জামাল সাহেব চুপচাপ বারান্দায় একটা বেতের চেয়ারে বসে আছেন। একটু পরপর বলছেন, আর কতক্ষন ? চা টা কি আজ খাওয়া যাবে ? আজ খুবই ফুরফুরা মেজাজে আছেন তিনি। টানা তিন দিন ধরে অনবরত আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামছে। দিনের বেলা বৃষ্টি তাঁর একদম ভাল লাগেনা। দিনে বৃষ্টির জন্য কোথাও বের হওয়া যায়না, রাতে অন্তত এই সমস্যাটা নেই। কিছুক্ষন পর স্ত্রী রাজিয়া বেগম এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় চলে আসলেন। কিঞ্চিত দুষ্টুমি করে তাকে বললেন- বুঝলা দিপুর মা, বৃষ্টি হবে রাতের বেলা। টিনের চালে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ আর পাশে একাকী তুমি। আহা! কি যে আনন্দের, তাই না ? রাজিয়া বেগম বলেন- কি যে বলো তুমি, মাথার চুল সাদা হলেও তোমার কথায় তার বিন্দুমাত্র রেশ নেই।
- আরে শুনো দিপুর মা, তুমি পাশে থাকলে সব কিছু কেমন জানি রঙ্গিন মনে হয়। মাথার চুলের কথা ভাবলে মনেহয় এগুলো এই মাত্র গজানো শুরু করেছে !
একটু মুচকি হাসি দিয়ে বললেন জামাল সাহেব।
- ঠিক আছে, তোমার আর পাকা চুলের কথা বলতে হবে না। বিকালের খালি গায়ে বৃষ্টি ভেজার কাহিনীটা বলো ।
আজ বিকেলে হঠাৎ করে খালি গায়ে বৃষ্টিতে ভিজে অনেকটা পাগলের মত ঘরে প্রবেশ করেন জামাল সাহেব। রাজিয়া বেগম তা দেখে দৌড়ে এসে বললেন- এ কী ! তোমার একি অবস্থা ?
- কি অবস্থা মানে ? দেখছো না, এটা আমার ভেজা অবস্থা, বৃষ্টিভেজা অবস্থা।
- তা তো দেখছি, কিন্তু কেন ? তোমার গায়ের শার্ট কোথায় ? পায়ের জুতা জোড়াও তো নাই দেখছি । কাদা লেগে আছে সারা শরীর জুড়ে। কি হলো তোমার ? এগুলো কোথায় ফেলে এসেছো ?
রাজিয়া বেগম কিছুটা রাগ¦ত এবং আশ্চর্য স্বরে একটানে কথাগুলো বলে গেলেন।
- আহা ! সব বলছি । আগে গামছাটা অন্তত দাও। সব না হয় একটু পরেই বলি। পারলে আমাকে এক কাপ চা খাওয়াতে পারো।
- ঠিক আছে, তুমি ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় বসো। আমি চা নিয়ে আসছি।
চায়ের অপেক্ষায় তাই বারান্দায় বসে আছেন জামাল সাহেব। স্ত্রীর কাছ থেকে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বললেন, তুমি তো জানো আমার বাবা ছোট্ট একটা চাকরি করতেন। আমি প্রায়ই বাবার অফিসে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করতাম। কিন্তু বাবা কখনও আমাকে তাঁর অফিসে নিয়ে যান নি। আমি যখন বলতাম, বাবা তুমি কী চাকরী কর ? বাবা আমার প্রশ্নটা শুনেও না শুনার ভান করতেন। আমি আবার জানতে চাইলে ধমকের সুরে বলতেন, আমি কী চাকরি করি তোর শুনার দরকার কি ? সময়মত দু’টা ভাত পেলেই তো চলে। আমি তাঁর ধমকের কারণ না বুঝে মায়ের কুলে আশ্রয় নিতাম। একদিন এক লোক আমাদের বাড়ীর সামনে এসে আমাকে বলে- এই ছেলে, খালেদ পিয়নের বাড়ী কোনটা রে ?
