প্রথম অংশ
ছয়
তন্বীর যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন বেশ সকাল হয়ে গেছে । বাইরের রোদ ওর মুখে এসে লাগছে । ঘুম ভাঙ্গার পর বেশ কিছুটা সময় ও বিছানাতেই শুয়ে রইলো । মাথাটা এখনও খানিকটা ভার ভার ঠেকছে । কিছু সময় বুঝতে পারলো না কেন এমন হচ্ছে।
চোখ বন্ধ করে আরও কিছুটা সময় শুয়ে রইলো ও । এক কাপ গরম চা খেতে ইচ্ছে করছে খুব । বিছানা থেকে জোরে ডাক দিলে ওর আম্মু হয়তো চা দিয়ে যাবে । কিন্তু ডাক দিতে ইচ্ছে হল না । মনে হল আরও কিছু সময় বিছানাতেই পড়ে থাকে । আজকে ওর অফিসেও যেতে ইচ্ছে করছে না ।
অফিসের কথা মনে হতেই গতকালকের সব কথা মনে পড়ে গেল ।
তন্বী একলাফে বিছানায় উঠে বসলো । এক ঝটকাতেই সবকিছু মনে পড়ে গেল । ও যে বারে ঢুকেছিলো এইটুকু মনে আছে, কিন্তু তারপর ? তারপর কি হয়েছিলো? এক ক্যান বিয়ার খেয়েছিলো এটাও একটু ভাসা ভাসা মনে আছে ! কিন্তু এরপরে আর কিছুই মনে পড়ছে না !
কি হয়েছিলো?
ও বাসায় কিভাবে এল রাতের বেলা ?
যখনই বাসার কথা মনে হল তন্বী ঘরটার দিকে তাকিয়ে দেখলো ।
ঘরটা ওর অপরিচিত ! এটা ওর নিজের ঘর না ।
এটা কার ঘর !
ওকে এখানে কে নিয়ে এসেছে ।
মনের ভেতরে একটা ভয় পেয়ে বসলো । বিছানার ঠিক ডানদিকে একটা বড় আয়না রয়েছে । সেখানে পুরো বিছানাটা দেখা যাচ্ছে । তন্বী নিজেকে দেখতে পেল সেখানে । দেখার সাথে সাথেই আরেকবার চমকে উঠলো । ওর পরনে গতকালের পোশাক নেই । একটা কালো টিশার্ট পরা রয়েছে । নিচে একটা টাইটস রয়েছে । অনুভব করতে পারলো ওর ভেতরে কোন আন্ডারগার্মেন্স পরা নেই ।
তন্বীর পুরো শরীর কাঁপতে লাগলো । কি হয়েছে গতরাতে ওর সাথে ?
কে ওকে নিয়ে এসেছে?
নিয়ে এসে আবার ওর পোশাকও বদলে দিয়েছে । তারপর কি করেছে ওর সাথে ?
ওর হুশ ছিল না তার মানে ওর সাথে যা ইচ্ছে করতে পারে । কথাটা ভাবতেই ওর পুরো শরীরটা কেঁপে উঠলো । কি করবে ও !
তন্বী বিছানা থেকে নেমে এল ! আগে দেখা দরকার ও এখন কোথায় আছে । দরজা খুলে বের হয়ে আসতেই জায়গাটা চিনতে পারলো । ফারিজের বাসা এটা । গতদিন পার্টিতে যাওয়ার আগে ওকে এখানে নিয়ে এসেছিলো ফারিজ । নিচের একটা ঘরে ওকে সাজানো হয়েছিলো । সেদিন ও উপরে ওঠে নি । তন্বী সিঁড়ি দিয়ে আস্তে ধীরে নিচে নেমে এল । ওর মনে হল যেন বাসায় কেউ নেই । ফারিজ কোথায় ?
সে ওকে কিভাবে এখানে নিয়ে এল ? আর রাতে সে কি করেছে ওর সাথে ?
যখন তন্বীর মনে হল যে বাসায় কেউ নেই তখনই একজন মেইড বের হয়ে এল । ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
-ম্যাম আপনি উঠেছেন ! কিছু খাবেন কি ?
খাওয়ার কথা মনে হতেই তন্বীর মনে হল ওর খুব ক্ষুধা লেগেছে । ওকে মুখ দিয়ে কিছু বলতে হল না । মেইড খাবার টেবিল সাজাতে শুরু করলো । কাছের বেসিন থেকে হাত মুখ নিল ও । সাথে সাথেই একটা তোয়ালে নিয়ে হাজির হল মেয়েটা । তন্বী আগে কিছু খেয়ে নিতে চাইলো । ওর সত্যিই খুব বেশি ক্ষুধা লেগেছে । এই সময়ে অন্যকিছু ভাবার সময় নেই ।
খাওয়া শেষ করতে না করতেই আবারও মেইড এসে হাজির হল । তন্বীর দিকে তাকিয়ে বলল,
-আপনার ঘরে আপনার জন্য পোশাক রেডি করা আছে । ড্রাইভার রওয়ানা দিয়েছে । কিছু সময়ের ভেতরেই চলে আসবে ।
এই বলে মেইড চলে যাচ্ছিলো । তন্বী বলল,
-শুনো
-জি ম্যাডাম !
-কাল রাতে আমি কখন এসেছি বাসায় ?
-ম্যাডাম আমি তো বলতে পারবো না । দারোয়ান বলতে পারবে !
-কেন ? তুমি ছিলে না ?
-জি না ম্যাডাম । আমি রাতে থাকি না এখানে । সকালে আসি আর সন্ধ্যার একটু পরেই চলে যাই । স্যার তো এখানে সবসময় থাকেন না । মাঝে মাঝে আসেন । যেদিন থাকেন সেদিন আমাকে আগে থেকে বলে যান । আমি তার জন্য রান্না করি । নয়তো কেবল ঘরদোর পরিস্কার করে চলে যাই । দারোয়ান থাকে সবসময় ।
-আচ্ছা, ঠিক আছে !
খুব সময় নিয়ে তন্বী গোসল সারলো । একটু আগে ও নিজের ফোনটা চেক করেছে । সেখানে দেখা যাচ্ছে গতরাতে ওর মাকে এই ফোন থেকে ফোন করা হয়েছিলো । কে করেছিলো সেটা বুঝতে কষ্ট হল না । ফারিজ ফোন করে কি বলেছে কে জানে ! সবচেয়ে বড় কথা ওর শরীর থেকে পোশাক খুলেছে সে । ওর কোন হুশ ছিল না । সে ওর সাথে কি করেছে ?
অনেক কিছু করতে পারে ! কথাটা ভাবতেই তন্বীর শরীরের ভেতরে একটা রাগ দেখা দিল । গতকাল ঐ এলাইনা নামের মেয়েটার কথায় ও খুব বিরক্ত হয়েছিলো । মেয়েটার সাহস তো কম না ! আর এই দিকে ফারিজ !
