লম্বা ছুটি নিয়েছিলাম অফিস থেকে । কদিন আগে করোনার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। বাধ্য হয়ে ছুটি নিতে হয়েছিলো আমাকে । মোটামুটি সুস্থ হয়ে এবং রিপোর্টে নেগেটিভ আসার পরে আবারও অফিস শুরু করতে হল । কাজ ছাড়া তো আর জীবন পার করা যাবে না । রাজা কিংবা জমিদারের ছেলে হলে ভিন্ন ব্যাপার ছিল ।
অফিস শুরু করতেই বুঝতে পারলাম যে অফিসে নতুন মানুষ এসেছে । আমি যতদিন ছিলাম না, এই ফাঁকে হয়তো রফিক ভাই নতুন কোন কর্মী নিয়োগ দিয়েছে । এবং নতুন নিয়োগ প্রাপ্ত কর্মীটি একজন মেয়ে। আযাদ এসে জানিয়ে গেল মেয়েটি নাকি দারুন সুন্দরী দেখতে । কাজ কর্মে খুব পারদর্শী । মুখের হাসিও নাকি খুবই চমৎকার । সবাই নাকি পাগল হয়ে গেছে এরই মধ্যে । মেয়েটির ব্যবহারও খুব সুন্দর । ইতিমধ্যে সিরাজ ভাই ঠিক করে ফেলেছে এই মেয়েকেই সে বিয়ে করবে ।
অবশ্য আমি এটা নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত হলাম না । আযাদের চোখের দুনিয়ার সব সিঙ্গেল মেয়েই মহা সুন্দরী । আর সিরাজ ভাইয়ের বিয়ে করার বয়স পার হয়ে গেছে । এখন যে মেয়েই দেখে সেই মেয়েকেই সে বিয়ে করতে আগ্রহী হয় । সুতরাং এদের কথা নিয়ে চিন্তা করার কোন কারণ নেই । তবে আমার চিন্তিত হওয়ার দরকার ছিল । কারণটা বুঝতে পারলাম যখন রফিক ভাইয়ের কেবিনে আবার ডাক পড়লো । আমি কেবিনের ঢুকতেই দেখতে পেলাম একটা মেয়ে রফিক ভাইয়ের সামনে বসে আছে । রফিক ভাইয়ের সাথে কথা বলছে । আমি ঘরে ঢুকতেই মেয়েটি আমার দিকে ঘুরে তাকালো । সাথে সাথেই আমার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো ।
এই মেয়ে এখানে কি করে?
এটাই সেই মেয়ে যাকে নিয়ে অফিসের সবাই কথা বলছে ?
সর্বনাশ!
মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো । কোন সন্দেহ নেই মোহনীয় হাসি কিন্তু আমি মোটেই খুশি হতে পারলাম না । খুশি হওয়ার কথাও না । আমার মনে হল এখনই দরজা দিয়ে পালিয়ে যাই । এই মেয়ে আমার পিছু পিছু এতোদুর চলে এসেছে । ভাবা যায় !
-আরে এসো এসো অপু ! বসো এখানে...
আমি রফিক ভাইয়ের দিকে তাকালাম । হাস্যজ্জ্বল মুখে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । সামনে বসা মেয়েটার ব্যাপার তার কোন ধারনাই নেই । যদি থাকতো তাহলে হয়তো এভাবে এমন করে হাসি মুখে বসে থাকতে পারতো না । হয়তো এখনই ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যেত। যাওয়ারই কথা ।
আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে এলাম। তারপর খুব সাবধানে বসলাম সামনের চেয়ারে । মেয়েটি আমার পাশেই বসে আছে । আমি যদিও মেয়েটার দিকে একবারও তাকাই নি তবে আমার বুঝতে কষ্ট হল না যে সে আমার দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে ।
রফিক ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কী ব্যাপার অপু এমন গোমড়া মুখ করে আছো কেন শুনি? আসফিমার দিকে তাকাও একটু । বেচারি তোমার কথা শুনে শুনে একেবারে তোমার ভক্ত হয়ে গেছে ।
