একটা সময়ে দুপুরের খাবার খেয়েই আমাকে দৌড় দিতে হত টিউশনিতে। দুপুরে ঘুমানোর উপায় ছিল না। কিন্তু লকডাউনের পর থেকে টিউশনী দুটোই বন্ধ হয়ে গেল । হাতে আমার অফুরন্ত সময় । ক্যাম্পাসে যেতে হয় না । কিন্তু সমস্যা হচ্ছে টিউশনী চলে যাওয়ার কারণে আমার হাত খরচে টান পড়তে শুরু করলো । বাসায় আমার টাকা চাইতে কখনই ভাল লাগে নি । বাধ্য হয়ে অন্য কাজ খুজতে শুরু করলাম । পেয়েও গেলাম একটা । ডেলিভারি ম্যানের কাজ ! তাও আবার রাতের বেলা ।
রাতের কাজ করতে হয় বলেই আমাকে এখন দুপুর বেলা ঘুম চলে আসে । আজকেও সেই রকম পরিকল্পনাই ছিল কিন্তু জেনির কারণে সেটা বাস্তবায়ন করা সম্বব হল না।
জেনি ফোন দিয়েছে । তার নাকি জরুরী কথা আছে ! আমাকে বলতেই হবে ! এবং আমাকে তা শুনতেই হবে । এটার সাথে নাকি আমার নিজের নিরাপত্তাও জড়িত ।
ঠিক হল দুপুরের খাবার আমরা এক সাথে খাবো ! নির্ধারিত সময়ে নির্ধারিত স্থানে পৌছে গেলাম । ডেলিভারি শুরুর পর থেকে অন্তত এই ব্যাপারটা আমার ভেতরে বেশ ভাল ভাবেই পেয়ে বসেছে । যে কোন স্থানে সময় মত গিয়ে পৌছানো । রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখি জেনি আগে থেকেই সেখানে বসে আছে । ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার বুঝতে কষ্ট হল না যে সে কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত কিংবা বলা যায় কিছুটা ভীত সে ! আমরা রাত তিনটা পর্যন্ত ডেলিভারির কাজ করি । তারপর আমাদের ছুটি । আমি সোজা বাসায় গিয়ে ঘুম দেই । জেনির চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হল ও একদমই ঘুমাতে পারছে না কদিন ধরে । চোখের নিচে কেমন কালো দাগ হয়ে গেছে । সেই সাথে চোখ গুলো যেন একটু বেশি ভেতরে ঢুকে গেছে ।
আমাকে দেখতেই জেনি খানিকটা হাসলো । শুকনো হাসি । মেয়েটা আসলেই কিছু নিয়ে চিন্তিত ।
আমি একটু হেসে বললাম, কি খবর? এতো জরূরী তলব ?
জেনি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি আর কাজ করবো না ?
আমি খানিকটা অবাক হয়ে বললাম, সেকি কেন ?
-না, আমি কাজ করবো না । তোমারও উচিৎ কাজ টা না করা !
বুঝতে পারলাম যে জেনির সাথে খারাপ কিছু হয়েছে কিংবা ও এমন কিছু দেখে ফেলেছে সেটা ওর দেখা উচিৎ হয় নি । আমি একটা বড় করে নিঃশ্বাস ফেললাম । মেয়েটাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম সেদিনই মনে হয়েছিলো এই মেয়েটা কাজটা করতে পারবে না ঠিক মত । আজকে ঠিকই আমার ধারনাটা সত্যিই হল । বললাম, কি হয়েছে বলবে আমাকে ?
-তুমি কি জানো আমরা কাদের খাবার সরবারহ করছি ?
-না ! আমি জানি না । আমি জানতে চাইও না । আমাদের চাকরির প্রথম শর্তই তো এটা ছিল ! কি ডেলিভারি করছি আর কাদের ডেলিভারি করছি সেটা নিয়ে মোটেও কৌতুহল দেখানো যাবে না । আমি তো দেখাই নি । তুমি কেন দেখাচ্ছো ?
-আমি ...... আমি .....
জেনি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল ! আমি ওর উদ্দিগ্ন চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুটা সময় । মেয়েটাকে কিছু যেন একটা শান্তি দিচ্ছে না । মেয়েটা কি ডেলিভারি করার সময় কিছু দেখেছে ? এমন কিছু জেনে ফেলেছে যা তার জানার কথা না !
