শোবার ঘরে ঢুকে দেখলাম মুনজেরিন বিছানাতে আধশোয়া অবস্থায় বই পড়ছে । ওর দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলাম কেবল । তারপর ঘরের মাঝে ঢুকতেই দেখলাম মুনজেরিন উঠে বসলো । আমার দিকে মুখ করে বলল, উপহারের জন্য থ্যাংকস !
আমি একটু হাসলাম । কাল থেকে আমি কেবল এই একটা কথা শোনার জন্যই অপেক্ষা করছি । কখন মুনজেরিন একটু খুশি হবে কিংবা আমাকে ধন্যবাদ দিবে ।
মুনজেরিন বলল, শাড়িটা সুন্দর হয়েছে । কিন্তু তুমি জানো আমি শাড়ি পরি না ।
-জানি ।
-তারপরেও?
ওর চোখে খানিকটা কৌতুহল । আমি একটু হেসে বললাম, নিজের বউকে যদি শাড়িই না উপহার দিলাম তাহলে কি উপহার দিলাম বল!
মুনজেরিন হাসলো । ওর হাসি দেখে এখনও আমার বুকের মাঝে যে কি ঝড় সৃষ্টি হয় সেটা যদি ওকে বোঝাতে পারতাম !
মুনজেরিন আর কিছু বলল না । আবারও বিছানাতে আধশোয়া অবস্থায় বই পড়তে শুরু করলো । আমি ওর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লাম ।
প্রতিদিন এমন ভাবেই মুনজেরিন ঘুমানোর আগে একটু বই পড়ে । আমি এই সময়ে মোবাইল টিপি নয়তো ওর দিকে তাকিয়ে থাকি । আমার ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগে । এমন কি সারা রাতই মুনজেরিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারি। আমার স্বপ্নের নায়িকা সে । আমার এখনও মাঝে মাঝে এই টা বিশ্বাস হয় না যে মুনজেরিন আমার বউ । আমার বিয়ে করা বউ ।
সেলিব্রেটি বলতে আমরা যা বুঝি মুনজেরিন সেই রকম টিভি অভিনেত্রী কিংবা গায়িকাদের মত কেউ ছিল না । কিন্তু তার থেকেও বেশি কিছু ছিল । তাকে সবাই চিনতো । এখনও চেনে খুব ভাল করে । পেশায় মুনজেরিন একজন ডাক্তার । তবে এইখানেই তার কাজ কর্ম সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে নি । মূলত প্রথমে তার একটা ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে । সেখানে বর্তমানে ২১ লক্ষ্য সাবস্ক্রাইবার । ডাক্তারী পড়া অবস্থাতেই মুনজেরিন মানুষের জন্য বিভিন্ন স্বাস্থ সেবা মূলক ভিডিও বানাতে শুরু করে এবং আস্তে ধীরে সেগুলো প্রথমে ইউটিউব এবং পরে ফেসবুকে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে । মুনজেরিনের কন্ঠ খুবই ঝকঝকে আর পরিস্কার । মাঝে মাঝে সে আবৃত্তি করতো তার চ্যানেলে । এছাড়া আরও কত রকম হাতের কাজই না সে জানে ।
এছাড়াও তাকে আরও একভাবে মানুষ চেনে । সেটা হচ্ছে মুনজেরিন একজন বাইকার । ওর একটা না, দুইটা রেসিং বাইক রয়েছে । আগে সেগুলো সে নিয়মিত চালাতো । কলেজে যেত এগুলোতে চড়েই এবং পরে নিজের কর্ম স্থলেও বাইক চালিয়ে যেত । মাঝে মাঝে নিজের বাইকের ভিডিও বাইক নিয়ে চালানোর ভিডিও ছবি সোস্যাল মিডিয়াতে দিলে সেগুলোও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় ।