লোকটা এত অবহেলার সুরে বলল যে তা শুনে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম । আমি তখন অন্য একটি বাড়ী দেখিয়ে বলেছিলাম- এটি খালেদ সাহেবের বাড়ী। লোকটি তখন আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে ছিল। আর আমি মাকে গিয়ে বললাম- মা ‘পিয়ন’ মানে কী ?
রাজিয়া বেগম হঠাৎ খেয়াল করলেন জামাল সাহেব একটু গোপনে চোখের পানি ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে মুছে নিচ্ছেন। এ যেন দু’জনের চার চোখের লুকোচুরি খেলা।
জামাল সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন- একবার বাবার সাথে গ্রামের মেলাতে গিয়েছিলাম। বাবা অনেক খোঁজাখুজি করে আমার জন্য একটা শার্ট পছন্দ করেন। দোকানদার শার্টটা আমাকে পরিয়ে দেয়। কিন্তুু সমস্যা হয় দাম নিয়ে। এত দামের শার্ট কেনা বাবার সামর্থ্যে ছিল না। আর আমিও ছিলাম নাচোড়বান্ধা। বেরসিক দোকানি আমার গা থেকে শার্টটা তাঁর সর্বশক্তি দিয়ে খুলে নিল। তবে শার্টের গায়ে লাগানো রঙ্গিন কাগজটা রাগে-ক্ষোভে ছিড়ে ফেলেছিলাম আমি। আমার আর শার্ট কেনা হলো না। আমি আর বাবা দু’জনই মন খারাপ করে বাড়ী ফিরে এসেছি,হাতে ঐ রঙ্গিন কাগজটা তখনও শক্ত করে ধরে রেখেছিলাম আমি।
আজ যখন রিক্সায় বাড়ী ফিরছি তখন ড্রাইভার তাঁর কষ্টের কথাগুলো আমাকে শুনাচ্ছিল। তার ছেলের কথা, মেয়ের কথা, তাঁর সীমাবদ্ধতার কথা, ছেলের ছেঁড়া শার্টের কথা। আমার তখন বাবার কথা মনেপড়ে যায়। মেলার পছন্দের শার্টের রং চোখে ভাসতে থাকে। ভাবলাম, আমার ডাক্তার ছেলে আমাকে তো অনেক শার্ট দিয়েছে তাছাড়া আমার দীপু’রও তো শার্টের অভাব নেই। তাই আমার ভেজা শার্টটা ড্রাইভারকে দিয়ে দিলাম আর কিছু টাকা তাঁর হাতে গুজিয়ে দিলাম ছেলেকে একটা শার্ট কিনে নেওয়ার জন্য।
রাজিয়া বেগম এতক্ষনের নিরবতা ভেঙ্গে বলে উঠলেন- আর তোমার জুতা ?
-জুতা ! আর বলো না, রিক্সা থেকে যখন নামছি তখন পা পিছলে একটা জুতা ছিড়ে গেল। তারপর আমি বাকী জুতাটা হাতে নিয়ে পাশের বাড়ীর বাঁশের ঝোপে এক ঢিলে ফেলে দিয়েছি। খালি পায়ে যখন হাটছি তখন ধপাত করে কাদা মাটিতে পা পিছলে পরেগেলাম। কানে যখন তীব্র হাসির আওয়াজ ধাক্কা খেল তখন দেখি পাশের বাড়ীর কাজের মহিলা আমার এই কাদা মাখামাখি দেখে তাঁর হলুদ দাতগুলো বের করে লাফাচ্ছে। প্রিয় ক্রিকেটার সিক্স মারার পর দর্শকরা যেভাবে লাফায় সেভাবে। আবার চিৎকার করে বলছে- খালাম্মা দেইখ্যা যান জামাল চাচা আছাড় খাইছে!