টিউশনী বন্ধ হয়ে গিয়ে আমি যখন অতৈ সাগরে পড়তে যাচ্ছিলাম তখনই ক্যাম্পাসের বড় ভাই আমাকে এই কাজের সন্ধ্যানটা দিলেন । ডেলিভারি ম্যান শুনে প্রথমে একটু সংকোচ হচ্ছিলো । কিন্তু অর্থের পরিমানটা শুনে আমার চোখ কপালে উঠলো । প্রতিদিন দুই হাজার টাকা !
মানে মাসে আমি ষাট হাজার টাকা আয় করতে পারবো ! কেবল ডেলিভারি করার জন্য এতো টাকা ! কি ডেলিভারি করবে ? অবৈধ কিছু নাতো ? পুলিশি ঝামেলা আছে নাকি ?
আমি বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, এতো টাকা দিচ্ছে, কি ডেলিভারি করতে হবে ভাই ?
বড় ভাই খানিকটা বিরক্ত কন্ঠে বলল, সেটা তোমার জানতে হবে না । তবে কোন অবৈধ কিছু না ।
আমি বললাম, না মানে এতো টাকা দিচ্ছে যে ?
বড় ভাই বলল, এসব নিয়ে তোমাকে মোটেও ভাবতে হবে না । তোমার কাজ হবে কেবল খাবার পৌছে দেওয়া । একটা রেস্টুরেন্ট থেকে শহরের নানান স্থানে তোমাকে খারাব নিয়ে যেতে হবে ।
বড় ভাই একটু থামলেন । মোবাইল বের করে কি যেন দেখলো সে । তারপর আবারও বলল, কোন ভয় পেও না । কোন অবৈধ জিনিস পত্র না । পুলিশের ঝামেলাতে তোমাকে পড়তে হবে না । আর যদি কোন সময়ে পুলিশের ঝামেলা হয়ও তবে তোমাকে রক্ষা করা হবে । সেই মোতাবেগই কন্ট্রাক্ট সাইন করা হবে !
এবার আমি আবারও চমকালাম । সামান্য ডেলিভারি ম্যানের কাজের জন্যও কন্ট্রাক্ট !
বড় ভাই বলল, চল আমার সাথে গেলেই দেখতে পারে । আজ রাত পোনে বারোটার দিকে আমি তোমাকে নিয়ে যাবো ! ঠিক আছে ?
আমি আর কিছু জানতে চাইলাম না । এই দুঃসময়ে দিনে দুই হাজার টাকা পাওয়া মুখের কথা না । এমন কি অবৈধ জিনিস হলেও আমি সম্ভবত কাজ করতে দ্বিধা বোধ করতাম না ।
বড় ভাই বাইক নিয়ে আমার বাড়ির সামনে এসে হাজির হলেন সময় মত । আমি তার পেছনে চেপে বসলাম ! আমি থাকি মোহাম্মাপুরে । রেস্টুরেন্টটা ধানমন্ডিতে । পৌছাতে খুব বেশি সময় লাগলো না ।
অদ্ভুত একটা রেস্টুরেন্ট । কোন নাম নেই । ধানমন্ডির সব থেকে অভিজাত স্থানে রেস্টুরেন্টটা অবস্থিত । দুই তলা বিল্ডিং । নিচ তলাকে গ্যারেজ । খুব বেশি হলে চার থেকে থেকে পাঁচটা গাড়ি ধরবে । উপর তলাতে মুল রেস্টুরেন্ট । পাশ দিয়ে লেক চলে গেছে । বাইরে থেকে দেখতে বেশ চমৎকার আর একটা অভিজাত অভিজাত ভাব রয়েছে । সারা দিন সেটা বন্ধ থাকে । চাকরি শুরুর পর থেকে আমি দিনের বেলাতে বেশ কয়েবার গিয়েছি । সাটার টেনে বন্ধ করে দেওয়া থাকে সকল কাঁচের গ্লাস গুলো । রেস্টুরেন্ট চালু হয় রাত বারোটার পর থেকে ।
আমি ভীত আর খানিকটা সংকুচিত ভাবে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠলাম । ভেতরে ঢুকতেই কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল মনে । কেন যে এই রকম অনুভূতি হল সেটা আমার কাছে পরিস্কার নয় । তবে বড় ভাই সাথে না থাকলে আমি যে কোন সময় দৌড় দিতাম, সেটা খানিকটা নিশ্চিত । এই ভয়ের অনুভূতিটা হওয়ার কি কারণ সেটা বুঝতে পারলাম না !
