রাত্রীর চেহারার দিকে তাকিয়েই নীলের বুঝতে কষ্ট হল না যে আজকে চেম্বারে কিছু হয়েছে । এই জন্য ওর মেজাজটা খারাপ । তাই নিজেকে আগে থেকেই সামলে নিল । বুঝতে কষ্ট হল না যে আজকে কথা বার্তা সাবধানে বলতে হবে নয়তো আরেকটা ঝড় বয়ে যেতে পারে । সবার আগে জানা দরকার রাত্রীর মেজাজ টা খারাপ হয়েছে কি কারনে । সেটা একবার জানতে পারলে ওকে সামলানো একটু সহজ হবে ।
-কি ব্যাপার সব ঠিক আছে ?
সাহস করে কথাটা বলেই ফেলল । রাত্রী ওর দিকে তাকিয়ে আবার নিজের কাজেমন দিল । তারপর বলল
-আচ্ছা যদি আমরা পুরো দিনের কুসংস্কারেরই বিশ্বাস করবো তাহলে এতো শিক্ষা এতো জ্ঞান বিজ্ঞানের দরকারটা কি ?
নীল বুঝতে পারলো আজকে চেম্বারে আবারও অন্য রকম কিছু হয়েছে । আবারও কোন রোগী এসে ডাক্তারী চিকিৎসার থেকে দেশী কুসংস্কারের উপরে বেশি আস্থা রেখেছে । নীল উঠে গিয়ে রাত্রীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো । মনে একটু ভয় ছিল হয়তো ও একটু রাগ করবে কিংবা নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে কিন্তু তেমন কিছুই করলো না । নীল আরও একটু প্রশ্রয় পেয়ে বলল
-সবাই তো আর তোমার মত ধারায় বিশ্বাসী হবে না । সেটা তো পারবেও না । এর চেয়ে বরং তাদের চিন্তা ভাবনাকে তাদের উপর ছেড়ে দাও । এখন আসো আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ন কাজ কর্ম করি !
রাত্রীর মুখে এবার হাসি ফুটলো । ওকে খানিকটা দুরে সরিয়ে দেওয়ার মত করে বলল
-দুষ্টামী করবা না এখন । এখন কাজের সময় !
নীল বলল
-মানে কি ? কেবলই না চেম্বার থেকে এলে । আবার কেন ?
-আর বল না । ঐশির কথা মনে আছে ?
-ঐ যে কোন শিল্পপতির মেয়ে ! যার এক ইমাজিনারি ফ্রেন্ড রয়েছে । এখন সেটাই মেয়েটাকে ডিস্টার্ব করছে ।
রাত্রী খানিকটা চোখ রকম করে বলল
-ইমাজিনারী ফ্রেন্ড হলে আবার ডিস্টার্ব করে কিভাবে ? তুমিও দেখি ওদের মতই কথা বলছো !
-আচ্ছা বাবা সরি । এখন বল কি সমস্যা ?
-আমি ঐ মেয়েটাকে দেখছিলাম । বেশ কয়েকদিন কাউন্সেলিং করছিলাম । আর কয়েকটা সিটিং নিলেই সব ঠিক হয়ে যেত । কিন্তু মেয়ের মা নাকি কোন ভুতের ওঝার সন্ধান পেয়েছে । সেই লোক নাকি খুব কাজের । সে এই সব ঝামেলা দুরকরে দিবে ! এখন এই শিক্ষিত লোকেরাই যদি এমন মনভাব পেষণ করে তাহলে বল তো কি হবে !
নীল একটু চুপ করে থেকে বলল
-তুমি ঐ মেয়ের মায়ের দিকটা একটু চিন্তা কর । আসলে মা তো তাই যে কোন ভাবেই মেয়েকে সুস্থ দেখতে চায় ।
-তাই বলে এই কাজ করবে ?
নীল কি বলবে আর খুজে পেল না । রাত্রী বলল, আজকে নাকি ঐ লোক আসবে । আমি এই সময়ে থাকতে চাই ওর সাথে । না জানি লোকটা বাচ্চা মেয়েটার সাথে কি করবে !
নীল হঠাৎ বলল, আমি আসবো তোমার সাথে ?
-কেন ?
-না মানে তুমি রাতে একা একা আসবে আমার একটা চিন্তা হবে । আর তাছাড়া মানে আর কি .... বুঝোই তো আমারও ভুতের ওঝা দেখার অনেক শখ !
রাত্রী হেসে ফেলল । তারপর বলল, আচ্ছা চল সমস্যা নেই । তৈরি হয়ে নাও ।
রাত্রী আর নীল যখন ঐশিদের বাসায় পৌছালো তখন রাত একারোটা বেজে গেছে । বাড়ির চাকর জানালো যে যার আসার কথা ছিল সে চলে এসেছে । ওদেরকে সরাসরি ঐশির ঘরেই নিয়ে যাওয়া হল । সেখানে আগে থেকেই ঐশির বাবা আর মা ছিল । ঐশি বসে ছিল ওর খাটের উপর । চুপ করে । আর একটা সোফার উপর বসে ছিল আরেকটা মানুষ ।
নীল মানুষটাকে দেখে বেশ অবাক হল । ভুতের ওঝা বলতে যা ও এতো দিন যা দেখে এসেছে এই ভুতের ওঝা একদমই সেই রকম না । বরং আধুনিক পোষাক পরিচ্ছদ পরা একটা ছেলে । দেখলে মনে হয় কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র । মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি । পরনে কালো শার্ট আর কালো জিন্স । হাতে একটা কালো রংয়ের ঘড়িও দেখা যাচ্ছে ।
হঠাৎ ছেলেটা বলল, ঐশি তোমার ঐ ফ্রেন্ড এসছে ?
ঐশি বলল, হুম !
-কোথায় সে ?
ঐশি একটু পেছন ফিরে তাকালো । খাটের পেছনের বারান্দায় যাওয়ার দরজার । ওখানে পর্দা রয়েছে । ঐশি বলল
-এই তো পর্দার আড়ালে দাড়িয়ে রয়েছে । সামনে আসছে না । ও তোমাকে পছন্দ করছে না ।
ঘরের সবার চোখ বারান্দার পর্দার দিকে চলে গেল । পর্দাটা এখনও নড়ছে বাতাশে । সেই নড়ার কারনে নীল একটা আয়বয় পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে । গায়ের রং কালো কুচকুচে । সেই সাথে লাল চোখটা দেখা যাচ্ছে । নীলের বুকটা কেঁপে উঠলো সাথে সাথেই । কারণ পার্দার আড়ালের সেই প্রাণীটা এখন ওর দিকেই তাকিয়ে আছে । প্রাণীটা বুঝতে পেরেছে নীল তাকে দেখতে পাচ্ছে ।
কিন্তু একটু পরেই সেই প্রাণীটার পুরো শরীরে একটা কাঁপন শুরু হল । সে যেন কিছু একটা দেখে খুব বেশ ভয় পেয়েছে । পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে । কিন্তু পারছে না ।
নীল তাকিয়ে দেখলো কালো পোষাক পরা মানুষটার হাতে একটা হলুদ লেবুর মত ফল চলে এসেছে । সেটা ও আস্তে আস্তে ঐশির দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে । ঐশির লেবুর মত ফলটা ধরতেই নীল দেখতে পেল পর্দার আড়ালের প্রাণীটা কেমন একটা চিৎকার দিল । তারপর বারান্দা দিয়ে কালো অন্ধকারের ভেতরে লাফ দিল ।
ঐশি বলল
-রাফায়েল আঙ্কেল ও চলে গেছে ।
-সত্যিই ? আমি ওকে আর পছন্দ করি না । ও চলে গিয়ে ভাল করেছে ।
লোকটা এবার হাসলো । তারপর বলল
-এই ফলটা সব সময় তোমার বালিশের পাশেই রাখবে । কেমন ! হারায় না যেন !
রাত্রী এতো সময় বিরক্ত নিয়ে অপেক্ষা করছিল । এবার নিজেই ঐশির দিকে এগিয়ে গেল । ওর হাতের পালস চেক করলো । রাত্রী জানেও না ওর আসার আগে এই রাফায়েল নামের লোকটা ওদের সাথে কি করেছে । তবে রাফায়েল নামের মানুষটার সাথে ওর একবার চোখাচোখী হয়েছে । লোকটা তীক্ষ চোখ দেখে বেশ অবাক হয়েছে । ওর বুঝতে কষ্ট হয় নি লোকটা চোখ দিয়ে মানুষকে সহজেই কাবু করতে পারো । হয়তো সম্মোহোন করে ফেলতে পারে । সেটাই করেছে ঐশি কে ! রাত্রীকে পরীক্ষা করা শেষ হলে ওর বাবা মা ঐশির কাছে গিয়ে দাড়ালো । রাত্রী তখন রাফায়েলের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো
-আপনার কাজ শেষ ?
রাফায়েল একটু হাসলো । তারপর বলল
-আপাতত আমার কাজ শেষ !
-সব কিছু ওকে ?
-এখনই না । তবে আপাতত একটা সমাধান করা গেছে । আপাতত ওটা আসবে না ।
নীল তখনও তাকিয়ে আছে রাফায়েলের দিকে । মানুষটা এখনও ওর দিকে একবারও তাকায় নি । রাফায়েলের চেহারার ভেতরে একটা অস্বাভাবিকত্ব আছে । একবার তাকালেই সেটা বুঝতে পারা যায় কিন্তু রাত্রী সেটা বুঝতে পারছে না । রাত্রী এখন তীব্র বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে রাফায়েলের দিকে । তবে মুখে কিছু বলছে না । নীলও চুপ করে তাকিয়ে আছে । এমন হঠাৎ করেই রাফায়েল নীলের দিকে তাকালো । এবং ওর দিকে বেশ কিছুটা সময় তাকিয়ে রইলো । নীলের কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগলো । এতো সময় পরে নীল আরও পরিস্কার ভাবেই বুঝতে পারলো যে রাফায়েল নামের মানুষটার ভেতরে আসলেই একটা অস্বাভাবিকত্ব আছে । বিশেষ করে এতো তীক্ষ্ম চোখ কোন মানুষের হতে পারে না ।
একটা সপ্তাহ কেটে গেল। রাত্রী একদিন সন্ধ্যাবেলা চেম্বার থেকে ফিরে এল তখন ওর মুখটা বেশ গম্ভীর মনে হল । এতো গম্ভীর কেন সেটা জানতে চাইলেই রাত্রী বলল
-তুমি কি আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছো ?
নীল খানিকটা অস্বস্থি নিয়ে বলল
-মানে ? কি লুকাবো ?
-প্রশ্নের উত্তর প্রশ্ন দিয়ে দিবে না । যা জানতে চেয়েছি তাই উত্তর দিবে ।
-মানে না !
-সত্যিই করে বল । ঐদিন ঐশীদের বাসা থেকে আসার পর থেকেই তোমার মাঝে একটা অস্বাভাবিকত্ব আমি দেখতে পাচ্ছি । দয়া করে লুকানোর চেষ্টা করবা না । তুমি খুব ভাল করেই জানো যে মানুষের আচরন বিশ্লেষণ করা আমার কাজ !
নীল কি বলবে খুজে পেল না । রাত্রীর কাছে মিথ্যা কথা সে বলতে পারবে না । কিন্তু যে কথাটা সে বলতে চাচ্ছে সেটাও বলতে সাহস পাচ্ছে না । ও ঠিক জানে না যে রাত্রী এই কথাটার বিপরীতে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে । কিন্তু কিভাবে বলবে কথাটা ওকে ?
নীল বলল, তুমি ঠিক বিশ্বাস করবে না ।
-ট্রাই মি ।
নীল আরও কিছুটা সময় চুপ করে রইলো । তারপর বলল, ঐশিদের বাসায় গিয়েছিলাম আমরা মনে আছে ?
-হ্যা খুব ভাল করেই মনে আছে । ঐ ফ্রডটা কি সব বুজরুকি কাজ করছিলো সবার সাথে তুমিও অবাক হয়ে দেখছিলে । তাই না ?
-সে ফ্রড না ।
-কিভাবে জানো তুমি ?
-ওয়েল, ঐশি যে ইমাজিনারি ফ্রেন্ড আসলে এতোটা ইমাজিনারি নয় । আমি নিজেও সেটাকে দেখতে পেয়েছি !
-ওহ! কাম আন ! কি যা তা বলছো ?
-সত্যিই বলছি ! বিলিভ মি ! সেই কালো কুচকুচে মুখটা আমি পরিস্কার দেখতে পেয়েছি । এবং ঘটনাটা এখানেই শেষ নয় !
-বাহ ! আরও আছে ?
-হ্যা ! সেই মুখটা এখন নিয়মিত ভাবে আমাকে দেখা দিতে শুরু করেছে !
রাত্রী কিছুটা সময় নীলের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো । সেই বিস্ময় ভাবটা কিছু সময় পরেই বিরক্তির দিকে মোড় নিল । রাত্রী বলল, এটা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে ?
-বিশ্বাস করবে না, এই জন্যই তোমাকে আমি বলতে চাই নি ।
নীল আর কিছু বলল না । ও খুব ভাল করে জানে রাত্রী এসব কোন ভাবেই বুঝতে পারবে না । বিশ্বাস করবে না । কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারছে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে । ওর ওখানে ওভাবে যাওটাটা মোটেও ঠিক হয় নি । গত কয়েকদিন ধরেই সেই কালো চেহারাটা ওর চোখের সামনে এসে হাজির হচ্ছে । তবে একেবারে সামনে আসছে না । আড়ালে আবদালে ওর আশে পাশে ঘোরাঘুরি করছে । যেন দুর থেকে ওর উপর নজর রাখছে ।
হ্যা এই কথাটাই মনে হয়েছে ওর । সেই কালো চেহারাটা ওর উপর নজর রাখছে । কিন্তু কিসের জন্য নজর রাখতে সেটা নীলের মোটেই বধগম্য হচ্ছে না । তবে নীল তাকে দেখতে পাচ্ছে । বেশ ভাল ভাবেই দেখতে পাচ্ছে । মনের ভেতরে একটা ভয় উকি দিচ্ছে । মনে হচ্ছে কোন একটা বিপদ আসতে যাচ্ছে তার সামনে । কিন্তু কি সে বিপদ সেটা বুঝতে পারছে না ।
এই ব্যাপারটা এমনই একটা ব্যাপার যে রাত্রীর সাথে এটা কোন ভাবেও আলোচনা করা যাবে না । সেদিন একটু বলার চেষ্টা করেছিলো । রাত্রীর মুখের ভাব দেখেই বুঝতে পেরেছে যে এটা সে মোটেই পছন্দ করছে না । অবশ্য রাত্রীর স্থানে যদি নীল নিজে থাকতো তাহলে সেও হয়তো এমন আচরনই করতো । ওকে দোষ দিয়ে তো আর লাভ নেই । নিজের মন থেকে ব্যাপারটা দুর করে দেওয়ার চেষ্টা করলো সে অশরীরিটা তো ওর কাছে আসছে না । দুরে দুরে থাকছে । থাকুক !