আমি কোন মতে মেয়েটির দিকে তাকালাম ।
সেই চোখ নেই নাক আর পাতলা লাল ঠোঁট । মেয়েটির দিকে একবার তাকালে আর চোখ ফেরানোর উপায় নেই । এই কথা অস্বীকার করতে পারবো না কিন্তু মেয়েটির আসল পরিচয় আমি জানি । এই জন্য এই সুন্দর চেহারা আমাকে ঠিক আকর্ষণ করতে পারছে না ।
আমি কিছু বলার আগেই মেয়েটি নিজের হাত বাড়িয়ে দিল । তারপর বলল, হ্যালো মিস্টার অপু হাসান । নাইস টু মিস ইউ । অফিসে জয়েন করার পর থেকে আপনার কথা এতোবার শুনেছি যে আপনার ফ্যান হয়ে গেছি । রফিক ভাইকে তো বলেছি আপনার সাথেই কাজ করতে চাই আমি । আপনার মত একজন বস পেলে কাজ করে খুবই আরাম পাবো আমি । অনেক কিছু শিখতেও পারবো আশা করি ।
আমি কিছু বলতেই যাচ্ছিলাম কিন্তু তার আগেই রফিক ভাই বলল, হ্যা হ্যা তাই তো । শুনি আজ থেকে আসফিমা তোমার সাথেই কাজ করবে । ওকে সব কিছু শেখাবে তুমি । যদিও এরই ভেতরে আসফিমা অনেক ভাল কাজ দেখিয়েছে তবে তোমার গাইডেন্স পেলে ও আরও ভাল করবে ।
আমার আর কিছু বলার থাকলো না । রফিক ভাইয়ের উপরে আমার কথা বলা চলে না । সে একবার যা বলবে তা শুনতে হবেই । আর তাকে কোন ভাবে দোষও তো দিতে পারি না । মেয়েটি কাউকে কিছু বলবে আর সেটা সে করতে বাধ্য হবে । যে কাউকেই মেয়েটি নিজের হাতের ইরাশায় নাচাতে পারে । ওরা সবই পারে ।
আমি কেবিনে ঢুকে চুপচাপ কিছু সময় বসে রইলাম নিজের চেয়ারে । কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না । মেয়েটি এখানে নিজের নাম আফসিমা বলেছে ।ওর আসল নাম আরিয়া । সর্দার আকিজবের ছোট মেয়ে । সে আমার স্ত্রী।
দুই
কলেজে পড়ার সময় থেকেই আমার মধ্যে ঘুরে বেড়ানোর শখ ছিল প্রবল । যখনই আমি কোথায় সুযোগ পেয়েছি তখনই আমি বেরিয়ে পড়েছি । কখন দলবল নিয়ে আবার কখনও বা একা । যে কোন স্থানেই যেতে আমার কোন সমস্যা ছিল না । আমি কোর প্রকার বাছাবিছা ছাড়াই যেকোন স্থানে চলে যেতাম । মাঝে মধ্যে যে বিপদে পড়তাম না এমনটা না । তবে তাতে আমার ভ্রমনের উৎসাহে কোন ভাটা পড়তো না । সুযোগ পেলেই নানান স্থানে গিয়ে হাজির হলাম ।
ঠিক তেমনি ভাবে এই বছরের শুরুতে আমি গিয়ে হাজির হয়েছিলাম পটুয়াখালিতে । সবাই যদি পটুয়াখালিতে আসে কেবল কুয়াকাটাতে যাওয়ার জন্য তবে আমার এবার কুয়াকাটাতে সীবিচে যাওয়ার কোন ইচ্ছে ছিল না । আমার মূল লক্ষ্য ছিল লেবু বাগানের ভেতরে যাওয়ার । কুয়াকাটায় একেবারে লেবুবনের মাঝে একটা হোটেল আছে । এতো চমৎকার এক স্থান । বনের অনেকটা ভেতরে এই হোটেলটা অবস্থিত । আমি সেখানে গিয়েই উঠলাম । ইচ্ছে দুটো দিন একেবারে নির্জনতার ভেতরে কাটাবো । বিশেষ করে ভরা পূর্নিমাতে লেবুবন নাকি চমৎকার লাগে । সেটা দেখার জন্যই এখানে আসা !
কিন্তু সেটা আর কাটানো হল না । প্রথম দিন রাতের খাওয়া শেষ করে হোটেল থেকে বের হতে যাবো তখনই বেয়ারা এসে বলল, স্যার রাতে বের হওয়া নিষেধ ।
আমি খানিকটা অবাক হয়ে বললাম, নিষেধ মানে কি?
-স্যার আজকে পূর্নিমা তো !
-তাতে কি?
-আসলে স্যার পূর্নিমাতে লেবু বনের ভেতরে ঢোকা কিংবা আশে পাশে যাওয়া নিষেধ !
