প্রথম পর্ব
জেনির সাথে আমার পরিচয়টা রেস্টুরেন্টের মাধ্যমেই । দিন দিন আমার কাজের পরিমান বৃদ্ধি পাচ্ছিলো । অর্থ্যাৎ আমাকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বেশি সংখ্যক ডেলিভারি করতে হচ্ছিলো । সাইকেল থেকে স্কুটিতে এসেছেও আমি ঠিকমত কুলিয়ে উঠছিলাম না । আমার নিজের কাছেও মনে হচ্ছিলো যে আরেকজনকে যদি কাজে নেওয়া হত, তাহলে হয়তো আমার কাজটা আরও একটু সহজ হত !
প্রায় দেড় মাস কাজ করার পরে একদিন রাতে যথারীতি রেস্টুরেন্টে হাজির হলাম অর্ডার নেওয়ার জন্য । স্কুটিটা পার্ক করতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম সেখানে আরেকটা স্কুটি পার্ক করা রয়েছে । এটা আমার কাছে খানিকটা নতুন মনে হল । আমি গত দেড় মাসে একদিনও দেখি নি রাতের বেলা এখানে কোন গাড়ি পার্ক করা রয়েছে । পুরো গ্যারেজটা ফাঁকা থাকে । অন্তত আমি যত সময় থাকি তত সময় কোন গাড়ি থাকে না ।
তবে এটার ব্যাপারে খুব বেশি কৌতুহল দেখালাম না । আমার এসব ব্যাপারে কৌতুহল দেখানোর কথা না । আমি সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলাম । আজকে আমার জন্য নতুন কিছু অপেক্ষা করছিলো । রেস্টুরেন্টে ঢুকেই আমি মেয়েটাকে দেখতে পেলাম । এই পরিবেশের সাথে বড্ড বেমানান । আমার কফির কাপ সেখানে রাখা, সেই টেবিলের উল্টো দিকে মেয়েটা বসে কফি খাচ্ছে । আমি কোন দিকে না তাকিয়ে আমার কফির কাপের সামনে গিয়ে বসলাম । কফির কাপের নিচেই আমার নীলখাম রাখা ছিল । সেটা পকেটে ভরে কফির কাপে চুমুক দিলাম ।
মনের ভেতরে একটা ইচ্ছে কাজ করছিলো যে সামনে বসা মেয়েটার সাথে একটু কথা বলি কিন্তু সেটা বললাম না । নিজেকে নিয়ন্ত্রন করে নিলাম ! তবে দেখলাম মেয়েটি নিজ থেকেই আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল ।
-হ্যালো! আমি জেনি!
একটু ইতস্তর করে আমি হাতটা ধরলাম । তারপর বললাম আমি অপু !
-তুমি কত দিন ধরে কাজ কর এখানে ?
-এই মাস দেড়েক!
-অনেক দিন । আমি গতকালকে জয়েন করেছি । আমি তো প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারি নি যে প্রতিদিন এরা দুই হাজার টাকা দেবে ! তোমাকে দেয় তো টাকা পয়সা ঠিক মত ?
আমি বললাম, হ্যা ! একদম নিয়মিত । এখনও একদিনও পেমেন্ট মিস হয়নি !
মেয়েটার মুখে একটা হাসি দেখতে পেলাম ! আমার কাছ থেকে নিশ্চিত হয়ে মেয়েটা যেন একটু শান্তি পেল ! তারপর বলল, রেস্টুরেন্ট টা নতুন তাই না ? একদিন ভাবছি বন্ধুদের নিয়ে আসবো ! আচ্ছা কেবল কি আমরাই কাজ করি এখানে ? আর কেউ করে ?
-আমি যতদুর জানি, না । এতো দিন আমি একা ছিলাম । আজকে তুমি যুক্ত হলে !
-আচ্ছা আচ্ছা!
আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না । মেয়েটার কেমন কৌতুহলী চোখ নিয়ে সব দিকে তাকাচ্ছে । এটাই আমার কাছে ভাল লাগলো না । গতকাল কি জেনিকে ওরা ঠিক মত ব্রিফ করে নি ? মেয়েটা মনে হচ্ছে এই কাজটা ঠিক মত করতে পারবে না ।
কফি শেষ করে আমাদের পার্সেল চলে এল । দুজনে এক সাথেই নিচে নামলাম । জেনিকে দেখলাম নিজ থেকে এগিয়ে এসে আমার কাছ থেকে নাম্বার নিল । বলল যেহেতু আমরা কলিগ, আমাদের মাঝে যোগাযোগ থাকা দরকার !