দুই
অফিস আওয়ারে নীলের কাছে মানুষ জন খুব একটা আসে না । সত্যি বলতে ওর এখানে মোটেই কোন বন্ধুবান্ধব নেই । ছোট বেলা থেকে নীল বড় হয়েছে মালেশিয়াতে । ওর বাবা মা সেখানেই থাকতো । তবে বাবা মায়ের কাছ থেকে সে শুনেছে যে নীলের জন্ম হয়েছে এই বাংলাদেশেই । রবিনগর নামের এক গ্রামে । তবে সেসব এখন আর নেই । নীলের বাবা ফরিদ আহমেদ সে সব কিছু বিক্রি করে দিয়ে পাড়ি জমান মালেশিয়াতে । কেন যে এই দেশ ছেড়ে একেবারে বিদেশে পাড়ি জমান সেটা নীলের কাছে ঠিক বোধগম্য নয় । হয়তো উন্নত জীবনের খোজে । নীলের জন্য একটা ভাল জীবন খুজতেই তিনি সেটা করেছিলেন । নীলও ব্যাপারটা মেনে নিয়েছিলো । নিজের দেশ বাংলাদেশের প্রতি ওর খুব একটা আকর্ষন ছিল না কোন কালেই । এদিকে আসার কোন ইচ্ছে ছিলো না।
তবে সব হিসাব উল্টে গেল রাত্রীর কারণে । রাত্রীর পড়াশুনা ছিল মালেশিয়াতেই । সেখানেই দুজনের ঘনিষ্ঠতা । রাত্রীর নীলকে বিয়ে করতে কোন আপত্তি ছিল না । তবে রাত্রী কোন ভাবেই মালেশিয়াতে থাকবে না । সে দেশেই ফিরে যাবে । নীল যদি তাকে বিয়ে করতে চায় তাহলে তাকে বাংলাদেশে যেতে হবে ।
একেবারে নতুন একটা দেশে গিয়ে হাজির হওয়া নিয়ে নীলের মনে একটা সংশয় ছিল । তবে তার কোন পিছু টান ছিল না । নীলের বাবা আর মা ততদিনে নীলকে ছেড়ে চলে গিয়েছে না ফেরার দেশে । আমরেরিকা থেকে ফেরার পথে এক প্লেন ক্রাশে তারা মারা যায় । নীলের তখন কাছের মানুষ বলতে কেবল রাত্রীই । নীল যে কোম্পানীতে চাকরি করতো সেটার শাখা অফিস ছিল এই দেশেই । আর আসলে কোন বাঁধা থাকলো না এই দেশে আসতে । নীলের বিয়ে আর এই দেশে এসে সব কিছু মানিতে নিতে নিতে বছর খানেক পার হয়ে গেল । সময় যে ওর খারাপ যাচ্ছে সেটা বলবে না । তবে মাঝে মাঝে বাবা মায়ের কথা মনে পড়ে । আর জানতে ইচ্ছে করে তার আদি নিবাসটা কোথায় ? যদিও সেখানে এখন আর কিছু নেই তবে একটু দেখে আসতে মন চায় । কিন্তু কোন কিছুরই খোজ সে বের করতে পারে নি ।
আজকে যখন কাজ করার সময় পিয়ন এসে বলে গেল যে তার কাছে একজন গেস্ট এসেছে তখন একটু অবাকই হল । ওর সাথে যাদেরই দেখা হয় সবাই ওর অফিস সংক্রান্ত কাজে । সেটা হলে সাধারনত আগেই ওকে জানানো হয়, এপোয়েন্টমেন্ট নিয়ে তারপর দেখা হয় । কিন্তু এইভাবে আবার কে এল ? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে প্রায় একটা বেজে গেছে । একটু পরেই লাঞ্চ ব্রেক শুরু হবে । রাত্রী মাঝে মাঝে লাঞ্চ আওয়ারে চলে আসে এক সাথে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য । তবে আসার আগে ফোন দিয়ে আসে । আজকে কি ঐ এল ?
নীল পিয়ন কে বলল, রাত্রী এসেছে ?
-জি না । একটা যুবক এসেছে ।
-যুবক?
-জি । বলেছে যে আপনাকে তার প্রয়োজন !
একটু সময় চিন্তা করলো । তারপর বলল, আচ্ছা নিয়ে এসো ।
দরজা ঠেকে যখন গেস্টটা ওর কেবিনে ঢুকলো নীল সত্যিই একটু চমকে গেল ।
এই মানুষ !
মনে মনে এই মানুষটাকেই সে খুজছিলো ।
সেদিনের পর এই মানুষটকেই মনে মনে খুজছিলো !
যুবকটার নাম তার মনে আছে !
রাফায়েল ।
রাফায়েল খুব স্বাভাবিক ভাবেই নীলের টেবিলের সামনের চেয়ারটা চেনে বসলো । যেন এখানে তার অনেক দিনের আসা যাওয়া । নীল কি বলবে কিছুই খুজে পেল না । কি বলা উচিৎ সেটাও জানে না । এমনিতে নীল কথা বার্তায় দারুন স্মার্ট । মানুষের সাথে বেশ সহজেই কথা চালিয়ে যেতে পারে । কিন্তু এই রাফায়েল নামের মানুষটার চোখের ভেতরে কিছু একটা আসে । যেটা ওকে সহজেই কথা বলতে দিল না । কিছু একটা দ্বিধা যেন ওকে পেয়ে বসলো ।
রাফায়েল বলল, কেমন আছেন নীল সাহেব !
-জি ভাল আছি ।
-সত্যিই ভাল আছেন কি ?
নীলের তখনই মনে হল যে সামনে বসা এই মানুষটা তার ভেতরের খবর জানে । সে যে খানিকটা অশান্তিতে আছে সেটা সে বুঝতে পারছে এবং সম্ভবত এই জন্যই এখানে এসেছে । নীল খানিকটা ইতস্তত করে বলল, আসলে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কি হচ্ছে আমার সাথে !
রাফায়েল বেশ কিছুটা সময় নীলের দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর বলল, সামনে আপনার কোন বিপদ আসতে পারে ।
-কি বিপদ ?
-আসলে সেটা আমি জানি না । তবে আসতে পারে ।
-আপনি কিভাবে জানলেন ?
রাফায়েল বলল, আসলে কিভাবে জানি সেটা বোঝানো একটু শক্ত । তবে আমি বুঝতে পারছি যে আপনার কিছু সমস্যা হচ্ছে । আপনার ঐদিন ওখানে যাওয়াটা মোটেও ঠিক হয় নি । আমি যতদুর ধারনা করতে পারি আপনাকে মরা বাড়ি তারপর এই রকম অস্বাভাবিক স্থান গুলোতে যেতে মানা করা হয়েছে । আপনি শুনেন নি ।
নীলের তখনই ব্যাপারটা মনে পড়লো । সত্যিই তাই ।
তখন ওর বাবা মা বেঁচে ছিল । মালেশিয়াতে ওর বাবার পরিচিত এক আঙ্কেল মারা গিয়েছিলো । সেখানে নীল যেতেই চাইলেই ওর মা ওকে সেখানে যেতে মানা করেন । এমন এটা এর আগেও হয়েছে । ওর বন্ধুর দাদা মারা গেছে, সেই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে তাকে যেতে দেওয়া হয় নি । একদীন নীল ওর মাকে জিজ্ঞেস করলো তাহলে আমি কি তোমাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতেও যাবো না ?
ওর মা বলেছিলো কেবল আমাদের দুজনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে গেলে তোর কোন সমস্যা হবে না । কারণ তোর সাথে সাথে আমার শরীরটাও বন্ধ করে দেওয়া আছে । এখানে গেলে কোন সমস্যা হবে না । কিন্তু অন্য কারোটাতে গেলে শরীর বন্ধটা ভেঙ্গে যাবে । তখন বিপদ হবে ।
নীল তখন জানতে চেয়েছিলো কিসের বিপদ ?
সেটা তোকে জানতে হবে না । কেবল শুনে রাখ যে যাবি না । কথা দে !
-আচ্ছা মা দিলাম !
তারপর নীল অবশ্য আর কোন মরা বাড়ি, সিমেট্রে কিংবা করবস্থানের ভেতরে ঢুকে নি । নীল রাফায়েলের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি এই কথাটা কিভাবে জানলেন যে আমাকে মানা করা হয়েছিলো ?
-কারণ এটাই নিয়ম । শুনুন
এই বলেই পকেট থেকে সেদিনের মত একটা হলুদ লেবুর মত ফল নীলের হাতে দিল । তারপর বলল, এটা সব সময় কাছে রাখবেন । সব সময় । এমন কি যখন গোসল খানায় যাবেন এটা সাথে করে নিয়ে যাবেন । ঘুমানোর সময় এটা রাখবেন বালিশের নিচে । কি যে আপনার পেছনে লেগেছে সেটা আমি এখনও বুঝতে পারছি না । তবে সেটা যে ভাল কিছু নয় সেটা পরিস্কার বুঝতে পারছি । আগে আমাকে আসল সত্য জানতে হবে । তাহলে কিছু একটা করা যাবে । আপনি বুঝতে পারছেন কি ?
-জি !
-সাবধানে থাকবেন ।
এই বলেই রাফায়েল উঠে দাড়ালো । চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ।
-ইয়ে মানে ....
কথাটা বলতে গিয়েও নীল থেমে গেল । একটু যেন সংকোচ হচ্ছে । রাফায়েল একটু হাসলো । তারপর বলল, আপনার স্ত্রী আমাকে এমনিতেও দেখতে পারে না । এখন যদি বলি আমার সার্ভিসের জন্য টাকা লাগবে তাহলে নির্ঘাত আমার নামে কেস করে দিবে ।
-না না আমি আসলে ...
-ঠোট্টা করছি নীল সাহেব । আমি এই সব কাজের জন্য কোন টাকা নেই না । আমার টাকা পয়সার খুব একটা দরকারও পড়ে না ।
-তাহলে কেন এসব করেন ?
রাফায়েল এবার আরও একটু হাসলো । বলল, আমার জন্মই হয়েছে এই জন্য । সাবধানে থাকবেন । যতদ্রুত সম্ভব এটা সমাধান করতে হবে ।
রাফায়েল আর দাড়ালো না । দরজার দিকে হাটা দিল । নীল হলুদ ফলটার দিকে একভাবে তাকিয়েই রইলো । ফলটা দেখতে লেবুর মত হলেও সেটা আসলে লেবু নয় । ফলটার ত্বকটা আরও বেশি মসৃণ। নাকের কাছে নিয়ে এসে একটু গন্ধ শুকে দেখলো । গন্ধটাও লেবুর মত নয় । এটা কি ফল কে জানে । তবে এটাতে কাজ হবে সে জানে । ঐদিন ঐশিদের বাসাতে দেখেছিলো । ঐ কালো মত অশরীরিটা কিভাবে পালিয়ে গিয়েছিলো এই ফলটার কারনে । নীলের বুকে একটা সাহস চলে এল । যে অস্বস্তিটা কাজ করছিলো সেটা কমে এল । তবে রাত্রীর কাছ থেকে এটা দুরে রাখতে হবে । ও যদি দেখে তাহলে সমস্যা হতে পারে ।
একটা সপ্তাহ চলে গেল কোন রকম ঝামলে ছাড়াই । এই একটা সপ্তাহ নীল সব সময় এই ফলটা ওর কাছেই রেখেছে । যেখানে গেছে সেখানেই ফলটা সাথে করে নিয়ে গেছে । ছোট ফল হওয়ার কারণে নিয়ে যেতে খুব একটা সমস্যা হয় নি । কিন্তু আট নম্বর দিনে একটা ঝামেলা বেঁধেই গেল । ফলটা রাত্রী দেখে ফেলল । ফলটা নিয়ে সে ওয়াশ রুমে গিয়েছিলো । সেটা হাতে নিয়ে বাইরে বের হয়ে গেল । তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছার জন্য ফলটা রাখলো ড্রেসং টেবিলের উপরে । কখন যে রাত্রী ঘরের ভেতরে চলে সেটা নীল দেখতেই পেল না । আর প্রথমেই ওর চোখ পড়লো ফলটার উপর । এবং সাথে সাথেই সেটা চিনে ফেলল । রাত্রীর স্মৃতিশক্তি বেশ ভাল । সেদিন ঐফলটা সে দেখেছিলো । নীল কিছু বলতে যাবে তার আগেই রাত্রী সেটা ছো মেরে হাতে তুলে নিল । তারপর সেটা নীলের দিকে ধরে বলল, এটা কি নীল ?
-কিছু না । ওটা দাও আমাকে !
-আগে আমাকে বল এটা কি ? ঐ ভন্ডটা তোমার সাথে দেখা করেছিলো নাকি তুমি গিয়েছিলে ?