-বিচে তো সারারাত ঘোরাফেরা করা যায় । আর এখানে রাত দশটা বাজতেই বলছো নিষেধ !
-স্যার একটু বোঝার চেষ্টা করুন ।
-আমাকে বোঝাও। আমি নিশ্চয়ই কেবল তোমাদের হোটেলে রাত কাটাতে আসি নি । তাই না?
বেয়ারা একটু সময় চুপ করে থেকে বলল, এটা স্যার আপনার ভালর জন্যই।
-আমার ভাল আমাকে বুঝতে দাও ।
-আসলে স্যার গত মাসে এখানে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে ।
আমার মন খানিকটা কৌতুহলী হয়ে উঠলো । বললাম, কী রকম দুর্ঘটনা?
-আসলে .....
আমার মনে হল বেচারা বলতে ঠিক সাহস পাচ্ছে না । এদিক ওদিক তাকাচ্ছে । আমি বললাম, বলে ফেলো । তোমার ম্যানেজার জানবে না ।
বেয়ারা এবার বলল, আমাদের এখানে পাংজু নামের এক উপজাতি ছেলে কাজ করতো । মূলত গেস্টদের বনের ভেতরে নিয়ে যাওয়া ঘুরিয়ে নিয়ে আসাই তার কাজ ছিল । রাতের বেলা সে প্রায়ই বনের ভেতরেই ঘুরে বেড়াতে । তারপর হঠাৎ একদিন সে গায়েব হয়ে গেল । আমরা অনেক খুজলাম, ওদের বাসায় খবর দিলাম কিন্তু কেউ কোন খবর বলতে পারলো না । প্রায় দিন পনেরো পরে পাংজুর লাশ পাওয়া গেল বনের একেবারে শেষ মাথায় । ঐদিকটা কেবল সাগর। আর কিছু নেই । লাশ দেখে মনে হল সে মাত্র একদিন আগে মারা গেছে । অথচ সে পনেরদিন থেকে গায়েব ছিল । এরপর গতমাসে এক পর্যটক একই ভাবে হারিয়ে যায় । তবে আশার কথা হচ্ছে তাকে আমরা একদিনের ভেতরেই উদ্ধার করি । কিন্তু .....
-কিন্তু কি?
-কিন্তু স্যার সেই পর্যটকের অবস্থা ভাল ছিল না ।
-ভালো ছিল না বলতে?
-ভালো ছিল না বলতে সে কেমন বিলাপ বকছিলো । বারবার বলছিলো কতগুলো লম্বা মানুষ তাকে নিয়ে গিয়েছিলো তাকে ধরতে আসছে । আর খুব ভয় পাচ্ছিলো । তার বন্ধুদের সাথে আমরা তাকে দ্রুত বাসায় ফেরত পাঠিয়ে দেই । তাদেরকে অনুরোধও করি যাতে এসব কথা বাইরে প্রকাশ না করে । বুঝতেই পারছেন তাহলে স্যার পর্যটক আসা কমে যাবে । এই জন্য স্যার আপনাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে রাতে বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে কড়াকড়ি করেছে হোটেল কর্তৃপক্ষ । সারা দিন ঘুরে বেড়ান, কোন সমস্যা নেই কিন্তু রাতের বেলাটা ঘুরে বেড়ানোটা একটু রিস্কি !
আমি বললাম, এই রিস্ক কেবল পূর্নিমাতে ?
-জি স্যার । অন্যান্য দিন কোন সমস্যা নেই তবে এই দুই তিন দিন একদমই না । প্লিজ স্যার একটু বোঝার চেষ্টা করেন ।
বেয়ারাকে বললাম যে আমি বাইরে যাচ্ছি না । এই হোটেল প্রাঙ্গনেই থাকবো । বেয়ারা আামর কথা শুনে আবার ঘরের ভেতরে চলে গেল । তবে আমার মনের ভেতরে কৌতুহল তো কমলোই না বরং আরও বেড়ে গেল । কী এমন থাকতে পারে জঙ্গলে যা দেখে ঐ পর্যটক এমন ভয় পেতে পারে আর ঐ উপজাতি ছোকরাকে কে মেরে ফেলল । আর কেনই বা মেরে ফেলল । লেবু বনের কুমির হয়তো থাকতে পারে । পানিতে ভেসে আসতে পারে । লেবু বনের ভেতরে সরু খাল আছে । খুব বেশি হলে কুমির কিংবা সাপ থাকতে থাকবে । এছাড়া লেবু বলে কোন হিংস্র জন্তু তো থাকার কথা না মোটেও । তাহলে কে মারতে পারে ! কিন্তু কথা হচ্ছে যদি কুমিরই হবে কিংবা অন্য কোন প্রাণী হবে তবে সেটা কেবল পূর্নিমাতেই কেন বের হবে !
আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলাম যে যেকোন ভাবেই হোক আমাকে বনের ভেতরে যেতে হবে এবং আজ রাতেই যেতে হবে । এই কৌতুহল আমাকে মেটাতেই হবে । রাত বৃদ্ধির জন্য আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম ।
রাত একটার দিকে মনে হল পুরো এলাকাটা একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেছে । হোটেলের সব রুমের দরজা আলো নিভে গেছে । আমি ঘরের আলো না জ্বেলেই বাইরে বের হয়ে এলাম । ঘুরতে যাওয়ার সময়ে আমি সব সময় সাথে করে একটা ছোট টর্চ সাথে নিই । সেই সাথে আমার মোবাইলের আলো তো আছে । খুব সাবধানে বের হয়ে এলাম । ভয় ছিল যে হোটেলের কারো সাথে হয়তো দেখা হয়ে যাবে । তবে সেটা হল না । দেখলাম সবাই বলতে গেলে ঘুমিয়ে আছে ।
প্রধান গেটের দিকে গেলাম না । সেখানে দুজন গার্ড থাকার কথা । ডান দিকে ছোট একটা গেট আছে যা সরাসরি লেবুবনের দিকেই গেছে । সেদিকেই হাটা ছিলাম । সেখানে যদি কোন পাহাদার থাকে তাহলে সমস্যায় পড়বো । আস্তে আস্তে হাটতে হাটতে এগিয়ে গেলাম ছোট গেটটার কাছে । কাছে গিয়ে কোন গার্ডকে দেখতে পেলাম না । তবে গেটে একটা তালা ঝুলতে । কিছু সময় ভাবলাম কী করা উচিৎ । যদি এখান থেকে ফিরে যাই তবে কোন সমস্যা হবে না হয়তো তবে নিজের মনের কৌতুহল সারা জীবন আমাকে পেয়ে বসবে । কোন ভাবেই সেটাকে নিবারণ করতে পারবো না । গেট টার দিকে ভাল করে তাকালাম । লম্বায় আমার সমান । তবে একটু কষ্ট করলে আমি এটার উপর দিয়ে পার হতে পারবো সহজেই । আরেকবার ভাবলাম । যদি গেট টপকাতে কেউ দেখে ফেলে তাহলে নিশ্চিত ভাবে আমাকে চোর মনে করতে পারে ।
মনে করলে করুক । আমাকে এখন গেট টপকাতে হবে । মোবাইল আট টর্চটা পকেটে ঢুকিয়ে আমি গেটের উপর চড়ে বসলাম । খুব বেশি কষ্ট হল না অবশ্য । গেটের ওপাশ গিয়ে আরেকবার ফিরে তাকালাম হোটেলটার দিকে । কেমন শান্ত হয়ে আছে । কেন যেন আমার মনে হল হোটেলটা আমাকে বলছে যে ফিরে যেতে । দরজার নেই এতো কৌতুহল নিবারন করার । সত্যিই যদি কিছু হয়ে যায় তখন কি হবে ? তবে শেষ পর্যন্ত কৌতুহলেরই জয় হল । আমি বনের দিকে হাটা দিলাম ।
লেবু বনটা স্বাভবিক লেবুর গাছ দিয়ে ভরা । তবে মাঝে মধ্যে অন্য গাছও রয়েছে । এটাকে বন না বলে বাগান বললে হয়তো ভাল হত । তবে এরিয়াতে বাগানটা অনেক বড় । তাই বল বলাই ভাল । আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে শুরু করলাম বনের ভেতরে । আকাশ মোটেই অন্ধকার না । চাঁদের আলোতে সব কিছু আলোকিত হয়ে আছে । সেই সাথে আমার হাতে টর্চ রয়েছে । আমি বনের এদিক থেকে ওদিকে হাটতে শুরু করলাম নিশ্চিন্তে । আমার কেন জানি ভয় করছে না । কেবল মনে হচ্ছে যে হাটতে গিয়ে না আবার কোন সাপের গায়ে পাড়া দিয়ে ফেলি । একটু সাবধানে চলতে হচ্ছে ।