রেস্টুরেন্টের ভেতরে মৃদু আলো খেলা করছে । মাঝে মাঝে সেই আলো দিক পরিবর্তন করছে । ভেতরের পুরো অংশটুকুর চেহারা কেমোন বদলে যাচ্ছে । আর চারিদিকে একটা মিষ্টি গন্ধ ছেঁয়ে আছে । আমি অনেক চেষ্টা করেও গন্ধটা চিনতে পারলাম না । বড় ভাই আমাকে একটা টেবিলে নিয়ে বসালো । আমি চারিদিকে তাকাতে শুরু করলাম । বন্ধুদের সাথে ধানমন্ডির অনেক রেস্টুরেন্টেই আমি গিয়েছি । কিন্তু এটা সব থেকে আলাদা । স্পষ্টই এখানে যারা আসে তরা সব অভিজাত আর পয়সাওয়ালা মানুষ । বড় বড় কাঁচে ঘেরা জানলা গুলো সব ভারী পর্দা নিয়ে ঘেরা । আলো বাইরে যাবে না ।
বড় ভাই আমাকে রেখে কোন দিকে গেল আমি টের পেলাম না । চারিদিকে ভাল করে লক্ষ্য করতে শুরু করেছি । দেখলাম আমি ছাড়াও আরও একজন মানুষ রয়েছে রেস্টুরেন্টের ভেতরে । একেবারে কোনার দিকে বসে আছে । আপন মনে কফি খাচ্ছে । এতো দুরে বসার কারনে আমি তার চেহারা পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি না । তবে কেন জানি মনে হল সে মাঝে মাঝে আমার দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছে ।
বসার কিছু সময় পরেই দেখলাম একজন আমাকে এক কফি দিয়ে গেল । কফি জিনিসটা আমার বেশ লাগে । কাপে চুমুক দিতেই পুরো শরীর টা যেনএকটু দুলে উঠলো । এমন চমৎকার কফি আমি আমার পুরো জীবনে খেয়েছি বলে মনে পড়লো না । আমার মনের ভেতর থেকে মুহুর্তের ভেতরেই সব দ্বিধা আর দ্বন্দ গায়েব হয়ে গেল । যে অস্বস্তিটা কাজ করছিলো সেটাও কেটে গেল ।
কফি শেষ করার সাথে সাথে একজন কোর্ট টাই পরা ভদ্রলোক আমার সামনে এসে বসে পড়লেন । মনে হল যে আমার কফি শেষ করার জন্যই তিনি বসে ছিলেন । আমার দিকে তাকিয়ে বলল, অপু তাহলে কাল থেকেই কাজ শুরু করে দাও !
কোন রকম ভনিতা না করেই তিনি কথাটা বললেন। আমি তার দিকে তাকালাম । বয়স খুব বেশি মনে হল না । খুব বেশি হলে ত্রিশ । তবে চেহারাতে কোন উজ্জল্য নেই । কেমন যেন একটা মন খারাপ করে ব্যাপার আছে । বিশেষ করে চোখ দুটো যেন বড় বেশি শান্ত । এক ভাবে তাকিয়ে থাকলে কেমন যেন লাগে !
লোকটা কথা বলার পর একটা কাগজ বের করে দিলেন আমার দিকে । তাকিয়ে দেখলাম একটা কন্ট্রাক্ট পেপার । সেখানে নানা রকম রুলস লেখা । কয়েকটা রুলস আমার দৃষ্টি কাড়লো । একটা কোন ভাবেই কোন কৌতুহল দেখানো যাবে না । কি ডেলিভারি করছি কিংবা কাকে করছি সেসব নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না । আরেকটা হচ্ছে খাবার ডেলিভারিতে দেরি করা যাবে না মোটেও । এক মিনিটও না !
আমি বললাম, ঢাকা শহরে আসলে সময় সময় কোথাও যাওয়াই মুসকিল । আপনি তো জানেন !
-সেটা নিয়েও তোমাকে খুব বেশি ভাবতে হবে না কারণ তোমার ডেলিভারি শুরু হবে রাত বারোটার পরে । রাস্তা ফাঁকা থাকবে ।
এবার আমি সত্যিই অবাক হয়ে গেলাম । রাত বারোটা ! তার মানে কি আমাকে সারা রাতই কাজ করতে হবে ? আর কে রাত বারোটার পরে অর্ডার দিবে শুনি !
লোকটা আবারও আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল, প্রতিদিন খুব বেশি ডেলিভারি করতে হবে না তোমাকে দুইটা থেকে তিনটা ! রাত তিনটার ভেতরেই সব কাজশেষ হয়ে যাবে! প্রতিটা ডেলিভারি প্যাকেটের গায়ে সময় ও ঠিকানা লেখা থাকবে সেগুলো ঠিক ঠিক সেই সময়েই পৌছাতে হবে ! একটুও যেন দেরি না হয় ! আবারও বলছি কোন ভাবেই দেরি করা যাবে না । বুঝতে পেরেছো কি?
