বেয়ে নেমে পড়ছে ঝর্নার শীতল জলধারা। মৃত মায়ের চেহারাটা এইমুহূর্তে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। মা ডাকছেন আমাকে। নির্মলা, নির্মলা, সাবধানে থাকিস মা।
বাসের গতি আরো বেড়ে গেল। খেয়াল করলাম হুটকরে আমাদের বাসটি ডানদিকের রাস্তায় ঢুকে পড়েছে। আমি চিৎকার করতে চাইলাম। কিন্তু পারছি না। কন্ঠ আমার কে যেন চেপে ধরেছে। এবার যেন মুক্তাও আমাকে ডাকছে। সে বলছে, নির্মলা, নির্মলা, আমার মতো তোমারও একই দশা হবে বোন। ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে নির্মলা।
আমি ভয়ে কাঁদতে শুরু করি। কন্ডাকটর গর্জে বললো, এই কাঁদবে না, এই কাঁদবে না। ভয়ে আমি জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকি।
দুই
হাসপাতালের বেডে শুয়ে অাছি। দুইজন পুলিশ আমার দুইদিকে দাঁড়িয়ে আছে। আমার ডানপায়ে লোহার শেকল বেঁধে বেডের সাথে তালা লাগানো হয়েছে। ডানহাতটায় প্রচন্ড ব্যথা। পুলিশকে বললাম, পুলিশভাই ভাত খাবো, ভাতের ব্যবস্থা করেন। পুলিশ বলে, তোমার শরীরে যা জোর আর ভাত খেয়ে লাভ নাই। আমি পুলিশের দিকে চোখ দুইটা বড় করে থাকাই। সে চুপ হয়ে যায়। চোখ রাঙানোকে সবাই ভয় পায়। আপনি যদি বাঘের সামনে পড়ে তার চোখে দুচোখ রাখেন তখন সে দ্বিতীয়বার চিন্তা করবে, আপনাকে আক্রমন করবে কি করবে না। পুলিশ ব্যাটাও ভয় পেয়েছে নিশ্চিত।
আমার পাশের বেডের এক রোগী খবরের কাগজ পড়ছেন। পেছনের পৃষ্ঠায় আমার পাসপোর্ট সাইজের একটা রঙিন ছবি দেখা যাচ্ছে। ছবিটা গার্মেন্টসে চাকরীর সুবাদে উঠানো হয়েছিল। আমার মা তখন জীবিত ছিলেন। দুজন হাঁটতে হাঁটতে বাজারে গিয়েছিলাম ছবি উঠাতে। মা তখন বলছিলেন কিরে, তুই একাই ছবি উঠাবে? তারপর আমি আর মা হাসিমুখে একটা ছবি উঠালাম। তার অল্প কিছুদিন পরেই মা মারা যান।
পাশের বেড থেকে খবরের কাগজটা নিয়ে পড়া শুরু করলাম। আমার ছবির পাশে বড় বড় অক্ষরে লিখা– এক মহিলা যাত্রীর ছুরির আঘাতে বাসচালক খুন।
হয়তো কিছুদিন পর আমার ফাঁসি হয়ে যাবে। জিহ্বাটা কন্ঠ থেকে বের হয়ে আসবে। আমার নিথর দেহ পড়ে থাকবে নরম মাটিতে। কিন্তু তাতে আমার কোনো ভয় নেই। আফসোস নেই। সত্যি বলছি, তাতে আমি মোটেই ভীত নয় !