স্কুটি নিয়ে বের হতে যাবে তখন আমি জেনিকে বললাম, জেনি !
-বল!
-তোমার কাজ কেবল পার্সেল পৌছানো! ঠিক আছে । অন্য কিছু খেয়াল করবে না অন্য কিছু নিয়ে ভাববেও না !
-এই কথা কেন বলছো?
-না মানে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি । কৌতুহল দেখাবে না এবং কোন কিছুতে ভয় পাবে না । তাহলেই সব কিছু ঠিক থাকবে !
জেনি কি বুঝলো কে জানে ! স্কুটি নিয়ে বের হয়ে গেল । আমি নিজেও বের হয়ে গেলাম নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে !
তারপর থেকে আমাদের প্রতিদিনই দেখা হতে লাগলো । আমরা একই সাথে ফুড পার্সেল নিতে রেস্টুরেন্টে যাই । কফি খেতে খেতে কথা বলি । জেনি নানান কথা বলে । বেশির ভাগ সময়ই আমি চুপ করে শুনি ! ঠিক সাত দিনের মাথায় রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখি জেনি আসে নি । প্রতিদিন আমার আগেই চলে আসে ও । সেদিন এল না । তার পরের দিনও না । ওকি কাজ ছেড়ে দিল ? নাকি আমি চলে যাওয়ার পরে আসে ? কে জানে ! তারপর আর আজকে এই মেয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে এসেছে এখানে ! কত কথা বলছে !
জেনি বলল, তুমি জানো ঐ বক্সের ভেতরে কি থাকে ?
আমি বললাম, কি থাকে ?
-তুমি বিশ্বাস করবে না কি থাকে !
একবার মনে হল জেনিকে বলি যে কি থাকে না থাকে সেটা আমার জানার দরকার নেই । আমি জানতে চাই না । কিন্তু একটু যে কৌতুহল হচ্ছিলো না সেটা বলবো না !
জেনি বলল, গত পরশু দিন আমার সাথে একটা ভয়ানক ঘটনা ঘটেছে ।
-কি ভয়ানক ঘটনা ?
জেনি একটু সময় চুপ করে তাকিয়ে রইলো টেবিলের উপরে রাখা খাবারের প্লেটের দিকে । তারপর বলল, তুমি তো জানো আমাদের কন্ট্রাক্টের একটা রুলস হচ্ছে ডেলিভারির সময়ে আমাদের কোথাও থামা চলবে না !
হ্যা । এই নিয়ম টা আছে । ডেলিভারির সময় আমাদের রেস্টুরেন্ট থেকে সোজা কাস্টোমারের বাড়ি, সেখান থেকে অন্য বাড়ি । মাঝে কোথাও থামা চলবে না । আমি কেবল মাথা ঝাকালাম !
জেনি বলল, আমার চা খাওয়ার সখ একটু বেশি । সেদিন যাওয়ার পথে দেখি পথের মাঝে একটা চায়ের দোকান । লোভ সামলাতে পারলাম না । স্কুটিটা এক পাশে দাড় করিয়ে চা খেয়ে নিলাম এক কাপ । তারপর আবারও রওয়ানা দিলাম । কিন্তু কিচু দুর যেতেই আমাকে দুইটা পুলিশ থামালো । টহল দিচ্ছিলো । আমাকে বলা হয়েছিলো যে কোন পুলিশি ঝামেলা হবে না । আর হলেও তারা সামলে নিবে ।
আমি জেনির দিকে তাকিয়ে রইলাম । আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি জেনি কি বলে । জেনি বলে চলল, পুলিশ দুজন আমাকে বেশ কিছু সময় ধরে নানা রকম প্রশ্ন করলো । তারপর আমাকে ব্যাগের ভেতরে থাকা পার্সেল বের করতে বলল । সেগুলো তারা খুলে দেখবে । যদিও খুব একটা ভয় করছিল না আমার । প্যাকেটের ভেতরে যদি অবৈধ কিছু না থাকে, কেবল খাবার থাকে তাহলে তো আর আমার চিন্তার কোন কারণ নেই । আমি একটা প্যাকেট বের করে দিলাম । পুলিশ দুজন হাতে নিয়ে কিছু একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগলো । তারপর একজন একটা পেনসিল নাইফ বের করল। মাঝ বরাবর কেটে ফেলল ।
লাইন গুলো বলে জেনি কিছু সময় আবার চুপ করে রইলো । আমি লক্ষ্য করলাম এই এসির ভেতরেও জেনির কপালে একটু একটু ঘাম জমেছে । আমি বললাম, কি দেখলে তুমি?