আমি বললাম, জি।
লোকটা আবার বলল, পথে কোন সমস্যা হবে না । যদি সমস্যা হয় তাহলে সেটা তোমাকে আগে থেকে কিংবা ফোনের মাধ্যমেই জানিয়ে দেওয়া হবে !
আমি এই ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না । আমার যাওয়ার পথে কোন সমস্যা হলে সেটা এরা কিভাবে জানবে ? কে জান !
লোকটা আবারও বলল, আর যে কোন সমস্যাতে আমরা তোমাকে রক্ষা করবো । এটা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।
আমি এই লাইন গুলো কন্ট্রাক্টও দেখলাম । সেখানে বলা হয়েছে যে আমাকে সব রকম নিরাপত্তা দেওয়া হবে । এতো সুযোগ সুবিধা তো ভাল ভাল মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি গুলোও দেয় না । আর এরা কি না সামান্য একজন ডেলিভারি ম্যানকে দিচ্ছে ! আমি আর কিছু ভাবলাম না ! আর কিছু ভাবার নেইও । প্রতিদিন হাজার দুই টাকা মানে হচ্ছে এই দুঃসময়ে বেশ কিছু দিন নিশ্চিন্তে কেটে যাওয়া !
আমি ডেলিভারি বয় হয়ে গেলাম । নিজের সাইকেল ছিল । সেটা চেপেই কাজ শুরু করে দিলাম পরদিন থেকেই ।
জেনির কথায় আবার বাস্তবে ফিরে এলাম। জেনি বলল, তুমি কি বুঝতে পারছো আমাদের চাকরিটা ছেড়ে দিতে হবে ?
আমি এবার একটু বিরক্ত হলাম । তবে সেটা আমি মুখে প্রকাশ করলাম না । আমি চাকরিটা করছি মোট ৫৫ দিন । একদিনও মিস করি নি । এই ৫৫ দিনে আমার পকেটে এক লাখ দশ হাজার টাকা এসেছে । টাকা দিতে একটা দিনও তারা দেরি করে নি । এমন চমৎকার একটা চাকরি আমি কেন ছেড়ে দিবো শুনি !
আমি বললাম, কেন শুনি?
জেনি গলার স্বর একটু নামিয়ে বলল, শোন ওরা মানুষ না ! বুঝেছো ? ওরা মোটেও মানুষ না ! তুমি বুঝতে পারছো না !
আমি বললাম, কেন মনে হল যে ওরা মানুষ না ?
-আমি দেখেছি ওদের ! সত্যিই বলছি আমি ওদের দেখেছি !
আমি বললাম, তুমি নিশ্চয়ই কন্ট্রাক্টে সাইন করেছিলে ? মনে আছে ? সেখানে কি লেখা ছিল মনে নেই তোমার? তুমি কেন দেখেছো ?
জেনি যেন একটু সময়ের জন্য থেমে গেল । কিছু যেন মনে করার চেষ্টা করলো । তারপর বলল, শোন ওসব কথা বলে লাভ নেই । আমি ওদের আসল চেহারা দেখে ফেলেছি । ওরা মানুষ না । কি ভয়ংকর ওদের চেহারা ! আর খুব বোটকা গন্ধ ওদের শরীরে । এমন কি ওরা রেস্টুরেন্টেও আসে । ওদের গায়ের গন্ধ লুকানোর জন্য এক ধরনের সেন্ট ব্যবহার করে যাতে বাইরের মানুষ ওদের চিনতে না পারে !
আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না । কারণ আমার ঠিক একই অনুভূতি হয়েছে যখন আমি প্রথম প্রথম খাবার ডেলিভারি করতে গিয়েছিলাম । আমার সেদিনের কথা এখনও পরিস্কার মনে আছে । আমার চাকরির প্রথম দিন ছিল সেদিন । আমি ঠিক সময় মত হাজির হয়ে গেলাম রেস্টুরেন্টে । বারোটার বাজার কিছু সময় আগেই । রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলাম । সেই অনুভূতিটা মনের ভেতরে জেগে উঠলো । ভেতরে ঠিক সেই গত দিনের মত মৃদু আলো দেখতে পেলাম । আজকে দেখতে পেলাম আগের দিনের মতই দুরে একজন বসে আছে কফির কাপ হাতে নিয়ে । একটা টেবিলের উপরে এক কাপ কফি রাখা । কাউকে বলে দিতে হল না যে কফির কাপটা আমার জন্যই রাখা হয়েছে । আমি কোন বাক্য ব্যয় না করে সেই টেবিল চলে গেলাম । কোন দিকে না তাকিয়ে কাপে চুমুক দিলাম । মাথার ভেতরে একটা তৃপ্তির অনুভূতি বয়ে গেল । সত্যিই এই কফির কোন তুলনা হয় না । বেশ সময় নিয়েই কফি শেষ করলাম । কফি শেষ করতেই একজন এসে হাজির হল আমার সামনে । হাতে একটা প্যাকেট । আমার হাতে সেটা দিয়ে কফির কাপটা নিয়ে চলে গেল কোন কথা না বলেই ।
প্যাকেটটা বেশ ভারী । একটা বড় ডিকশনারী সাইজের প্যাকেট ! ভেতরে কি আছে কে জানে ! প্যাকেটটার উপরে একটা কাগজ টেপ দিয়ে আটকানো রয়েছে । সেখানে একটা ঠিকানা লেখা । ধানমন্ডির কাছেই । নিচে আমার জন্য কয়েকটা লাইন লেখা ।
প্যাকেটা ডেলিভারি দিয়ে ফেরৎ আসবে । পেমেন্ট আগেই দেখা হয়েছে । রাত দেরটার আগে পৌছানো চাই । একটুও যেন দেরি না হয় !
আমি কাধে করে একটা ব্যাগ নিয়ে এসেছিলাম । প্যাকেটটা ব্যাগে ভরে নিলাম । তারপর নিচে সাইকেল নিয়ে রওয়ানা দিয়ে দিলাম । ঠিকানাটা গুগল ম্যাপসে এন্টার করতেই একেবারে পয়েন্ট আকারেই ঠিকানাটা পাওয়া গেল । আমি মোবাইলটা মোবাইল ক্যারিয়ারে সেট করে সাইকেল চালাতে শুরু করলাম ।
একটার বাজার কিছু পরেই আমি বাড়ির সামনে এসে হাজির হলাম । বাড়ির সামনে এসে খানিকটা চমকাতে হল আমাকে । ঠিকানা দেখে নিশ্চিত হলাম যে আমি সঠিক স্থানেই এসেছি। আমি ভেবেছিলাম ধানমন্ডির ভেতরে বাসা যেহেতু নিশ্চয়ই অনেক আধুনিক বাড়ি হবে । কিন্তু এই বাড়িটা মোটেই আধুনিক নয় । একেবারে পুরানো এক তলা বাড়ি । পুরো বাড়িটা উচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা । তবে গেটটা একটু নিচু । সেটা দিয়েই বাড়ির ভেতরটা দেখা যাচ্ছে । গেট দিয়ে বেশ কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলে বাড়িটা । বাড়ির সামনে বেশ কিছুটা ফাঁকা স্থানে নানান গাছপালায় ভরে আছে । গেটের বাইরে থেকেও আমি অযত্নের ছাপ দেখতে পাচ্ছি। গেটের ঠিক সামনেই একটা ৬০ পাওয়ারের আলো জ্বলছে । পুরো বাড়ি অন্ধকার । আর কোন আলো নেই। নেই কোন আওয়াজ।
আমি কিছু সময় বোকার মত তাকিয়ে রইলাম বাড়িটার দিকে । যদিও রাস্তার পাশেই বাড়ি এবং আশে পাশে আরও বেশ কিছু উচু উচু বিল্ডিং রয়েছে তবে এই বাড়ির ভেতরে ঢুকতে কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগলো । গেটের কাছে কি কেউ আছে ?
আমি সাইকেলটা দাড় করিয়ে দু একবার ডাক দেওয়ার চেষ্টা করলাম ।
কেউ আছেন ?
ফুড সার্ভিস ! অর্ডার এসেছে !
কোন আওয়াজ এল না ! কি করবো বুঝতে পারলাম না । এভাবে চলে যাওয়ার তো কোন উপায় নেই । গেট দিয়ে কি ঢুকবো ভেতরে ?