এরপর মুনজেরিনকে বিভিন্ন কোম্পানি তাদের প্রোমোশনাল ভিডিওর জন্য হায়ার করতে শুরু করলো । বলতে গেলে সোস্যাল মিডিয়াতে মুনজেরিন একজন খুবই পরিচিত মুখ হয়ে গেল সবার কাছে । আমিও তার লক্ষ ভক্তের ভেতরে একজন ছিলাম । আমার সাথে ওর প্রথম দেখা হল আমাদের কোম্পানির একটা প্রোমোশনাল ভিডিও ওকে সাইন করতে এসেছিলাম । আমি তো আগেই ওর প্রেমে পড়েছিলাম । সরাসরি দেখে একেবারেই গলে গেলাম । আগে তো কেবল তার বাহ্যিক দিকটা দেখে আমি তার প্রেমে পড়েছিলাম ।
তারপর টুকটাক কথা হত । একদিন সাহস করে নিজের মনের কথা আমি বলেই দিলাম । আমি জানতাম সে গ্রহন করবে না । করেও নি । আমি সেদিন জানতে পারলাম যে তার বয়ফ্রেন্ড আছে । তাও আবার যেন তেন বয়ফ্রেন্ড না, একেবারে বাসায় জানানো বয়ফ্রেন্ড ।
ছেলেও মুনজেরিনের মত ডাক্তার । তবে সে এই দেশে থাকে না । ইংল্যান্ড থাকে । সেখানকার ডাক্তার । অনেক দিন থেকেই ওদের প্রেম চলছে । মুনজেরিন কদিন পরে হয়তো সেখানে চলে যাবে । বাসায় ওদের কথা জানে এবং মেনেও নিয়েছে সব । এমনই তো হওয়ার কথা । মুনজেরিন যেমন পার্ফেক্ট তার বয়ফ্রেন্ডও হওয়া দরকার পার্ফেক্ট এবং তার যোগ্য । আমি তো তার ধারে কাছেও যাই না । তবুও আমি মাঝে মাঝে মুনজেরিনের সাথে কথা বলতাম । তবে এমন ভাবে কথা বলতাম যাতে ও কোন ভাবেই বিরক্ত না হয় । বিরক্ত হয়ে যদি আমাকে ব্লক করে দেয় তাহলে আমার কষ্টের সীমা থাকবে না । আমি কেবল ওর সাথে একটু কথা বলে, একটু চোখের দেখা দেখেই খুশি ।
কিন্তু একদিন সব উলট পালট হয়ে গেল । মুনজেরিন খুব বাজে ভাবে বাইক এক্সিডেন্ট করলো । সারা শরীরের আঘাত তো পেলই সাথে সাথে । ওর বাঁ পা টা খুব খারাপ ভাবে ভেঙ্গে গেল । আমার মনে আছে আমি কতদিন ঐ হাসপাতালে গিয়ে বসে থেকেছি । ওর কেবিনের দরজার সামনে ওর ঘুমন্ত বেদনাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যথিত হয়েছি। নিজেকে কী যে অপরাধী মনে হয়েছে তখন! বারবার উপরওয়ালার কাছে দোয়া করেছি যেন মুনজেরিন ঠিক হয়ে যায় । ওর যেন কষ্ট কম হয় । আস্তে আস্তে ও সেরে উঠলো ঠিকই তবে ওর পা টা এমন ভাবেই ভেঙ্গেছিলো যে সেটা পুরোপুরি ঠিক হল না । ওকে একটা স্টিক নিতে হল । এবং ঠিক এই সময়েই সব থেকে বড় ধাক্কাটা সে খেল । শারীরিক ভাবে ঠিক হতে না হতেই মুনজেরিন খবর পেল যে তার ভালোবাসার মানুষ তার সাথে ভালোাসার সম্পর্ক শেষ করে দিয়ে অন্য একটা মেয়ের সাথে এঙ্গেইজমেন্ট করে ফেলেছে ।
মুনজেরিনের অবস্থা দেখেই সে এমন কাজ করেছে । ওর পা হয়তো আর কোন দিন ঠিক হবে না । এই জন্যই সে মুনজেরিনকে আর বিয়ে করতে রাজি নয় । তার মত একজন পার্ফেক্ট ছেলে কেন একজন শারীরিক ভাবে ডিসেবল মেয়েকে বিয়ে করবে ! এই ধাক্কাটা মুনজেরিনের জন্য সহজ ছিল না । সে সামলে নিতে পারলো না । এখানেই আসলে আমার আবির্ভাব ।