তন্বী গোসল শেষ করে জামা কাপড় পড়ে নিল । গাড়িতে উঠতেই ড্রাইভার মনজুর বলল,
-কোনদিকে যাবো ম্যাডাম ? আপনার অফিস ?
-না । তোমার স্যারের অফিসের দিকে যাও !
মনজুর কোন কথা না বলে গাড়ি স্টার্ট দিল ।
রিসিপশনের মেয়েটা কিছু বলতেই যাচ্ছিলো কিন্তু পেছন থেকে মনজুর এসে বলল,
-ইনাকে ভেতরে যেতে দেন ।
রিসিপশনের মেয়েটা আর কিছু জানতে চাইলো না । ভাগ্য ভাল বুদ্ধি করে তন্বী মনজুরকে সাথে নিয়ে এসেছে । নয়তো এই বিশাল অফিসের ভেতরে ও ঢুকতে পারতো না এতো সহজে !
মনজুর ওকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল । একেবারে ফরিজের ক্যাবিনের সামনে গিয়ে থামলো । ওদেরকে থামতে হল । আরও একজন মানুষ ওদের পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে । ছেলেটা সম্ভবত পিএস টাইপের কিছু হবে । একেবারে ফারিজের কেবিনের সামনে তার ডেস্ক ! তন্বীর দিকে তাকিয়ে বলল,
-এখন স্যার মিটিংয়ে আছেন । আপনি ভেতরে যেতে পারবেন না ।
মনজুর কিছু বলতে গেল তবে তন্বী তাকে হাত ইশারা করে থামিয়ে দিল । তারপর লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল,
-তুমি কি পোস্টে চাকরি কর ? ফারিজের পিএস ?
তন্বী দেখলো সামনে দাঁড়ানো স্যুট পরা মানুষটার চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে । সম্ভবত তন্বী যে তাকে তুমি করে বলছে এটা সে খানিকটা মেনে নিতে পারছে না । কিন্তু তন্বীর ঔদ্ধত্য দেখে কিছু বলতেও পারছে না । তন্বী তার বসের নাম ধরে ডাকছে । তার উপর পেছনে বসের ড্রাইভার দাঁড়িয়ে রয়েছে ।
তন্বী কিছু সময় ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকলো । বুঝতে কষ্ট হল না যে ছেলেটা দ্বিধান্তিত হয়েছে । তন্বী আর কিছু চিন্তা করলো না । সোজা কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেল । পেছনে থেকে ছেলেটা ওকে আটকানোর চেষ্টা করেছিলো কিন্তু তন্বী সেটা শুনলো না ।
কেবিনের ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেল ফারিজের সাথে আরও তিন মানুষ রয়েছে । কোন বিষয় নিয়ে তারা কথা বলছিলো । ওকে ঢুকতে দেখে ওর দিকে ফিরে তাকালো । ফারিজের চোখে খানিকটা কৌতূহল । অন্য তিনজন তাকিয়ে আছে ওর দিকে । তন্বী সেদিকে মন দিল না । ফারিজের দিকে তাকিয়ে বলল,
-উই নিড টু টক !
ফারিজ বলল,
-এখন ? কাজ করছি তো !
সামনে থেকে একজন বলল,
-ফারিজ সাহেব, মনে হয় অনেক কাজ করা হয়েছে আপাতত । আমরা অনেক সময় ধরেই কথা বলছি । একটু ব্রেক দরকার । লাঞ্চ আওয়ারের পরে আবার শুরু করি !
ফারিজ সেই লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল,
-আর ইউ শিওর ?
-হ্যা হ্যা অবশ্যই । কোন সমস্যা নেই । আমাদের মূল আলোচনা তো হয়েই গেছে । এখন কেবল কিছু মাইনর আলোচনা বাকি ! আপনারা বরং নিজেদের মাঝে কথা শেষ করে নিন ।
ফারিজ হাতের ডানদিকে একটা সুইচে চাপ দিল । সাথে সাথে দরজা খুলে সেই পিএস ছেলেটা ঘুরে ঢুকলো ।
-জি স্যার ?
-ইনাদের ভিআইপি গেস্টরুমে নিয়ে যাও, তারপর লাঞ্চের ব্যবস্থা কর । দেখো কি খেতে চান ওনারা ! ঠিক আছে ?
-জি স্যার ।
-আর আমাদের জন্য কফি দাও দুই কাপ ।
তন্বী ফারিজের সামনে বেশ কিছু সময় বসে রইলো । তাকিয়ে আছে ফারিজের দিকে । মনে মনে যে রাগটা ও নিয়ে এসেছিলো, এমনকি কেবিনে ঢুকেও যে রাগ নিয়ে কথাটা বলেছিলো, সেটা কেন যেন এখন আর ধরে রাখতে পারছে না । তারপরেও তন্বী বলল,
-কাল রাতে আমাদের মাঝে কি হয়েছে ?
ফারিজ প্রশ্নটা শুনে যেন খুব কৌতুকবোধ করলো । তারপর বলল, কি হবে ?
-আমি কিভাবে জানবো?
ফারিজ হাসলো । তারপর বলল,
-আমি কেন বলবো শুনি? বিয়ার খেয়ে মাতাল হয়েছিলে তুমি । কি করেছো সেটার জন্য তো অন্য কেউ দায়ী হতে পারে না । সহ্য হয় না তো খেতে বলেছে কে?
তন্বী ক্ষুদ্ধ চোখে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো ফারিজের দিকে । তারপর বলল,
-আমার যদি কিছু হয় তাহলে তোমাকে আমি দেখে নিবো বললাম ! সত্যিই দেখে নিবো । তুমি আমাকে পেয়েছো কি ? তোমার একটা উপকার করেছি কি করি নি, তাই বলে এই সুযোগ তো তোমাকে দেই নি আমি ।
তন্বী ফারিজকে উঠে দাঁড়াতে দেখলো। ফারিজ আস্তে আস্তে এগিয়ে এল ওর দিকে । তন্বী কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না । ওর মনে আবারও সেদিনের সেই ভয়টা জেঁকে বসলো । ছেলেটার চোখে কি যেন আছে । তন্বী কিছুতেই সেটা সহ্য করতে পারে না ।
ফারিজ তন্বীকে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরলো খানিকটা । তন্বীর সব হাত পা অবশ হয়ে এল মুহূর্তেই । ফারিজ ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
-গতরাতে কি হয়েছিলো বলবো? তুমি এতোটাই ড্রাংঙ্ক হয়েছিলে যে বমি করে ভাসিয়ে দিয়েছিলে । তোমাকে তুলে নিয়ে ঘরে আসি । তারপর ওয়াশরুমে নিয়ে যাই । তোমার শরীর থেকে সব জামাকাপড় আমি নিজে খুলেছি ।
কথাটা বলে তন্বীর চোখের দিকে একভাবে তাকালো ফারিজ । তন্বীর বুকটা কেমন কেঁপে উঠলো । সামনে দাঁড়ানো মানুষটা কালকে ওকে কাপড় ছাড়া দেখেছে । তন্বী কোনমতে বলল,
-তারপর?