মন সায় দিল না । কারণ এই ভাবে রাতের বেলা কারো বাড়ির গেট দিয়ে ঢোকাটা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না । চোর বলে পুলিশে দিতে পারে ! তবে যেহেতু অর্ডার এসেছে তার তো জেগে থাকার কথা ! তারপরেও ভেতরে ঢুকতে সাহস হচ্ছে না ।
আবার চলেও যেতে ভরশা পাচ্ছি না । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি একটা বিশ বেজে গিয়েছে । দেড়টা বাজতে আর বেশি সময় বাকি নেই।
উপরওয়ালার নাম নিয়ে গেটে মৃদুভাবে হাত দিলাম । আমাকে খানিকটা অবাক করে দিয়েই গেটটা খুলে গেল । গেট বন্ধ নয় । ধীরে ধীরে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলাম । অন্ধকার রাত । চারিদিকটা একেবারে সুনশান নিরব। বাড়ির সামনে দিয়ে একটা পাকা রাস্তা চলে গেছে যদিও এটা প্রধান রাস্তা না । ধানমন্ডির আবাসিক এলাকার রাস্তা । বাড়িটা একেবারে শেষ মাথায় । আশে পাশে বড় বড় অনেক বিল্ডিং রয়েছে । তবে এই বাড়ির ভেতরটা যেন অন্য কোন জগতের । বেশ কিছু গাছ পালা রয়েছে । উপরের দিকে তাকালে বলতে গেলে কিছুই দেখা যায় না ।
আমি গাছে ঘেরা বাড়ির লনের রাস্তা দিয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে চললাম । চারিদিকে উচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা । তার উপরে আবার কাঁটা তার দেওয়া । মানুষজনকে বাড়ি থেকে দুরে রাখার জন্যই এই ব্যবস্থা । অথচ বাড়ির গেট খোলা ! আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না ব্যাপারটা । অন্তত একটা দারোয়ান তো থাকার কথা গেটে ! হাটছি আর চারিদিকটা আরও ভাল করে দেখছি । গেটের কাছের আলো এতো দুর এসে ভাল ভাবে পৌছায় না । বাড়ির ভেতর থেকে কোন আলো আসছে না । তবে এই অন্ধকারের ভেতরেও চারিদিকে অযত্নের ছাপ বোঝা যাচ্ছে স্পষ্ট ! অনেক দিন কেউ বাগানের পরিচর্যা করে না । গেট থেকে বাসা পর্যন্ত রাস্তাটাও পরিস্কার করে না কেউ । বাসায় কি কেউ থাকে না ?
আমি কি পরিত্যাক্ত এক বাড়িতে চলে এসেছি ?
কিন্তু ঠিকানা যা দেওয়া আছে আর বাড়ির নাম্বারটা রয়েছে সেটা থেকে তো ভুল হওয়ার কথা না !
তবে গেট দিয়ে এই পর্যন্ত আসতে আমার মনে একটা অনুভূতি খুব তীব্র ভাবেই কাজ করছে । সেটা হল কেউ আমার দিকে তাকিয়ে আছে । আমার প্রতিটা পদক্ষেপ যেন সে লক্ষ্য করছে ! কোথা থেকে লক্ষ্য করছে সেটা আমার জানা নেই তবে কেউ দেখছে আমাকে !
আশে পাশের কোন বিল্ডিং থেকে কি ?
আমি জানি না ! মনের ভেতরে সেই ভয়টা আস্তে আস্তে বাড়ছে । কিছুতেই শান্ত করতে পারছি না । এই ভয়টা আমি কেন পাচ্ছি কে জানে ! আমার কি এখনই চলে যাওয়া উচিৎ এখান থেকে ?
হঠাৎই একটা শব্দ হল !
শুকনো পাতা মাড়িয়ে কেউ এগিয়ে আসছে । বুকের ভেতরটা ধরাৎ করে উঠলো । এমন একটা নির্জন বাড়িতে কেউ যদি আমার উপরে হামলা করে বসে তাহলে হয়তো আমার লাশও খুজে পাওয়া যাবে না ।
ঐ তো ! আরেকবার !
আরেকবার হল আওয়াজ টা !
আমি দৌড় দিতে যাবো তখনই দেখতে পেলাম তাকে । অন্ধকারের ভেতরেও জ্বলজ্বল করছে চোখ দুটো ! আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে ! আমি দৌড়াতে যাবো তখনই ব্যাপারটা বুঝে ফেললাম !
একটা বেড়াল !
আমার দিকে আছে । আমি বেড়ালটাকে চিনতে পেরেছি এটা জানান দিতেই সেটা মিয়াও বলে ডেকে উঠলো !
আমি কিছুটা সময় বোকার মত সেটার দিকে তাকিয়ে রইলাম ! তারপর আবারও প্রধান বাড়ির দিকে হাটা দিলাম !
যখন দরজার কাছে এসে দাড়ালাম তখনও ৫ মিনিট বাকি আছে । মোবাইলের আলো জ্বেলে দরজাটা ভাল করে দেখলাম ।
নাহ !
এই দরজা নিয়মিত খোলা হয় !