-এটা কি খুব বেশি জরূরী ? আমার উপকার হচ্ছে এটাই বড় কথা ।
রাত্রী বলল, আশ্চর্য হয়ে যাই আমি তোমার আচরনে ! তুমি একটা পড়াশোনা জানা মানুষ । তুমি এসবে বিশ্বাস কর ! আমার সত্যিই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে ।
নীল বলল, দেখো এসব নিয়ে তুমি এতো কিছু ভেবো না প্লিজ । সামান্য একটা ফল হাতে রাখার জন্য যদি আমার উপকার হয় তাহলে তাহলে রাখি । সমস্যা তো হচ্ছে না ।
রাত্রীর মুখটা এবার কঠিন হয়ে উঠলো । সে নীলের দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বলল, না । আামর ঘরে কোন কুসংস্কারের ঠাই নেই । এই বলে ফলটা সে জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলো । নীল চিৎকারে সেদিকে দৌড়ে যেতে লাগলো । তখনই ঘটলো ঘটনাটা।
রাত্রী কেবল চোখ বড় বড় তাকিয়ে রইলো । নিজের চোখকে যেন সে বিশ্বাস করতে পারছিলো না ।
তিন
রাত্রী কোন দিন ভাবে নি রাফায়েল নামের মানুষটার কাছে তাকে আসতে হবে । কিন্তু যখন চোখের সামনে সব চেষ্টা বিফল হতে শুরু করে তখন মানুষ যে পথ দেখতে পায় সেদিকেই পা বাড়ায় । নীলের সেদিনের কথা ওর মনে পড়লো খুব । মায়ের মন যেমন মেয়েকে সুস্থ দেখতে চায় যে কোন ভাবেই, রাত্রীও কেবল নীলকে এখন সুস্থ দেখতে চায় । তারপরেও ঐদিন চোখের সামনে ঐ ঘটনাটা ঘটে যাওয়াটা ও কিছুতেই ভুলতে পারছে না । ।
ও নিজে যখন হলুদ ফলটা ছুড়ে ফেলে দিল নীল তখন দৌড়ে জানালার দিকে যাচ্ছিলো । রাত্রী দেখতে পেল নীল মাঝ পথেই থেমে গেল । রাত্রীর কাছে কেবল মনে হল যেন অদৃশ্য কিছু একটা নীলের দেহকে ধাক্কা দিল শক্ত ভাবে । সেই ধাক্কার কারনেই নীল আবারও পেছনের দিকে উড়ে এসে পড়লো । রাত্রী অবাক চোখে কেবল তাকিয়ে রইলো সেদিকে । তখনও ঠিক বুঝতে পারছিলো না যে কি হল ! চোখের সামনে নীলের দেহ যেভাবে পেছনের দিকে উড়ে এল, সেটা ওর মাথার ভেতরে ঠিক ঢুকলো না । একজন মানুষের পক্ষে একা একা কোন ভাবেই নিজেকে এভাবে পেছনে ধাক্কা দিয়ে ফেলা সম্ভব না ।
মেঝেতে পড়ে গিয়ে নীল চোখ বন্ধ করে ছিল । সম্ভবত অজ্ঞান হয়ে গেছে । রাত্রী ধীরে ওর শরীর স্পর্শ করার সাথে সাথেই নীল চোখ মেলে তাকালো । তারপর রাত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । যেন রাত্রীকে ঠিক মত চিনতে পারছে না । তবে একটা সময় সে রাত্রীকে চিনতে পারলো । চিনতে পারতেই চিৎকার করে বলে উঠলো, রাত্রী, ও চলে এসেছে ।
রাত্রী তখন নিজেকে সামলে নিয়েছে খানিকটা । সে আরও খানিকটা কাছে এগিয়ে গেল নীলের । তারপর লক্ষ্য করলো নীল ভীত চোখে তাকিয়ে আছে ওর পেছনের দিকে । এমন একটা ভাব যেন ওদের পেছনে কেউ এসে দাড়িয়েছে । রাত্রী সাথে সাথেই পেছনে ঘুরে তাকালো । অথচ পেছনে কাউকে দেখতে পেল না । আবার যখন নীলের দিকে তাকালো দেখতে পেল নীল ঠিক একই ভাবে সেই আগের স্থানেই তাকিয়ে আছে । নীলের চোখে এই নির্মহ ভয়টা যে মিথ্যা নয় সেটা বুঝতে কষ্ট হল না । নীল কিছু একটা দেখতে পাচ্ছে । নীলের সম্ভবত হ্যালুসিনেশন হচ্ছে । রাত্রী ওকে কয়েকবার বুঝানোর চেষ্টা করলো কিন্তু কোন লাভ হল না ।
সারাটা রাত নীলের একই ভাবে কাটলো । ক্ষণে ক্ষণে তীব্র ভয়ে পেয়ে উঠছে । শেষে রাত্রী আর উপায় না দেখে নীলকে একটা ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে দিল । একটু পরেই নীল ঘুমে ঢলে পড়েছিলো । তবে ঐদিন রাতে রাত্রী অনুভব করলো যে ওদের বাসায় নীল আর ও ছাড়াও আরও একজন যেন রয়েছে। এই অনুভূতিটা সে কিছুতেই মন থেকে বের করে দিতে পারলো না । ও নিজের মন থেকে এই বিশ্বাসটা বের করে দিতে চাইলো কিন্তু পারলো না । পুরো বাড়ি জুড়ে অস্বাভাবিক কিছুর অস্তিত্ব সে অনুভব করতে পারছিলো।
রাত্রী ভেবেছিলো যে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে গেলে নীল আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠবে । কিন্তু সেটা হল না । নীল যেন আরও ভীত হয়ে উঠলো । দিনের আলোতে রাত্রীর সব ভয় কেটে গেলেও নীলের যেন সেটা ভেড়ে গিয়েছিলো তীব্র ভাবে । সে যেন সত্যি কাউকে দেখতে পাচ্ছে । বুঝিয়ে শুনিয়ে কোন ভাবেই নীলকে ধরে রাখা যাচ্ছিলো না । বিকেলের দিকে ঘটলো সব থেকে মাররাত্বক দুর্ঘটনা । নীল ঘরের ভেতরে ভাংচুর করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল । পালাতে লাগলো উদ্ভ্রান্তের মত । দুর থেকে দেখলে মনে হবে যেন ওর পেছনে কেউ তাড়া করে বেড়াচ্ছে ।
রাত্রীর এক মামাত ভাই পুলিশে চাকরি করে । তার সহায়তায় নীলকে আবার ধরা গেল । তবে তাকে আর বাসায় আনা হল না । রাত্রীর ক্লিনিকেই ভর্তি করা হল । তারপর থেকে নীল সেখানেই আছে । সারাটা সময় ওকে ঘুম পাড়িয়েই রাখা হয় । ঘুম ভাঙ্গলেই সে কেবল ভয়ে চিৎকার করে ওঠে । পালাতে চায় । নীল যাতে পালাতে না পারে সেই ব্যবস্থা অবশ্য করা আছে ।
দিনের পর দিন নীলের অবস্থা খারাপই হচ্ছে । ওর শরীর শুকিয়ে যাচ্ছে । মনে হচ্ছে যেন ওর শরীর থেকে কেউ রক্ত খেয়ে নিচ্ছে । রাত্রীর পরিচিত সকল বড় বড় প্রোফেসরেরা দেখে গেল । কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হল না । নীলের শরীর দিনের পর দিন খারাপই হতে থাকলো । রাত্রীর মা এক প্রকার জোর করেই এক বড় হুজুর নিয়ে এল ক্লিনিকে ।
হুজুর নীলের কেবিনে ঢুকে সবাইকে বের করে দিল । রাত্রীর যদিও কোন ইচ্ছে ছিল না নীলকে এভাবে একা রেখে বের হয়ে যাওয়া তবে মায়ের কারণে কিছু বলতে পারলো না ।
ওরা বাইরে বের হয়ে এসে কয়েক মিনিট দাড়িয়েছে তখনই ভেতর থেকে জোরে একটা চড়ের আওয়াজ শুনতে পেল । রাত্রীর মনে হল হুজুর মশাই নিশ্চয়ই নীলকে চড় মেরেছে । সে গ্রাম গঞ্জে ওঝাদের ভুত তাড়ানোর ব্যাপারটা জানে । রোগীকে দড়ি দিয়ে বেঁধে কি রকম নির্যাতন চালানো হয় । রাত্রীর ব্যাপারটা মনে হতেই মাথায় রক্ত চড়ে গেল । সে ভেতরে যেতে উদ্ধত হতেই দেখতে পেল হুজুর মশাই বাইরে বের হয়ে এল । তার ডান গালটা লাল হয়ে আছে । সেখানে চার আঙ্গুলের স্পষ্ট একটা দাগ । সে বাইরে এসে রাত্রীর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, এই জিনিস আমার দ্বারা সমাধান করা সম্ভব না । আমাকে মাফ করবেন !
বলে আর একটুও দেরি করলো না । দ্রুত সে স্থান থেকে চলে গেল । রাত্রী আর ওর মা কেবল একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগলো । বুকের মধ্যে একটা দুরুদুরু ভয় করতে শুরু করলো তার ! হুজুরকে ওভাবে কে চড় মারলো । বেডের সাথে নীলের হাত পা আটাকানো রয়েছে । যাতে করে ও পালাতে না পারে । নীলের পক্ষে হুজুরকে চড় মারা সম্ভব না। তাহলে কে মারলো? তার মানে সেটা ঘরের ভেতরেই আছে নীলের সাথে ! ও এখন কি করবে !
তারপরেই রাত্রীর রাফায়েলের কথা মনে পড়লো । এই মানুষটা কি কিছু করতে পারবে ? নীলের এই অবস্থা হওয়ার আগে এই মানুষটার সাথে নীলের দেখা হয়েছিলো । এই মানুষটা নীলকে কোন ভাবে সাহায্য করেছিলো । আবার কি সাহায্য করতে পারবে ?
রাফায়েলের খোজ শুরু করলো সে । কিন্তু কার কাছে খোজ করবে সেটা মোটেও বুঝতে পারলো না । নীলের মোবাইল ফোন চেক করে দেখলো । ভেবেছিলো হয়তো এইখানে রাফায়েলের মোবাইল নাম্বার থাকবে কিন্তু তেমন কিছুই নেই সেখানে । এরপর সে ঐশির মায়ের সাথে যোগাযোগ করলো । জনতে চাইলো সে রাফায়েলের সাথে কিভাবে যোগাযোগ করেছে । ঐশির মাও কোন সাহায্য করতে পারলেন না । তিনি বললেন যে কোন কন্ট্যাক্ট নাম্বার তো নেই । একদিন নাকি ছেলেটা নিজ থেকে তার সাথে দেখা করেছিলো । কিভাবে ঐশির কথা জেনেছিলো সেটা সে জানে না । তবে তারপর থেকে ঐশি ভাল আছে অনেক । এখন আর আগের ঝামেলা নেই ।
একটা সময়ে রাত্রী লক্ষ্য করলো যে রাফায়েল নামের সেই মানুষটার সাথে যোগাযোগের কোন উপায় নেই । সে কোন ভাবেই তার সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না । রাত্রীর কেবল কান্না আসছে । নীল চোখের সামনে এভাবে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আর সে কিছুই করতে পারছে না । কি করবে ও !
ক্লিনিকে ছেড়ে একটু সময়ের জন্যও রাত্রী বাসায় যায় না । সারাটা সময় নীলের পাশেই থাকে । দিনের বেশির ভাগ সময়ে নীল ঘুমিয়ে থাকলেও যখনই তার ঘুম ভাঙ্গছে নীল কিছু একটা দেখে ভয় পাচ্ছে । এই ঘরের ভেতরেই সেটা রয়েছে । রাতের বেলা যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে তখন এই ব্যাপারটা রাত্রী নিজেও উপলব্ধি করতে পারে । বুঝতে পারে যে সত্যিই কিছু একটার অস্তিত সে রয়েছে । তবুও নীলকে ছেড়ে সে যায় না । ওর ভয়ভয় করতে থাকে । তবুও নীলকে একা রেখে কোথাও যায় না ।
আজকেও সে একই ভাবে নীলের বেডের কাছে বসে ছিল । একটু ঝিমুনির মত এসেছিল কিন্তু হঠাৎই মনে হল যে কেউ ওর পাশে এসে দাড়িয়েছে । ওর শিরদাড় বেয়ে একটা সুক্ষ ভয়ের অনুভূতি নেমে আসতে লাগলো । হাতের লোম খাড়া হয়ে গেল । নিজের মনকে শান্ত করতে চাইলো কিন্তু পারলো না । খুব কষ্টে পেছনে তাকানো থেকে নিজেকে শান্ত করলো । মনে মনে দোয়া পড়তে শুরু করলো সে । চোখ বন্ধ করে উপরওয়ালার নাম নিতে শুরু করলো । রাত্রী নীলের হাতটা আরও শক্ত করে চেপে ধরলো । আর মনে মনে বলল, আমি নীলকে ছেড়ে যাবো না যাবো না যাবো না ! কোন ভাবেই যাবো না !
কত সময় সে চোখ বন্ধ করে দোয়া পড়েছিলো রাত্রী বলতে পারবে না । একটা সময়ে হঠাৎ দরজাতে টোকা পরলো । চমকে চোখ খুলে ফেলল সে । দেখতে পেল একজন নার্স ভেতরে উকি দিয়েছে । রাত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, ম্যাম একজন দেখা করতে এসেছে আপনার কাছে !
রাত্রী বলল, আমার কাছে ? এখানে ?
-হ্যা । বলল যে নাকী স্যারের পরিচিত ! এতো রাতে সে গেট কিভাবে পার হল বুঝতে পারছি না ম্যাডাম !
রাত্রী বুঝতে পারলো না এখানে এতো রাতে আবার কে দেখা করতে এল । নার্সটা বলল, উনি বলেছেন নীল স্যারকে রেখেই আসতে । কোন ভয় নেই ।
রাত্রী এবার একটু চমকালো । নার্সকে বলল, আচ্ছা একটা টুল নিয়ে বাইরে বস । কেমন । নীল যদি ঘুম ভেঙ্গে যায় আমাকে ডাক দিবে সাথে সাথে !
-জি আচ্ছা ম্যাডাম!
নিজের কেবিনে যখন গিয়ে হাজির হল দেখতে পেল সেই রাফায়েল নামের মানুষটা বসে আছে । রাত্রী সত্যিই অবাক না হয়ে পারলো না । এতোদিন কত ভাবেই না তাকে খোজার চেষ্টা করেছে । আর যখন সব আশা ছেড়ে দিয়েছিলো তখনই এই লোক এখানে এসে হাজির !
রাত্রীর দিকে তাকিয়ে রাফায়েল একটু হাসলো কেবল । রাত্রীর তখনই পুরো শরীরটা কেমন কেঁপে উঠলো । একটা কথাই তার মনে হল । এই মানুষটার চোখ খুব বেশি তীক্ষ্ণ । অন্তরভেদী । মানুষকে চোখ দিয়ে খুব সহজেই সম্মোহন করার ক্ষমতা রাখে এই মানুষটা ।
চার
রাফায়েল আবারও বলল, বুঝতে পারছেন কি আমার কথা ?
রাত্রী কি বলবে ঠিক বুঝতে পারছে না । সামনে বসা এই মানুষটির মাঝে কিছু অস্বাভাবিকত্ব আছে সেটা সে বুঝতে পারছে । কিন্তু সেটা কি রাত্রী তা ধরতে পারছে না । তবে মানুষটা যে অসম্ভব ধূর্ত সেটা বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না মোটেও । এতো সময় ধরে তাদের মাঝে নীলের ব্যাপার নিয়ে কথা হচ্ছিলো । নীলের এই দশার পেছনে আসলে কে দায়ী কেন সাধারন চিকিৎসাতে কোন কাজ হচ্ছে না সেই সব নিয়ে । রাফায়েল যে সব তথ্য দিলো রাত্রীর তা বিশ্বাস হচ্ছে না । হওয়ার কোন কারণ নেই । ও একজন ডাক্তার । মানুষের মনতত্ত্ব নিয়ে তার বিস্তার পড়াশোনা । সে নিজেই যদি এমন কিছু বিশ্বাস করে তাহলে ব্যাপারটা কেমন হয়ে যাবে । কিন্তু আবার অন্য দিক দিয়ে নীলের এই অবস্থা দেখে সে এসব ফেলেও দিতে পারছে না । অন্তত সামনের মানুষটা তাকে সাহায্য করতে চাইছে । ঐশির মায়ের কাছ থেকে শুনেছিলো যে রাফায়েল নামের মানুষটা ঐশিকে সুস্থ করতে কোন টাকা পয়সা নেয় নি । ঐশির মা খুশি হয়ে টাকা দিয়ে চেয়েছিলো তখনও নেয় নি । কেবল বলেছিলো যেন অন্য কোন দরকারী মানুষকে সাহায্য করে । তাহলেই ও খুশি হবে । এটা থেকে অন্তত এই টুকু বুঝতে পেরেছে যে মানুষটা টাকা পয়সার জন্য কিছু করছে না ।
রাফায়েল আবার বলল, আরও পরিস্কার করে বলি । ধরুন আপনি আপনার হাজব্যান্ড কে ভালবাসেন । বাসেন না ?
