মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ত্রিশ লাখ নাকি তিন লাখ এই নিয়ে যে তর্কের পেছনে যে প্রথম কথাটা মানুষ বলে সেটা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তিন লাখকে ভুল করে তিন মিলিয়ন বলেছিলেন। আসলে মানুষ কি এতোই বোক হতে পারে? তাও আবার শেখ মুজিবরের মত মানুষ? তিনি আর যাই হোউন তিন লাখকে ভুল করে তিন মিলিয়ন বলার মত মানুষ নিশ্চয়ই ছিলেন না। আবার অনেকে এটাও বলেন যে শেখ মুজিব তো পুরোটা সময় জেলেই ছিলেন। তার পক্ষে তো সত্যি কথা জানার কোন উপায় নেই।
এই গল্পের ডানা পাখা মেলে যখন ২০১১ সালে গার্ডিয়ান পত্রিকাতে বিবিসি বাংলার তৎকালীন ডেপুটি হেড সিরাজুল ইসলাম একটা প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে তিনি লেখেন যে যখন শেখ মুজিব মুক্তি পেয়ে লন্ডনে আসেন তখন তখন তিনি ছিলেন তার সাথে দেখা করা প্রথম ব্যক্তি। আর তার সাথে ছিলেন ভারতের হাই কমিশনার আপা ভাই পান্থ। এরাই শেখ মুজিবকে বিমান বন্দর থেকে হোটেলে নিয়ে যান। তারপর সিরাজুল ইসলামই নাকি শেখ মুজিবকে দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে সব কিছু জানান। এমন কি তিনি বলেছিলেন যে যুদ্ধে মৃত্যুর সংখ্যা তিন লাখ। যদিও এই সিরাজুল ইসলাম কিভাবে জানলেন যে মৃতের সংখ্যা তিন লাখ? এই লেখা শেষ পর্যন্ত পড়লে বুঝবেন যে তার পক্ষে সংখ্যাটা যে তিন লাখ এটা সঠিক ভাবে জানা সম্ভবই না। কারণ সকল পত্রপত্রিকাতে অন্য কথা বলছে !
কিন্তু গার্ডিয়ান পত্রিকাতে আরও একটা চিঠি ছাপা হয় । সেটা লেখেন বাংলাদেশের হাই কমিশনার রাশেদ চৌধুরী। তার ভাষ্যমতে সেদিন শেখ মুজিবের সাথে সিরাজুল ইসলাম বা পান্থের দেখাই হয় নি । শেখ মুজিবকে সেদিন রিসিভ করেছিলেন বাংলাদেশের কুটনৈতিক এবং ফরেন অফিশিয়ালরা। একটা কথা তো এখানে স্বাভাবিক যে বাংলাদেশের কুটনৈতিক তাকে রিসিভ করবে। সেখানে সিরাজুল ইসলামের ভাত কই ?
এই ত্রিশ লাখের কথা আসলে কোথা থেকে এল? এই ত্রিশ লাখ পরিমানটা কি শেখ মুজিবই প্রথম উচ্চারণ করেছে নাকি অন্য কেউও করেছিল? যদি কেবল শেখ মুজিবই প্রথম এই ৩০ লাখ উচ্চারণ করে তাহলে হয়তোও তিনি ভুল করে থাকবেন । কিন্তু যদি তার আগেই এই ত্রিশ লাখ উচ্চারণ করে থাকে ? তাহলে?
দেশ স্বাধীন হয়েছে ১৬ ডিসেম্বর এবং শেখ মুজিব মুক্তি পেয়েছে আট জানুয়ারি । ২৩ দিন। এই ২৩ দিনের দেশী বিদেশী পত্রিকা কী বলে?
১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে প্রকাশিত হয় ‘রক্তাক্ত বাংলা’ গ্রন্থটি । সেখানে বিশ লক্ষ নরনারীর প্রাণ হারানোর কথা উল্লেখ করা হয়। তখনও কিন্তু যুদ্ধ শেষ হয় নি । আর সাড়ে চারমাস বাকি ।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এম আর আখতার মুকুলের চরমপত্র ছিল জলজ্যান্ত দলীল ! ২৫ মে ১৯৭১ থেকে সেটা ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত চালু ছিল । ১৬ই ডিসেম্বরের চরম পত্রের একটা লাইন ছিল ‘জেনারেল টিক্কা খান হেই অর্ডার পাইয়া ৩০ লাখ বাঙালির খুন দিয়া গোসল করল’। এই ৩০ লাখ শব্দটা আসল কোথা থেকে ? শেখ মুজিব তো তখন জেলে !
দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার সম্পাদক ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে তার পত্রিকার একটা সম্পাদকীয় লেখেন। সেখানে এই ৩০ লাখ বাঙালী নরনারী হত্যার কথা উল্লেখ আছে।
সোভিয়েত রাশিয়ার অফিশিয়াল মুখপাত্র প্রাভদা ৩ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে ৩০ লক্ষ শহীদের কথা উল্লেখ করেন। সেটার শিরনামটাকে বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘’লুকানো গেল না।’’
এই প্রাভদার কথা উল্লেখ করে ৫ জানুয়ারি মর্নিং নিউজ পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের আজাদ পত্রিকাতে প্রকাশিত হয় ৫ তারিখে। দৈনিক বাংলা পত্রিকাতে জল্লাদের বিচার করতে হবে শিরনামে প্রকাশিত প্রবন্ধেও এই ৩০ লাখ শহীদের কথা উল্লেখ আছে।
তার মানে আপনারা এই যে বলে বেড়াচ্ছেন যে শেখ মুজিব ভুল করেই তিন লাখকে ত্রিশ লাখ বলেছে এই তথ্য সঠিক না। লন্ডনে পৌছানোর পরে এবং পত্রিকাতে সাক্ষাৎকার দেওয়ার আগে শেখ মুজিব তার পরিবার এবং নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ করেন । সেখান থেকেই তিনি দেশের ক্ষয় ক্ষতি সম্পর্কে জানতে পারেন। প্রায় ত্রিশ লাখ শহীদের সংখ্যাটাও সেখান থেকেই তিনি জানতে পারেন । ত্রিশ লাখ শহীদের হিসাবটা তিন লাখকে ভুল করে তিন মিলিয়ন থেকে উৎপন্ন নয় !