ফারিজ যেন খুব মজা পেল । তারপর বলল,
-আরও শুনতে চাও ? আচ্ছা শুনো তাহলে । যখন ঐ অবস্থাতে তোমাকে বিছানাতে শুইয়ে দিয়ে ফিরে যাচ্ছিলাম তখন তুমি হঠাৎ আমার হাত চেপে ধরলে । বললে, 'কোথায় যাও বয়ফ্রেন্ড ! তুমি কেমন বয়ফ্রেন্ড শুনি ? নিজের গার্লফ্রেন্ডকে এভাবে একা ফেলে যাচ্ছো !' তারপর আমাকে টেনে নিয়ে গেল বিছানাতে .... আরও শুনবে ?
তন্বী চোখ বন্ধ করে ফেলল । খনিকটা কল্পনা করার চেষ্টা করলো গত রাতের ঘটনাটা । আর ভাবতে পারলো না । ওর পা টা যেন আরও একটু কাঁপতে লাগলো । ফারিজ ওর আরও খানিকটা কাছে চলে এসেছে । এমন সময় খুট করে দরজা খুলে গেল । ফারিজের পিএস ছেলেটা হাতে দুইটা কাপ নিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েছে । ওদেরকে ওভাবে দেখে খানিকটা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো । ফারিজ বলল,
-জাকির, নক করে ঢোক ।
-স্যরি স্যার । দুই হাতেই কফি তো ...
-যাও কফি রাখো টেবিলে । গেস্টদের খাবার দেওয়া হয়েছে ?
-জি স্যার ।
-আচ্ছা যাও !
জাকির নামের ছেলেটা দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল দ্রুত । ফারিজ এবার তন্বীকে ছেড়ে টেবিলের কাছে চলে গেল । সেখান থেকে একটা কাপ এনে তন্বীর হাতে তুলে দিল । তারপর আবারও নিজের ডেস্কের দিকে এগিয়ে গেল । বলল,
-কৌতূহল মিটেছে ?
তন্বী কোন কথা বলল না ।
-এবার থেকে আর একা একা বিয়ার খেতে যেও না। যদি বিয়ার খেতেই ইচ্ছে হয় তাহলে আমাকে বলবে । আমার বাসাতেই আছে । ভাগ্য ভাল যে আমি তোমাকে আনতে মনজুরকে পাঠিয়েছিলাম । ও তোমার খোঁজ পেয়ে আমাকে ফোন দিয়েছিলো । নয়তো কাল কি হত একবার ভেবেছো কি ?
তন্বী মনে মনে বলল,
-আর হওয়ার বাকি আছে কি !
মুখে বলল,
-আমি বাসায় যাবো ।
-কফি খেয়ে যাও ।
-না কফি খাবো না। বাসায় গিয়ে বিয়ার খাবো । তারপর আবারও মাতাল হব । তোমার কোন সমস্যা ?
ফারিজ কফিতে একটা চুমুক দিয়ে হা হা করে হেসে ফেলল । তারপর,
-মনজুর আছে । ওকে নিয়ে যাও ।
-লাগবে না । আমি একাই যেতে পারবো । আজকের পর থেকে আমাদের মধ্যে আর কোন সম্পর্ক নেই । বুঝতে পারছো । যে ডিলটা হয়েছিলো সেটা অফ ! টাটা ।
ফারিজকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তন্বী বের হয়ে গেল । দরজা দিয়ে বের হতেই লক্ষ্য করলো যে অফিসের প্রতিটা চোখ ওর দিকে নিবদ্ধ । এতো সময় সবাই!যে কান খাড়া করে ওদের দিকেই তাকিয়ে ছিলো সেটা বুঝতে বাকি রইলো না ।
তন্বী কোনদিকে না তাকিয়ে দ্রুত লিফটের দিকে হাঁটতে শুরু করলো । ওর নিজেকে কষে একটা চড় মারতে ইচ্ছে করছে । কেন এমন একটা পাগলামো করতে গেল কালকে । কি দরকার ছিল বারের ভেতরে ঢোকার । এমনিতেও একটা বিয়ার খেয়ে কত বড় ঝামেলাতে পড়েছিলো । আর গতদিন কতগুলো খেয়েছে সেটা ওর মনেও নেই । ফারিজ যা বলল তা যদি সত্যি হয় !!
তন্বী আর কিছু ভাবতে পারলো না । আর কিছু ভাবতে চায় না ও । সবকিছু ভুলে যেতে চায় !
সাত
তন্বীর অফিসে দম ফেলার মত সময় এখন নেই । যে কোন অফিসের প্রধান হওয়াটা যে কত প্যারার একটা কাজ সেটা তন্বী এই কদিনের হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে । এখন অফিসের সব কিছু তন্বীর নজরদারীতে হচ্ছে । হতে হচ্ছে । অনেক কিছুই বদলে গেছে । তন্বী নিজের মত করে সামলে নিচ্ছে । প্রথমে একবার মনে হচ্ছিলো যে পারবে না । তবে এখন মনে হচ্ছে পারবে ।
আগের ম্যানেজার যে কোন প্রজেক্টের কাজ অন্যের উপর চাপিয়ে দিয়ে নিজে বসে বসে হাওয়া খেত তার ভুল ভ্রান্তি বের করতো । কিন্তু তন্বী এই কাজটা করে নি । যে কোন প্রজেক্টের সাথে তন্বী একেবারে প্রথম থেকে যুক্ত থাকছে । নিজে কাজ করছে । এই কারনটা সম্ভবত তন্বীকে অফিসে জনপ্রিয় করে তুলল ।
আগে তো তন্বী কেবল একটা প্রেজেক্ট নিয়েই ব্যস্ত থাকতো এখন নিজের একটা প্রধান প্রজেক্ট বাদ দিয়েও প্রায় প্রতিটি প্রজেক্টে ওর সংযুক্তি রয়েছে । তন্বীর এই ব্যস্ততা ভাল লাগছে । প্রথম প্রথম একটু কষ্ট যে হয় নি সেটা না তবে সামলে নিয়েছে সে । সব চেয়ে বড় কথা রাতে ভাল ঘুম হচ্ছে ওর । প্রতিদিন কঠিন পরিশ্রম করে বাসায় গিয়ে যখন হাজির হয় তখন ক্লান্তিতে শরীর ভেঙ্গে পড়ে । খেয়েই ঘুম দেয় । এক ঘুমিে রাত পার । আবিদের সাথে ওর ব্রেকআপের পর ঘুমে বেশ সমস্যা হচ্ছিলো । তবে সেটা এখন একেবারে চলে গেছে ।
আজকে প্রায় এক মাস পরে তন্বী একটু স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলল । যে বড় প্রেজেক্টটা নিয়ে ওরা কাজ করছিলো সেটা আজকে শেষ হয়েছে । ক্লান্ত খুবই পছন্দ করেছে ওদের কাজ । আগামী এক বছরের জন্য ওদের সাথে এক ডিল ফাইনাল হয়ে যাবে খুব জলদি । বস ফোন দিয়েছিলো তন্বীক । ওর খুব প্রসংশা করলো ।
অফিস ছুটি পর আরও কিছু সময় সে নিজের কেবিনে বসে রইলো । সামনে কদিন একটু কাজের চাপ কম । কটা দিন একটু আরাম করে ঘুমানো যাবে । কিন্তু তন্বী জানেও না যে তার জন্য তার নিজের বাসাতে কি অপেক্ষা করছে ।
আজকে একটুঅফিস থেকে বের হয়ে বেশ কিছু সময় সে হাটাহাটি করলো । এদিক ওদিক আগে আগের মত । আগে প্রায়ও অফিস শেষ করে সে এদিক ওদিক হাটাহাটি করতো । আজকেও বেশ কিছুটা সময় সে হাটাহাটি করলো একা একা । তারপর বাসার দিকে রওয়ানা দিল । বাসায় পৌছাতে পৌছাতে আজকে একটু রাত হয়ে গেল। বাসায় ঢুকতেই বড় সর একটা ধাক্কা খেল সে । ওর মনে হল যেন ও অন্য কারো বাসায় ঢুকে পড়েছে । ভাসা ভর্তি মানুষ জন । বেশির ভাগ মানুষদেরই ও চিনে না । কোন দিন দেখে নি । ও বাসার ভেতরে ঢুকতেই সবাই ওর দিকে ঘুরে তাকালো । তন্বী ঠিক বুঝতে পারছিলো না যে কি করবে !