হঠাতই সামনে একটা ছোট খাল পড়লো । খালের পাড়ে কিছু সময় চুপচাপ দাড়িয়ে রইলাম কেবল । একবার মনে হল খাল পার হওয়ার কোন দরকার নেই । এখান থেকেই ফিরে যাই । কিন্তু তারপর মনে হল এসেছি যখন দেখেই যাবো সব টা । আর এই খাল গুলোতে খুব বেশি পানি থাকে না । পায়ের স্যান্ডেল খুলে প্যান্ট গুটিয়ে নিলাম । তারপর আস্তে আস্তে পানিতে নেমে পড়লাম । যদি পানি প্যান্টের উপরে উঠে যায় তাহলে আর যাবো ঠিক করলাম । কয়েক পা যেতেই প্যান্টে পানি স্পর্শ করে ফেলল । আবারও উঠে পড়লাম । পানি যদিও কম ভেবেছিলাম কিন্তু দেখা যাচ্ছে পানি বেশ ভালই আছে । যাওয়া যাবে না । ফিরে যেতে হবে । কিন্তু ঘরে যেতে মন বলল না কিছুতেই ।
আমার মনে আছে যখন আমি ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি তখন বন্ধুদের সাথে একবার এসেছিলাম এখানে । এবং এই এমন একটা খাল পাড় হয়েছিলাম । খালের পাড়ে প্রায়ই কোন গাছ পড়ে যায় পানিতে । কোন কোন গাছ একেবারে চলে যায় ওপাড়ে । তেমনই একটা গাছ আমাকে খুজে বের করতে হবে কেবল । তাহলেই আমি ওপাড়ে যেতে পারবো । আমি খালের পাড় ধরেই এগিয়ে যেতে থাকলাম । ওপাশটা আমার কাছে একটু যেন বেশিই ঘন মনে হল ।
বেশি দুর আমাকে যেতে হল না । তার আগেই আমি পেয়েগেলাম এমন একটা গাছ । তবে গাছটা একেবারে পুরো খাল টুকু কাভার করে নি । চার ভাগের তিনভাগ পর্যন্ত গিয়েছে । বাকি পথ টুকু আমাকে ঠিকই নামতে হবে পানিতে । হোক সমস্যা নেই । আমি গাছে উঠে পড়লাম । তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে লাগলাম । গাছটা বেশ মোটাই বলা চলে । এতো মোটা গাছটা কিভাবে ভাঙ্গলো কে জানে ! এখন তো ঝড়ের সময় নয় আর খুব জলদি তো ঝড় হয়েছে বলে জানিও না । অথচ গাছটার দিকে তাকিয়ে মনে হল যেন খুব সম্প্রতি গাছটা এভাবে পড়েছে এখানে ।
গাছের শেষ মাথায় এসে খানিক সময় তাকিয়ে রইলাম । কি করবো বুঝতে পারছিলাম না । লাফ দিলে কি পার হতে পারবো?
মনে মনে এমন কথাই যখন ভাবছি তখনই আমার মনের ভেতরে যেন একটা শব্দ শুনতে পেলাম । কেউ যেন বলছে, পারবে না । লাফ দিও না ।
এবং এর পর কাছেই একটা পাখি ডেকে উঠলো তীক্ষ্ণ স্বরে । আমি চমকে উঠলাম । মনের ভেতরে একটা সুক্ষ ভয় খেলে গেল । বারবার মনে হল কে কথা বলল?
নাকি আমার মনের ভুল ?