রাত্রী মাথা নাড়ালো । রাফায়েল বলল, আপনা সাথে আপনার হাজব্যান্ডের একটা বন্ড তৈরি হয়েছে । এখন যদি আপনাদের মাঝে সম্পর্ক ছিন্নও হয়ে যায় তখনও একটা বন্ড রয়েই যাবে । অদৃশ্য বন্ধন । হয়তো দুর্বল হয়ে যাবে তবে রয়েই যাবে । হয়তো কোন বিশেষ ঘটনার জন্য সেই বন্ডটা আবার জোরদার হয়ে যেতে পারে । যেমন মনে করুন যে আপনাদের প্রথম যেখানে দেখা হয়েছিলো সেখানে আবার আপনাদের দুজনেরই দেখা হয়ে গেল । তখন দুজনের মনেই সেই অতীত স্মৃতি জেগে উঠবে । তখন দুজনের মনে একে অন্যর একটা টান অনুভব করবেন । মানে হচ্ছে যে বন্ডটা তৈরি হয়েছিলো মাঝে যেটা দুর্বল হয়ে গিয়েছিলো সেটা আবারও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে । কি কারনে ঐ যে স্থানটার কারনে । এখানে স্থান হচ্ছে ফ্যাক্টর ! ঠিক তেমনি নীলের সাথেও কিছু একটা ছিল সেই ছোট বেলা থেকে । কিভাবে সেটা ওর কাছে এসেছিলো সেটা আমি জানি না । তবে ছিল । নীলের সাথে সেই বন্ডটা যুক্ত হয়েছিলো । মাঝে সেটা সেই বন্ডটা দুর্বল করে দিয়েছে মানে সেটার থেকে নীলকে আলাদা করে দিয়েছিলো । কিন্তু সেই বন্ডটা আবার যুক্ত হয়ে গেছে ! ঐদিন ঐশির বাসায় নীলের যাওয়া ঠিক হয় নি । ওটা ফ্যাক্টরকে হিসাবে কাজ করেছে । আবার সেই বন্ডটা শক্তিশালী করেছে ।
রাত্রী বলল, আপনি বলতে চান যে ঐশির সাথে যেটা ছিল সেটাই কি নীলের সাথে আগে ছিল ।
-না সেটা ।
-তাহলে কিভাবে ?
-ব্যাপারটা এতো সহজ না । যখন একটা অশরীরিকে একজন মানুষ থেকে আলাদা করা হয় তখন কিছু প্রটেক্টশন শীল্ড সেই মানুষটার চারিদিকে বেঁধে দেওয়া হয় । এই কারনে সেই অশরীরিটা আর সেই মানুষটাকে খুজে পায় না কিংবা তার কাছে যেতে পারে না । কিন্তু যখনই সেই মানুষ অন্য কোন অস্বাভাবিক স্থানে যায় বিশেষ করে কোন হন্ডটেড হাউজ মৃত বাড়ি অন্য কোন রিচুয়্যালের স্থানে তখন সেই প্রেটেক্টিভ শীল্ডটা ভেঙ্গে যায় । আর বন্ডটা সেই বন্ডটা আবার রিকানেক্ট হতে থাকে । আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে আমরা যেমন একে অন্যের সাথে যোগাযোগ রাখি এই সমস্ত অশরীরিরাও একে অন্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত ।
রাত্রীর এসবের কিছুই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল না । তবে এসব নিয়ে আর কোন কথা বলতে ইচ্ছেও হল না । সে রাফায়েলকে বলল, নীলকে কিভাবে এসবের ভেতর থেকে রক্ষা করবো ? আমার আর কোন কিছু জানতে মন চাইছে না । আমি কেবল চাই নীল যেন এসবের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে । আমি ওকে সুস্থ দেখতে চাই ।
রাফায়েল বলল, এর জন্য আমাদের নীলের উৎপত্তি স্থলে যেতে হবে । শুনেছি নীল এখানেই জন্ম নিয়েছে । এই ব্যাপার গুলো সাধারনত ছোট বেলা কিংবা জন্ম থেকেই শুরু হয় । ওর জন্ম হওয়ার সময়ই কেউ এই কাজটা করেছে । সেখানেই যেতে হবে আমাদের !
পাঁচ
সন্ধ্যা নামতে খুব একটা বাকি নেই । রাত্রী দুরে তাকিয়ে রয়েছে । যতদুর চোখ যায় কেবল ধূধূ ফসলের মাঠ ছাড়া আর কিছু নেই । হেমন্তের ফসল ঘরে উঠেছে । তাই মাঠ এখন খাঁ খাঁ করছে । মাঠের পরেই বন শুরু হয়েছে । রাত্রীর মন খারাপ লাগছে । বিয়ের পর রাত্রী কখনই একা একা কোথাও বেড়াতে যায় ন । এমন কি কাজের কারণে কোথাও যেতে হলে নীল ওর সাথে যেত । নীল ওকে জড়িয়ে ধরে বলতো যে রাতে ওকে জড়িয়ে ধরে না ঘুমালে নাকি নীলের ঘুম আসে না । অথচ আজ কত গুলো দিন নীল একা একা পড়ে রয়েছে হাসপাতালের কেবিনে ।
জায়গাটার নাম বরিনগড় । সাতক্ষীরা জেলার একেবারে ভেতরের দিকে । একেবারে সুন্দরবনের কাছে গ্রামটা। এলাকাটা খুবই গ্রাম্য । এখান তবে একটু একটু আধুনিকতা সোঁয়া পেতে শুরু করেছে । এটাই নীলের দাদা বাড়ি । রাফায়েলের সাথে গতকাল এখানে এসে পৌছিয়েছে সে । নীল যদি সাথে থাকতো তাহলে হয়তো এই দিগন্ত বিস্তৃত খোলা মাঠ দুজন এক সাথে বসে দেখতো । এক সাথে উপভোগ করতো । কিন্তু এখন সেসবের বালাই নেই । মাথার ভেতরে দুষ্চিন্তার শেষ নেই । নীল ওখানে একা রয়েছে ক্লিনিকে । যদিও রাত্রী বাবা মা আর ছোট ভাই সেখানে আছে তারপরেও রাত্রী চিন্তা হচ্ছে খুব। নীলকে দেখতে মন চাইছে ।
রাত্রী বাবাই এই রবিনগড়ের খোজ বের করেছে । রাত্রীর আব্বা মন্ত্রনালয়ের সিনিয়র সচিব। তার চেনা জানার চোখে অনেক । সিভিল সার্ভিসে চাকরি করার কারণ কাজটা করা সহজ হয়েছে। এমন কি থাকার জায়গাটারও বেশ ভাল ব্যবস্থা করা হয়েছে । এখানকারই ফরেস্ট অফিসের বাংলোতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে । রবিনগড় বাংলো থেকে কিছু দুর হাটলেই পড়ে । ফরেস্ট গার্ড ছাড়াও এখানকার স্থানীয় থানার ওসি সাহেব এসে খোজ খবর নিয়ে গেছে । বলেছে যে কোন সমস্যাতেই যেন তাকে সরাসরি ফোন দেওয়া হয় ।
এখানে এসেই রাফায়েল নামের লোকটা কোথায় যেন গেছে । তার কোন খবর নেই । রাত্রী একা একাই বাংলোতে বসে সময় কাটাতে শুরু করলো । ফোনে সব সময়ই ঢাকার সাথে ওর যোগাযোগ রয়েছে । তবে সমস্যা হচ্ছে এখানে বেশির ভাগ সময়েই নেটওয়ার্ক থাকে না । ফরেস্ট অফিসের মাথার উপরে একটা এন্টেনা বসানো আছে । তার নিচে গেলে একটু ভাল নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় । এই বাংলা অফিস থেকে একটু দুরে ।
রাফায়েলের দেখা দেখা হল রাতের খাওয়ার সময়ে । রাত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, কাজের কাজ আসলে কিছুই হয় নি ।
-মানে ? কিছু বের করা যায় নি ।
-নাহ ! তেমন কিছুই জানা যায় নি । তবে জমিদার বাড়িটা খুজে বের করা গেছে । আশে পাশে মানুষের কাছ থেকে জানা যায় জমিদার বাড়িটা গত বিশ বছরের বেশি সময় ধরেই পরিত্যাক্ত হয়ে আছে । সর্ব শেষ জমিদারের নাম ছিল আলী আহমেদ। এটা সবাই জানে । তার এক ছেলে। ছেলে জন্ম দিতে গিয়েই তার স্ত্রী মারা যান । পরে আর দ্বিতীয় বিয়ে সে করেন । আলী আহমেদই হচ্ছে নীলের দাদু ।
রাত্রী বলল, তারপর ?
-তারপর যে আসলে কি হয়েছে সেটা কেউ জানে না । নীলের বাবা ফরিদ আহমেদ পড়াশুনা প্রথমে ঢাকাতে । সেখানে পরিচয় হয় নীলের মায়ের সাথে । নীলের দাদুর ইচ্ছে ছিল তার ছেলে গ্রামে ফিরে এসে জায়গা জমি দেখবে, এলাকাটাকে আরও আধুনিক করবে । কিন্তু ফরিদ আহমেদের অন্য ই্চ্ছে ছিল । সে শিক্ষকতা করতে ইচ্ছুক ছিল । সেটাই তার লক্ষ্য ছিল । বাবাকে এই কথা বলতেই আলী আহমেদ একটু অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন বটে তবে আপত্তি করেন নি। এমন কি বিয়েও অমত করেন নি । ছেলের ইচ্ছাই মেনে নিয়েছেন । অথচ এটাও শোনা যায় যে ছেলের বিয়ে নাকি অন্য কোথায় ঠিক করে রেখেছিলেন ।
রাত্রী কোন কথা বলল না । রাফায়েল একভাবে বলেই চলল ।
-আমি আরও খোজ খবর নিয়ে যা জানতে পেরেছি সেটা হচ্ছে ছেলে বউ নিয়ে ঢাকা থাকতে শুরু করার পরে আলী আহমেদ খানিকটা নির্জিব হয়ে গিয়েছিলো । সারাদিন নিজের রুমের ভেতরেই থাকতো । খুব একটা বের টের হত না । একটা সময়ে সে তার সকল সম্পত্তি বিক্রি করে দিতে শুরু করে । আশে পাশে যত সহায় সম্পত্তি ছিল সব আস্তে ধীরে বিক্রি করে দিতে শুরু করে ।
-তারপর ?
-তারপর নীল যখন পেটে এল তখন আলী আহমেদ খুব জেদ করে তার ছেলেকে যেন এখানেই এসে থাকে । প্রথমে খুব একটা রাজি না হলেও বাবার কথা মত বউকে নিয়ে চলে আসে এখানে । বলা যায় কোন ঝামেলা ছাড়াই নীলের জন্ম হয় এখানে । বেশ কিছুটা সময় তারা এখানেই ছিল । এরপর ... এরপর যে কি হল সেটা আসলে কেউ বলতে পারে না । একদিন গ্রামের লোকজন দেখতে পেল যে ফরিদ আহমেদ তার বউকে নিয়ে চলে গেল । অনেকের ধারনা ছিল বাবার সাথে কোন ব্যাপার নিয়ে তার রাগারাগি হয়েছিলো । তারপর মাস খানেক পরে জমিদার আলী আহমেদ মারা যায় । কিভাবে মারা যায় সেটা কেউ বলতে পারে না । মারা যাওয়ার পরে ছেলে ফরিদ আহমেদ এসেছিলো আবার গ্রামে । বাদ বাকি যা ছিল সব কিছু বিক্রি করে দিয়ে চলে যায় । কেবল জমিদার বাড়িটাতে একজন কেয়ার টেকার নিয়োগ করে রেখে যায় । তবে সে বেশি দিন সেখানে কাজ করতে পারে নি । বাড়ির ভেতর থেকে নাকি অদ্ভুত সব চিৎকার আসতো । বিশেষ করে যে ঘরে জমিদার মারা গিয়েছিলো সেখান থেকে । কয়েকজন বাড়ির ভেতরে চুরি করতে গিয়ে নাকি ভয় পেয়েছে । আস্তে আস্তে জংলা বেড়েই গিয়েছে । ভেতরে কেউ যায় না ।
রাত্রী বলল, আপনার কি মনে হয়? জমিদার কেন মারা গিয়েছিলো ? কিভাবে ?
-এটার ব্যাপারে আসলে কেউ জানে না । যে কয়জন চাকর ছিল বাড়ির ভেতরে তারা তখনই বয়সে বেশ বুড়ো ছিলো । তারা সবাই মারা গিয়েছে । কেউ ভেতরের খবর জানে না ।
-তাহলে আমরা কিভাবে জানবো ? নীলের সাথে কেন এসব হচ্ছে ?
-সেটা আমাদের বের করতে হবে । এই জন্য কাল আমাদের ঐ জমিদার বাড়ির ভেতরে যেতে হবে । আপনার যাওয়ার দরকার নেই ।
রাত্রী সাথে সাথে বলে উঠলো, জি না । আমি যাবো । আমি এখানে কেন এসেছি ? শুনুন নীল আমার স্বামী। আমার এই সব কিছু জানার অধিকার রয়েছে ।
-দেখুন বিপদ হতে পারে !
-হোক । সামলে নিতে পারবো আমি ।
রাফায়েল বেশ কিছুটা সময় রাত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর বলল, আচ্ছা কাল যাওয়া যাবে । সকালের নাস্তা খেয়ে আমরা বের হব !
