ছাই চাপা আগুন, ছাই ফেলতে ভাঙ্গা কুলো - এরকম হাজারো কথায় ছাই-কে আমরা কতই না তুচ্ছ করে এসেছি এতদিন। কিন্তু এখন মনে হয়- একটু নতুন করে ভাববার সময় এসেছে। দয়া করে ভাববেন না – আমি ছাই-এর ব্যবসা করি। অবশ্য করলেও মন্দ হতোনা। কারণ অনেক ঠেকে এবং শিখেই কথাগুলো লিখছি।
ছাইকে আমরা যতই অবহেলা করিনা কেন, ছাই এখন অমূল্য বস্তু। বিশেষত ঢাকার মত শহরে। যেখানে প্রাকৃতিক গ্যাসের কল্যাণে আমাদের আধুনিকা স্ত্রীরা পাতা বা কাঠের চুলার কথা ভুলেই বসেছেন এবং আমরা আধুনিক স্বামীরা চুলার জন্য মাসে মাসে লাকড়ি কেনার চল কোন কালে ছিল কিনা- এ নিয়ে চিন্তা করাও ছেড়ে দিয়েছি। ব্যাপারটা গ্রামেও সত্য যেখানে গ্যাস এসেছে, হোক তা পাইপলাইন অথবা সিলিন্ডারের মাধ্যমে। তাছাড়া ভীম, ট্রিক্স এসবের কারণে থালা-বাসন ধোয়ার কাজেও যে কখনো ছাই ব্যবহৃত হতো - তা আর ক‘দিন পর হয়তো ইতিহাসের পাতায়ই পড়তে হবে।
যাহোক, এতদিন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ব্যাচেলর জীবন কাটাতে কাটাতে গৃহস্থালির অনেক কিছুই ভুলে বসেছি। নতুন করে সবকিছু মাথায় নিয়ে পুরনো ব্যবস্থায় যখন ফিরেছি- তখন ভাবি, সুখে থাকতে ভুতে কিলায় বলেই হয়তো মানুষ বিয়ে করে!
দিনটা ছিল শুক্রবার। সপ্তাহের প্রয়োজনীয় সব কিনতে আমি আর আমার ভাই গিয়েছি বাজারে। বলা ভাল - ওই আসলে নিয়ে গেছে আমাকে। বাজার করা, কাপড় ধোয়া, রান্না করা, ঘর ঝাড়পোছ করা এসব ব্যাপারে আমার মাত্রাতিরিক্ত অনিচ্ছাই এর কারণ।
বাজারে গিয়ে মুরগী, শাক-সবজী, ডিম, এটা-সেটা আরও অনেক কিছুই কিনলাম! তারপর গেলাম মাছ কিনতে। কাটা-কুটোর ঝামেলায় হাজার লোভ হলেও ছোট মাছ কিনি না, বড় মাছ-ই কিনি সবসময়। সেদিনও তাই বড় দেখে কাতলা, রুই কিনে (এবং কাটিয়ে) বাসায় ফিরছি; দেখি ভাই আমার কৈ-মাছের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এতটাই লোভ ছিল সেই দৃষ্টিতে, টেনে সরাতে গিয়েও আমি ব্যর্থ হলাম।
ও মাছের দরদাম শুরু করল। আমি প্রথমে মৃদুভাবে, তারপর আর একটু গলা চড়িয়ে, শেষপর্যন্ত রীতিমত চিৎকার-চেঁচামেচি করে নিষেধ করলাম। ও দেখি তবু গোঁ ধরে আছে।
কেউ আবার ভেবে বসবেন না - কৈ আমার অপছন্দের। কৈ আমার খুবই পছন্দের, বিশেষ করে যদি তা হয় প্রাকৃতিক, মানে বিল-টিলের। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। কোন মাছ বিক্রেতাই এই মাছ কাটার ঝামেলা নেয় না, আর নিলেও পাতিলে জ্যান্ত মাছ রেখে খাওয়ার আনন্দের সাথে তার কোন তুলনাই হয়না। বাসায় কাজের লোক নেই। (অবশ্য থাকলেও, ঢাকা শহরের বুয়ারা মাছ কাটার ঝামেলায় যায়না। মাছ কাটতে যদি বলেন, তাও যদি হয় আবার কৈ মাছ –তাহলে সাথে সাথে “বুয়া” পোষ্টে Resign দিয়ে জীবনেও আর আপনার ঘরমুখো হবেনা।) ঘরে আছে ভাইয়ের বউ, একাই। সে বেচারি সকাল-সন্ধ্যা চাকরী করবে, দুই বেলা রান্নাও করবে, আবার এই মাছ কাটবে – এত আশা করা নিতান্তই ওর উপর অত্যাচার। নারী নির্যাতন মামলার ভয় না থাকুক, নিজের বিবেক-বুদ্ধি তো অন্তত কিছু আছে!
শেষে বললাম- এই মাছ তোকে কাটতে হবে। আর যদি ঠিকমতো না পারিস, তাহলে তোকেই সব মাছ কাঁচা খাওয়াব।
লোভে পড়ে কি না জানিনা, সে দেখি হাসিমুখে রাজী হয়ে গেল এবং এক কেজি কৈ মাছ কিনেও ফেলল।
সারা রাস্তা রাগে আমি গজগজ করতে থাকলাম, আর ও চুপচাপ সব শুনে গেল।
বাসায় ফিরে ভাই আর ভাইয়ের বউ মিলে শুরু করল মাছ কাটা। সে এক করুণ কাহিনী। ছাই ছাড়া সে মাছ ওরা কিভাবে যে কেটেছে তার বিস্তারিত লেখার সামর্থ্য আমার নেই, কারণ আমি তখন একশ হাত নয়, একদম কোটি কোটি আলোকবর্ষ দুরে। (যদিও খাওয়ার সময় আমার হম্বি-তম্বিই ছিল বেশী এবং খেয়েছিও বেশ মজা করেই।)
যাহোক, মাছ কাটতে গিয়ে নামলাম ছাই-এর সন্ধানে। খুঁজি নাই এমন কোন জায়গা নেই। এমনকি ইন্টারনেটও বাকী রাখিনি। কোন দোকানে যেন প্যাকেটে করে ছাই বিক্রি করতে দেখেছিলাম। তাই ভাবলাম- ইন্টারনেটে অন্তত তার খোঁজ পাব।
এই দুঃসহ অভিজ্ঞতার এখানেই শেষ নয়। এখনও আছি ছাইয়ের সন্ধানে। যদি কেউ পেয়ে থাকেন, দয়া করে জানিয়ে ধন্য করবেন।
ছোটবেলায় পড়তাম-
যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই
পাইলেও পাইতে পার, মানিক-রতন।
এখন মনে হয়, সেটা আসলে ভুল ছিল। ওটা হওয়া উচিত এরকম-
যেখানে দেখিবে ছাই, তাড়াতাড়ি লও ভাই
নিশ্চিত পেয়েছ জেনো, মানিক-রতন।
পুনশ্চ: “ভাই” লেখাতে বোন বা ভাবীরা মনঃক্ষুণ্ণ হবেন না প্লীজ। নারীবাদী কেউ আবার আমার লেখায় শাশ্বত পুরুষালী মনোভাব খুঁজে পেয়ে তীব্র ধিক্কার বা নিন্দা-জ্ঞাপন করবেন না দয়া করে। আসলে এটা শুধুই কথার কথা, ছন্দ মেলানোর জন্য লেখা। আর এতক্ষণ ধৈর্য ধরে এই ছাই-পাশ পড়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।