এছাড়া নানান আন্তর্জাতিক পত্রিকাতেও এই মৃতের সংখ্যার উল্লেখ আছে। এই সংখ্যা গুলো সব যুদ্ধের ভেতরের সংখ্যা । টাইম সাময়িকীয় ৭১এর এপ্রিলের ১২ তারিখে শহীদের সংখ্যা লিখেছে ৩ লাখ। যুদ্ধের বাকি আট মাস। এপ্রিলের মাঝামাঝিতে নিউজ উইকে শহীদের সংখ্যা লিখেছে সাত লাখ। এখানেও আট মাসের যুদ্ধ বাকি। দি বাল্টিমোর সান, ১৪ই মে ১৯৭১ সালে শহীদের সংখ্যা লিখেছে ৫ লাখ। যুদ্ধের তখনও সাত মাস বাকি। দি মোমেন্টো ক্যারাকাস জুনের ১৩ তারিখে শহীদের সংখ্যাটা লিখেছে ৫ থেকে ১০ লাখ। যুদ্ধের বাকি ছয় মাস। কাউরান ইন্টারন্যাশনাল জুলাই মাসে শহীদের সংখ্যাটা লিখেছে ৫ লাখ। যুদ্ধের বাকি ৫ মাস। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে জুলাই মাসের ২৩ তারিখে এই সংখ্যাটা ২ থেকে ১০ লাখ উল্লেখ করেছে। টাইম সাময়িকীর সেপ্টেম্বরে শহীদের সংখ্যাটা ছিল ১০ লাখ। লন্ডন থেকে প্রকাশিত দি হ্যাম্পস্টেড এন্ড হাইগেট এক্সপ্রেস, পহেলা অক্টোবর ১০৭১ এ শহীদের সংখ্যাটা লিখেছে ২০ লাখ। ন্যাশলাম জিওগ্রাফি ১৯৭২ সালে এই সংখ্যাটা উল্লেখ করেন ৩০ লাখ।
আওয়ামীলীগের আমলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু বলা, আরও ভাল করে বললে আওয়ামীলীগ যা ঠিক করে দিয়েছে তার বাইরে কিছু বলাটা একেবারে ব্লাস্ফেমি ছিল। এই ত্রিশ লক্ষ শহীদের ব্যাপারটাও সেই রকম ছিল । মানুষের প্রশ্ন করা সন্দেহ করা জানতে চাওয়ার ভেতরে আমি কখনই কোন দোষ দেখি না । কার যদি সত্যিই ত্রিশ লক্ষ শহীদ নিয়ে সন্দেহ জাগে মনে তাহলে অবশ্যই সেটা নিয়ে পড়াশোনা করা উচিৎ, জানার চেষ্টা করা উচিৎ ! কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আপনার সত্যিই কি জানার আগ্রহ আছে? আপনি কি আসলেই জানতে চান নাকি আপনি ৩/৩০ লাখের ব্যাপারে আপনার আগে থেকে নেওয়া সিদ্ধান্তকে বিশ্বাস করতে চান? শহীদের সংখ্যা ত্রিশ লাখ হলেও যেমন আপনার ব্যাপারটা জানা উচিৎ তেমননি ভাবে আপনার যদি তিন লাখে বিশ্বাস স্থাপন করতে ইচ্ছে হয় সেই ব্যাপারেও আপনার নিজে জানার আগ্রহ থাকা উচিৎ । এটা তো আল্লাহর বানী না যে নবী এসে বলল আর আপনার চোখ বুজে সেটা বিশ্বাস করে নিতে হল !
কিন্তু যারা এই ত্রিশ লক্ষ শহীদের সংখ্যাটা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, সেটা পক্ষে হোক আর বিপক্ষে হোক, তাদের বেশির ভাগেরই জানার আগ্রহ নেই। তারা কেবলমাত্র নিজেদের স্বার্থ চারিতার্থ করতে ব্যস্ত ! সত্য নয় কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কুপোকাত করার চেষ্টায় লিপ্ত !
আপনি যদি সত্যিই জানতে চান যে মুক্তিযুদ্ধে কতজন মানুষ মারা গিয়েছিল তাহলে কেবল একটা দুইটা ফেসবুক পোস্ট পড়ে বিশ্বাস করবেন না। এ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে, বই বের হয়েছে। সেগুলো পড়ার চেষ্টা করুন। কারো মনগড়া কথা, কারো করা প্রশ্ন দিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় না। আরিফ রহমানের লেখা ‘ত্রিশ লক্ষ শহিদ’ দিয়ে শুরু করতে পারেন।
নোট: বর্তমানে শহীদ শব্দটার সঠিক বানান হচ্ছে শহিদ । তবে আমার কেন জানি শহীদ লিখতে বেশি ভাল লাগে !
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