তৃষা খানিকটা বিরক্ত চোখে অতৃর দিকে তাকালো । তারপর তাকালো নিজের বাবার দিকে । আমি এক পাশে চুপ করে বসে আছি । এসব ব্যাপারে আমার কথা বলার কোন দরকার নেই । এই ঝামেলার ভেতরে আমি পড়তে চাই না ।
তৃষা আমার শ্বশুর মশাইয়ের দিকে বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বলল, ওকে কেন নিয়ে গিয়েছো হাটে ?
শ্বশুর মশাই কাচুমচু করে বলল, আরে যেতে চাইলো তাই নিয়ে গেলাম !
-এই যে এখন কাঁদছে ! এটার কি হবে শুনি ?
-ঠিক হয়ে যাবে!
-হবে না ! আমি ওকে খুব ভাল করে চিনি । সারা সময় ও কেবল মুখ ভার করে বসে থাকবে !
-কি করবো?
-জানি কি করবা কিচ্ছু জানি !
এরপর আমার দিকে তাকিয়ে তৃষা বলল, তুমি আবার এই ভাবে বসে আছো কেন শুনি ! সারা দিন কেবল মোবাইল আর মোবাইল ! অন্য কোন কাজ নেই?
আমি বললাম, আরে ঈদের ছুটিতে বাসায় এসেছি । এখানে কি কাজ করবো ?
-না তা করবা কেন ! তোমরা তো নবাব ! তোমরা ঈদের ছুটিতে বাসায় এসেছো আমি কি ছুটিতে আসি নি !
-তাহলে তুমিও মোবাইল টেপো আমার মত । মানা করেছে কে !
তৃষা কিছু সময় আমার দিকে অগ্নি চোখে তাকিয়ে থেকে বের হয়ে গেল দরজা দিয়ে । আমি এবার একটু অতৃর দিকে এগিয়ে গেলাম । মেয়েটা একটু একটু যেন ফোঁফাচ্ছে । আমি অতৃকে কোলের উপরে তুলে নিয়ে বললাম, কি হয়েছে ? আমাকে বল ?
-আমরা ওদের গরুটা কেন নিয়ে এলাম বাবা ! মেয়েটা কি রকম কাঁদছিলো !
-কোন মেয়েটা ?
এই প্রশ্নের জবাব দিল শ্বশুর মশাই । তিনি যা বললেন তার সারমর্ম হল অতৃকে নিয়ে শ্বশুর মশাই গিয়েছিলো স্থানীয় হাটে গরু কিনতে । যদিও এই বছরের কুরবানীর গরু আগেই কেন হয়েছে । তবে ঈদের পরে অতৃর আকিকা দেওয়া হবে । এই জন্য শশুর মশাইয়ের মনে হল গরু একটা কম কেন হয়েছে । আরেকটা কেনা দরকার । দাদু হাটে গরু কিনতে যাবে শুনে অতৃও বায়না ধরে গরুর হাটে যাবে । দাদুর হাত ধরে হাটে গিয়ে পৌছালো তারা ।
গরু পছন্দ করা হল । কেনাও হল । গরু নিয়ে যখন চলে আসবে তখন একটা ঘটনা ঘটলো । গরুটা যার তার সাথে তার নিজের নাতনিও এসেছিলো হাটে । গরুটা আর নাতনির বয়স অনেকটাই কাছাকাছি । মেয়েটা নাকি নিজ হাতে গরুটাকে লালন পালন করেছে । নিজে ঘাষ খাইয়েছে । এক সাথে খেলা করেছে । মেয়েটার খেলার সাথী সে । সেই গরুটাকে যখন নিয়ে আসছিলো মেয়েটা শেষ বারের মত গরুটাকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে দিল । লোকজন জড় হল মেয়েটার কান্না দেখে । অতৃ এই কান্না দেখে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না । বারবার কেবল বলছে মেয়েটার গরুটাকে আমরা কেন নিয়ে এলাম ! কেন তারা গরুটাকে বিক্রি করে দিল !
মেয়েটাকে কিভাবে বুঝাই যে আমরা কিনে না আনলেও অন্য কেউ ঠিকই কিনে আনতো !