হয়তো আমার অবচেতন মনই বলে উঠেছে যে আমি লাফ দিলে পার হতে পারবো না । অন্য কিছু নয় । আমি আর কিছু ভাবলাম না । মনের ভেতরের ভয়টা দুর করার চেষ্টা করলাম । এতো দুরে এসে ফিরে যাওয়ার কোন মানে হয় না । আমি পকেটের মোবাইলটা আরেকবার হাত দিয়ে দেখলাম ঠিক জায়গা মত আছে কি না ।
তারপর হাত দিয়ে টর্চটা শক্ত করে ধরে লাফ দিলাম ওপাড় বরাবর ।
ভেবেছিলাম হয়তো পৌছে যাবো তবে পৌছাতে পারলাম না । পানির ভেতরে গিয়েই পড়লাম ।
সাথে সাথেই একটা যেন হাসির আওয়াজ শুনতে পেলাম । কৌতুক পূর্ন হাসি । আমি সাথে সাথেই এদিক ওদিক তাকালাম তবে কাউকে দেখতে পেলাম না । অন্ধকার রাতের রাতের আলোতে কেবল গাছ গুলোকে দেখা যাচ্ছে নিশ্চল ভাবে দাড়িয়ে আছে । আমি পানি থেকে উঠে পাড়ের দিকে হাটা দিলাম । লাফ ফিয়ে পড়াতে আমার প্যান্টের উড়ু পর্যন্ত ভিজে গেছে । তবে পকেট পর্যন্ত আসে নি পানি । তাই মানি ব্যাগ আর মোবাইল ভিজে নি । আমি পাড়ে উঠে এলাম । তারপর চারদিকটা ভাল করে খেয়াল করলাম ।
আমার কাছে মনে হল হঠাৎ করেই যেন চারিদিকের পরিবেশটা কেমন বদলে গেছে । ওপাশে যতসময় ছিলাম তত সময়ে সব কিছুই আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়েছে । সাধারন একটা রাত যেমন হয় সব কিছু তেমনই ছিল কিন্তু এই পাড়ে আসার পর থেকেই আমার মনে হচ্ছে যেন আশে পাশটা কেমন যেন একটু ভারি হয়ে গেছে । বাতাসে একটা গুমট ভাব কাজ করছে । আমার মনের ভেতরে আবারও একটা অনুভূতি হতে লাগলো । অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি । বারবার মনে হতে লাগলো যে এখনই আমার ফিরে যাওয়া উচিৎ । এই বনের ভেতরে প্রবেশ করাটা মোটেই ঠিক হবে না । তবে সেই সাথে একটা অদম্য কৌতুহলও আমাকে পেয়ে বসলো । কিছুতেই নিজেকে আমি স্থির করে রাখতে পারলাম না । আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে শুরু করলাম বনের ভেতরে ।
যতই আমি এগিয়ে যেতে শুরু করলাম ততই মনে হতে লাগলো যে নিজের ভেতরে কিছু একটা ঠিক নেই । কেউ যেন দুর থেকে আমার উপর সজাক দৃষ্টি রাখছে । সেই সাথে সে যেন আমাকে খানিকটা নিয়ন্ত্রন করে নিয়ে যাচ্ছে । আমার মনের ভেতরে বারবার বলছে এখনই আমার ফিরে যাওয়া উচিৎ কিন্তু সেই মনের ভেতরে অন্য কেউ যেন আমাকে বলছে সামনে এগিয়ে যেতে । আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে চললাম । পায়ে নিচে কী পড়ছে সেদিকে আমি আর খেয়াল দিলাম না । এগিয়ে চলেছি তো চলেছি এমন কি কোন দিকও ঠিক নেই আমার । অন্ধকারের ভেতরে কেবল এগিয়ে চলেছি ।
আমার প্রথমে মনে হয়েছিলো যে আমি হয়তো এলোমেলো ভাবে কোন দিন বিবেচনা না করেই এগিয়ে চলেছি । কিন্তু একটা সময় লক্ষ্য করলাম যে আমি একটা আলো লক্ষ্য করে এগিয়ে চলেছি । বনের ভেতর থেকে সেই আলোটা আমি দেখছি পাচ্ছি । বিন্দু ফোটার মত আলোটা আসছে বনের গাছের ডাল পালা ভেত করে । আমি সেদিকেই এগিয়ে চলেছি । আস্তে আস্তে সেটা এগিয়ে আসছে আমার দিকে । একটা সময় সেটা দৃষ্টি গোচর হল আমার । আমার প্রথমে মনে হয়েছিলো বুঝি বনের ভেতরে কেউ আগুন জ্বালিয়েছে । কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম যে সেটা মোটেই আগুন কিছু নেই । কোন কিছু থেকে আলো বের হচ্ছে । স্থির আলো । এবং সেই আলোকে কেন্দ্র করে কয়েকজন মানুষ ঘুরছে !
সত্যিই কি মানুষ তারা?
আমি অন্ধকারের ভেতরে দেখতে পাচ্ছি না তাদের । কেবল তাদের শরীরের আলখেল্লা পোশাক দেখতে পাচ্ছি । মাথাও বড় হুডি পরা । মুখটা দেখা যাচ্ছে না । তবে মানুষ গুলো স্বাভাবিকের চেয়ে যেন একটু বেশি বড়, লম্বা । অন্তত সাত আর ফিট ।এতো লম্বা লম্বা মানুষ ! আমি চুপ করে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম । ওরা কী করছে সেটা বুঝতে চেষ্টা করলাম । কী হচ্ছে এখানে? মনে হল যেন ওরা বিশেষ কোন রিচু্য়্যাল করছে এখানে !