একটু দম নিয়ে জেনি আবার বলল, প্যাকেট টা খুলতেই চারিদিকে একটা তীব্র কটু গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল । আমার মনে হল আমি জীবনে এতো তীব্র পঁচা গন্ধ কোন দিন পাই নি । আমার নাড়ি ভূড়ি সব উল্টে এল । ল্যাম্প পোস্টের আলোতে দেখতে পেলাম প্যাকেটের কাটা অংশ থেকে মুরগির পঁচা নাড়িভূড়ি বের হয়ে এসেছে । আমার মত পুলিশ দুই জনও তীব্র ভাবেই অবাক হয়েছে । তারা যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না যে কেউ মুরগির পঁচা নাড়ি ভূড়ি এভাবে প্যাকেট করে নিয়ে যেতে পারে । একজন আমার দকে তীব্র রাগের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে বলল, এগুলো কি? তুমি না বললে খাবার ! এ ……
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো সে তার আগেই তার ফোন বেজে উঠলো । ফোনের দিকে তাকাতেই সে সোজা হয়ে গেল । তারপর ফোন টা ধরেই বলল, জি স্যার !
দেখতে পেলাম তার মুখের ভাব বদলে গেছে । সে বলার চেষ্টা করলো
জি স্যার ! না মানে ……।। জি স্যার ! জি আচ্ছা স্যার ……
আমি বললাম, এর পর?
জেনি বলল, আমাকে অবাক করে দিয়ে পুলিশ লোকটা বলল, সরি ম্যাডাম, আমরা আসলে বুঝতে পারি নি । প্লিজ কিছু মনে করবেন না ।
তারপর পাশের লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল, এই রশিদ গাড়িতে স্কচটেপ আছে । জলদি নিয়ে আসো তো । কুইক !
পুলিশের গাড়িটা আমাদের থেকে একটু দুরেই দাঁড়িয়ে ছিল । লোকটা সেখানে থেকে দ্রুত স্কচটেপ নিয়ে এল । তারপর নিজ দায়িত্বেই ওরা প্যাকের কাটা অংশ টেপ দিয়ে আটকে দিলো এবং সেটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল । আমার কেন জানি সেটা আর নিতে ইচ্ছে করলো না । একটা ঘেন্না করতে লাগলো ।
পুলিশ দুজন নিজেদের গাড়ি নিয়ে যেতেই আমার ফোনে ফোন এসে হাজির । ওপাশ থেকে বলল, আমাদের কাস্টমার ক্ষুদার্থ ! জলদি যাও ……
কন্ঠটা এতো ঠান্ডা ছিল যে আমার পুরো শরীর কেঁপে উঠলো । আমার সেটা অমান্য করার কোন শক্তি ছিল না। আমি আপনা আপনি স্কুটিতে চেঁপে বসলাম ।
আমার মনের ভেতরে কেমন একটা অদ্ভুত মিশ্র প্রতিক্রিয়া হল । অন্য সময় কিংবা অন্য কোন বিষয় হলে হয়তো আমি জেনির সাথে একমত হতাম । তবে এখন কেন জানি আমার কাছে ব্যাপারটা মোটেই খারাপ কিছু মনে হল না । কেবল মনে হল কেউ যদি মুরগির নাড়ি ভুড়ি খায় । খাক ! আমার কি ? আমার কাজ হচ্ছে সেগুলো তার কাছে পৌছে দেওয়া এবং বিনিমনে টাকা নেওয়া । অন্য কিছু আমার ভাবার দরকার নেই ।
জেনির কথা আমি অবিশ্বাস করলাম না । আমার মনে হল জেনি সত্য কথা বলছে । এর পেছনে আরেকটা কারণও আছে । যে বড় ভাই আমাকে এই চাকরিটা জোগার করে দিয়েছে, তার কাওরান বাজারে মুরগির আড়ত আছে । সুতরাং প্যাকেটের ভেতরে এই বস্তু গুলো কোথা থেকে আসে সেটা মেলাতে আমার কষ্ট হল না । কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কোন মানুষ কি এই পঁচা জিনিস গুলো খেতে পারে? আদৌও কি সম্ভব ?