এরা কারা ! এদের তো আগে কোন দিন দেখে নি ?
ওর মা কিংবা বাবার পরিচিত মানুস হতে পারে না । কারণ ওদের যা আত্মীয় স্বজন আছে সবাইকেই মোটামুটি সে চিনে । এতো গুলো অপরিচিত মানুষের মাঝে হঠাৎ করেই একজন পরিচিত মুখ সে দেখতে পেল !
মনের ভেতরে একটা ধাক্কা দিলো সাথে সাথে !
একটা প্রশ্নই মাথার ভেতরে এল !
এই মহিলা এখানে কি করছে ?
তার তো এখানে কোন ভাবেই থাকার কথা না । এখানে কি করছে ?
ওর বিস্ময় আরও একটু বাড়িয়ে দিতে দেখতে পেল ভেতরের ঘর থেকে এক বদ্ধা বের হয়ে এল হাসি মুখে । বৃদ্ধা তন্বীকে দেখে আরও একটু বিস্তৃত হাসি দিলেন ! বললেন, হেয়ার ইউ আর মাই চাইল্ড ! কাম হিয়ার !
তন্বী ধীরে ধীরে ফারিজের দিম্মার দিকে এগিয়ে এল । তিনি তন্বীর মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন । তারপর তার কপালে একটু ছোট্ট চুমু খেয়ে বললেন, তুমি তো সেই গেলে আমাদের একেবারে ভুলেই গেলে । তাই চলে এলাম তোমার সাথেই দেখা করতে !
এমন যে কিছু হতে পারে সেটা তন্বী মোটেও ভাবতে পারে নি । ফারিজের সাথে শেষ দেখা হয়েছিলো সেই মাস খানেক আগে । এরপর সে কি করেছে কিংবা কোথায় গিয়েছে সেই ব্যাপারে তন্বীর কোন ধারনা নেই । সে সব কিছু শেষ করে দিয়ে এসেছিলো । তার আর কিছু ভাবার ছিলও না । আর নিজের কাজ নিয়েই সে ব্যস্ত ছিল বিধায় অন্য কিছু ভাবার সময়ও ছিল না ।
তন্বীর এবার তাকালো ফারিজের মায়ের দিকে । তিনি তন্বীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকে আমি কি বলেছিলাম ?
তন্বী ঠিক কিছু মনে করতে পারলো না যে কি বলেছিলেন উনি । খানিকটা মনে করার চেষ্টা করলো ।
-এসো আমার সাথে !
এই বলে তন্বীকে নিয়ে তন্বীর নিজের ঘরের দিকে হাটা দিল । যাওয়ার পথে রান্না ঘরে উকি দিয়ে দেখলো ওর মা রান্নাতে ব্যস্ত । তাকে দুজন অপরিচিত মহিলা সাহায্য করছে । তাদের সাথেই গল্প করছে । ফারিজের দিম্মও এসে যোগ দিল তাদের সাথে । তন্বীর দিকে তাকিয়ে ওর মা একটু হাসলো । বুঝতে কষ্ট হল না যে পুরো বাড়িটা ফারিজের আত্মীয় স্বজন দখল নিয়ে নিয়েছে । তন্বী ফাজির মায়ের সাথে নিজের ঘরে ঢুকলো । ফারিজের মা ওর দিকে তাকিয়ে বলল, আমি কি তোমাকে বলেছিলাম না যে কোন ঝামেলা হলে আমার কাছে আসবে । হঠাৎ করেই কিছু সিদ্ধান্ত নিবে না !
তন্বী কিছু বলতে গিয়েও যেন বলতে পারলো না ।
-তোমরা যে ঝগড়া করে ব্রেক আপ করেছো এটা না তুমি বলেছো না ফারিজ ! কেউ বলে নি আমাকে ! কদিন ধরেই ফারিজের মুড অফ ! ঠিক মত খায় না, ঘুমায় না। সারারাত বাড়িময় পায়চারি করেছে ! বাড়ির সবাই এটা নিয়ে খুব চিন্তিত ! তারপর সেই যে ইউএসতে গেল আর আসার নাম নেই । ঠিক মত ফোনটোন দেয় না । তারপর জাকিরের কাছ থেকে শুনতে পেলাম যে তুমি অফিসে গিয়েছিলে । ব্রেক আপ করে এসেছো !
জাকির টা কে?
তন্বী মনে করার চেষ্টা করলো । তারপর মনে পড়লো । ফারিজের সেই পিএস টাইপের ছেলেটা !
তন্বীর মা বলল, ফারিজ আর তোমার মাঝে সেদিন রাতে কি হয়েছে সেটাও জাকির শুনেছে । প্রথমে বলতে চাইছিলো না তবে আমি ধকম দেওয়াতে বলেছে !