- তোমার এই কাদা মাখা শরীর পাশের বাড়ীর রেহানার মা ও দেখেছে !
অবাক ভঙ্গিতে রাজিয়া বেগম কথাটা বললেন।
- হুম, সাথে কাজের মেয়ের সাথে লাফালাফিও করেছে।
রাজিয়া বেগম তা শুনি হা হা করে হাসতে লাগলেন।
জামাল সাহেব বলে উঠলেন- তুমিও হাসছো ?
*******
পাশের বাড়ীর সাথে জামাল সাহেবের সাপে-নেউলের মত সম্পর্ক। এক বাড়ীর দুঃসংবাদ অন্য বাড়ীর হাসির কারন। এই দুই বাড়ী নিয়ে গ্রামে দুইটা লাঠিয়াল গ্রুপ গড়ে উঠেছে। কিন্তু এর পেছনের কারণ বড় কিছু নয়। একটি সুপারী গাছ মাত্র। এক সরু সুপারী গাছের জন্য বড় বড় ঘটনা ঘটে যাচ্ছে দুই পরিবারের মধ্যে। গ্রামের তৃতীয় একটি পক্ষ অবশ্য আগুনে তেল দেয়ার মতো তাতে অনবরত ইন্দন যোগায়।
- আহারে , তোমাকে তো আসল কথা বলাই হয়নি।
জামাল সাহেব স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন।
- কি ?
- দীপু ফোন করেছিল। আজ রাতে বাড়ী আসবে।
- ও তাই ! আমাকে তো বলেনি !
- তোমাকে বলবে কেন ? সে তো আমাকে বেশী পছন্দ করে তাই আমাকে আগেই জানিয়ে দিয়েছে।
জামাল সাহেব হেসে হেসে কথাটা বললেন।
- ও তাই ! আমাকে বুঝি ভালোবাসেনা !
দীপুকে নিয়ে তাদের স্বপ্নের শেষ নেই। সদ্য পাশ করা ডাক্তার ছেলে দীপুকে নিয়ে গ্রামের একপক্ষ যেমন অতি উৎসাহী অন্যপক্ষ তখন তাকে নিয়ে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে ব্যস্ত। তাই জামাল সাহেব চান না দীপু গ্রামে আসুক কিংবা বাস করুক।
পরের দিন দীপু দুপুরের ভাত খাচ্ছে। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি। পাশের চেয়ারে বসে জামাল সাহেব খেতে খেতে গতকালের রিক্সা ড্রাইভারের গল্প শুনাচ্ছেন। রান্নাঘর থেকে দীপুর মা বলে উঠলেন, শুধু ড্রাইভারের গল্প করলে হবে, তোমার আছাড় খাওয়ার গল্পটা বলে নিও। তখন জামাল সাহেব উচ্চ স্বরে হেসে উঠলেন। তাঁর অট্টহাসি থামতে না থামতেই পাগলা গরুর মতো বৃষ্টিতে ভেজা ছেড়া শার্ট গায়ে ঘরে প্রবেশ করলো খলিল মিয়া। এই খলিল মিয়া জামাল সাহেবের বিরোধী লোক হিসাবেই পরিচিত। সে কেঁদে কেঁদে বলল- ‘জামাল ভাই,আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে! আপনার দলের লোক আমার ছেলের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে।’ তারপর দীপুর দিকে তাকিয়ে বলল -দীপু বাবা, তুমি আমার ছেলেকে বাঁচাও।’
দীপু লাফ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে গেল। পাশের রুম থেকে সে তাঁর ঔষধের ছোট ব্যাগটা কাধে নিয়ে নিল। রাজিয়া বেগম চিৎকার শুনে তড়িৎবেগে রান্নাঘর থেকে চলে আসলেন। এসে দেখেন দীপু যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। তাকে টেনে পাশের রুমে নিয়ে বললেন- ওরা তো আমাদের বিরোধী দলের মানুষ বাবা ! দীপু বলল- ঠিক আছে মা, ওরা বিরোধী দলের কিন্তু আমি তো ডাক্তার। আমাদের তো কোন দল নেই। ডাক্তার হিসাবে আমার কিছু দায়িত্ব পালন করতেই হবে।