কেন খাবে?
আমি জেনির দিকে তাকিয়ে বললাম, আচ্ছা বুঝলাম । কিন্তু সেটা কি সমস্যা আমি তো বুঝতে পারছি না । হ্যা ঠিক আছে পচা নাড়িভূড়ি নিয়ে যাচ্ছো । কিন্তু এতে আমার তোমার কি সমস্যা ? হতে পারে এটা ওরা কোন প্রাণীকে খাওয়ায়?
জেনি যেন খানিকটা অবাক চোখেই আমার দিকে তােকিয়ে রইলো । তারপর বলল, তোমার কাছে এটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে?
-না । স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না । কিন্তু জগতে কতই না অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে । আর আমরা সে কাজ করছি সেটার পেমেন্ট কি স্বাভাবিক ? বল স্বাভাবিক ? কিছু অস্বাভাবিক কাজের জন্যই আমাদের কে এতো টাকা দেওয়া হচ্ছে । তবে কাজটা অস্বাভাবিক হতে পারে অন্যায় না । অন্যায় কি?
জেনি আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । যেন বুঝতে চেষ্টা করছে আমার মনভাব ! তারপর বলল, তুমি যদি ওদের চেহারা দেখতে তাহলে এই কথা বলতে না !
-তুমি দেখেছো ওদের?
-হ্যা । কি বিভৎস ওদের চেহারা সেটা তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না । ঐদিনই আমি পার্সেল নিয়ে আবারও রওয়ানা দিলাম । তিনটার ভেতরে দুইটা পার্সেল জায়গা মত স্থানে পৌছে দিলাম । তবে তৃতীয়টা পৌছাতে গিয়ে আমার কেমন যেন ভয় করতে শুরু করলো । আমার একদম প্রথমদিনই আমি এখানে এসেছিলাম পার্সেল দিতে । একটা চার তলা বিল্ডিং ! কাস্টোমার তিন তলায় থাকে । আমি ধীর পায়ে উপরে গেলাম সিড়ি দিয়ে । আমার বুকের ভেতরে একটা দুরু দুরু অনুভূতি হচ্ছিলো ।
জেনির চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারছিলাম ও একটা ভয় অনুভব করছে । যেন সেই দৃশ্যটা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছে ও । জেনি টেবিলের উপরে রাখা গ্লাস থেকে ঢকঢক করে পানি খেল । তারপর বলল, আমি কলিং চাপ দিলাম । একবার দুবার তিন বার ! অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছিলো । বারবার মনে হচ্ছিলো যেন দৌড় দিয়ে চলে যাই । আরও একবার কলিংবেল চাপ দিলাম । তারপরই আমি প্রতিদিনের মত যা হওয়ার তাই হল । তীব্র একটা বোটকা গন্ধ পেলাম । তারপর ভেতর থেকে আওয়াজ শুনতে পেলাম । আমাকে বলা হল আমি যেন প্যাকেট রেখে চলে যাই । আমিও এটা শোনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম । আমি প্যাকেটটা নিচে রেখে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াই । করিডোর দিয়ে সিড়ি পর্যন্ত যেতেই আমি পেছন থেকে দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম । অন্যান্য দিন সাধারনত এরকম হয় না । রাত নিতব্ধ থাকে । আমি যখন বিল্ডিংয়ের নিচে নেমে আসে কিংবা সিড়ির দিয়ে কয়েকধাপ নেমে আসি তখনই দরজা খোলার আওয়াজ পাই । কোন দিন সেটাও পাই না । কিন্তু আজকে এতো জলদি কেন দরজা খুলে গেল সেটা আমি বুঝতে পারলাম না । সম্ভবত আজকে আমার পৌছাতে একটু দেরি হয়েছিলো বলেই দরজাটা খুলে গেল।
কথা গুলো একভাবে বলেই জেনি চুপ করলো কিছু সময়ের জন্য । এবার আমি নিজে ওকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলাম । এবার সত্যিই আমি নিজে খানিকটা চিন্তিত হলাম জেনির চেহারা দেখে । মেয়েটা সত্যিই ভয় পেয়েছে সেটা বুঝতে মোটেও কষ্ট হল না আমার । আমি বললাম, তুমি যদি না বলতে চাও তাহলে বলতে হবে না । আমি তোমার কথা বিশ্বাস করছি ।
জেনি বলল, না। আমি তোমাকে বলি । তাহলে হয়তো তুমি ব্যাপারটা বুঝতে পারবে !