ওরা কারা?
এখানে কি করছে?
তখনই আমার হুস ফিরে এল যেন । আমার সেই উপজাতি ছেলেটার কথা মনে পড়লো, মনে পড়লো সেই পর্যটকের কথা !
উপজাতি ছেলেটাকে মেরে ফেলে কেউ আর পর্যটক কিছু দেখে খুব বেশি ভয় পেয়েছিলো । বারবার বলছিলো আলখেল্লা পরা লম্বা ! কাউকে বলে দিতে হল না তবে আমি পরিস্কার বুঝতে পারলাম যে ঐ দুটি ঘটনার সাথে এরা জড়িতো । এবং ওদের সাথে যদি এমন কিছু ঘরতে পারে তাহলে আমার সাথেও ঘটতে পারে !
আমাকে এখনই এখান থেকে চলে যেতে হবে । একটাতীব্র ভয় আমাকে পেয়ে বসলো । আমি পেছনে দিকে যাওয়ার জন্য এক পা বাড়িয়েছি তখনই মনে হল পায়ের নিচে একটা শুকনো ডাল মরলো তারপর সেটা মট করে ভেঙ্গে গেল । খুবই স্বপ্ন আওয়াজ কিন্তু ঘুর্ণনরত সব আলখেল্লা পরা মানুষ কিংবা মানুষের মত জীব গুলো দাড়িয়ে গেল । তারপর এক সাথে তাকালো আমার দিকে ।
আমি কেবল বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলাম তাদের দিকে । কারণ তাদের চেহারাতে কোন চেহারা নেই । একেবারে কালো অন্ধকার হয়ে আছে । কেবল লাল চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে আমার দিকে তাকিয়ে । আমার বুকের ভেতরে যে কি হল আমি বুঝতে পারলাম না । এমন কি আমি দৌড়াতে পর্যন্ত পারলাম না । মনে হল যেন আমার পা দুটো অবস হয়ে গেছে । আমার নিজের আর কোন ক্ষমতা নেই । আমি চলতে পারবো না ! আমি সেখানে পড়ে গেলাম । ঠান্ডা বালিমাটি আমাকে স্পর্শ করলো । তবে ঐ কালো আলখেল্লা পরা প্রাণী গুলোকে আমি ঠিকই দেখতে পাচ্ছিলাম । ওরা এগিয়ে আসছে আমার দিকে । আমার নড়ার কোন ক্ষমতা নেই । একেবারে যখন কাছে চলে এসেছে তখনই দেখলাম আরও একটা কালো আলখেল্লা পরা অয়বয় তাদের পথ রোধ করে দাড়ালো । অর্থ্যাৎ সে আমার পেছন থেকে এসে আমার আর তাদের মাঝে দাড়িয়েছে ।
আমি শুয়ে শুয়েই দেখতে পেলাম যে আমার দিকে পেছন করে দাড়ানো আলখেল্লাটা সামনের দাড়ানো দলের সাথে যেন কথা বলছে কি বলছে আমার সেটা জানা নেই, কারণ ওদের কথার কোন আওয়াজ আমি শুনতে পাচ্ছি না । কোন আওয়াজও হচ্ছে না । আমি কেবল হাত নাড়ানোটা দেখতে পাচ্ছি । এটা দেখেই বুঝতে পারছি যে ওরা হয়তো নিজেদের ভেতরে কথা বলছে !
আচ্ছা এরা কারা?
এই খানে এই আলোটাকে ঘিরে ওরা কী করছে?
আমার মনে হল যে ঐ উপজাতি ছেলেটাও সম্ভবত এমন একটা সময়ে চলে এসেছিলো । এবং তাই তাকে মেরে ফেলেছে । এমন কি ঐ পর্যটকও সম্ভবত এমন সময়েই চলে এসেছিলো । ওকেও মেরে ফেলতো তবে লোকজন চলে আসায় আর মারে নি । তাহলে আমাকেও কি মেয়ে ফেলবে?
আমাকে রক্ষা করতে তো কেউ আসবে না ! কেউ জানেই না আমি এখানে আছি ।
এখনই মরে যাবো? হায়হায় আমার তো এখনও বিয়েও হয় নি !