অতৃ এক রকম কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়লো আমার কোলে । মেয়েটার জন্য আমার কেমন মন খারাপ হল ! টাকা পয়সার জন্য এই রকম কত কিছু আমাদের ছেড়ে দিয়ে হয় । আজকে মনে হয় সেই মেয়েটির ঘুম আসবে না আর । কালকের ঈদে কি মেয়েটা ঠিক মত আনন্দ করতে পারবে । এক সময় হয়তো মেয়েটা সব ভুলে যাবে কিন্তু মেয়েটির ছোট্ট মনে বারবার আমাদেরকে নিষ্ঠুর এক চরিত্র হিসাবেই মনে করবে যারা তার পছন্দের খেলার সাথীকে নিয়ে গেছে ।
রাত তখন আট টা বাজে । অতৃর পাশে আমিও শুয়ে রয়েছে । আমার নিজের মনটা খানিকটা বিষন্ন লাগছে । বারবার মনে হচ্ছে গরুটা ফিরিয়ে দিয়ে আসি । কিন্তু আজকে আমরা গরু ফিরিয়ে দিলে অন্য কেউ ঠিকই কিনে নিয়ে যাবে । লাভটা হবে কি !
এমন সময় তৃষা ঘরের ভেতরে ঢুকলো । আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ও কি ঘুমিয়েছে ?
-হুম !
আরও একটু কাছে এসে মেয়ের গালে চুমু খেল একটা । চোখের পানি শুকিয়ে গেছে অতৃর গালে । সেটা মুছিয়ে দিল । তারপর বলল, ওকে জাগাও !
-কেন ? ঘুমাচ্ছে ঘুমাক !
-না জাগাও । ওকে জাগাও । এক জায়গাতে যাবো !
-আজ থেকেই শুরু !
-অপু ! এতো কথা কেন বল শুনি !
আমি অতৃকে জেগে তুললাম । তারপর তৃষাই ওর হাত মুখ ধুইয়ে দিল ।
যখন বাসা থেকে বের হলাম আমি তৃষাকে বললাম, আমরা কোথায় যাচ্ছি বলবা ?
-গেলেই দেখতে পাবা !
পনের মিনিটের মাথায় একটা গেরস্থ বাড়িতে এসে হাজির হলাম । দুই পাশে ছোট দুটো টিনের বাড়ি । শেষের দিকে বেশ বড় একটা টিনের ঘর । মেঝে মাটির । মাঝে বড় উঠান ! বাড়ির ঠিক মাঝে বেশ কিছু মানুষ বসে গল্প করছে । আমরা ঢুকতেই আমাদের দিকে তাকালো সবাই । বুঝতে পারলাম আমাদের এই ভাবে এখানে আশা করে নি এখানে ! এক বৃদ্ধ লোক এগিয়ে এল আমাদের দিকে । তৃষাকে চিনতে পারলো সম্ভবত । একটু হাসি মুখেই বলল, তুমি চেয়ারম্যান সাহেবের নাতনি ?
-জি ! অর্থিকে ডাক দিবেন একটু ?
দেখলাম একটা মেয়ে উঠানের মানুষ গুলোর ভেতর থেকেই উঠে এল । কলা পাতা রংয়ের একটা জামা পরে আছে । মুখ শুকনো ! অতৃর থেকে মেয়েটা কয়েক বছর বড়ই হবে ! মেয়েটাকে দেখে অতৃ বলে উঠলো, বাবা এর গরুই আমরা নিয়ে গিয়েছি !
সাথে সাথেই আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম । তৃষা কেন আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে সেটা বুঝতে মোটেও কষ্ট হল না । আমি খানিকটা অবাক চোখে তৃষার দিকে তাকালাম । তৃষা এমন একটা ভাব করলো যেন এটা খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনা । অবশ্য তৃষার জন্য খুবই স্বাভাবিক !
তৃষা অর্থিকে বলল, তোমার মন খারাপ মামনি ?
মেয়েটা কেবল মাথা ঝাকালো ।
তৃষা হাসলো । তারপর বলল, তোমার মন আমি এক বারে ভালা করে দিতে পারি ! দিবো ?