সকাল বেলা নাস্তা শেষ করে বের হতে হতে দশটা বেজে গেল । বরিন গড়ের জমিদার বাড়িতে যেতে যেতে আরও মিনিট পনের লাগলো । রাত্রীর সব সময় প্রকৃতি পছন্দ। ছুটি পেলেই নীলের সাথে সে নানান স্থানে ঘুরে বেড়ায় । ইদানীং বেশ কিছু ট্যুর গ্রুপ হয়েছে । তাদের সাথে ভীড়ে গেলেই হল । কেবল টাকা দিলে ভ্রমনের অন্যান্য আর কোন চিন্তা করতে হয় না ।
রাত্রী গ্রামের যে রাস্তা দিয়ে হাটছে নীল সাথে থাকলে এমন একটা পরিবেশ সে খুব বেশি উপভোগ করতো । নীলের হাত ধরে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতো । কিন্তু এখন এসব কিছুই তাকে স্পর্শ করছে না । মাথার ভেতরে কেবলই বারবার নীলের চেহারাটা ভেসে উঠছে । অন্য কিছু তাকে স্পর্শই করছে না । তাই হঠাৎ ওর কাধে স্পর্শ পেয়ে রাত্রী বাস্তবে ফিরে এল । তাকিয়ে দেখলো রাফায়েল ওর থেকে
কয়েক হাত দুরে দাড়িয়ে আছে । একটু চমকে গেল সে । ওর শরীরে হাত দিল কে !
এদিক ওদিক তাকালো সে ! এই দিনের বেলাতেও ভয়ের একটা অনুভূতি পেয়ে বসলো ওকে ! এদিক ওদিক তাকালো সে । রাফায়েলের দিকে তাকিয়ে মনে হল যেন সে নিজেও কিছু বুঝতে পেরেছে। ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ভয় পাবেন না ।
-কি হল ?
রাত্রী সামনে জঙ্গলটার দিকে ভাল করে তাকালো । আশে পাশে গাছ পালা দিয়ে ভর্তি । তবে সেটার আড়ালে একটা বাড়ির অস্তিত্ব ঠিকই বোঝা যাচ্ছে স্পস্ট । সীমানার একদম কাছেই ওরা দাড়িয়ে আছে । ভেতরে প্রবেশ করার আগেই এই অনুভূতিটা হল । যেন কেউ ওদেরকে ভেতরে ঢুকতে দিতে চাচ্ছে না । রাফায়েল রাত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, কিছু একটা রয়েছে এই খানে ।
-কি ?
-এটাকে অনেকটা প্রকেটশন সীল্ড বলে । বাড়ির চারিদিকে এই সীল্ড দেওয়া । বিশেষ করে আমাকে ঢুকতে দিতে চাচ্ছে না।
রাত্রীর কথাটা বিশ্বাস হল । অন্য সময় হলে সে হয়তো হাস্যকর ভেবে উড়িয়ে দিতো । তার পুরো জীবনে সে এই সব জিনিস একদম বিশ্বাস করে নি । বিশ্বাস করার কোন কারণ সে পায় নি । তবে গত কিছু দিন ধরে নীলের সাথে যা হচ্ছে সেটা দেখার পর থেকে কোন কিছুই সে অবিশ্বাস করতে পারছে না । আর এখন এই পরিবেশটাও খানিকটা অন্য রকম । সব কিছু বিশ্বাস ধরিয়ে দেয় । রাত্রীর বিশ্বাসকে আরও একটু পাকাপক্ত করতেই আরও একটা ঘটনা ঘটলো । রাত্রী কেবল চোখ বড় বড় করে সেটার দিকে তাকিয়ে রইলো ।
রাফায়েল কিছু একটা পড়ে বাড়ির ভেতরে ঢোকার জন্য এক পা বাড়িয়েছিলো । ঠিক সেই সময় ঘটনাটা ঘটলো । রাত্রীর কেবল মনে হল কেউ যেন রাফায়েলকে জোড়ে ধাক্কা দিল । একেবারে শেষ মুহুর্তে রাফায়েল সেটা বুঝতে পারলো । নিজের হাত দিয়ে সেই অদৃশ্য আঘাত টা ঠেকানোর চেষ্টা করলো । রাত্রী দেখতে পেল রাফায়েল যেন একে ধাক্কাটা খেয়ে খানিকটা দুরে ছিটকে পড়লো । নীল ঠিক যেভাবে উড়ে গিয়ে পড়েছিলো রাফায়েলও সেই রকম ভাবে খানিকটা পেছনে গিয়ে আছাড় গেল । তবে সাথে সাথেই উঠে সেটা সামলে নিল । রাত্রী এবার দেখলো রাফায়েল মুখ দিয়ে অদ্ভুত ভাষার কিছু একটা উচ্চারণ করলো । পরবর্তী ব্যাপারটা দেখে রাত্রীর চোখ বড় বড় হয়ে গেল । এই জীবনে যে এমন কিছু দেখতে পাবে সেটা সে কোন দিন ভাবতেও পারে নি ।
"অপ্রে ভিয়েস্তা"
রাফায়েলের দুই হাত দিয়েতীব্র আলো ঝলকানী বের হল । সেটা গিয়ে সোজা গিয়ে আঘাত করলো সামনে । রাত্রীর মত তীব্র আলো গিয়ে অদৃশ্য একটা দেওয়া গিয়ে লাগলো । রাত্রী অনুভব করতে পারলো তার পায়ের নিচের মাটি কেঁপে উঠেছে । সেই ভেঙ্গে পরার তীব্র আওয়াজ ! রাফায়েল আবারও শব্দ দুটো উচ্চারন করলো !
''অপ্রে ভিয়েস্তা" ।
ঠিক একই ভাবে আবারও আলো ঝলকানি গিয়ে সামনে লাগলো । এবং এবার হুড়মুড় করে কিছু ভাঙ্গার আওয়াজ শোনা গেল । রাত্রী তাকিয়ে দেখলো রাফায়েলের মুখের পেশী আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে আসছে । সে রাত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, আপাতত সব শান্ত । আসুন ভেতরে যাওয়া যাক !
-কি ছিল এটা? আর আপনি কিভাবে এসব করছেন ?
রাত্রীর এখনও ঠিক যেন বিশ্বাস হচ্ছে না । নিজের চোখে না দেখলে সে হয়তো কখনই এটা বিশ্বাস করতো না । তার সামনে দাড়ানো এই মানুষটা কোন স্বাভাবিক মানুষ নয় । তার ভেতরে অস্বাভাবিকত্ব রয়েছে অনেকটাই । কিন্তু এটা সে কি দেখছে ! এটাও কি সম্ভব !
রাফায়েল বলল, আসুন ! এইবার যাওয়া যাবে ভেতরে !
রাত্রী কোন কথা না বলে পা বাড়ালো । জমিদার বাড়িটার ভেতরে প্রবেশ করতেই একটা অস্বাভাবিক বাতাস অনুভব করতে পারলো । বাতাসটা কেমন যেন একটু ভারী ভারী ঠেকলো রাত্রীর কাছে । নিঃশ্বাসের সাথে অনুভব করা যায় ।
দুইতলা বাড়ি । তবে খুব বেশি বড় না । উপর নিচে সব মিলিয়ে এগারোটা ঘর । তবে এখন কোন ছাদই আর অবশিষ্ট নেই । সব ভেঙ্গে পড়েছে । ব্যাপারটা রাত্রীর কাছে একটু অবাকই লাগলো । পরিত্যাক্ত বাড়ি হলেও এই বাড়িটার অবস্থা যেন একটু বেশি শোচনীয় । একশ দুইশ বছর বাড়ি টিকে থাকে আর এটা মাত্র বিশ বছর ধরে বছর ধরে পরিত্যাক্ত । এটার অবস্থা এতো করুণ কেন !
বাড়িটার আসলে কিছুই অবশিষ্ট নেই । পুরো বাড়িটাকেই প্রকৃতি গ্রাস করে নিয়েছে । দেওয়াল ছাড়া আর পিলার ছাড়া বলতে গেলে আর কিছুই নেই । বাড়ি থেকে বের হয়ে রাফায়েল চিন্তিত মুখে বলল, বাড়িটাতে কিছুই নেই যা আমাদের সাহায্য করতে পারে । সব কিছুই নষ্ট হয়ে গেছে । কিছু জিনিস পত্র থাকলে কাজ হত ।
রাত্রী বলল, জিনিস পত্র দিয়ে কি করতেন ?
-জানা যেন অতীতে এখানে কি হয়েছে ?
-কিভাবে ?
-উপায় আছে । এমনটা করা যায় ! ব্যবহারের জিনিস পত্রে স্মৃতি জড়িয়ে থাকে । সেগুলো থেকে তা বের করা সম্ভব !
রাত্রী কিছুটা সময় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো । রাফায়েল আবার বলল, কিন্তু এখানে সবই নষ্ট হয়ে গেছে । সেটা করা সম্ভব না । এখন কেবল একটা উপায় রয়েছে ।
-কি উপায় ?
-সেটা শুনতে হবে না । এখানে আপাতত করা সম্ভব না !
-আমাকে বলুন কেন সম্ভব না ।
রাফায়েল কিছু সময় রাত্রীর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, জিনিস পত্র ছাড়াও আরও অনেক কিছুতেই স্মৃতি জড়িয়ে থাকে । অনেক এন্টিটি থাকে আমাদের চারিপাশে যা সবাই দেখতে পায় না। কিন্তু এরা সব কিছু দেখে সব কিছু হিসাব রাখে ।
-এটা কিভাবে সম্ভব ?
কেন সম্ভব না ? মনে করুন আপনি একজন মানুষ । ছোট বেলা থেকেই আপনার চারিপাশে যত ঘটনা ঘটেছে সব আমি দেখেছেন । এখন আপনার কাছে যদি কেউ জানতে চায় আপনি বলতে পারবেন না ? এই ব্যাপারটাও ঐ রকম । কেবল আপনি মানুষ । আর এটা ঠিক মানুষ নয় । এদের কে বলে ওয়াচার স্প্রিট । এরা বলতে গেলে সব জায়গাতেই থাকে ।
-তাহলে ? কিভাবে তাদের নিয়ে আসতে হবে । নিয়ে আসুন !
-আসলে এতো সহজে তাদের আনা যায় না ।
-কি করতে হবে শুনি ? মিডিয়াম হতে হবে ? আমি হব !
মিডিয়াম হওয়ার কথা শুনে রাফায়েল হাসলো । তারপর বলল, না না মিডিয়াম না । তবে এর জন্য দরকার প্রবল ইচ্ছা শক্তি । আপনার এটা জানা দরকার এমন একটা কিছু । না জানলে হবেই না । এবং এরজন্য আপনাকে কষ্ট ভোগ করতে হবে !
-কি রকম ?
-মানে আপনার শরীর থেকে কিছুটা পরিমান রক্ত ঝরাতে হবে !
রাত্রীর কাছে এই রিচুয়াল গুলো সব সময়ই ভোগাস মনে হয় । কিন্তু আজকে ও বেপোরোয়া । নীলের জন্য ও সব কিছু করতে পারে । রাত্রী বলল, ওকে কোন সমস্যা নেই । বলুন কি করতে হবে ! আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি সত্যটা জানার জন্য এবং নীলকে ঠিক করতে যে কোন কিছু করতে রাজি আছি । বুঝতে পারছেন না ?
-হ্যা পারছি ।
রাফায়েল কিছু সময় এদিক ওদিক তাকালো । তারপর তূলনা মূলক ভাবে একটা খালি স্থান খুজে বের করলো । পকেট থেকে একটা ছোট ছুরি বের করে জায়গাটা পরিস্কার করলো । একটু গর্ত করে মাটি বের করলো । তারপর আরও কি যেন করলো চারি পাশ জুড়ে। রাত্রী তার কিছুই বুঝতে পারছিলো না । কেবল চেয়ে দেখলো ।
একটা সময় রাফায়েলের কাজ শেষ হলে রাত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, আসুন ঐ স্থানে বসুন !
রাত্রী দেখানো স্থানেই বসে পড়লো । রাফায়েল এবার হাতের চাকুটা রাত্রীর দিকে বাড়িয়ে দিল । তারপর বলল হাতের ঠিকতালু থেকে রক্ত ঝড়াবেন । রক্ত যেন গড়িয়ে এই গর্তে পড়ে ।
রাত্রী কিছু সময় রাফায়েলের দিকে তাকিয়ে থাকলো । তারপর ওর হাত থেকে চাকুটা নিল । একটু একটু যেন কাঁপছিলো তবে সেটা সামলে নিল । আর কিছু না ভেবে একটা চান দিল হাতের তালু বরাবর । প্রথম কয়েক মুহুর্ত কোন অনুভূতি না হলেও পরে একটা ব্যাথার অনুভুতি রাত্রীর মস্তিস্কে অনুভুত হল । সেটা দাঁতে দাঁত চেপেই সহ্য করলো সে । তবে চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি ঠিকই বের হয়ে এল । রাফায়েল অবশ্য সেদিকে তাকালো না । তার চোখ গর্তের দিকে । রক্তের কয়েক ফোটা গড়িয়ে পড়লো মাটির ছোট গর্তে । রাত্রীর মনে হল যে যেন ভুল দেখছে কিন্তু না সত্যিই দেখলো কিছু একটা আলোর মত বের হয়ে আসছে গর্ত থেকে । দেখতে দেখতে সেটা বড় হতে শুরু করলো । রাত্রী নিজের হাতের ব্যাথা ভুলে গেল যেন । সে কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সেদিকে । আলোটা আস্তে আস্তে বড় হতে ফুট তিনেক মত লম্বা হল । তারপর আস্তে মানুষের মত আকৃতি ধারন করলো । সরু দেহের দিকে রাত্রী কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো । ওর চোখে তীব্র বিস্ময় !
রাত্রী কি বলবে বুঝতেই পারলো না । কেবল চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো । আলোর ওয়াচার স্প্রিট চলে এসেছে ।
সত্যিই চলে এসেছে !
রাফায়েলের দিকে চোখ পড়তেই সেটা অশ্রাব্য ভাষা কিছু গালী দিয়ে উঠলো ।
-তোর এতো বড় সাহস আমাকে ডেকে এনেছিস ! এখনও যেতে সে আমাকে ! তোর ভাল হবে না বলছি !
রাফায়েল শান্ত চোখে কিছু সময় সেদিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর নিজের হাতটা একটু সামনে এগিয়ে নিয়ে আসতেই ওয়াচার স্পিরিটটা চিৎকার করে উঠলো ব্যাথায় !
রাফায়েল বলল, একদম দম চুপ । যা জিজ্ঞেস করবো সেটার জবাব দেবে । তাহলে ছেড়ে দিবো । নয়তো এখানেই আটকে রাখবো এই ভাবে !
-তুমি এটা করতে পারো না !
-আমি চাইলে সব পারি ! তুমি জানো আমি কোন কিছু ধার ধারি না । জানো না ?
ওয়াচার স্পিরিট টা কিছু বলল না । মুখে একটা তেজি ভাব নিয়ে তাকিয়ে আছে রাফায়েলের দিকে । তবে সেটা আস্তে আস্তে কমে আসছে । রাফায়েল বলল, তুমি যত সময় এখানে এভাবে থাকবে আস্তে আস্তে তোমার শরীরের উজ্ঝলতা কমতে থাকবে । সানবার্ন বলতে পারো । তাই যা জানতে চাইছি চট করে বলে কেটে পর । ঝামেলা শেষ কর ! তোমাকে ডেকে আনতে একজন তার শরীরের রক্ত ঝরিয়েছে । ব্যাপারটা মাথায় রাখো !
