যৈন দার আজ মন খুবই খারাপ।
আগামীকাল উনার বিয়ে তাই। বিয়ে একটা আনন্দের ব্যাপার। হাসি খুশির ব্যাপার। যার বিয়ে সে কারণে অকারণে মিটমিট করে হাসবে। একে তাকে দাওয়াত দিবে। আরেকজনকে পুটুস পুটুস করে চিমটি কাটবে। ভাসা ভাসা চোখে পিটপিট করে তাকাবে। হঠাৎ দরজা বন্ধ করে দিয়ে ঘুমাবে... আর সেখানে আমাদের যৈনদা কি করছেন? মন খারাপ করে বসে আছেন! ব্যাপারটা আমাদের মোটেও ভালো লাগছে না। আমাদের মানে আমি, রশু,পনি আর জনির। আমরা উনার এলাকার গ্যাং। বাপ মা শুধু জন্ম দেয়। কিন্তু মানুষ চলাফেরা করে তার গ্যাং নিয়ে। সেই অর্থে আমরাই উনার সবকিছু, তাই না? সেই আমাদেরকেও উনি কিছু বলছেন না। এক কোনায় চুপচাপ বসে আছেন।
-যৈনদা? ও যৈনদা? কি হইলো...? কিছু কইবেন না? রশু নিরবতা ভেঙ্গে জানতে চায়।
যৈনদা কিছু কহেন না।
আমি আগবাড়িয়ে উৎসাহ নিয়ে বললাম--যৈনদা আজকে রশু আইস্ক্রিম খাওয়াবে! কি আইস্ক্রিম খাওয়া যায় বলেন তো? কাপ, কুলপি, নাকি দুধ মালাই?
যৈনদা নিরুত্তর।
রশুর ঘাড় ভাংতে আমাদের সবারই ভালো লাগে। সে এলাকায় ২টা কচি মেয়েকেপড়ায়। একটার সাথে আবার প্রেম ট্রেম-ও করে। মাস শেষে বেতনের পাশাপাশি বোনাস-ও পায়। বোনাসটা তার প্রেমিকা কাম ছাত্রী তার বাবার কাছে কান্নাকাটি
করে ম্যানাজ করে দেয়। পাড়াতো মেয়ের সাথে প্রেম করবে, কচি প্রেমের রস খাবেআর খাওয়াবে না... তাই কি হয় নাকি!! যৈনদার তাই ওর ঘাড় ভাঙ্গতেই বেশিভালো লাগে। কিন্তু আজ রশুর ঘাড়ভাঙ্গার কথা শুনেও যৈনদার মুড অফ! ব্যাপারটা নিশ্চয়ই সাংঘাতিক রকমের খারাপ! খারাপ খবর লুকিয়ে রাখতে চাইলে সেটা জানার ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। আমাদের-ও তাই হলো আমরা উৎসুক মুখে তাকিয়ে রইলাম। যৈনদা তবুও নিরুত্তর।
-যৈনদা, তোমার বিয়ে বলে মন খারাপ?
যৈনদা করুণ চোখে তাকায়।
আশ্চর্য্য! বিয়ে হলে মন খারাপ হবে কেন? অন্তত যৈনদার বেলায় তা হবার কথা নয়। তার বয়স হতে চললো প্রায় ৩৫। এর মাঝে উনি ৯টি প্রেম করেছেন। কিন্তু বিয়েতে পরিণত করতে পারেননি একটিকেও। এই এলাকায় উনার মত আর
একটাও আইবুড়া নাই। এই রেকর্ডের জন্য আমরা যৈনদাকে নিয়ে ব্যাপক লেভেলের গর্ব করতাম। সেই গর্ব থাকতে থাকতেই হঠাৎ যৈনদার অধঃপতন! আমরা কিছু বুঝে উঠার আগেই শুনি উনার বিয়ে!! তাও আবার প্রেম করে! সেটাও আবার উনার পাশের বাসার নতুন ভাড়াটিয়ার মেয়ের সাথে! ভাড়াটিয়ার মেয়েতে আমাদের আপত্তি নাই। কিন্তু মেয়ে আবার সেই লেভেলের ট্যাড়া। আমাদের তো ঘোরতর সন্দেহ যে ওই মেয়ে পশ্চিম দিকের ‘রকি ভিলা’র রকির সাথে লুকিয়ে
‘লুকলিক’ করার চেষ্টা করতো। কিন্তু ট্যাড়া বলে সেই কুদৃষ্টি ঘুরে উত্তর দিকের যৈনদার বেডরুমে ক্রাশ খায়। আর এতেই আমাদের প্রিয় যৈনদার সর্বনাশ হয়। আমাদের সন্দেহের কথা বহুবার যৈনদাকে বলা হলেও উনি গা করেননি। তাহলে
কি আমাদের সেই সন্দেহই সত্যি? আর সেই কঠিন সত্য জেনেই কি যৈনদার মন খারাপ? আমাদের কৌতুহল আরো বেড়ে যায়।
-যৈনদা তোমার কি এই বিয়েতে মত নেই?