- ঠিক আছে বাবা, এই ভাতটুকু খেয়ে যায়।
- না মা, এসে খাব।
জামাল সাহেব পাথরের মতো চেয়ারে বসে রইলেন। দীপু ঐ লোকটির সাথে বের হয়ে গেল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দীপু সংঘর্ষের জায়গায় পৌছে গেল। এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল তা বুঝতেই পারেনি তারা। খলিল মিয়ার ছেলে রাসেল সবুজ ঘাসের উপর লাশের মতো পড়ে রয়েছে। মাথা থেকে রক্তের ধারা বৃষ্টির পানির সাথে মিশে যাচ্ছে। দীপু মাটিতে বসে রাসেলের মাথাটা তার কুলে নিয়ে ব্যান্ডেজ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
অন্যদিকে বিরোধী দলের কয়েকজন দীপুকে তাদের কব্জায় পেয়ে একটা হিংস্র চাল চালতে লাগলো। তারা একে অন্যের সাথে চোখের ইশারায় দীপুকে তাদের ফাঁদে আটকে ফেলল। বুদ্ধিমান দীপু তাদের ইশারা বুঝতে পারল ঠিক, কিন্তুু বিশ্বাস করতে পারল না। নিজেকে তাঁর এই মুহুর্তে খুবই অসহায় মনে হচ্ছে। রাসেলের মাথায় ব্যান্ডেজ করে যখন উঠতে যাবে ঠিক তখনই একজন একটা মোটা লাঠি দিয়ে তাঁর মাথায় সজোরে আঘাত করল। দীপু আর দাঁড়াতে পারল না। শুধু একবার ‘মাগো’ উচ্চারণ করে লুটিয়ে পরলো বৃষ্টি ভেজা নরম সবুজ ঘাসের উপরে। মাথা থেকে টলটল করে রক্ত বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে ঝরে পরছে।
জামাল সাহেব বাড়ীতে আর থাকতে পারছেন না। এক ধরনের অস্থিরতা তাঁর মনের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। তিনি একটি ছাতা নিয়ে বাড়ী থেকে বের হয়ে গেলেন। কিছ দূর যাওয়ার পর তিনি দেখতে পেলেন কয়েকজন লোক কাকে যেন ধরাধরি করে তাদের বাড়ীর দিকে নিয়ে আসছে। তাঁর পা কাঁপতে শুরু করল। মনের মধ্যে কেমন জানি বিজলীর মতো আগুন জেঁলে উঠছে। লোকগুলো তাঁর কাছে আসতেই দীপুর রক্ত মাখা মুখটা ভেসে উঠল। তিনি চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন, আমার দীপুর এ কী হলো রে! চিৎকার শুনে রাজিয়া বেগম দৌড়ে ঘর থেকে বের হলেন। দীপুর মুখটা দেখে তিনি হিতাহিত জ্ঞানশুন্য হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরলেন। সবাই যখন দীপুর দেহটা তাদের বাড়ীর উঠানে রাখল তখন জামাল সাহেব খেয়াল করলেন দীপুর মাথা থেকে রক্তের ধারা বৃষ্টির পানির সাথে মিশে সেই সুপারী গাছের গোড়া দিয়ে পাশের বাড়ীর উঠানে প্রবল স্রোতের বেগে বয়ে যাচ্ছে। তিনি তখন আকাশপানে প্রবল বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে ভাবলেশহীন তাকিয়ে রইলেন। এ যেন শুন্যের মাঝে কারো আশায় তাকিয়ে থাকা, যারে আর কখনও পাওয়ার নয় !
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০১৪ দুপুর ১২:৩৯