মুনজেরিন হাসপাতাল থেকে বাসায় গিয়েছে । হাসপাতালে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে । সারাদিন বাসায় বসে থাকে চুপচাপ । আমি সুযোগ পেলেই ওর বাসায় যাই । ওর সামনে বসে থাকি । টুকটাক কথা বলি চলে আসি । একদিন নিজেই ফোন করে আমাকে ওর বাসায় যেতে বলল । আমি যথা সময়ে গিয়ে হাজির হলাম । ওর মা আমাকে ওর ঘরে নিয়ে গেল । এই কয়েক মাসে মুনজেরিন যেন একেবারে বদলে গিয়েছে । ওর চেহারাতে সেই ঔজ্বাল্যো আর নেই । মুখের সেই মিষ্টি হাসি আর দেখাই যায় না ।
আমি প্রথমে কিছু কথা বলার চেষ্টা করলাম । মুনজেরিন চুপ করে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলো । তখন বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যা নামছে । মুনজেরিন হঠাৎ বলল, রাকিব, আমাকে একটু বারান্দাতে নিয়ে যাবেন?
আমি ওর বিছানার সামনে এলাম । মুনজেরিন খুব স্বাভাবিক ভাবে আমার হাত ধরলো । স্টিকটা নিল না । আমার হাত আর ঘারের উপর ভর দিয়ে হেটে গেল বারান্দাতে ।
আমার কেন জানি তখন খুব বেশি ভাল লাগছিলো । হয়তো মুনজেরিনের হাতে আমার হাত রয়েছে এটাই ছিল সব থেকে বড় কারণ ।
মুনজেরিন বলল, আপনি সেদিন ঠিক কথাই বলেছিলেন।
-কোন কথাটা ?
-ঐ যে আমি সবার চোখে পার্ফেক্ট বলেই সবাই আমাকে পছন্দ করতো । এই দেখুন আমি এখন আর মোটেই পার্ফেক্ট নই । পা ভেঙ্গে খোড়া হয়ে গেছি । ঠিক মত চলতে পারি না । মুখের কাছে দেখি কাটা দাগ !
আমার মনে আছে কোনদিন আমি কথাটা বলেছিলাম । ওর বাইক এক্সিডেন্টের দিন দুয়েক আগে । তাকে বলেছিলাম যে চেহারা খুব গুরত্বপূর্ন একটা ব্যাপার । মানুষ কেবল পা্র্ফেক্ট টাকে পছন্দ করে অন্য কিছু তাদের আকর্ষণ করে । কোন কারণে যদি সেই পার্ফেকশনটা চলে যায় তাহলে তাদের সেই ভালো লাগার আকর্ষণটাও চলে যায় । মুনজেরিন অবশ্য আমার সাথে একমত হয় নি । খানিকটা কথা কাটাকাটি হয়েছিলো । সে জোর দিয়েই বলেছিলো যে মানুষ যাকে ভালোবাসে তাকে ছেড়ে যায় না ।
আমি মুনজেরিনের কন্ঠে একটা বেদনা অনুভব করলাম । নিজের কাছের সেই অপরাধবোধটা আমার আবারও বেড়ে গেল । আমি বললাম, কথাটা মোটেই ঠিক না । আপনাকে এখনও সবাই পছন্দ করে । মানুষ আপনাকে আপনার চেহারা কিংবা শারীরিক সৌন্দর্য্যের জন্য আপন করে নেয় নি, নিয়েছে আপনার কাজের জন্য ।
আমি একটু চুপ করলাম । অনুভব করলাম মুনজেরিন তখনও বাইরের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে । আমি আবার বলা শুরু করলাম, আমি মানছি যে সুন্দর চেহারা দৈহিক গঠন মানুষকে আকর্ষন করে কিন্তু বিশ্বাস করুন এই আকর্ষণ বেশি দিন থাকে না । মানুষ একজনের প্রতি ভালোবাসা টিকে থাকার জন্য সেই মানুষের ব্যক্তিত্ব কর্ম অনেক গুরুত্বপূর্ন ।
-চেহারা থেকেও?