আমি ওকে আরও একটু দম নেওয়ার সময় দিলাম । জেনি নিজেও যেন একটু সময় নিল । আমার মনে হল যেন ও মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছে কথা গুলো। জেনি আবারও বলতে শুরু করলো, আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রন করার খুব চেষ্টা করলাম । কিন্তু খুব একটা কাজ হল না । আমি পেছনে তাকিয়ে ফেললাম । ঠিকই দরজাটা পুরোপুরি খুলে গেল । তার সেই জিনিসটা বের হয়ে এল ।
জেনির চোখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল যে ও এখনও চোখের সামনে তাকে দেখতে পাচ্ছে ।
-ওটাকে আর যাই বলা হোক, মানুষ কোন ভাবেই বলা যাবে না । কোন ভাবেই না । লম্বায় আমার সমানই হবে । মানুষের মতই গড়ত । চোখ মুখ হাত সবই রয়েছে । তবে সেগুলো মানুষের মত নয় । মুখের স্থানে অনেকটা লম্বা ঠোঁট রয়েছে । কাল ঠোঁট । পাখিদের যেমন হয় । আরও ভাল করে বললে কাকের যেমন হয় । সেই ঠোঁটের উপরেই নাকের ফুটো । তার একটু উপরে চোখ । মানুষের মত গলা থেকে বুক আর কোমর । তবে সেগুলো বেশ সরু ! পা আর হাতের নিটে চারটা করে আঙ্গুল । তিনটা একদিকে বাকি একটা অন্য দিকে ।
পুরো শরীরে কোন পোশাক নেই । তবে কালো আবরন রয়েছে । সেটা আমার দিকে কিছু সময় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো । আমি যে ঘুরে দাড়াবো সেটা সম্ভবত আশা করে নি । চোখ দুটো মানুষের মত না । অনেকটা গোল গোল । তার ভেতরে কালো চোখের মনি । আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে স্থির ভাবে ।
আমি চুপচাপ শুনে গেলাম । কি যে বলবো সেটা বুঝতে পারছি না । কি বলা উচিৎ ?
কিছু যে একটা অস্বাভাবিক কাজ আমি করছি সেটা আমি শুরু থেকেই জানতাম । তবে সেটা যে এমন হবে সেটা তো বুঝতে পারি নি ।
জেনি বলল, সেটা তারপর দ্রুত প্যাকেট টা নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল । পুরো পথ আমি কিভাবে এসেছি কেবল আমি জানি । আমার মনে যে কি ভয় ধরে গেছে সটা আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারবোনা ।
আমি বললাম, তুমি কি করতে চাও?
-জানি না কি করবো তবে আর যাচ্ছি না আমি । তোমারও যাওয়া উচিৎ না। তোমার সেফটির জন্যই আমি বললাম। আমি যাবো না ওখানে । বুঝতে পেরেছো কি ! তবে আমি চুপও থাকবো না। এই সব ভয়ংকর প্রাণী আমাদের মাঝে রয়েছে । না জানি ওরা কি করবে ! আমি কালই পুলিশের কাছে যাবো । আমার এক বন্ধুর বাবা পুলিশে আছে। তাকে খুলে বলবো । অন্তত ঐ রেস্টুরেন্টে আর যে কয়টা বাড়ি আমি চিনি সেখানে পুলিশ নিয়ে যাবোই । বেটাদের ধরবো তারপর দেখা যাক কি করা যায় !
আমি জেনির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এলাম । মনের ভেতরে অদ্ভুত সব চিন্তা ভাবনা কাজ করছে । কিছুতেই আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না । জেনি যা বলেছে সেটা আমি মোটেই অস্বীকার করছি না । অন্য কেউ ওর কথা এতো সহজে বিশ্বাস করবে না আমি জানি । কিন্তু পুরোপুরি ভাবেই বিশ্বাস করেছি । তাহলে এখন আমার কি করা উচিৎ ?
জেনির কথা মত কাজ কর্ম বাদ দিয়ে দেওয়া উচিৎ ? আমিও জেনির সাথে সুর মিলিয়ে ঐ প্রাণীদের কে ধরিয়ে দিবো ?