এবার একটু যেন নমনীয় হল সে । তারপর বলল, কি জানতে চাও বল !
-এখানে কতদিন ধরে আছো?
-প্রায় আড়াইশ বছর!
-আচ্ছা । এই বাড়িতে কি হয়েছিলো ? আমি জানতে চাই কি এমন অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছিলো এখানে ? জমিদার আলী আহমেদ কিভাবে মারা গেল ?
ওয়াচার স্পিরিট কিছু সময় থেমে বলল, সে মারা যায় নি । তাকে মেরে ফেলা হয়েছে ?
-কে মেরেছে ?
-কে মেরেছে বলবো না। তুমি জানো এই সব কথা বার্তা আমরা বলতে পারি না ।
রাফায়েল কিছু বলতে গিয়েও বলল না । কিছু সময় কি যেন ভাবলো । তারপর বলল,
-আর কি জানো ?
-আলী আহমেদের স্ত্রীর মৃ্ত্যুর পরে সে অনেকটাই একা হয়ে যায় । এবং তারপর যখন তার ছেলে তাকে ছেড়ে পড়াশুনা করতে চলে যায় তখন সে একেবারেই একা হয়ে যায় । তখনই সে কালো জাদুর উপর ঝুকে পড়ে । অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী হতে চাইতো সে । এই জন্য সে একজনের সাথে একটু চুক্তি করে ।
-চুক্তি ?
-তুমি জানো কিভাবে চুক্তি করতে হয় !
রাফায়েল মাথা নাড়ালো । সে এই ধরনের চুক্তি কিভাবে করে সেটা সে খুব ভাল করেই জানে । রাফায়েল বলল
-কার সাথে চুক্তি করে ?
-চুক্তি করে....
একটু যেন ইতস্তঃ করে সে ।
রাফায়েল বলল, বলে ফেল । এই জিনিস লুকিয়ে লাভ নেই । বল কাকে ডেকে এনেছিলো সে ?
-হ্যাগেন্থি ! হ্যাগেন্থিকে ডেকে এনেছিল সে !
-তারপর ?
-হ্যাগেন্থি তাকে কথা দেয় সর্ব জ্ঞানী বানানোর জন্য কথা দেয় বিনিময়ে হ্যাগেন্থির দরকার ছিল একটা দেহ যার উপরে সে ভর করতে পারে । পৃথিবীতে আসতে পারে । আলী আহমেদ সেই অনুপাতেই কাজ করে । তার ছেলে বিয়ে করে যখন তার বউ প্রেগনেন্ট হয় তখনই পেয়ে যায় তার কাঙ্খিত বস্তু । ছেলের বউকে আলী আহসান কোন দিন পছন্দ করেন নি । তার মতে এই মেয়েই তার ছেলেকে দুরে নিয়ে গেছে । নাতীর জন্ম হল। আলী আহসান আস্তে আস্তে নিজের কাজ করতে শুরু করলো । রাতে যখন ছেলে আর ছেলে বউ ঘুমিয়ে যেত তখন আলী আহসান তার নাতিকে নিয়ে যেত । এই বাড়ির নিচে পাতাল ঘরে নিয়ে যেত । হ্যাগেন্থির মুর্তির সামনে রেখে সে পুজা করতো । নাতির চুল ঢুকিয়েছিল এই মুর্তির ভেতরে । মুর্তির সাথে তার সংযোগ স্থাপন হয়। পুনা চলে হ্যংগেন্থির জন্য ! এই সময়ে নাতীর শরীরে বেশ কিছু দাগের সৃষ্টি হত । একদিন সেই দাগ গুলো দেখেই তার ছেলের বউয়ের সন্দেহ হয় । পরে সে সব কিছু দেখে ফেলে । এটা দেখার পরছেলে আর ছেলে বউ থাকে নি এখানে ।
ওয়াচার স্পিরিট থামলো । রাফায়েলের দিকে তাকিয়ে রইলো বেশ কিছু সময় । তারপর বলল, এবার আমাকে যেতে দাও । তুমি যা জানতে চেয়েছো আমি জানিয়েছি !
রাফায়েল আবারও কিছু একটা পড়ে ফু দিল । রাত্রী দেখতে পেল স্পিরিটটা আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে । যাওয়ার ঠিক আগের মুহুর্তে সে রাফায়েলের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার জন্য একজন অপেক্ষা করছে!
রাফায়েল সাথে সাথে বলল, কে ?
তবে আর কোন জবাব পাওয়া গেল না । ততক্ষণে সে গায়েব হয়ে গেছে । রাত্রী তাকিয়ে দেখলো রাফায়েল সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে আপন মনে । কিছু যেন বুঝার চেষ্টা করছে কিংবা কিছু মনে করার চেষ্টা করছে । তবে সেটা সে কাটিয়ে উঠলো একটু পরেই । রাত্রীর দিকে ফিরে তাকায় । তারপর বলল, আপনার হাত কি বেশি ব্যাথা করছে !
রাত্রী তখনই ব্যাথাটা অনুভব করলো । এতো সময়ে যেন মনেই ছিল না । এতোটাই অবাক হয়ে গেছে যে কিছুতেই স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছে না । রাত্রী হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো । সেখান থেকে এখনও রক্ত পড়ছে । তার সাথে একটু একটু যেন ব্যাথাও করছে ।
এবার রাত্রী আরও একটা অবাক করা কান্ড দেখতে পেল । রাফায়েল রাত্রীর হাতের তালুর উপর হাত হাত রাখলো । রাত্রী ঠিক বুঝতে পারলো না এমন একটা কাজ কেন করলো সে । কিন্তু যখন রাফায়েল নিজের হাত টা সরিয়ে নিল রাত্রী অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো যে ওর হাতের কাটা টুকু একেবারে গায়েব হয়ে গেছে ।
একটু আগে যেখানে কাটা দাগ ছিল সেখানে একেবারে কিছু নেই । রাত্রীর মনে হল যেন কোন দিন তার হাত কাটাই ছিল না । সে কোন হাতটা কাটেই নি । এমনটা কি হতে পারে ?
সম্ভব কিভাবে ?
রাত্রী কিছুই চিন্তা করতে পারলো না । এমনটা আসলেই কিভাবে সম্ভব ?
যে কোন মেডিসিন দিলেও হাতের দাগটা তো থাকবে !
অথবা এমন হতে পারে যে একটু আগে যা হয়েছে, ওর হাত কাটা, ঐ স্পিরিট টা আসা সবাই হল মনের ভ্রম ! আর কিছু না ! কদিন আগে তার সামনে এমন কিছু হলে সম্ভবত রাত্রী এমনটাই ভেবে নিত । কিন্তু এখন সে এসব ভাবতে পারছে না । তার মনটা এখন অশান্ত । সঠিক ভাবে চিন্তা করার শক্তি যেন রাত্রী আস্তে ধীরে হারিয়ে ফেলেছে কদিন থেকে । প্রিয় কারো উপর যখন বিপদ নেমে আসে তখন অনেক কিছুই মানুষ মেনে নিতে বাধ্য হয় । অনেক দিনের বিশ্বাসেও চিড় ধরে ।
রাত্রী বলল, এখন কি করবেন ?
রাফায়েল বলল, আপাতত কিছু করার নেই । এই বাড়ির নিচে একটা ঘর আছে । সেটা আমাদের খুজে বের করতে হবে । হ্যাগেন্থির ব্যাপারটা যতদুর আমি জানি তাকে এই পৃথিবীতে ডেকে আনা হয়েছে । কিন্তু সে তার পরিপূর্ণ ভোগ পায় নি । সেটা সে না নিয়ে যাবে না । আপাতত বাংলোতে ফিরে চলুন ।
-পাতালঘরটা খুজে পাওয়া দরকার ?
-হ্যা । ওখানে একটা মুর্তি থাকার কথা । ওটার ভেতরে নীলের চুল রয়েছে , মূলত ওটার কারণেই নীল আটকে আছে ঐ অপদেবতার সাথে । তবে এভাবে যাওয়া যাবে না সেখানে । আমি আরও কিছু খোজ খবর করি । তারপর অন্য কিছু চিন্তা করা যাবে ।
রাত্রীকে বাংলোর পথে পাঠিয়ে দিয়ে রাফায়েল অন্য দিকে চলে গেল । তবে রাত্রীর মনে মোটেই শান্তি লাগলো না । ঐ জমিদার বাড়ির নিচে একটা ঘর আছে । সেটা খুজে বের করতে হবে । রাত্রী বাংলোর গেটের কাছে দাড়িয়ে রইলো কিছু সময় । তার ফোনে ওসির ফোন নাম্বার সেভ করা আছে । ফোনটা বের করে ওসিকে ফোন দিল ।
-আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে !
-অবশ্যই । বলুন ।
-আমাকে কিছু ওয়ার্কার ম্যানেজ করে দিতে হবে ! এখানে রবিনগড়ে একটা জমিদার বাড়ি আছে! ওটার ভেতরে একটু খোড়াখুড়ি করতে হবে !
ওপাশ থেকে বেশ কিছু সময় কোন জবাব পাওয়া গেল না । রাত্রী বলল, শুনছেন ওসি সাহেব !
-আসলে ঐ এলাকাটাতে কেউ যেতে চায় না ।
-কেন ?
--জানেনই তো গ্রামের মানুষ কেমন কুসংস্কারাছন্ন !
-আপনিও কি? আপনিও কি বিশ্বাস করেন এসব ?
-আরে না না । কি যে বলেন !
-তাহলে ব্যবস্থা করে দিন । আপনি বলবেন আর সেটা হবে না এমন তো না নাকি ! এখানে তো আপনই বস ! বলুন তাই নয় কি ?
শেষ লাইনটা বলার সময় রাত্রী একটু নমনীয় গলা ব্যবহার করলো । রাত্রী জানে একটু তোষামদীতে কাজ হবে । যদিও এমন কাজ করতে তার ভাল লাগে না তবে এখন করতে হচ্ছে । এতেই যদি না হয় তাহলে এরপর তার বাবার কথা নিয়ে আসতে হবে । বলতে হবে যে আপনার এই উপকারের কথা সে বাবাকে বলবে । আশা করলো তাতে কাজ হবেই । তবে ওসি সাহেব এতেই গলে গেল । বলল, আরে কি যে বলেন ! আমি এক ঘন্টার ভেতরে লেবার নিয়ে হাজির হচ্ছি । আপনি মোটেই চিন্তা করবেন না ।
ছয়
সত্যিস সত্যিই একঘন্টার ভেতরেই হাজির হল এক ঘন্টার ভেতরে । মোটে দশ জন মানুষ এসেছে । আবারও জমিদার বাড়ির সামনে গিয়ে হাজির হল তারা । রাত্রীই সবার আগে ঢুকলো । ওসি সাহেব যতই বলুক সে ভয় পায় না তবে যখনই জমিদার বাড়ির সামনে এসে হাজির হল তখন তার কলাপে রাত্রী একটু ঘাম দেখতে পেয়েছিলো । সে নিজেও খানিকটা ভয় পাচ্ছে বুঝতে কষ্ট হল না । তার ঠিক করলো যে নিজে আগে ঢুকবে । একটা মেয়ে হয়ে যখন সে সামনে ঢুকে পড়বে, ওসি সাহেব সহ অন্যান্য লেবাররা না ঢুকে পারবে না ।
তবে রাত্রীর মনে খানিকটা ভয় ছিল যে সকালে এখানে ঢুকতে যে সমস্যাটা হয়েছিলো তেমন কিছু না হলেই হল । যখকন গেটের কাছে পা দিল দেখলো তেমন কিছুই হল না । এমন কি সেই অশুভ ভাবটাও সে অনুভব করছে না । রাফায়েল বলেছিলো পুরো বাড়িটা একটা প্রোটেকশন শীল্ড দিয়ে ঘেরা ছিল যেটা সে ভেঙ্গে ফেলেছে । এখন নিশ্চয়ই সেটা নেই । সকালে যেখানে বসেছিলো সেটার কাছে এসে দাড়ালো । এখনও সেখানে সেই গর্তটা রয়েছে । রাত্রী পেছনে তাকিয়ে দেখলো পেছনের মানুষ গুলো কেমন পাংশু মুখেই এগিয়ে আসছে।
রাত্রী লেবারদের দিকে তাকিয়ে বলল, এই বিল্ডিংয়ের নিচে একটা পাতালঘর আছে । সেটাই আপনাদের খুজে বের করতে হবে ।
লেবারেরা অনিচ্ছা স্বত্তেও কাজে নেমে গেল । ওসি সাহেবের ভয়ে তাদের কাজ করতে হবে । আর ওসি সাহেব নিজের প্রেস্টিজ তার উপর সচিবের মেয়ের ইচ্ছার কারণে না রাজি হয়ে পারছে না । তবে কিছু সময়ের মাঝেই সে উদ্ধার পেয়ে গেল । একটা অযুহাত সে পেয়েও গেল এই স্থান থেকে বের হওয়ার । একটু পরেই তার মোবাইলে একটা কল এল । তাকে এখনই যেতে হবে থানাতে ।
রাত্রী বলল, আপনি চলে যান । কেবল বলে যান যেন এই লেবারেরা ভাল ভাবে কাজ করে । আর কিছু দরকার নেই ।
ওসি সাহেব যাওয়ার আগে কড়া করে বলে গেলেন যেন ম্যাডামের কথার বাইরে না যায় । যদি যায় তাহলে খবর আছে !
রাত্রী এদিক ওদিক হাটতে শুরু করলো । এদিকে লেবারেরা কাজ করতে শুরু করলো । মাটি খুড়তে চলেছে তারা । কত সময়ে পার হয়েছে রাত্রী বলতে পারবে না, মাথার ভেতরে নানান কথা বার্তা ঘুরপাক খেতে শুরু করলো । কি করছে সে এখানে ? জীবনে এমন একটা কিছু সে করবে কিংবা এমন একটা পরিস্থির সাম্মুখীন হবে সেটা সে কোন দিন ভাবতেও পারে নি ।
আফা!
পেছন থেকে ডাক শুনতে পেল ।
ড়াত্রী দ্রুত সেদিকে পা বাড়ালো । একেবারে শেষ মাথার ঘরটাতে গিয়ে হাজির হল । মাঝের অনেকটা খোড়া । সেখানেই একটা গর্ত দেখা যাচ্ছে । গর্তের ফাক দিয়ে একটা সিড়ির মত স্তর দেখা যাচ্ছে ।
রাত্রীর বলল, আরও একটু বড় কর । যাতে মানুষ ঢুকতে পারে !