-হ্যা চেহারা থেকেও ।
মুনজেরিন হাসলো । তারপর বলল, আপনি যে কথা বলেছিলেন সেটাই কিন্তু হয়েছে । আমার পার্ফেকশন চলে যাওয়ায় সায়ন চলে গেছে ।
আমি বললাম, কারণ সায়ন কোনদিন আপনাকে ভালোবাসে নি । সে আপনার পার্ফেকশনকে ভালোবেসেছে আপনাকে না ।
-সবাই তো তাই বাসে ।
-না সবাই তাই করে না ।
-আপনি?
-আমি আপনাকে ভালোবাসি । আপনার ভাল মন্দ সব কিছু !
-যদি বলি চলুন বিয়ে করি । করবেন ?
আমি একটা সেকেন্ড দেরি করলাম না । বলল, চলুন। এখনই ।
-পরে পস্তাবেন না? আবেগে বসবতি হয়ে মনে হবে না একটা ডিসেবল মেয়েকে বিয়ে কেন করলাম ?
-কোনদিন মনে হবে না ।
এই লাইনটা এতো দৃঢ় ভাবে বললাম যে মুনজেরিন যেন একটু কেঁপে উঠলো । তবে কিছু বলল না । একভাবে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো ।
তারপরের সপ্তাহেই মুনজেরিনের সাথে আমার বিয়ে হয়ে যায় । কোন অনুষ্ঠান ছিল না । কেবল ছোট করে ঘোরোয়া ভাবে বিয়ে ।
-লাইট বন্ধ করে দিবো?
মুনজেরিনের কথায় ওর দিকে ফিরে তাকালাম । এতো সময়ে আমি এসবই ভাবছিলাম। আমি বললাম, আমি দিচ্ছি । তুমি শুয়ে পড় ।
তারপর একটু চুপ করে থেকে বললাম, একটা কথা বলবো?
-হুম বল ।
-আর হাসপাতালে যাবে না?
-নাহ !
-কেন ?
-জানি না । আসলে আমার ভেতরে আর আগেই কিছু নেই । নিজের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি । আমার নিজের উপরেই যখন নিজের ভরশা নেই আমি কোন সাহসে অন্যকে চিকিৎসা করবো। আমি জানি এই কথা শুনলে তোমার খারাপ লাগবে তবে আমি সায়নের উপরে খুব বেশি ভরশা করেছিলাম । আর সেটা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো যে ওকে আমি আমার স্তম্ভ বানিয়ে ফেলেছিলাম । আমার ভীত । সেটাই যখন ভেঙ্গে গেল তখন আমার সব কিছু উঠলো । আবার কবে নিজের উপর আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবো আমি জানি না । আদৌও পাবো কি না তাও জানি না !
দুই
আমি মুনজেরিনের চিৎকার শুনতে পেলাম । স্টিকের ঠকঠক আওয়াজটা দ্রুত এগিয়ে আসতে শুরু করেছে রান্না ঘরের দিকে । আমি নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রয়েছি । সেখান থেকে সমানে রক্ত বের হচ্ছে হাত কেটে গেছে আমার । ধারালো ছুরিটা এভাবে হাত থেকে ছুটে অন্য স্থানে লাগবে সেটা টেরই পাই নি ।
-ও মাই গড ! কিভাবে হল !
-কেটে গেছে !
-দেখতেই তো পাচ্ছি কেটে গেছে !