অন্তত দিনে একবার হলেও কেউ এটা খোলে । তার মানে ভেতরে লোক থাকা খুব সম্ভব ! পাশের কলিংবেল দেখতে পেলাম ।
আমি আর খুব একটা চিন্তা না করে কলিংবেলে চাপ দিলাম ।
একবার !
দুবার ।
তারপর আরেকবার !
আরেকবার চাপ দিতে যাবো ঠিক তখনই দরজার ওপাশ থেকে একটা গাঢ় আওয়াজ ভেসে এল !
পার্সেল দরজার সামনে রেখে চলে যাওয়া !
আওয়াজটা এতোটাই আকস্মিৎ এল যে আমি খানিকটা চমকে উঠলাম । আরেকটু হলে আমার হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে যেত । তবে সামলে নিলাম । সাথে সাথেই একটা তীব্র বোটকা গন্ধ নাকে এল ! গন্ধটা দরজার ওপাশ থেকে আসছে সেটা আমার বুঝতে কষ্ট হল না !
গন্ধটা পরিচিত মনে হল বেশ । একটু আগেই আমি ডাস্টবিনের সামনে দিয়ে এসেছিলাম । অনেক দিনের পচা ডাস্টবিন পরিস্কার করতে গেলে যেরকম গন্ধ বের হয় ঠিক সেই রকম গন্ধ ।
এরা কি গোসল করে না নাকি !
নাকি বাড়ির ভেতরটা ডাস্টবিন বানিয়ে ফেলেছে !
কে জানে !
যাক আমার কি !
আমি প্যাকেটটা দরজার কাছে রেখে কয়েক মুহুর্ত দাড়িয়ে রইলাম । ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কি করবো । আশা করেছিলাম যে দরজা হয়তো খুলে যাবে । তবে সেটা খুলল না । পাশে একটা বেড়াল দেখেছি । বেড়ালটা যদি এসে খেয়ে নেয় !
নিক ! আমার সেটা চিন্তা করার দরকার নেই । আমাকে পার্সেল রেখে চলে যেতে বলা হয়েছে । বেড়াল খেল কি কুকুর খেল সেটা আমার দেখার বিষয় না !
আমি আর দাড়ালাম না । গেটের দিকে হাটা দিলাম । গেট দিয়ে যখন বের হয়েছি তখনই পেছন থেকে দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম । চারিদিকে এতো সুনশান নিরবতা বিরাজ করছে যে আওয়াজটা আমি পরিস্কার শুনতে পেলাম । খুব ইচ্ছে হল যে আমি একটু ফিরে যাই কিন্তু সেই কৌতুহলটা দমন করে নিলাম । চাকরীর প্রধান শর্তই হচ্ছে কৌতুহল দেখানো যাবে না ।
পরের দিন আবারও নির্ধারিত সময়ে পার্সেল নিতে গেলাম । রেস্টুরেন্টে দেখি আবার জন্য আবারও এক কাপ কফি অপেক্ষা করছে । দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো যে সদ্যই টেবিলে এনে রাখা হয়েছে। যেন তারা ঠিকই জানতো আমি এখনই এসে হাজির হবে । আজকে কফির কাপের সাথে একটা নীল খাম রয়েছে । খামটা খুলতেই সেখান থেকে চকচকে দুটো এক হাজার টাকার নোট বের হয়ে এল । আমার মনটা ভাল হয়ে গেল । মনের ভেতরে একটা সুক্ষ ইচ্ছে কাল রাত থেকেই কাজ করছিলো যে আজই আমি চাকরিটা ছেড়ে দেব কিন্তু চকচকে নোট দুটো দেখে সেই ইচ্ছেটা একেবারেই চলে গেল ! আমাকে তো আস্বস্ত করা হয়েছেই যে আমার কোন ক্ষতি হবে না যদি আমি কোন প্রকার কৌতুহল না দেখাই ।
গত দিনের মত আজও দেখতে পেলাম একজন কফি খাচ্ছে একেবারে পেছনের একটা টেবিলে । এবং সেই অনুভূতিটা আজও আমার হল যে সে আমার দিকে মাঝে মাঝেই তাকাচ্ছে । যথারীতি কফি খাওয়া শেস হওয়ার সাথে সাথে সেই ওয়েটার লোকটা এসে হাজির । হাতে পার্সেল । বিনা বাক্য ব্যয়ে সেটা দিয়ে খালির কাপ নিয়ে চলে গেল ।
