আমি আসলে এই দু'জন মানুষের কাছা-কাছি মানুষদের কেউনা; আমি আমার পেশাগত দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বলছি, আমার মন্যুষত্ব নিয়ে যখন সন্দিহান হয়ে পড়তাম তখন মন উথাল-পাতাল করতো একটা সুন্দর ছবি কিংবা সুন্দর সিনেমা কিংবা একটা বই হাতে নিয়ে বসে যেতাম। তারেক মাসুদকে পছন্দ করে ফেললাম তাঁর বিখ্যাত সেই ছবি 'মাটির ময়না' দেখার পর। সেই ছবিতে মমতাজের কন্ঠে সেই বিখ্যাত বাউল গানঃ
যদি আল্লাহর সন্ধান চাওগো
প্রেম রাখিও অন্তরের ভিতর।
একবারো মনে হয়নি গানটি ছিলো আরোপিত আর আমি দেখছিলাম আমার শৈশবকে। ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা গড়ে উঠার আবাহন জানায় যে বাংলার সহজিয়া বাউলবাদ তা কতো সহজে তুলে ধরলেন তাঁর 'মাটির ময়না' ছবিতে। অল্প দুই একটা শর্ট দিয়েই বুঝিয়ে দিতেন আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য।
তারেক মাসুদ তার বাল্যকালের অধিকাংশ সময়ই কাটিয়েছিলেন মাদ্রাসায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার মাদ্রাসা শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে। যুদ্ধের পর তিনি সাধারণ শিক্ষার জগতে প্রবেশ করেন এবং একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থেকেছেন এবং দেশে-বিদেশে চলচ্চিত্র বিষয়ক অসংখ্য কর্মশালা এবং কোর্সে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৮২ সালের শেষ দিকে তিনি জীবনের প্রথম ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এই ডকুমেন্টারিটি ছিল প্রখ্যাত বাংলাদেশী শিল্পী এস এম সুলতানের জীবনের উপর। এরপর থেকে তিনি বেশ কিছু ডকুমেন্টারি, এনিমেশন এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ২০০২ সালে তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মাটির ময়না মুক্তি পায়। এই চলচ্চিত্রটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় এবং দেশে-বিদেশে বিশেষ প্রশংসা অর্জন করে। বাংলাদেশের বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সংগঠন শর্ট ফিল্ম ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি। ১৯৮৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসবের কো-অরডিনেটর হিসেবে কাজ করেছেন। এছাড়া তিনি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দেয়ার পাশাপাশি কয়েকটি সাময়িকী ও পত্রিকায় চলচ্চিত্র বিষয়ে লেখালেখি করতেন।
০১ আ কাইন্ড অফ চাইল্ডহুড বেটাক্যাম এসপি ৫০ মিনিট ২০০২ তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ জিঙ্গু ফিল্ম্স, অডিওভিশন ঢাকার কর্মজীবী শিশুদের জীবন সংগ্রামের উপর ডকুমেন্টারি
০২ মাটির ময়না ৩৫এমএম ৯৮ মিনিট ২০০২ তারেক মাসুদ ক্যাথরিন মাসুদ ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের মাদ্রাসায় পরিচালকের বাল্য জীবনের অভিজ্ঞতার উপর পূর্ণ দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র
০৩ নারীর কথা বেটাক্যাম এসপি ২৫ মিনিট ২০০০ তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ যুদ্ধে বেঁচে থাকা নারীদের অভিজ্ঞতার উপর ডকুমেন্টারি
০৪ মুক্তির কথা বেটাক্যাম এসপি ৮২ মিনিট ১৯৯৯ তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাধারণ গ্রামীণ জনগণের অভিজ্ঞতা
০৫ ইন দ্য নেইম অফ সেফ্টি ডিভিক্যাম ২৫ মিনিট ১৯৯৮ তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ টিভিই লন্ডন, অডিওভিশন বাংলাদেশে মানবাধিকার লংঘনের উপর ডকুমেন্টারি
০৬ ভয়েসেস অফ চিলড্রেন বেটাক্যাম এসপি ৩০ মিনিট ১৯৯৭ তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ ইউনিসেফ, অডিওভিশন বাংলাদেশের কর্মজীবী শিশুদের উপর ডকুমেন্টারি
০৭ মুক্তির গান ৩৫এমএম ৭৮ মিনিট ১৯৯৬ তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় একটি ভ্রাম্যমান গানের দলের উপর পূর্ণ দৈর্ঘ্য ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র
০৮ ইউনিসন ইউম্যাটিক ভিডিও ৪ মিনিট ১৯৯৪ মানবজাতির ঐক্যের উপর এনিমেশন চলচ্চিত্র
০৯ সে ৩৫ এমএম ১০ মিনিট ১৯৯৩ তারেক মাসুদ, শামীম আখতার একটি নারী ও পুরুষের বেদনাদায়ক পুনর্মিলন
১০ আদম সুরত ১৬ এমএম ৫৪ মিনিট ১৯৮৯ তারেক মাসুদ বাংলাদেশী শিল্পী এস এম সুলতানের জীবন ও শিল্পকলার উপর ডকুমেন্টারি
১১ অন্তর্যাত্রা তারেক মাসুদ লন্ডন প্রবাসী এক সিলেটী পরিবারের গল্পের মাধ্যমে মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ
একুশে টেলিভিশন চালু হওয়ার সময় হেড অব অপারেশন্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এরপর বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস, চ্যানেল ফোর ও সিবিসি টেলিভিশনের ক্যামেরা অপারেটর হিসেবে কাজ করেন। গত বছর দেশে ফিরে এটিএন নিউজের সিইও’র দায়িত্ব নেন।
আর লিখতে ইচ্ছে করছেনা; তারা দু'জন সহ চলে গেলেন আরো পাঁচজন মানুষ। ফিরবেননা!! শহীদ মুনীর চোধুরী তনয় মিশুক মুনীর কিংবা তারেক মাসুদদের জন্ম প্রতিদিন প্রতি মুহুর্তে হয়না। তাই তারা ক্ষনজন্মা।