মুনজেরিন আমার হাত পরীক্ষা করতে শুরু করলো । তখনই খেয়াল করে দেখলাম ওর হাতের স্টিকটা নেই । ও নিজের পায়ে দাড়িয়ে । মুনজেরিন আমাকে নিয়ে এসে ডাইনিংয়ের চেয়ারে বসালো । ফার্স্ট এইড কিট ডাইনিংয়ের শোকেজের উপরেই থাকে । সেখান থেকে নামিয়ে যত্ন সহকারে আমার হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল । তারপর আমার দিকে তাকিয়ে রাগত স্বরে বলল, কি এমন ঘোড়ার ডিমের কাজ করতে যাচ্ছিলেন যে এভাবে হাত কেটে গেল ?
আমি একটু হাসলাম । তারপর বললাম, বস, আমি নিয়ে আসছি !
-মানে....
-আরে বস না ! নিয়ে আসছি !
এই বলে আমি রান্নাঘরের দিকে হাটা দিলাম । আরও কিছু কাজ করা বাকি । জলপাই কাটতে গিয়েই হাত কেটে গিয়েছিলো । তাকিয়ে দেখি যথেষ্ঠ কাটা হয়েছে । এখন বাকি কাজ করা লাগবে । আরও মিনিট পনের কেটে গেল । তারপর আমি বাটিটা হাতে নিয়ে মুনজেরিনের সামনে রাখলাম ! । বাটির ভেতরে একটা ভর্তা জাতীয় খাবার । বেশি করে কাঁচামরিচ, ধনিয়াপাতা আর লবণ বেঁটে নিয়ে জলপাই থেঁতলে তার সাথে পাটালিগুড় মিশিয়ে এই জিনিস বানানো হয়েছে ।
মুনজেরিন আমার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, এই জিনিস বানিয়েছো ?
-আরে খেয়েই দেখো না । এটা হচ্ছে অমৃত ! আরে খাও খাও !
এই বলে আমি আমার মোবাইল দিয়ে ওর এক্সপ্রেশন ভিডিও করতে শুরু করলাম !
মুনজেরিন একটু মুখে দিল । ওর মুখ দেখেই বুঝতে পারলাম স্বাধটা ওর ভাল লেগেছে । তারপর আরও মুখে দিল ! এরপরেই আসল খেলা শুরু ! কিছু সময়ে রভেতরেই দেখতে পেলাম মুনজেরিনের নাক কপাল ঘেমে একাকার ! একটু বেশি ঝাল হয়েছে । তবে মুনজেরিন কিন্তু খাওয়া বন্ধ করলো না ! বাটির সব টুকু শেষ করে ফেলল । আমি যে ওর মুখের ভাব টুকু সব টা ভিডিও করছি সেটা সে খেয়ালই করলো না ! আমার দিকে না তাকিয়ে বলল, ওফ বাবা এতো ঝাল কেন !
-সুন্দর না?
-ছাই সুন্দর ! কই পানি দাও !
-আরে পানি লাগবে না । এটাই ফিল করো ।
আমি টিস্যু এগিয়ে দিলাম ওর দিকে । ওর নাকে তখনও ঘাম লেগে রয়েছে । একটা রক্তিম আভা যুক্ত হয়েছে সেখানে । আমি মগ্ধ চোখে সেটা দেখতে পেলাম । এই এতোদিন পরে মুনজেরিনের মুখে আমি একটু স্বাভাবিক আচরন দেখতে পেলাম । এতোদিন একটা বিষণ্ণ ভাব লেগেই থাকতো সব সময় ! রিদি আপাকে একটা ধন্যবাদ দিতেই হবে এই রেপিসি দেওয়ার জন্য ।
ঐদিন বিকেল বেলা মুনজেরিনকে বলল, যে খাবারটা খেলে সেটা নিয়ে একটা ভিডিও বানালে কেমন হয়? এমন একটা খাবারের ব্যাপারে অনেকে জানে না ।
দেখলাম মুনজেরিনের মুখটা কেমন যেন মলিন হয়ে গেল । বলল, না
-কেন না?
-আমি ক্যামেরার সামনে কথা বলতে পারবো না।
-একবার চেষ্টা করা যাক অন্তত ।
-না । আমার দ্বারা হবে না !