মেয়েটা কেবল কৌতুহল নিয়ে তৃষার দিকে তাকালো । ঠিক এমন সময়ই তৃষাদের বাড়ির কাজের ছেলেটা গরুটা নিয়ে উঠে প্রবেশ করলো । অর্থি গরুটাকে দেখে এক দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো । গরুটাও যেন পরিচিত মানুষের ছোঁয়া পেয়ে হাম্বা করে ডেকে উঠলো ।
অতৃকে দেখলাম আস্তে আস্তে গরু আর মেয়েটার কাছে গিয়ে হাজির হল । তারপর বলল, এটা তোমার গরু ! ঠিক আছে !
তৃষাও মেয়েটার কাছে গিয়ে বলল, তোমার গরু তোমার থাকবে ।
এতো সময় বৃদ্ধলোকটা কথা বলে উঠলো, আপনারা কি গরু ফেরাই দিতেছেন ?
তার মুখে সংঙ্কাটা আমি বেশ ভালই টের পেলাম । তৃষা বলল, গরু ফেরৎ দিচ্ছি না । আমার মেয়ে এই গরুটা অর্থিকে উপহার দিল ।
তীব্র বিস্ময় নিয়ে বৃদ্ধ লোকটা আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো । দেখলাম বাড়ির প্রতিটি মানুষ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে । তৃষা বলল, গরুটা আমার মেয়ের আকিকার জন্য কিনেছিলাম কিন্তু মেয়ের কান্না দেখে আর সেটা মন চাইলো না । আসলে পোষা পশু পাখির প্রতি মানুষের ভালবাসাটা সব থেকে নিঘাত । এই ভালবাসার মূল্য দেওয়া সম্ভব না !
অর্থিকে দেখলাম তখনও গরুকে জড়িয়ে ধরেই আছে । আদর করে যাচ্ছে । তৃৃষা এবার বৃদ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল, এই গরুকে দয়া করে বিক্রির চেষ্টা করবেন না । কথাটা যেন মনে থাকে ।
তারপর অর্থিকে ডেকে বলল, এটা আজ থেকে তোমার গরু ! তোমার । এটা কেউ জোর করে বিক্রি করতে গেলে সোজা আমাকে খবর দেবে ! মনে থাকবে !
মেয়েটা কেবল মাথা কাত করে সম্মতি জানালো !
আমরা চলে আসার জন্য পা বাড়াতে যাবো তখনই বৃদ্ধ লোকটা বলল, তোমরা একটু ভেতরে আইসা বস !
-না না । এখন এসবের সময় নেই । কাল সময় পেলে আসবো !
-সত্যিই আইবা তো!
-অর্থিও দাওয়াত রইলো আমাদের বাসায় । ও যেন আসে !
ফিরে আসার সময় দেখলাম অতৃ মায়ের কাছে বসেছে । মাকে জড়িয়ে ধরে আছে । সে আজকে মায়ের উপর খুব খুশি ! এবারের ঈদ কেবল একটা নয় আরও একটা পরিবারের সকল সদস্য নিয়ে আনন্দের সাথে পালিত হবে । সবার মুখে থাকবে হাসি !
-০-
গল্প লেখার এই একটা মজা। নিজের ইচ্ছে মত এন্ডিং দেওয়া যায় । প্রথম আলোর এই খবরটা পড়ে, অর্থি নামের এই ছোট্ট মেয়েটির কান্নার ছবি দেখে, কেন জানি আমার নিজের চোখ দিয়েই পানি বের হয়ে এল । অর্থির জন্য আমার নিজের কষ্ট হতে লাগলো খুব । এই কষ্ট কোন ভাবে ভাষার প্রকাশ করা সম্ভব না । জীবন গল্প গুলোর মত হয় না । জীবনে অর্থের কাছে বারবার মানুষকে পরাজিত হতে হয় ! বার বার ।
সবাইকে ঈদ মোবারক!
আপনার ঈদ ভাল আনন্দে কাটুক !
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০২০ রাত ৯:২৯