যৈনদা প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে উঠে।
আমরা মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যাই। যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। যৈনদার মতের অমতে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আগে যেমন মেয়ের অমতে বিয়ে দেওয়া হতো, এখন দিন বদলাইসে। এখন পুরুষের অমতেও বিয়ে দেওয়া হয়। এর উদাহরণ আমার
দুলাভাই নিজে। আমার আপা ভয়ঙ্কর রাগী। এটা দুলাভাই বিয়ের দিন জানতে পারেন। সেই সময়ে দুলাভাই বিয়ে করতে প্রায় নারাজী হয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু আমার বাবা মানে উনার শ্বশুড় আব্বার ধমকে বিয়েতে কবুল বলতে বাধ্য হন।
কল্পনায় দুলাভাইয়ের করুণ মুখ ভেসে উঠে। আর তাই যৈনদার জন্য আমার মনটা হাহাকার করে উঠে। মনে মনে সংকল্প করি উনার জন্য কিছু করতেই হবে।
-যৈনদা... তোমার বিয়ে আমরা ক্যানসেল করে দেই?- আমি চোখমুখ শক্ত করে প্রস্তাব দিলাম।
যৈনদা এবার ডুকরে কেঁদে উঠে।
নাহ্। কেউ কাঁদলে- বিশেষ করে যৈনদা কাঁদলে আমাদের আর ভালো লাগে না। ভেতরটা কেমন যেন খালি হয়ে যায়। বুক শুকিয়ে উঠে। গলা কাঠ হয়ে যায়। যৈনদা প্রথমবার প্রেমে ব্যর্থ হয়ে যখন কান্নাকাটি করেছিলো, আমরাও তখন
চোখের পানি আটকে রাখতে পারিনি। এরপর আরো সাতবার ব্যর্থ হওয়াতে আমাদেরও বোঝা হয়ে গেছে। এখন আমরাও কাঁদতে চাই। কিন্তু গলা শুকায়, বুক শুকায়... পানি বেরায় না। আমি তাই থুথু দিয়ে চোখ ভেজানোর চেষ্টা নেই। বাকীরা
ফোঁপাতে থাকে।
যৈনদা আমাদের ফোপানী দেখে মুখ খোলে।
--আমার বিয়েটা মনে হয় টিকবে না রে!
- কেন? কি হয়েছে?
--বাসর রাতে বউ যদি আমার আসল নাম জানতে চায়? তখন কি হবে? এরপর যদি আমাকে প্রতারক ভাবে? তারপর যদি বউ পালিয়ে যায়?
এতক্ষণে আসল কাহিনী বুঝা গেলো। যৈনদার সবচেয়ে পুরাতন সমস্যা। উনার নাম।
ব্যাপারটা ভালো করে বুঝার জন্য ৩৫ বছর পেছনে যেতে হবে। যৈনদার জন্মের পরপরই উনার বাবা তার নাম রাখলেন – যৈন। আত্মীয়রা সবাই অবাক। যৈন- এ কেমন নাম! তার বাবা ব্যাখ্যা দিলেন যে তার প্রো-পিতামহের নাকি জৈন ধর্মের অনুসারী হবার শখ ছিলো। সেই শখ নিজেও পুরা করতে পারেননি। পারেননি তার পরিবারের বংশধরদের কেউ-ই। আর তাই সন্তানের নাম রাখবেন- যৈন। তার বাবার কথার কেউ প্রতিবাদ না করলেও যৈনদা এই নামের জন্য ঠোক্কর খেয়েছেন জীবনভর। স্কুলে সবাই তাকে ‘যৌন’ বলে ডাকতো। একবার বাংলার মাষ্টারমশাই ভুলে ‘বাবা যৌন, এখানে আসো তো’ বলার পরই যৈনদা ক্ষিপ্ত হয়ে একেবারে স্কুল থেকেই বেরিয়ে আসেন। আর জাননি কোনদিন। নিজে বহুবার নাম বদলানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তার বাবার প্রো পিতামহের ইচ্ছা বলে কথা! পারেননি। এলাকায় উনি জ্বিনদা/নুনুদা... এসব হাবি জাবি নামে পরিচিতি পান। এরপর-ই তার আমাদের নিয়ে গ্যাং তৈরি করা বাধ্যতামূলক হয়ে উঠে। আমাদের কাজই একটা। কেউ নুনুদা/জ্বিনদা এইসব কুৎসিত নামে ডাকলেই তাকে উলঙ্গ করে ছেড়ে দেওয়া। এসব কাজে আমরা ব্যাপক মজা পেলেও যৈনদার মন কখনোই শান্ত হয়নি। উনি প্রেম করতেন নাম ভাড়িয়ে। মিঠুন, রাকেশ, রানভীর... এইসব তারকা + কমন প্রেমিক নাম নিয়ে উনি তরুনীদের পত্র দিতেন। গভীর প্রেমের কোন এক পর্যায়ে তার আসল নাম ফাঁস হয়ে যেত। সাথে নাম নিয়ে যত কাহিনী সবই। এরপরই সম্পর্কে কাটাকাটি। একবার তো বিয়ে হয় হয় এমন সময় নাম জানাজানি হয়ে যায়। আর মেয়ে ১৮০ ডিগ্রী বেঁকে বসে। সে এক কেলেংকারি কান্ড। আগে একবার এমন হবার পর উনি যখন আবার প্রায় বিয়ে করে ফেলছেন... তখন তার মনে সেই পুরানো ক্ষত উদয় হওয়া অস্বাভাবিক নয়। আমরাও তাই ভাবনায় পড়ে যাই। কি করা যায়?