কথাটা শোনার সাথে সাথে তন্বীর বুকটা কেঁপে উঠলো । একটা তীব্র লজ্জার অনুভূতি পুরো শরীর জুড়ে বয়ে গেল । নিচের দিকে তাকিয়ে ফেলল । ইচ্ছে হচ্ছিলো এখনই মাটির সাথে মিশে যায় সে ।
-এতো বড় সাহস বেয়াদপ টার । ওর বাবা কিংবা দাদু যদি এই কথা জানতে পারে তাহলে ওর পিঠের ছাপ তুলে ফেলবে একেবারে ! তুমি যে রাগ করে ব্রেক করেছো সেটা আমি বুঝতে পারছি ! কিন্তু মা এভাবে কিছু করা তো ঠিকনা । তুমি এভাবে ছেড়ে দিবে ?
তন্বী মুখ তুলে তাকালো ! সে কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না ।
ফারিজের মা বলল, শুনো মেয়ে নিজের অধিকার নিজে আদায় করে নিতে হয় । বুঝেছো ? এভাবে ছেড়ে দিতে নেই ।
-মানে ?
-বোকা মেয়ে বলে কি ! মানে আবার কি কথা ! তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে খুব । কেবল আমারই না পরিবারের সবাই । আমরা কোন ভাবেই চাই না তোমাকে যেতে দিতে । অন্তত এখন আরও না ।
এখন তো আরও না বলতে ফারিজের আম্মু কি বোঝাতে চেয়েছে সেটা তন্বীর বুঝতে মোটেও কষ্ট হল না ।
-আমি তো সারা জীবন ফারিজের বাবা কথা মত চলে এসেছি । আমার শ্বাশুড়িও তাই । কোন দিন তাদের ছেড়ে যাওয়ার কথা মনেও আনি নি । কিন্তু তোমার ভেতরে একটা অন্য ভাব আছে । এই যে একটা ড্যাম কেয়ার ভাব এটা আছে ! এটা ফারিজকে সোজা করবে ! আর ফারিজ এই কটা দিন খুবই টেনশনে ছিল । বলাই বাহুল্য তোমাকে নিয়ে ! ফারিজের ইগো বেশি তো এই জন্য তোমার কাছে যে আসছে না নয়তো চলে আসতো । যাই হোক এই সব ভেবে এখন লাভ নেই । আজকেই সব সমাধান হয়ে যাবে !
-মানে?
-মানে তুমি বুঝবে একটু পরেই । ফারিজ ল্যান্ড করে ফেলেছে । একটু পরেই সে এখানে চলে আসবে । তাকে যদিও কিছু বলি নি । ওর দাদু আর তোমার বাবা গিয়েছে ফারিজকে আনতে । দাদুর সামনে কিছু বলতে পারবে না ও । ফারিজের বাবা অবশ্য বেশ ব্যস্ত । সে আজকে হয়তো আসতে পারবে না এখানে । তাকে আমি সব বলেছি । সে আপত্তি করে নি ।
তন্বীর মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হল না । কেবল সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো । সে যেন কিছুই বুঝতে পারছে না । এসব কি হচ্ছে ওর সাথে আর কেন হচ্ছে ! সামনে দাড়ালো এই মহিলা কি বলছে !
ঘন্টা খানেক পরে যা ঘটতে শুরু করলো তার জন্য তন্বী মোটেই প্রস্তুত ছিল না । ফারিজ তীব্র বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিল তন্বীর দিকে ঠিক একই ভাবে তন্বীও তাকিয়ে রয়েছে ফারিজের দিকে । কি হচ্ছে দুজনের কেউ বুঝতে পারছে না । কেউ বাঁধাও দিতে পারছে না । ফারিজের দুই পাশে ওর বাবা আর দাদু বসে আছে । একেবারে শেষ মুহুর্তে সে চলে এসেছে ছেলের বিয়েছে !
হ্যা । ওর দাদু ঠিক করেছে অনেক হয়েছে । এখনই ওদের বিয়ে হয়ে যাবে । পরে একটা সময় সুযোগ বুঝে অনুষ্ঠান করা হবে । ফারিজ গত একমাস যে খুব কষ্ঠে থেকেছে এটা সে দাদু হিসাবে দেখতে পারছে না । সবার ধারনা হয়েছে ফারিজের এই অবস্থা হয়েছে কারন তন্বী ওর সাথে ব্রেক আপ করেছে । তাই এখন এমন ব্যবস্থা করা হবে যেন আর ব্রেক আপ না হতে পারে !
তন্বীর এক পাশে ওর মা বসেছে আর অন্য পাশে ফারিজের দিম্মা বসেছে । তন্বী মা খুশি । এতোদিন সে তন্বীর বিয়ে নিয়ে কত চিন্তা করছিলো পরে ফারিজদের মত পরিবারে তন্বীর বিয়ে হচ্ছে এটা জানতে পেরে সে আর কোন আপত্তি করে নি । তন্বীর বাবা একটু বলতে চেয়েছিলো যে এতো তাড়াহুড়ার দরকার কি ছিল । তবে সবার সামনে সেই আপত্তি টেকে নি ।
রাত এগারোটার ভেতরে তন্বী আর ফারিজের বিয়ে হয়ে গেল । ফারিজ কিংবা তন্বী কেউ তখনও ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছে না । তাদের দুইজনেরই মনে হচ্ছে যেন তারা কোন স্বপ্ন দেখছে । এখনই সে ঘুম ভেঙ্গে যাবে । ঘুম ভেঙ্গে সব কিছু আগের মত হয়ে যাবে ।
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে ফেরার আগে ফারিজের মা তন্বীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো । তারপর বলল, এখন থেকে তুমি আমাদের পরিবারের অংশ । বুঝতে পেরেছো কি ? এখন থেকে বস কিছুর উপর তোমার অধিকার রয়েছে । বুঝেছো মেয়ে ?
তন্বী কেবল মাথা নাড়ালো ।
-খুব জলদি তোমাকে আমাদের বাসায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবো । তার মানে এই না যে তুমি আমাদের বাসায় আসতে পারবে না । এখন থেকে তোমার দুইটা বাড়ি । দুই বাড়িতে নিয়মিত যাওয়া আসা করবে ।
তন্বী আবারও মাথা নাড়ালো ।
রাতে তন্বীর ঘুম এল না কিছুতেই । কি থেকে কি হয়ে গেল আর কিভাবে হিসাবে হয়ে কিছুই বুঝতে পারলো না সে ! কেবল একটা কথাই তার মনে হচ্ছে সেদিন যদি সেই এক ক্যান বিয়ার সে না খেত তাহলে আজকে তার ফারিজের সাথে বিয়ে হত !
আট
তন্বী কেন যে ফারিজের অফিসে এসে হাজির হল সেটা ও নিজেও বলতে পারবে না। বাসা থেকে সে বের হয়েছিলো অফিসের যাওয়ার উদ্দেশ্যেই । বের হওয়ার সময় তন্বীর মা ওর দিকে খানিকটা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
-তুই আজকেও অফিস যাবি ?
তন্বী তার থেকেও অবাক হয়ে বলল,
-অফিসে যাবো না কেন ?
-বাহ রে ! কাল না তোর বিয়ে হল !