নাকি কিছুই হয় নি ভেবে আগের মতই পার্সেল সার্ভিস দিয়ে যাবো ?
একটা ব্যাপার আমি খুব ভাল করেই বুঝতে পারছি যে যদি জেনির সাথে হাত মিলাই তাহলে প্রতিদিন আমার পকেটে যে দুই হাজার টাকা করে আসছে সেটা আর আসবে না । সেটা বন্ধ হয়ে যাবে । দেশের পরিস্থিতি খুব সম্প্রতি ভাল হবে বলে আমার মনে হয় না । আমি তখন কি করবো ?
আর মেনে নিলাম যে তারা মানুষ না । কিন্তু আমার কি কোন ক্ষতি করছে ? এই যে এতোদিন আমি ওদের বাসার সামনে গিয়ে হাজির হলাম যদি আমার কোন ক্ষতি করার ইচ্ছে ওদের থাকতো তাহলে তারা ঠিকই ক্ষতি করে ফেলতো ! তাহলে নিশ্চিত একটা অর্থ প্রাপ্তির পথ আমি কেন বন্ধ করবো ? আর অন্যকেই বা কেন বন্ধ করতে দিবো ?
আমি বাসার নিচে এসে আবারও স্কুটিটা ঘুরিয়ে ফেললাম । সোজা হাজির হলাম রেস্টুরেন্টের সামনে । আমি দিনের বেলা যতদিন এখানে এসেছি ততদিন দরজা বন্ধই পেয়েছি । কিন্তু আজকে আমাকে অবাক করে দিয়েই দরজার একটা পাল্লা মনে হল খোলা । আমি স্কুটি টা সামনে পার্ক করে দরজা দিয়ে ঢুকে গেলাম ভেতরে !
সেদিনের সেই কম বয়সী লোকটা আমার দিকে বেশ কিছু সময় তাকিয়ে রইলো । আমি এতো সময়ে জেনির কাছ থেকে যা শুনেছি সবই বলে দিয়েছি । সে শান্ত মুখে আমার কথা শুনলো । তারপর বলল, তোমার মনে হয় যে জেনি যা বলেছে সব সত্যি?
আমি ইতস্তত করে বললাম, হ্যা সত্যি ।
-তারপরেও তুমি এসেছো ?
-হ্যা ।
-কারণ কি জানতে পারি কি?
-কারণটা খুবই স্বাভাবিক । আমি আগে থেকেই জানতাম যে কাজ আমি করছি তার ভেতরে কিছু তো অস্বাভাবিকতা আছে । আর কাজ টা যেহেতু অবৈধ না, এবং সেই প্রাণী গুলো মানুষ হোক বা না হোক তারা মানুষের ক্ষতি করছে না । করছে কি ? তাহলে কেন আমি তাদের শান্তিভঙ্গ করবো ?
এইবার লোকটার মুখে হাসি ফুটলো । তারপর বলল, তোমার কথা শুনে খুশি হলাম । তুমি এখন আসতে পারো । জেনির ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে !
একটু ভয় হল । জেনিকে আবার না ওরা কিছু করে ফেলে । আমি বললাম, জেনিকে কি করবেন আপনারা?
লোকটা একটু হাসলো। তারপর বলল ভয় পেও না । আমরা খুন খারাবীতে বিশ্বাসী নই । তবে জেনির ব্যাপারে কিছু করতে হবে । যেহতু সে আমাদের ব্যাপারে হুমকি হয়ে দাড়াতে পারে । তুমি চিন্তা কর না । আমরা সামলে নিবো ।
আমার মনে তবুও জেনির জন্য একটু চিন্তা হতে লাগলো । মনে হল যে জেনির যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে সেটার জন্য আমিই দায়ী থাকবো । কিন্তু এখানে আমার আর কি বা করার ছিল । আমি যখন উঠতে যাবো তখন লোকটা আবারও আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ইউ আর রাইট ! ওরা ডিফারেন্ট কিন্তু ক্ষতিকর না । আমাদের দেশে ভিন্নতাকে সবাই গ্রহন করতে পারে না, ভয় পায়, ক্ষতি করার চেষ্টা করে । আমরা কেবল ওদের একটু সাহায্য করছি । আর কিছু না ।
আমি হঠাৎ বলল, ওরা কারা?