-যৈনদা, আপনে নাম বলবেন না! তাইলেই তো হয়। ভাবির সামনে আমরাও আপনেরে কোনদিন যৈনদা কমু না।– পনি প্রস্তাব দেয়।
--নারে... তাতে কি আর সত্য চাপা থাকবো? একদিন তো সে জানবোই, তাই না?
- তাইলে কি করবেন দাদা?
--জানি না। বলেই যৈনদা ব্যাজার মুখে চলে যান।
আমরা আরেকটা অনাকাংখীত দুঃসংবাদের জন্য অপেক্ষায় থাকি। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে বিয়েটা হয়ে যায়! বিয়ের রাত পেরিয়েও যায়!! আমরা বাসার বাইরে উৎকন্ঠিত হয়ে বসে রই। কিন্তু কোন সাড়া পাই না।
পরের দিন সকালে যৈনদা হাসতে হাসতে হাজির। আমরা যারপরনাই অবাক। বউ তাহলে পালিয়ে যায়নি!!
-ব্যাপার কি যৈনদা? তোমার বউ পালিয়ে যায়নি? ভাবি তোমার নাম শুনে আঁতকে উঠেনি? আমি ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলাম।
--ধূর গাধা! সে আঁতকে উঠবে কেন? আঁতকে তো উঠেছিলাম আমিই।
- বলো কি? তুমি? কেন!? তুমি আঁতকে উঠবে কেন? আমরা নিদারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠি।
-- হ্যাঁ তাই। আমিই আতঁকে উঠেছি রে। তোর ভাবির নাম যে পোঁড়ামুখী!
অ্যাঁ! পোড়ামুখী?! ভাবির নাম শুনে আমরাই যে আতঁকে উঠি!
--অ্যাঁ না রে, হ্যাঁ।
আমি প্রতিবাদ করলাম
-কক্ষনো না! তার নাম তো সুতপা দেবী।
--ঐটা কি আর আসল নাম গাধা!? ঐটাই যে ভাড়ানো নাম। পোড়ামুখি নাম যে তারেও পোড়ায় রে- যৈনদা নতুন বউয়ের কথা ভেবে হাহাকার করে উঠে। আমরা বাকিটা শুনার জন্য অস্থির হয়ে উঠি।
-- শোন-যৈনদা চালিয়ে যান। বাসর ঘরে ঢুকতেই তোর ভাবি আমার হাত জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না! আমি তো সাক্ষাৎ ভেবড়ে গেছি। এরপর বলল- তার আসল নাম সুতপা না। আসল নাম পোড়ামুখী। তোর ভাবী ওই পরিবারের চতুর্থ মেয়ে। তার বাবা চেয়েছিলো তিনটা মেয়ের পর অন্তত একটা ছেলে হোক। দিনরাত ভগবানের কাছে ধন্যা দিয়ে শেষে পেলো আরেকটা মেয়ে! খেপে গিয়ে নাম রাখলো পোড়ামুখী।ওই নাম জানলে কি আর আমি প্রেম করতাম রে বল?! তাই তো নাম ভাড়িয়ে সুতপা হয়েছে! এখন বুঝেছিস গাধার দল?
যৈনদা মুক্তির হাসি হাসেন। আমরা উনার গ্যাং। আমরাও কি না হেসে পারি?