ফারিজের সাথে বিয়ে হওয়াতে সবথেকে বেশি খুশি হয়েছে তন্বীর মা । সে সবসময়ই চাইতো তন্বীর যেন একটা ভাল জায়গাতে বিয়ে হয়। তার ইচ্ছে ছিল তন্বীর বাবার মতই একজন সরকারী কর্মকর্তার সাথে ওর বিয়ে হোক । সারাজীবন সে যেমন আর্থিকভাবে নিশ্চিত থেকেছে, তার মেয়েও যেন তেমনই থাকে সেটাই চেয়েছে । তবে ফারিজের সাথে বিয়ে হওয়াতে তন্বীর মা খুব বেশি খুশি হয়েছে ।
তন্বী মায়ের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে বের হয়ে গেল ঘর থেকে । গেট দিয়ে বের হতেই দেখতে পেল মার্সিটিজ গাড়িটা ।
ও বের হওয়ার সাথে সাথে দরজা খুলে মনজুরকে বের হতে দেখলো ।
তন্বী বলল,
-তুমি এখানে ?
মনজুর হাসলো । তারপর বলল,
-জি, আজ থেকে আমার ডিউটি আপনার এখানে ।
-মানে ?
বলেই বুঝতে পারলো কারণটা । এখন তো সে আর সাধারণ কেউ নয় । মনজুর বলল,
-আপনার জন্য গাড়ির অর্ডার দেওয়া হয়েছে । সেটা যতদিন না আসছে ততদিন এইটা আপনার !
-তা আমি এটাতে চড়লে তোমার স্যার কোনটাতে চড়বে ?
-স্যারের আরেকটা গাড়ি আছে ।
মনজুর দরজা খুলে দিল । গাড়িতে উঠে বসতে বসতে তন্বীর মনে হল আজকে ও অফিস যাবে না । আপাতত অফিসে কাজের চাপ নেই । কালপরশু থেকে কাজ শুরু করা যাবে ।
-ম্যাডাম কোনদিকে যাবো । অফিসের দিকে ?
-না । তোমার স্যারের অফিসে চল !
-জি আচ্ছা ।
তন্বীর বিয়ের কথা বাইরে এখনও প্রকাশ পায় নি । তবে ফারিজের অফিসে পৌঁছানোর পরেই কেন জানি মনে হল যে অফিসের সবাই ব্যাপারটা জেনে গেছে । গতদিন সেই রিসিপশনের মেয়েটা ওকে দেখতেই দাঁড়িয়ে সালাম দিল । তারপর যতজনের সাথে দেখা হল প্রতিটা মানুষ উঠে দাঁড়ালো । তন্বী ঠিক বুঝতে পারলো না যে এই একদিনের ভেতরে ওকে সবাই চিনে ফেলল কিভাবে ?
আর খবরটা জানলোই বা কিভাবে ?
ফারিজের কেবিনের সামনে এসে গতদিনের মতই জাকিরকে ও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো । জাকিরের চেহারা দেখেই বুঝতে পারছে যে আজকে ওকে আটকানোর কোন চেষ্টা সে করবে না । তন্বী দাঁড়িয়ে পড়ে জাকিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
-আপনার স্যার কোথায় ?
জাকির বিগলিত হাসি দিয়ে বলল,
-স্যার ভেতরেই আছে । আপনি যে এসেছেন এই খবর তার কাছে পৌঁছে গিয়েছে ।
-আজকে আটকাবেন না আমাকে ?
-কি যে বলেন ম্যাডাম ! হে হে হে !
তন্বী আর কিছু জানতে না চেয়ে দরজাতে হাত রাখলো । নিজেই দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো । ওর মনে অদ্ভুত একটা অনুভুতি হচ্ছে । এই অনুভূতিটা ও ধরতে পারছে না । এমন কেন হচ্ছে সেটা ওর ধারণার বাইরে । দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখতে পেল তাকে । আজকে সে টেবিলের উপরে খানিকটা হেলান দিয়ে বসে আছে । ঘরে ঢুকতেই প্রথমেই চোখাচোখি হল তন্বীর সাথে । তন্বী সেখানেই থেমে গেল ।
গতমাসে যখন এসেছিলো তখন ওর মাথার ভেতরে অন্যকিছু চলছিলো । তাই ফারিজকে ও ভাল করে লক্ষ্য করে নি । আজকে ভাল করেই লক্ষ্য করলো তাকে । আবারও ওর মাথার ভেতরে চক্কর দিয়ে উঠলো । তবে এইবার মাথার ভেতরের সেই অনুভূতিটার ভিন্ন একটা রূপ কাজ করছে । সামনে দাঁড়ানো এই মানুষটা ওর স্বামী ! কি আশ্চর্য একটা ব্যাপার !
ফারিজ তন্বীর দিকে তাকিয়ে বলল,
-কি ব্যাপার এখানে কেন ?
তন্বী খানিকটা সামলে নিল । ফারিজের কন্ঠটা কেমন যেন একটু রুক্ষ্ণ শোনাচ্ছে । তন্বী অবশ্য খুব একটা তোয়াক্কা করলো না । বলল,
-এমনি এলাম তোমাকে দেখতে !
-আমাকে দেখার কি আছে?
-কিছু নেই?
বলে আরেকবার ফারিজের দিকে ভাল করে তাকালো । এমনভাবেই তাকালো যে তন্বী অনুভব করলো ফারিজ যেন খানিকটা অস্বস্তিবোধ করছে । শেষে আর না থাকতে পেরে ফারিজ বলল,
-কি বেয়াদবের মত তাকিয়ে আছো তুমি ?
তন্বী বলল,
-বাহ তুমি আমাকে বেহুশ পেয়ে বেয়াদবের মত আচরণ করতে পারবে আর আমি আমার বিয়ে করা স্বামীর দিকে ভাল করে তাকাতেও পারবো না ?
ফারিজ কিছু বলতে গিয়েও আটকে গেল । কি বলবে সেটা সত্যিই বুঝতে পারলো না । কথাটা হজম করতে যেন ওর একটু সময় লাগছে । তন্বী বলল,
-আমি তোমার সাথে ব্রেকআপ করে গিয়েছিলাম বলে কি বিরহেই না তুমি পড়ে গিয়েছিলে । শুনলাম নাকি রাতে ঘুমাতেই পারো নি । তা কাল রাতে ঘুম হয়েছে তো ?
ফারিজ খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তন্বীর দিকে । সত্যিই কিছু বুঝতে পারছে না । মেয়েটির আচরণ কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগছে । এমন কেন হচ্ছে সে নিজেও বুঝতে পারছে না । তবে অবাক করে দেওয়ার ব্যাপার হচ্ছে কাল রাতে সত্যিই তার ঘুম ভাল হয়েছে । বেশ ভালই হয়েছে । কেন ভাল হয়েছে সেটার কোন ব্যাখ্যা তার কাছে ছিল না । যেখানে গতরাতে এমনভাবে ওদের বিয়েটা হয়েছিলো ফারিজ ভেবেছিলো হয়তো সারারাত নির্ঘুম কাটাতে হবে ।
ফারিজ বলল,
-তোমার সাথে আমার সাথে কি ডিল হয়েছিলো মনে আছে তো তোমার?