কথাটা মনে হতেই খানিকটা অবাকই হলাম । এখানে আমার জীবন মরণ নিয়ে সমস্যা আর আমি আফসোস করছি আমার এখনও বিয়ে হল না এই নিয়ে ! হায়রে মানুষের মন !
একটা সময় মনে হল যে তাদের আলোচনা শেষ হল । বুঝতে পারলাম যে এবার আমার মরণের পালা । এরা এখনই আমাকে মেরে ফেলবে । দেখলাম লম্বামত একজন আমার সামনে এসে দাড়ালো । আমি কেবল ভীত চোখে হুডির ভেতরের সেই অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছি । লাল চোখ জ্বল জ্বল করছে আমার দিকে । লাল চোখ বলল, তোমাকে আমার মেয়ে পছন্দ করেছে ।
আমি এদের কাছে অন্তত বাংলা আশা করি নি । তাও আবার শুদ্ধ বাংলা ! তবে সে মুখ দিয়ে কথা বলল না । তার তো মুখই নেই সেটা দিয়ে কথা বলবে কিভাবে । মনে হল যেন কেউ আমার মাথার ভেতরে সেই কথা গুলো ঢুকিয়ে দিল ।
সে আবার বলল, নয়তো আজকে তোমার জীবিত থাকার কথা না । আজই তোমাদের বিয়ে হবে !
একটু আগে আমি বিয়ে নিয়ে আফসোস করছিলাম আর এখন আমার বিয়ে ! তাও আবার এদের সথে !
লোকটা বলল, আমার নাম আকিজব । আমি এই গোত্রের সর্দার । আজ থেকে তুমিও আমাদের সাথে থাকবে ! আমাদের মনিরত্ন তুমি দেখে ফেলার পরেও তুমি স্থির আছো দেখে মনে হচ্ছে তোমার ভেতরে সহনশক্তি খুব বেশি । নয়তো তুমি পাগল হয়ে যেতে । যাই হোক আমার ছোট মেয়ে আরিয়ার সাথে তোমার বিয়ে হবে আজই ।
আমার মতামতের কেউ কোন তোয়াক্কা করলো না । আমি বিয়েতে রাজি কি না সেটা কেউ শুনতেও চাইলো না । একটু পরেই অনুভব করলাম যে আমি যেন মাটি থেকে একটু উপরে উঠে গেছি । তারপর উড়তে উড়তে চলেছি । এরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ?
ওরা আমাকে নিয়ে বনের বাইরে নিয়ে এল । দেখতে পেলাম যে সমুদ্রের উপরে একটা চমৎকার জাহাজ দাড়িয়ে রয়েছে । বাইরে থেকে দেখেই মনে হচ্ছিলো যেন বিলাশ বহুল একটা শীপ । সেটার ভেতরে আমাকে নিয়ে গেল । একটা বড় হল ঘরের মত স্থানে রাখা হল আমাকে । ঘরের ভেতরেও আবছায়া আলো । আমি ছাড়াও আরও বেশ কিছু কালো আলখেল্লা পরা আয়বয় রয়েছে সেখানে । সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে সেই লাল চোখ । কারো চেহারা আমি দেখতে পাচ্ছি না । চেহারা বলতে কারো নাক মুখ দেখতে পাচ্ছি না । সেখানে কেবল গাঢ় অন্ধকার । কেবল লাল চোখ দেখা যাচ্ছে । প্রায় ঘন্টা খানেক পরে আমার সাথে আরিয়া বিয়ে হয়ে গেল । যদিও আরিয়াকে সামনে আনা হল না । সম্ভব অন্য ঘরে তাকে রাখা হয়েছে ! অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম বিয়ের সময় যে দোয়া পড়া হল সেটা শুনে আরবিই মনে হল । অর্থ্যাৎ আমার ধর্ম মতেই বিয়ে হল !
কিন্তু বিয়ে হলটা কার সাথে ?
আকিজবের মেয়ে তো তার মতই হবে । মুখ নাক ছাড়া ! কী ভয়ংকর চেহারার সেই মেয়ের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে ! আমি লেখক মানুষ । নিজের বউয়ের যদি নাক চোখ নাই থাকে তাহলে সেসব নিয়ে ফেসবুকে কিভাবে স্টাটাস দিবো ?
ও মাই গড!
কৌতুহল মেটাতে গিয়ে আমি কোন বিপদে পড়লাম !
চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০২১ রাত ১২:৫৯