দেখতে পেলাম লোকটার চোখ কেমন যে জ্বলে উঠলো । তবে সেটা নিভে গেল সাথে সাথেই । আমি বললাম, সরি, আসলে এই কৌতুহল আমি দমাতে পারলাম না ।
লোকটা বলল, ওরা কারা এটা জানার খুব একটা দরকার নেই । কেবল এই টুকু বলে রাখি যে ওরা এই পৃথিবীতে আছে অনেক দিন থেকে । অনেক দুর থেকে এসেছে, এখনও আসছে । আমাদের কাজ কেবল ওদের খাবার সরবারহ করা । বিনিময়ে আমরা এর অর্থ পাই । ঠিক আছে ?
-জি ঠিক আছে !
পরিশিষ্টঃ
রেস্টুরেন্ট থেকে আমাকে একটা বাইক কিনে দেওয়া হয়েছে । সেই সাথে প্রতিদিনের পেমেন্টের পরিমানটাও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে । তবে খাবার ডেলিভারির সময়টা একটু বেড়েছে এখন । আগে তিনটার ভেতরে সব শেষ করতে হত এখন চার পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে । সেই সাথে আমাকে আরও একটু সুবিধা দেওয়া হয়েছে । আমাকে একটা আলাদা চাবি দেওয়া হয়েছে । চাবিটা অনেকটা মাস্টার কি এর মত । আমাকে এখন আর কাস্টমারদের বাসায় গিয়ে কলিংবেল চাপতে হয় না । এই চাবি টা দরজাতে প্রবেশ করালেই দরজা খুলে যায় । এই এক চাবি দিয়ে সব দরজা খুলে যায় । আমি দরজার কাছে প্যাকেট টা রেখে আবার দরজা বন্ধ কে চলে আসি । সুতরাং কাস্টোমার পেছনে আমার সময় কম খরচ করতে হয় । বেশি বেশি ডেলিভারি করা যায় !
আমি হিসাব করে দেখেছি, মাসের ভেতরে ঘুরে ফিরে পঞ্চাশটা বাড়িতে আমি খাবার সাপ্লাই করি । যদিও এখনও কারো সাথে আমার সামনা সামনি দেখা হয় নি । তবে একদিন তাদের সামনে থেকে দেখার বেশ ইচ্ছে আমার । আমার কাছে চাবি থাকা স্বত্ত্বেও কাজটা কারতে আমি ঠিক সাহস পাই না । যতই আমাকে বলা হোক যে ওরা আমার কোন ক্ষতি করবে না তারপরেও আমার এই সাহস এখনও হয় না যে ওদের ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ি । প্রতিবার দরজা খুলতেই একটা বিদঘুটে গন্ধ এসে নাকে লাগে । যা একেবারেই সহ্য হয় না ! কোন মতে খাবার রেখেই চলে আসি !
জেনির সাথে আমার মাস খানেক পরে আবার দেখা হয়েছিলো । আমি ওকে ডাক দিলাম । আমার ডাক শুনে আমার দিকে ফিরে তাকালো । কিন্তু ওর চোখের দৃষ্টি দেখে আমি অবাক হলাম । আমার কাছে এসে বলল আমি ওকে চিনি কি না ! সে নাকি আমাকে চেনে না ! ঐ লোকটা বলেছিলো যে জেনির ব্যবস্থা ওরা নিবে । সম্ভবত এই ব্যবস্থা নিয়ে ফেলেছে ! জেনি আমাকে চিনতে পারছে না, এর অর্থ হচ্ছে ওর কিছু মনে নেই । মনটা খানিকটা শান্ত হল । জেনির আপাতত ঠিক আছে । যে ভয়টা পাচ্ছিলাম সেটা হয় নি ।
জেনির মত আমিও যদি বেশি কৌতুহল দেখাতে যাই তাহলে আমারও হয়তো এমন কিছু হবে । দরকার নেই এসব চিন্তা করার । আমার কাজ হচ্ছে ফুড ডেলিভারি করা । এর বিনিময়ে আমি টাকা পাই । আমি সেটাই করি বরং । এতো কৌতুহল দেখানোর কি দরকার শুনি !
(সমাপ্ত)
ব্লগার কল্পদ্রুম এর গল্পানুঃ দশচক্রের তিন চক্র এর প্রথম অনু গল্প ক্ষুধা থেকে এই গল্পের সুচনা ।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুলাই, ২০২০ দুপুর ২:১৪