আমি মোবাইলের ভিডিওটা বেশ কয়েকবার চালু করে দেখতে লাগলাম । ওর মুখের ঐ ন্যাচারাল এক্সপ্রেশনটা দেখতে এতো চমৎকার লাগছিলো ! তখনই আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এল । জানি না মুনজেরিন এতে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে তবে একটা ঝুকি নেওয়াই যায় !
আমি মুনজেরিনের কাছ থেকে ওর ল্যাপটপ চেয়ে নিলাম । তারপর সেটা দিয়ে ওর ইউটিউব চ্যানেলে ঢুকলাম । ভাগ্যভাল যে এখন সব লগিং অবস্থাতেই আছে । ওর ঝাল জলপাইয়ে ভর্তা খাওয়ার ভিডিও টা আপলোড করে দিলাম । রাতে আর তেমন কিছু হল না ।
কিন্তু সকাল বেলা আমি আবার যখন ইউ চ্যানেলে ঢুকলাম আমার চোখ কপালে উঠলো । মাত্র এক রাতেই ভিডিওটা প্রায় এক মিলিয়ন ভিউয়ের কাছে চলে গেছে । আর কমেন্টের সংখ্যা প্রায় দশ হাজারের কাছাকাছি । এবং সেটা বাড়ছেই । সবাই তাকে কত মিস করে সে কেমন আছে আরও প্রশ্ন ! আমি ল্যাপটপ টা নিয়ে হাজির হলাম মুনজেরিনের সামনে ! ও তখন রান্না ঘরে বুয়াকে কি যেন বলছিলো ! আমাকে আসতে দেখে বলল, কিছু বলবা? অফিস যাবা কখন?
আমি বললাম, আজকে অফিস যাবো না ।
-কেন ?
-তোমাকে একটা জিনিস দেখাবো ! এসো !
ওকে শোবার ঘরে নিয়ে এলাম। তারপর ওর চ্যানেলটা চালু করে দেখালাম ।
আমাকে কিছু বলতে যাচ্ছিলো তবে থেমে গেল । নিচের ওর ভক্তদের করা কমেন্ট গুলো দেখতে শুরু করেছে । সেগুলোই পড়তে শুরু করলো । একটা সময়ে আমার দিকে তাকালো । তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো । অনুভব করলাম যে ও যেন একটু কাঁপছে । কাঁদছে হয়তো । আমি ওকে আদর করতে করতে বললাম, দেখেছো তোমাকে এখনও কত মানুষ ভালোবাসে । কত মানুষ তোমাকে মনে রেখেছে । তোমার জন্য অপেক্ষা করছে । আর কেবল একজন মানুষের জন্য তুমি ওদের বঞ্চিত করছো !
আমার থেকে মুখ না তুলেই মুনজেরিন বলল, আমার কী করা উচিৎ ?
-যা করতে আগে! তাই কর ! হাসপাতালে যাও, ভিভিও আপলোড দাও, বাইক চালাও ।
-আমি কি পারবো?
-অবশ্যই পারবে ! আমি আছি না তোমার সাথে !