-আফা আমরা ভেতরে ঢুকতে পারবো না । আমাদের মাফ করে আফা ! আমরা মাইরা ফেললেও নিচে যাবো না !
-আচ্ছা ঠিক আছে আপনাদের নিচে যেতে হবে না । কেবল আমার নিচে যাওয়ার মত করে একটা গর্ত খুড়ে দেন । তাহলেই হবে !
-আফা আপনেও যাইয়েন না । এই জায়গাটা ভাল না !
-যা বলছি করেন ! তারপর আপনেরা চলে যান !
রাত্রীর কথা উপরে আর কেউ কোন কথা বলল না । মেঝের গর্তটা আরও কিছুটা বড় করে দিল । গর্তটা আরও একটু বড় করতেই একটা তাদের কোদালটা একটা শক্ত কিছুটার সাথে ধাক্কা খেল । আওয়াজ শুনে রাত্রীর বুঝতে কষ্ট হল না যে কোন লোহার দরজার সাথে ধাক্কা লেগেছে । আরও কয়েকজন এসে হাত লাগাতেই এবার দরজাটা খুজে পাওয়া গেল । দরজাটা টেনে খুলতেই নিচে নামার একটা সুদৃশ্য সিড়ি পাওয়া গেল কিছু দুর গিয়ে আর কিছু দেখা যাচ্ছে না । অন্ধকার ।
রাত্রী কি করবে ঠিক বুঝতে পারছে না । রাফায়েল ওকে রেখে কোথায় গেছে কে জানে । নিশ্চয়ইও কোন কাজে রাফায়েল ওকে বলেছেন নিচে একটা মূর্তি পাওয়ার কথা । মুলত এই মূর্তির ভেতরেই সেই অপদেবতাকে ডেকে আনা । তারপর মুর্তির সাথে নীলের একটা সংযোগ স্থপন করা হয়েছে । আস্তে আস্তে মূর্তি থেকে অবদেবতা নীলের ভেতরে প্রবেশ করছিলো । কিন্তু মাঝ পথেই সেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে । এখন আবারও সেই সংযোগ যুক্ত হয়েছে তাই আবারও প্রতিস্থাপন শুরু হয়েছে ।
রাত্রী বেশ কিছু সময়ে সেই গেটের মুখেই দাড়িয়ে রইলো । ওর থেকে একটু দুরে লেবারেরা দাড়িয়ে রয়েছে । ভীত মুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে । রাত্রী আর কিছু চিন্তা করলো না । মনে হল যেন এখনই ওর ভেতরে ঢোকা দরকার । অন্তত কি আছে সেখানে সেটা জানা দরকার !
সিড়ির প্রথম ধাপ নামতেই একজন লেবার আবারও বলল, আফা একা একা নাইমেন না !
-চিন্তা করো না । তোমরা চলে যেতে পারো । আমি একটু দেখেই উপরে উঠে আসবো ।
রাত্রী এবার ধীরে ধীরে নিচে নেমে এল । মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে নিল । সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে শুরু করলো !
সাত
রাত্রী ভেবেছিলো হয়তো হয়তো অল্প একটু নামতে হবে । কিন্তু অনুভব করলো প্রায় দুই তলা সমান নিচে নামতে হয়েছে ওকে । একটু একটু ভয় করতে শুরু করলো ওর । এখানে এভাবে একা একা নামাটা কি ঠিক হচ্ছে ওর ?
মোটেই না । রাফায়েলকে সাথে নিচে নামলে ভাল হত । এখানে কত রকমের বিপদ থাকতে পারে । তবে কৌতুহল ধরে রাখতে পারলো না । ভেতরে একটা মুর্তি থাকার কথা এবং সেটার ভেতরে নীলের চুল থাকার কথা । সেটা বের করতে পারলেই নীল মুক্ত হবে । এটাই আপাতত রাত্রীর চিন্তার বিষয় ।
রাত্রীট সাহসের আরেকটা কারণ হচ্ছে ওর কোমড়ে একটা রিভালবার গোজা রয়েছে । এটা ওর নিজের রিভালবার । লাইসেন্স করা । সেটা সাথে আছে যত সময় খুব একটা ভয়ের কারণ নেই ।
রাত্রী মেঝেতে নেমে এল । একটাই মাত্র ঘর । তবে ঘরটা বেশ বড় । নিচের মোবাইলের আলোতে সে এদিক ওদিক দেখতে শুরু করলো । অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো যে পুরো ঘরটা খবই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ! যেন নিয়মিত পরিস্কার করা হয় এটা । আরও কয়েকধাপ এগিয়ে গেল সে । তখনই দেখতে পেল সে মুর্তিটা ! দুর থেকেই মুর্তিটা দেখা যাচ্ছে । লম্বায় খুব বেশি ফুট দেড়েক হবে । দেওয়ালের পাশের একটা বেডির উপর দাড় করানো । আরও একটু এগিয়ে গেল সে !
আর তখনই তীব্র একটা বিস্ময় ধাক্কা দিল তাকে । মুর্তি দেখে সে অবাক হয় নি । অবাক হয়েছে মুর্তির নিচে একজন মানুষকে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে । যেন ঘুমিয়ে রয়েছে ঠিক মুর্তির পায়ের কাছে । রাত্রী বড় বড় চোখ নিয়ে সেদিকে কেবল তাকিয়ে রইলো । চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা মানুষটা নীল !
নীল এখানে কিভাবে এল!
কিছুতেই ওর মাথায় ব্যাপারটা খেলল না । ও কি ভুল দেখতে পাচ্ছে ! চোখের ভুল !
না না । মোটেই না । নীল এখানে থাকতেই পারে না । গতকাল রাতেরও ওর বাসায় কথা হয়েছে । তারা জানিয়েছে নীল সেখানেই আছে । তাহলে নীল এখানে কিভাবে আসলো ?
এখানে তো ওর আসার কথা না
রাত্রী আরও একটু এগিয়ে গেল । কোন ভুল নয় । চোখের ভুল হওয়ার প্রশ্নই আসে না ।
রাত্রী আরও একটু এগিয়ে গেল । তারপর খানিকটা উপুর হয়েই নীলের দেহের দিকে তাকালো । ঠিক সেই সময়ই নীলের চোখে খুলে গেল । সরাসরি রাত্রীর চোখের উপর চোখ পড়লো তার । গাঢ় লাল চোখ ।
ভয়ংকর চোখের দিকে তাকিয়ে রাত্রীর পুরো শরীরটা কেঁপে উঠলো কেবল !
এক ধাক্কাতে পিছনে চলে এল এল । হাত থেকে মোবাইল ফোনটা পড়ে গেল। তবে সেটার ফ্লাশ লাইটের অংশ টুকু উপরের দিকেই পড়ে রয়েছে বিধায় ঘরে কিছুটা অংশ আলোকিত হয়েই রয়েছে । রাত্রী কোমর থেকে রিভালবারটা বার করলো । সরাসরি তাক করলো নীলের দিকে । গুলি করতে গিয়েও পারলো না । যদি এটা নীল হয় ! কোন ভাবে এখানে চলে আসতে পারে কিংবা ওকে নিয়ে আসতে পারে, তখন ? নাহ ! সে গুলি করতে পারবে না ।
নীল ততক্ষণে উঠে দাড়িয়েছে । রাত্রীর মনে হল এখান থেকে পালানো দরকার ! ও নীলকে গুলি না করতে পারলেও নীল ওকে ছাড়বে না ! স্বল্প আলোতে নীলকে দেখতে পেল সে । কেমন যেন শরীরটা বাঁকিয়ে হাটছে সে । ওর দিকে এগিয়ে আসছে । রাত্রী আর দাড়িয়ে থাকতে পারলো না । বুকের মাঝে তীব্র একটা ভয় ঢুকে গেছে । রাত্রীর মনে হল এখনই এখান থেকে পালাতে হবে । নয়তো এখানেই তার মৃত্যু হবে । সিড়ির দিকে ঘুরতে যেতেই সে হোচট খেয়ে পড়ে গেল । হাত থেকে পিস্তলটা পড়ে গেল তার । সাথে সাথেই উঠে দাড়ালো রাত্রী । পিস্তলটা আর খুজতে গেল না । সিড়ির দিকে পা বাড়ালো । আগে এখান থেকে বের হতে হবে তার ।
রাত্রী যখন সিড়ির কাছে পৌছালো পেছনে একবার ঘুরে তাকালো । দেখতে পেল নীল উঠে বসেছে । তার লাল চোখ অন্ধকারের ভেতরেও কেমন জ্বলজ্বল করছে । রাত্রীর কেবল মাথা ঘুড়িয়ে সামনের সিড়িতে পা দেওয়ার আগে সে দেখতে পেল নীল উঠে দাড়াচ্ছে । ওর পেছন পেছন আসবে ।
রাত্রী উর্ধশ্বাসে দৌড়াতে থাকে সামনের দিকে । পেছন থেকে ধুপধাপ করে এগিয়ে আসছে কেউ । রাত্রী নিজের বোকামীর জন্য নিজের গালে একটা চড় মাড়তে চাইলো । এই ভাবে এখানে একা একা ঢোকা মতেও উচিৎ হয় নি । মোটেও না ।
সামনে আলো দেখা যাচ্ছে । ঐ তো চলে এসেছ । সেই সাথে পেছনের আওয়াজটাও আরও কাঁছে চলে এসেছে । রাত্রী সেটা বুঝতে পারছে ।
দিনের আলোতে বের হয়ে এসেও রাত্রী দাড়িয়ে থাকতে সাহস পেল না । কারণ পেছন থেকে ঠিকই নীলের উপড়ে উঠে আসার আওয়াজ ভেসে আসছে । ভাঙ্গা বাড়িটা থেকে বের হতেই দেখতে পেল তখনও একজন লেবার বসে রয়েছে বাড়ির ভেতরে । আর কাউকে দেখতে পেল না । সম্ভবত অন্য সবাই চলে গেছে । এই লোকটিও ওকে ভেতরে ঢুকতে মানা করেছিলো । রাত্রীকে একা রেখে লোকটির যেতে মনে সায় দেয় নি । রাত্রীকে বের হয়ে আসতে দেখে লোকটার মুখ উজ্জ্বল হল বটে তবে সেটা মুছে গেল কয়েক মুহুর্ত পরেই । লোকটা পেছনে কাউকে দেখতে পেয়েছে ।
রাত্রী কোন মতে চিৎকার দিয়ে উঠলো, পালাও পালাও !
লোকটা যেন ফ্রিজ হয়ে দাড়িয়ে গেছে । রাত্রীর অবশ্য সেদিকে চিন্তা করার সময় নেই । ওকেও পালাতে হবে । কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে রাত্রী কতদুর পালাতে পারবে !
প্রশ্নটর উত্তর পাওয়া গেল একটু পরেই । রাত্রী কেবল ভাঙ্গা বিল্ডিং থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছিল । তবে মুল বাড়ির আঙ্গিনার বাইরে যেতে পারলো না । তার আগেই রাত্রী অনুভব করলো ওর কাছে খুব শক্ত কিছুর আঘাত । মনে হল যেন ওর কাধে কোন জন্তুর নখ বসে গেছে । ওকে পেছনে হেচকা টান দিয়ে আবার উড়িয়ে নিয়ে ফেলল । বেশ খানিকটা দুরে গিয়েই সে পড়লো । মাথাটা কেমন কেঁপে উঠলো । মনে হল যেন চেতনা হারিয়ে ফেলবে । তবে সেটা হল না। একটু পরেও আরও একটা ভয়ংকর আর্তনাদে ওর চেতনা পুরোপুরি ফিরে এল । মাথা তুলে দেখতে পেল যে নীল কিংবা নীল সেই লেবার লোকটাকে চেপে ধরেছে । ঠিক কাধের কাছে কামড় দিয়ে ধরেছে । রাত্রী কি করবে বুঝতে পারলো না । তবে লোকটা ওর জন্য মারা যাবে সেটা মোটেই মেনে নিতে পারলো না । ঠিক ওর সামনেই একটা বড় পাথর খন্ড পড়ে ছিল । সেটা তুলতে গিয়েই অনুভব করলো যে কাধে ভয়ানক ব্যাথা করছে । ব্যাথাটা মুখ বুঝে সহ্য করলো । তারপর সেটা তুলে নিয়ে সোজা গিয়ে নীলের শরীরে আঘাত করলো । নীলের কিছু হল না বটে তবে সে লোকটা কে ছেড়ে দিল । ফিরে তাকালো ওর দিকে !
ভাঙ্গা গলাতে কিছু যেন একটা বলল । কোন অদ্ভুত ভাষা । এই কণ্ঠ মোটেও নীলের না । সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল রাত্রীর দিকে । খপ করে চেপে ধরলো রাত্রীর গলা । রাত্রী কিছু সময় নিজেকে ছাড়ানোর ব্যার্থ চেষ্টা চালিয়ে গেল । তবে এক সময় বুঝতে পারলো তার কিছু করার নেই । আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে আসতে থাকলো রাত্রীর দাপাদাপি । শেষ মুহুর্তে ওর কেবল নীলের কথা মনে পড়লো । সামনের লাল চোখের জন্তুটাকে সে নীল ভাবতে পারছে না মোটেই । নীলের সেই হাস্যোজ্জ্বল চোখটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে !
এই তাহলে শেষ!
আট
রাত্রীর যখনই মনে হল ওর দিন এবারই শেষ তখনই হাতের জোর কমে এল । রাত্রী নিজেও অনুভব করলো যে কিছু একটা এসে ধাক্কা মেরেছে সামনের নীলকে ! রাত্রীকে ফেলে দিতেই রাত্রী জোরে করে কেশে উঠলো । দম নিচ্ছে প্রাণ ভরে ।
খানিকটা ধীর স্থির হয়ে তাকালো সামনের দিকে ।
রাফায়েল!
নীলের মত দেখতে মানুষটা রাত্রীকে ছেড়ে দিয়ে রাফায়েলের দিকে এগিয়ে যেতে যাবে তখনই রাফায়েল তার হাত দুটো সামনে এনে মুখ দিয়ে সেই অদ্ভুত ভিনদেশী আওয়াজ করলো ।
''অপ্রে ভিয়েস্তা''
রাত্রী দেখলো দুই হাতের মাঝ দিয়ে একটা আলোর রেখে বের হয়ে এল । তীব্র গতিতে সেটা গিয়ে আঘাত করলো নীলকে । তারপর আবার, আরও একবার ! নীল রাত্রীর থেকে খানিকটা দুরে ঘিয়ে উল্টে পড়লো । আর উঠলো না ।
রাফায়েল চলে এসেছে রাত্রীর কাছে । ওকে উঠতে সাহায্য করলো । তারপর বলল, একা একা কেন এসেছেন এখানে ! মাথা খারাপ আপনার ?