তন্বী হাসলো । তারপর বলল,
-হাহ ! আসছে ! শুনো, সেই ডিল সেইদিনই শেষ ।
তারপর ফারিজকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তন্বী ঘর থেকে বের হয়ে গেল । ফারিজ কিছুটা সময় তন্বীর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলো একভাবে । ও এখনও ঠিক বুঝতে পারছে না আসলে কি হচ্ছে । এই মেয়ে এতো সাহস পেল কিভাবে !
কিন্তু ফারিজের সম্ভবত তন্বীর ব্যাপারে ভুল ধারণা জন্মেছিলো । সে ভেবেছিলো যে সে ঠিকই তার কাজ করিয়ে নিতে পারবে । তন্বীর ব্যাপার তার অনুভূতির কোন ব্যাখ্যা নেই । তবে মেয়েটা যে তার জীবনে অন্য সাধারণ কোন মেয়ের মত নয় সেটা বুঝতে পারলো আরও কয়েকদিন পরে । বিয়ের পর তন্বী প্রায়ই ফারিজদের বাসায় গিয়ে ঘুরে যেত । বিশেষ করে অফিস শেষ করে নিজের বাসায় ফেরার আগে ওদের বাসা হয়ে যেত । ফারিজের সাথে মাঝে মধ্যে দেখা হত । ফারিজ অন্তত এটা বুঝে গেল যে এই মেয়েটা তাদের পরিবারের ভেতরে আস্তে আস্তে একটা শক্ত আসন গেড়ে বসছে । অথচ সে কি চেয়েছিলো ?
সে চেয়েছিলো মেয়েটার সাথে একটু মেলামেশা শুরু করলেই এলাইনা সুরসুর করে তার কাছে ফিরে আসবে । কিন্তু এদিকে সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল । পরিকল্পনামাফিক কোন কাজ হল না ।
বিয়ের ঠিক মাসখানেক পরে এলাইনা ফারিজের অফিসে এসে হাজির হল । এলাইনাকে দেখে ফারিজ খানিকটা অবাকই হল । ভেবেছিলো হয়তো এই মেয়ে ওকে ভুলেই গিয়েছে । এলাইনার চোখ দেখেই বুঝতে পারছিলো যে কিছু হয়েছে !
ফারিজকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলো,
-ঐ মেয়েকে তুমি বিয়ে করেছো?
ফারিজ কি বলবে বুঝতে পারলো না । বিয়ে যে করেছে সেটা তো মিথ্যা না ।
এলাইনা এবার সরাসরি এসে ফারিজকে জড়িয়ে ধরলো । ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল,
-আমি বুঝতে পারি নি । আমি ভেবেছি যে আমি হয়তো তোমাকে ভালবাসি না । আর মনে হয়েছে তুমি আমার কাছে ফিরে আসবে । আমি জানি ঐ মেয়েকে তুমি ভালবাসো না । তোমার বাসা থেকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে !
ফারিজ কিছু বলতে যাবে তখনই ওর কেবিনের দরজা খুলে গেল । দেখতে পেল সেখানে তন্বী দাঁড়িয়ে আছে !
এই রে সর্বনাশ করেছে!
এই মেয়ে এখানে কেন!
ফারিজ ভেবেছিলো তন্বী বুঝি এবার রাগ করে চলে যাবে । আর ওর কাছে ফিরে আসবে না । ওর নামে কেস করবো । একটা বড় পরিমাণ টাকা কম্পেনসেশন দিতে হবে । কিন্তু এসবের কিছুই হল না । তন্বী রাগান্বিত চোখে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো । এলাইনা ততক্ষণে ফারিজকে ছেড়ে দিয়েছে । তন্বী সোজা এগিয়ে এল । তারপর এলাইনা আর ফারিজকে অবাক করে দিয়ে খপ করে এলাইনার চুল চেপে ধরলো ! তারপর এক প্রকার টানতে টানতে কেবিনের বাইরে নিয়ে গেল । এলাইনা কিছু বলা তো দূরে থাকুক তীব্র বিস্ময়ে কিছু সময় ফারিজের দিকে তাকিয়ে রইলো । আশা করেছিলো ফারিজ হয়তো কিছু বলবে কিন্তু ফারিজ কিছুই বলল না । ফারিজ বলবে কি ওর নিজেরই বিস্ময় কাটছে না । এমন কিছু যে হতে পারে, এই মেয়ে যে এমন কিছু করতে পারে সেটা সে ভাবতেই পারে নি !
মিনিটখানেক পরেই তন্বী আবারও ফিরে এল ওর কেবিনে । এসেই দরজা বন্ধ করে দিল ! ফারিজ তন্বীর চোখের দিকে তাকিয়ে জীবনে প্রথমবারের মত কোন মেয়েকে ভয় পেল । ওর বুকের ভেতরে একটা অদ্ভুত ভয় কাজ করতে শুরু করলো । যে মেয়ে এইভাবে আরেকটা মেয়েকে চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে যেতে পারে, সে মেয়ে যে কোন কিছু করতে পারে !
ফারিজ ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে রইলো তন্বীর দিকে । মেয়েটা কি করবে এখন ?
শেষ পর্ব
ফারিজ নিজের মায়ের দিকে বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো । তার মা রেবেকা সুলতানা নিজের হাসি থামাতে পারছেন না । হাসতে হাসতে তার চোখে পানি চলে এসেছে । পাশে ফারিজের দিম্মা বসে আছেন, তিনিও হাসছেন । ফারিজ খানিকটা বিরক্ত হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-ও, কাম আন মম । এভাবে হাসবে না তো !
রেবেকা সুলতানা আরও কিছু সময় হাসলেন প্রাণভরে । তারপর নিজের হাসি থামিয়ে বললেন,
-ও এমনটা করলো আর তুই সেটা মেনে নিলি ?
তারপর আবারও কিছু সময় হাসি !
ফারিজ কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল । সত্যিই তো । এই ব্যাপারটা তো সে মোটেও ভেবে দেখেনি । তাই তো ! সে তন্বীর ঐ আচরণটা কিভাবে মেনে নিলো ! তখন কিছু বলতে পারলো না কেন ! আর এখন এসে মায়ের কাছে কেন বলছে এইসব । ফারিজের নিজের কাছেই নিজের আচরণ কেমন যেন অবাক করা মনে হল । এমন তো হওয়ার কথা না ।
আচ্ছা সত্যিই সে তন্বীকে কিছু বলতে পারলো না কেন ?