আমি অনুভব করলাম মুনজেরিন যেন আমাকে আরও একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে ।
পরিশিষ্টঃ
পরের সপ্তাহেই মুনজেরিন নতুন একটা শিক্ষা মূলক ভিডিও আপলোড দিলো । আমি সব সময়ই ওর সাথে সাথে ছিলাম । ভিডিও শেষে সে আমাকে টেনে নিয়ে গেল স্ক্রিনে। সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল ।
মাস খানেকের ভেতরেই আবার হাসপাতালে যাওয়া শুরু করলো । এবং আরও কিছু সময় পরে আবার নতুন করে বাইক চালাতে শুরু করলো । যদিও রাস্তায় বের হল না এখনই । বাসার পাশের মাঠে চালাতো আবার সেই আত্মবিশ্বাসটা ফিরে আসতে আরও একটু সময় হয়তো লাগবে তবে সেটা নিশ্চিত ফিরে আসবে । এবং প্রতি রাতেই সে আমাকে নতুন ভাবে আদর করতে শুরু করলো । আমার কাছে সে কৃতজ্ঞ । আমার কারণেই নাকি সে হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে ।
রাতে হঠাৎ হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় ! আমি বিছানা থেকে উঠে বাবান্দায় চলে আসি । তাকিয়ে থাকি আকাশের দিকে । একটা তীব্র অপরাধবোধ আমাকে এখনও কুড়ে কুড়ে খাও । সেদিন মুনজেরিনের বাইকটা এমনি এমনি এক্সিডেন্ট করে নি । এর পেছনে আমার হাত ছিল । সেদিন মুনজেরিনের হাসপাতালের গেট দিয়ে ঢুকতে গিয়েই আমি সায়নকে দেখতে পাই । বাইক নিয়ে ভেতরে ঢুকছে । বাইকের নম্বরটা চট করেই চোখের সামনে চলে আসে । আমার তখন কি যে হয়ে যায় আমি নিজেও বলতে পারবো না । দুদিন আগে এই সায়নকে নিয়ে কী এক আত্মবিশ্বাস দেখিয়েছে মুনজেরিন । আমার সেটা মোটেও সহ্য হয় নি । আমি হাসপাতালের ভেতরে না গিয়ে বাইরে বের হয়ে এলাম । কিছু সময়ে এদিক ওদিক খুজতে লাগলাম । পেয়েও গেলাম বাইকের রিপেয়ারিংয়ের দোকানটা ! প্রথমে ওরা যন্ত্র দুইটা দিতে না চাইলেও আধা ঘন্টার জন্য যখন ৫০০ টাকার একটা নোট বের করে দিলাম তখন আর মানা করলো না । ব্যাগটা ঐ দোকানে রেখে একটা কাগজে মুড়ে নিলাম যন্ত্র দুটো তারপর পার্কিংয়ে গিয়ে হাজির হলাম । বাইকটা খুজে বের করতেও খুব একটা সমস্যা হল না । বাইকের ব্রেকের তার ক্ষতিগ্রস্ত করে দিলাম । একেবারে কেটে দিলাম না । তবে কয়েকবার চাপ দিলে ছিড়ে যাবে । আমি বের হয়ে এলাম । কিন্তু তখনও যদি জানতাম যে ঐ বাইকটা আসলে মুনজেরিনেরই। সায়ন মুনজেরিনকে ফিরিয়ে দিতে এসেছিলো, এটা আসলে মুনজেরিনই চালাবে তাহলে কি ঐ কাজটা করতে পারতাম?
মুনজেরিন আস্তে আস্তে আবার আগের মত হয়ে যাচ্ছে । কিন্তু আমার ভেতরের এই অপরাধবোধ কোনদিন যাবে না বুঝি । কোনদিন আমি মুনজেরিনকে এই কথা বলতেও পারবো না । ওকে হারাতে হয় এমন কথা আমার পক্ষে বলা সম্ভব না ।
-রাকিব?
তাকিয়ে দেখি মুনজেরিন আমার পাশে এসে দাড়িয়েছে ।
-এখানে কি?
-ঘুম ভেঙ্গে গেল হঠাৎ !
আমি হঠাৎ ওকে জড়িয়ে ধরলাম । অনুভব করলাম বুকের মাঝে কেমন যেন একটা অনুভুতি হচ্ছে । ভেঙ্গে চুড়ে কান্না আসছে । আমি কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, আই সরি মুন !
-সরি কেন ?
-যদি সামনে কোন দিন আমি কোন অন্যায় করি তাই আগে থেকেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি ! তোমাকে কোন ভাবেই আমি হারাতে চাই না । কথা দাও কোনদি আমাকে ছেড়ে যাবে না !
মুনজেরিন হাসলো । তারপর আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, সবাইকে ছেড়ে দিতে পারি তোমাকে ছারবো না ! বুঝলে ! এখন শান্ত হও তো !
গল্পটি আগে নিজেস্ব সাইটে প্রকাশিত
pic source
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২১ দুপুর ২:১৮