রাত্রী সে প্রশ্নের জবাব দিল না । তার বদলে বলল, নীল এখানে কিভাবে এল ?
-এটা নীল না । যাই হোক । ঐ পাতাল ঘরে কোন নীল মুর্তি রয়েছে । আমাদের সেখানে যেতে হবে ! ওটার ভেতরে নীলের শরীরের কোন অংশ আছে । সেটা খুজে বের করে ধ্বংশ করতে হবে ।
রাফায়েল রাত্রীকে নিচে আবারও পাতালঘরের দিকে পা বাড়াবে তখনই পেছন থেকে ভয়ানক আওয়াজ পেল শুনতে পেল ওরা । নীলের মত দেখতে সেই অপদেবতা জেগে উঠেছে আবার !
রাফায়েল থেমে গেল । পকেট থেকে একটা ছুরি বের করে রাত্রীর হাতে দিল । এটা নিয়ে যান । এটা মুর্তিটাকে ভেঙ্গে ফেলবেন । তারপর সেই অংশটা খুজে বের করবেন যে ভাবই হোক !
-আপনি!
-আমার চিন্তা করতে হবে না । আমি যেভাবেই হোক আটকে রাখবো এটাকে । এখন যান জলদি যান ! আর ভুল করেও মুর্তির চোখের দিকে তাকাবে না ! মনে থাকবে ?
-আচ্ছা!
রাত্রী আর কিছু চিন্তা করলো না । দৌড়াতে শুরু করলো আবারও । ধুপধাপ করে নেমেই চলল সিড়ি দিয়ে । পাতাল ঘরে পৌছিয়ে খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল । ওর হাত থেকে পড়ে যাওয়া মোবাইলটা এখনও পড়ে আছে । সেটার থেকে ফ্লাশ লাইট ছড়িয়ে রয়েছে । পুরো ঘরে একবার আলোটা ছড়িয়ে ফেলতেই পড়ে থাকা রিভালবারটা দেখতে পেল । সেটা কোমরে খুজে নিল । উপরর থেকে তখন কিছু ভেঙ্গে পড়ার আওয়াজ আসছে । ওকে জলদি করতে হবে ! রাত্রী মুর্তিটার দিকে পা বাড়ালো ।
মোবাইলটা হাতে নিয়ে নিয়ে এগিয়ে গেল মুর্তিটার কাছে । সব ঝামেলা এই মুর্তিট ভেতরেই । এটাকে সবার আগে ধ্বংশ করতে হবে ! মুর্তিটার দিকে তাকাতেই মনে হল সেটা জীবিত । রাফায়েল ওকে বলেছিলো চোখের দিকে না তাকাতে ! কিন্তু রাত্রী সেই কৌতুহল টা দমাতে পারলো না । সে তাকিয়ে ফেলল চোখের দিকে ।
রাত্রীর দিকে চোখ পাকিয়ে ভয়ংকর চোখে তাকিয়ে আছে লাল চোখের মুর্তিটা । রাত্রীর মনে হল যেন ওটা কিছু বলছে । কিছু বলার চেষ্টা করছে । রক্ত লাল চোখ দিয়ে তাকিয়ে আছে একভাবে । রাত্রীর পুরো শরীর কেঁপে উঠলো ।
মুর্তিটা ওকে যেন বলছে, কেন করছো ? নীলকে তোমার কি দরকার ! তুমি এতো সুন্দর একটা মেয়ে ! এতো যোগ্য ! কি দরকার এক নীলের পেছনে জীবন নষ্ট করার ! ওকে ছেড়ে দাও ! আমার কাছে এসো ! দেখো সব কিছু পাবে তুমি ! সব কিছু !
রাত্রীর হাত থেকে ছুরিটা পরে গেল । রাত্রীর মনে হল তাই তো ! সে কেন এতো কষ্ট করছে নীলের জন্য ! ডাক্তারি পড়ার সময়ে কত মানুষ ওর জন্য পাগল ছিল । এমন কি কদিন আগেও একজন ওকে দেখে পাগল হয়েছিলো । ওকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো । বিশাল বড় লোক সে ! পরে ও বিবাহিত শুনে পিছিয়ে গেছে ! আজকে নীল না থাকলে সে কত কিছু পেত !
তাই তো সে কেন নষ্ট করবে নীলের জন্য ! কিছু নেই ওর !
ও রাত্রীর স্বামী হওয়ার যোগ্যই না !
রাত্রী একভাবে তাকিয়ে রইলো মুর্তির চোখের দিকে । মুর্তিটা ওকে আবারও বলল, এই তো ! এবার তোমাকে আমি সব কিছু দেব ! সব । তুমি যা চাইবে সব পাবে তুমি ! কেবল তুমি আমাকে গ্রহন কর ! একবার আমাকে গ্রহন কর ! নিজের ভেতরে আমাকে ডাকো আর আমার কথা মত কাজ কর!
রাত্রী বলল,হ্যা আমি করবো ! আমি সব করবো ! আমি সব কিছু চাই !
ঠিক এই সময়ে রাত্রীর মনে হল কেউ তার মাথার ভেতরে যেন একটা তীব্র ছুরির ফলা ঢুকিয়ে দিল । চিনচিন করে ব্যাথা অনুভব করলো । রাত্রী নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো ওর হাতেই সেই ক্ষতটা আবার ফিরে এসেছে । সেখান দিয়ে রক্ত পড়ছে । মাথার ভেতরে এবার অন্য একটা কন্ঠস্বর শুনতে পেল !
রাত্রী ! আমার কথা শোন ! নীল তোমার জন্য অপেক্ষা করছে !
মাথাটা আবারও ঝিম ঝিম করে উঠলো । বাস্তবে ফিরে এল আবার !
হ্যা কি করছিলো ও ! মুর্তিটা ওকে কাবু করে ফেলেছিলো প্রায় !
রাত্রী কোমর থেকে রিভালবারটা বের করলো। এবার আর কোন ভুল করলো না । মুর্তিটার দিকে তাকালো না । সেফটি লক খোলাই ছিল । মুর্তি বরাবর গুলি চালিয়ে দিল । সাথে সাথেই উপর থেকে একটা গগন ফাটানো চিৎকার শুনতে পেল সে ! সম্ভবত কাজ হয়েছে । আরও তিনটা গুলি করলো সে । চোখ বন্ধ করেই গুলি করেছে সে ।
চোখ খুলে দেখলো মুর্তির মাথাটা প্রায় ধ্বংশ হয়ে গেছে ! কাজ হয়েছে ! এরপরও আসল কাজ শুরু ! ছুরি দিয়ে একের পর এক গর্ত করতে করতে শুরু করলো । ভেবেছিলো মুর্তিটা বুঝি পাথরের তৈরি কিন্তু সেটা পাথরের না ! অন্য কিছুর তৈরি । কিসের তৈরি সেটা সেটা বলতে পারলো না । তবে সেবস চিন্তা করার সময় নেই এখন । আগে পুরো মুর্তিটা খুজে দেখতে হবে ! ওর হাতে বেশি সময় নেই । কে জানি উপরে রাফায়েল কি করছে । সে দ্রুত হাতে মুর্তিটাকে ছুরি দিয়ে ভাঙ্গতে শুরু করলো । ঠিক সময়েই সিড়ি দিয়ে ধুপধাপ নামার আওয়াজ শুনতে পেল । কেউ একজন খুব দ্রুত নেমে আসছে ।
রাফায়েল নামছে না এটা সে নিশ্চিত !
তাহলে কি !!
আরও মিনিট খানেক পরে তাকে দেখতে পেল । ভয়ংকর ভাবে চমকে গেল সে । কোন মানুষ হতে পারে না । শরীরের নানান স্থানে ক্ষত । যেন ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছে । রাত্রীর দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো । রাত্রী কি করবে এখন ?
পাশেই রিভালবারটা পড়ে ছিল । সেটা তুলে নিয়ে একের পর এক গুলো চালাতে শুরু করলো । প্রতিটা গুলির আঘাতে সেটা একটু দুরে সরে গেল বটে তবে সেটা থেমে গেল না । আবারও উঠে আসতে শুরু করলো । এবার চার পায়ে হেটে আসছে সে ! একেবারে জন্তুর মত করে ।
গুলি শেষ হয়ে গেল একটু পরেই । মুর্তি ভাঙ্গতেই চারটা গুলো খরচ করে ফেলেছিলো ।
এইবার কিভাবে থামাবে ওটাকে ?
রাত্রী যেন ফ্রিজ হয়ে গেছে । সেটা এবার রাত্রীর শরীর উদ্দেশ্য করে লাফ দিলো! তবে রাত্রীর শরীর বরাবর পৌছাতে পারলো না । ঠিক সামনে এসে থেমে গেল । রাত্রী অবাক আর অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলো সেদিকে । দেখলে মনে হবে যেন ওটাকে কেউ শূন্যে ধরে রেখেছে ।
রাত্রীর চোখ চলে গেল পেছনে । দেখলো পেছনে রাফায়েল এসে দাড়িয়েছে । দুই হাত সামনে তুলে ধরে রেখেছে । রাত্রীকে বলে দিতে হল না যে এই জন্তুটাকে শূন্য ধরে রেখেছে । রাত্রী দেখতে পেল রাফায়েল দুই হাত এক পাশে টান দিতেই জন্তুটা এক পাশের দেওয়ালে গিয়ে আছাড় খেল । মুখ দিয়ে আবারও তীব্র চিৎকার বের হয়ে এল । পুরো ঘরটা যেন কেঁপে উঠলো ।
রাফায়েল বলল, আপনি খুজে বের করুন জলদি !
এবার রাত্রী আবারও নিজের কাজে নেমে গেল । ছুরি দিয়ে মাথাটা খোঁচাতে শুরু করলো। মাথাটা ধ্বংশ করতে কাঙ্খিত বস্তুটা পেয়ে গেল সে । একটা কাগজে মুড়ে মুর্তির ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া রয়েছে ।
একগাছি চুল !
-পেয়েছি!
রাফায়েল আরেকবার জন্তুটাকে দুরে ছুরে ফেলে দিয়ে রাত্রীর কাছে এগিয়ে এল । তারপর চুপটা হাতে নিলো । দুই হাতের ভেতরে চেপে ধরেই কিছু একটা বলল । কি যে বলল রাত্রী সেটা বুঝতে পারলো না । তবে দেখতে পেল সাথে সাথেই হাতের ভেতরে আগুন ধরে গেল । সেই সাথে সাথেই আরেকটা চিৎকার শুনতে পেল ।
আর্তনাদের চিৎকার । দেওয়ালের শেষ ঐ দিক থেকে আসছে । রাফায়েল এবার সেদিকে ফিরে তাকালো । কঠিন স্বরে কিছু যেন বলল তাকে । উত্তরে সেটাও কিছু বলল । যেন অনুনয় বিনয় করছে ।
রাফায়েল কিছু বলতে যাবে তার আগেই তীব্র বেগে সে সিড়ি দিয়ে দৌড়ে পালালো । রাত্রী বলল, ওটা যে পালিয়ে যাচ্ছে !!
-যাক ! সমস্যা নেই ।
-নেই?
-নাহ !
পরিশিষ্টঃ
ফরেস্ট বাংলোটার ডান দিকে লম্বালম্বি দুটো মোটা গাছের সাথে একটা ঝুলন্ত নেটের বিছানা বাঁধা হয়েছে। গত দুই দিন থেকে এই ঝুলন্ত বিছানাতাই রাত্রী আর নীলের সব থেকে পছন্দের জায়গা হয়ে দাড়িয়েছে । দিনের বেশির ভাগ সময়টা ওরা এখানেই কাটায় । দুজন এক সাথে যেন বিছানাতে বসে কাটাতে পারে এমন শক্ত আর মজবুত করেই বানানো হয়েছে ।
রবিন গড়ে ওরা ওরা ফিরে এসেছে । মাত্র মাস দুয়েক পরেই যে রাত্রী আবার ফিরে আসবে এবং নীলকে সাথে নিয়ে সেটা কোন দিন ভাবতেও পারে নি । তখন ওর কাছে মনে হচ্ছিলো যেন এই দুঃসময় যেন আর কাটবে না । কিন্তু কেটে গিয়েছে ।
ঐদিনের সেই অবিশ্বাস্য ঘটনার পরই ওরা ঢাকাতে ফিরে গিয়েছিলো । বাসায় যাওয়ার আগে গিয়ে হাজির হয়েছিলো ক্লিনিকে । যাত্রা পথেই রাত্রীর কাছে ফোন এসে হাজির হয়েছিলো । নীলের ঘুম ভেঙ্গেছে । অন্য ডাক্তারেরা পরীক্ষা করে দেখেছেন । নীলের অবস্থা নাকি স্বাভাবিক । যেন হঠাৎ করেই সব ঠিক হয়ে গেছে । নীল যে ভয় পাচ্ছিলো সেটাও পাচ্ছে না এখন আর ! কেবিনে ঢুকে সবার আগে নীলেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থাকলো । মনে হল যেন কতদিন পরে নীলকে এভাবে জড়িয়ে ধরতে পারলো সে ।
রাফায়েল ওদেরকে আশ্বস্ত করলো যে এখন আর কোন ভয় নেই আপাতত । তবে অনেক দিন নীলের সাথে ঐ অপদেবতাটার একটা সংযোগ ছিল সামনে কিছু ঝামেলা হতে পারে । তবে সেটা নিয়ে ভয় পাওয়ার একদমই কিছু নেই । এমন সমস্যা হলে যেন ওকে খবর দেওয়া হয় !
তারপর যতই দিন যেতে লাগলো নীল দ্রুত ঠিক হয়ে উঠতে শুরু করলো । তারপর যখন একেবারে সুস্থ হয়ে উঠলো তখন নীলের ইচ্ছে হল । ওরা সেই রবিন গড়েই বেড়াতে এসেছে । এখানে সময় কাটছে ওদের বেশ ! এখনও সেই ঘটনা রাত্রীর কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয় । রাত্রীর মনে হয় ও একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছে কেবল । এখন জেগে উঠেছে । ওর পুরো বিশ্বাসটা কেমন যেন নাড়িয়ে দিয়েছে রাফায়েল নামের মানুষটা ! তবে রাত্রী এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে পৃথিবীর সব কিছুর ব্যাখ্যা সম্ভব না । পৃথিবী ব্যাখ্যার অতীত অনেক কিছু ঘটে । এটা মেনে নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে ! তবে নীলের জীবনের কালো একটা অধ্যায় যে শেষ হয়েছে সেটাই রাত্রীর জন্য অনেক বড় কিছু । ওদের জীবনে যে অশুভ ছায়াটা এসে ভর করেছিলো সেটা বিদায় নিয়েছে ।
রাফায়েল সিরিজ ১৭
ব্লগ নিয়ে জরিপে অংশ নিয়ে সাহায্য করুন
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০২১ রাত ২:১১