প্রথম প্রথম আমি যখন নতুন কোথাও পার্সেল পৌছাতে যেতাম, আমার মনে একটা ভয় কাজ করতো । বেশির ভাগ পার্সেলের ঠিকানাই হত নির্জন কোন বাড়ি । আজ পর্যন্ত নতুন এপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে আমি কোন পার্সেল দিতে যায় নি । প্রথম দিনের সেই বাড়িটাতে সপ্তাহে একবার গিয়েছি । প্রতিবারই সেই কালো বেড়ালটার সাথে আমার দেখা হয়েছে । চার-পাঁচতলা বিল্ডিংয়ে পার্সেল পৌছেছি বেশ কয়েকবার তবে সেই বিল্ডিং গুলো সবই পুরানো । এই রেস্টুরেন্টের কাস্টোমারেরা যেন নতুন বিল্ডিংয়ে থাকেই না ।
এবং প্রতিবারই আমি যখন গেটের কাছে পার্সেল নিয়ে গেছি, প্রতিবারই গেটের ওপাশ থেকে আমাকে কেউ বলেছে পার্সেল যেন আমি গেটের কাছে রেখেই চলে যাই । আজ পর্যন্ত আমি কোন কাস্টোমারের চেহারা দেখি নি । কেবল কন্ঠস্বর শুনেছি ।
কেবল একটা বাক্যই ।
দরজার সামনে পার্সেল রেখে চলে যাও ।
আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, স্থান আলাদা হলেও সব গুলো স্থানেই গলার ভয়েজ যেন আমার কাছে একই মনে হয়েছে । মনে হয়েছে যেন এখই লোক ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে আমার কাছ থেকে পার্সেল গ্রহন করছে । গলার স্বর গাঢ় আর থেবড়ানো । কোন মানুষের গলার স্বর যে এমন হতে পারে সেটা আমার ধারনার বাইরে ছিল । প্রথম প্রথম আমার বেশ ভয়ভয় করতো । তবে সপ্তাহ দুই যেতে না যেতেই আমার ভয়টা আস্তে আস্তে কমে এল । আর প্রতিদিন দুই এক হাজার টাকার নোট আসছিলো পকেটে । এটাও ভয় কাটাতে সাহায্য করলো বেশ ।
প্রথম প্রথম একটা করে ডেলিভারি থাকলেও আস্তে আস্তে সেটা বাড়তে থাকলো । একটা থেকে দুইটা, দুইটা থেকে চারটা । সাইকেল নিয়ে আমার সামলাতে হিমসিম খাচ্ছিলাম । কারন ডেলিভারি শেস করতে হত তিনটার আগেই । বারোটা থেকে তিনটা ।
বিশ দিনের মাথায় আমাকে রেস্টুরেন্ট থেকে একটা স্কুটি কিনে দেওয়া হল । আমার কাজে তারা খুবই সন্তুষ্ট । তারা চায় আমি যেন তাদের সাথে দীর্ঘদিন কাজ করি । বছর খানেক এখানে কাজ করলেই এই স্কুটিটা আমার হয়ে যাবে । আমাকে কেবল শর্ত মেনে কাজ করে যেতে হবে ।
এতো ভাল একটা চাকরি, আর এই মেয়ে বলে কিনা ছেড়ে দিতে !
জেনি আমার দিকে অনুনয় করে বলল, প্লিজ তুমি চাকরিটা ছেড়ে দাও ! এরা মানুষ না !
আমি জেনির দিকে তাকিয়ে বললাম, আচ্ছা তুমি কি দেখেছো আমাকে বল !
জেনি এদিক ওদিক তাকিয়ে নিল একটু ! তারপর আমার দিকে আরও একটু এগিয়ে এল । তারপর বলল, তুমি জানো যে পার্সেল আমরা নিয়ে যাই তার ভেতরে কি আছে ?
আমার মনে যে কৌতুহল হয় নি এমন না । অনেকবার মনে হয়েছে যে একটু প্যাকেটা ফুটে করেই দেখি ভেতরে কি আছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা আর করা হয় নি । কি দরকার বাবা ! ওরা তো বলেছেই যে ভেতরে কোন অবৈধ জিনিস পত্র নেই । তাহলে আর কি সমস্যা !
জেনি আবারও আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি জানো ঐ পার্সেলের ভেতরে কি থাকে ?
প্রশ্নটা করবো না করবো না করেও, করেই ফেললাম, কি থাকে ?
শেষ পর্ব
ব্লগার কল্পদ্রুম এর গল্পানুঃ দশচক্রের তিন চক্র এর প্রথম অনু গল্প ক্ষুধা থেকে এই গল্পের সুচনা ।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০২০ রাত ১০:৫১