মায়ের কাছে তো আসল কথা সে এখনও বলেই নি । তন্বী কেবল এলাইনাকে চুল ধরে অফিস থেকে বের করে দিয়ে আসে নি । রিসিপশনের মেয়েটার কাছ থেকে জাকির শুনে এসেছে তন্বী ঠিক কী করেছে । ফারিজ কেবল কেবিনে যা হয়েছে সেটা দেখেছে । বাইরে আসলে কি হয়েছে সেটা ফারিজ দেখে নি । অফিসে সবার সামনেই তন্বী একেবারে চুলের মুঠি ধরেই এলাইনাকে বাইরে গেটের কাছে নিয়ে যায় । তারপর ধাক্কা দিয়ে বাইরে বের করে । আঙ্গুল তুলে এলাইনার দিকে শাসিয়ে বলে,
-এরপর থেকে আমার স্বামীর আশেপাশে যেন তোমাকে না দেখি । অন্যের স্বামীর দিকে নজর দাও, এতো বড় নির্লজ্জ কিভাবে হলে ? বাবা মা শেখায় নি কিছু তোমাকে !
তারপর রিসিপশনের মেয়েটা আর গার্ড লোকটার দিকে তাকিয়ে বলে,
-শুনো, এই মেয়ে যেন কোনভাবেই এই গেট দিয়ে না ঢুকতে পারে । যদি ঢোকে তাহলে তোমাদের চাকরি আমি খেয়ে ফেলবো । মনে থাকে যেন !
এই ঘটনা সবাই দেখেছে । কিন্তু এরপর তন্বী কেবিনে এসে কি করেছে সেটা কেউ দেখে নি । সেটা কেবল ফারিজ আর তন্বীর ভেতরেই সীমাবদ্ধ আছে । কথাটা সে মাকে বলবে কিনা বুঝতে পারছে না । বললে আরও একদফা অপদস্থ হতে হবে মা আর দিম্মার কাছে ।
ফারিজের দিম্মা বললেন,
-বল কেন কিছু বলতে পারিস নি ?
ফারিজ চুপ করে রইলো । দিম্মা বলল,
-তোর দাদা আর বাবা যেমন তুই তেমনই হয়েছিস ?
-মানে কি ?
-মানে হচ্ছে দুনিয়ার সবার সাথে বাহাদুরী করলেও তোরা বউয়ের কাছে একেবারে ভেজা বেড়াল । তোর দাদাকে বাড়ি আর অফিসের সবাই জমের মত ভয় পেত তখন কিন্তু আমার সামনে আসলেই তার জারিজুরি সব ঠান্ডা । তোর বাবার বেলাতেও তাই । আর এখন দেখছি তুইও তাই হয়েছিস !
এই বলে বউ শ্বাশুড়ি মিলে আরেক দফা হেসে নিল । ফারিজ বুঝলো যে এখানে দাঁড়িয়ে থাকা মানে হচ্ছে হাসির পাত্র হওয়া । সে নিজের ঘরের দিকে হাটা দিল । মাথা ঠান্ডা করা দরকার । নিজের ঐ বাসাটায় এখন যেতে পারলে ভাল হত । হাতে ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে সুইমিংপুলে কিছু সময় নিজের শরীর ডুবিয়ে রাখলে হয়তো মাথা ঠান্ডা হবে । সবকিছু মাথা থেকে দূর হবে ।
রাতে ডিনারের পরেই রেবেকা সুলতাকার ফোনটা বেজে উঠলো । মোবাইল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে তার ভ্রু খানিকটা কুচকে উঠলো । এই মহিলাকে তিনি মোটেই পছন্দ করেন না । তবুও নিজেকে যথাযথভাবে শান্ত করে ফোনটা ধরলেন ।
-হ্যালো ।
-ভাবী এটা কি শুনছি ?
-কি শুনছেন ?
-আপনার ছেলের বউ নাকি এলাইনার গায়ে হাত তুলেছে !
-কই আমি তো এসব জানি না ।
-ভাবী, আপনার এর একটা বিচার করতে হবে । কোথাকার কোন দুই পয়সার মেয়ে আমার মেয়ের গায়ে হাত তোলে !
-ভাবী, তন্বী এখন এই বাড়ির বউ এটা মনে রাখবেন । আর নিজের স্বামীর দিকে যদি অন্য নারী চোখ দেয়, আমি হলে তো সেই চোখ কাঁটাচামচ দিয়ে তুলে নিতাম । তন্বী তো ভদ্র অনেক । কেবল চুল ধরে বের করে দিয়েছে । আপনার মেয়েকে বলবেন সে যেন ফারিজের উপর থেকে নিজের কুদৃষ্টি সরিয়ে নেয় । একসময় ওদের মাঝে যা ছিল সেটা এখন অতীত । এখন ফারিজ অন্য কারোর স্বামী । এটা তাকে মনে রাখতে বলবেন !
রেবেকা সুলতানা আর কিছু না বলে ফোনটা রেখে দিলেন । ফোন রাখার পরে হঠাৎই মনে হল তার অনেক বেশি ভাল লাগছে । মনে মনে ঠিক করে নিলেন তন্বীকে একটা পুরস্কার দিতে হবে এই কাজের জন্য । কি দিতে হবে সেটা এখন ভাবতে হবে ।
এই এলাইনা কিংবা তার মাকে তিনি পছন্দ না করলেও ফারিজের জন্যই একদিন কথা বলতে গিয়েছিলেন । ফারিজ নিজ থেকে কিছু না বললেও মা হিসাবে রেবেকা সুলতানা ঠিকই বুঝতে পারতেন যে তার ছেলেটা ভাল নেই । সেইজন্যই কথাবার্তা বলতে গিয়েছিলো এলাইনার মায়ের সাথে । এলাইনার বাবার সাথে ফারিজের বাবার অনেক দিনের চেনা জানা । সেই সুবাদেই দুই পরিবারের কাছাকাছি আসা, যদিও রেবেকা সুলতানা কেন জানি কোনদিনই এদেরকে পছন্দ করতে পারেন নি । ফারিজের সাথে যখন এলাইনার বন্ধুত্ব একটা সম্পর্কের ভেতরে চলে গিয়েছিলো তখনও রেবেকার পছন্দ হয় নি । তবে তিনি কিছুই বলেন নি । ছেলের পছন্দ বলে কথা । চুপচাপ মেনে নিয়েছিলেন । তারপর মেয়েটা যখন ইচ্ছে করে ফারিজের সাথে সব সম্পর্ক নষ্ট করে দিল তখন মেয়েটার উপর প্রচন্ড রাগ হয়েছিলো । তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছিলেন যে এলাইনা তখন কোন এক ব্রিটিশ বিজনেসম্যানের প্রেমে মজেছে । তারপরেও ছেলের জন্য এলাইনার মায়ের কাছে গিয়েছিলেন তিনি । এলাইনাকে যেন বুঝিয়ে শুনিয়ে কিছু একটা করা হয় । সেদিন সরাসরি রেবেকা সুলতানাকে অপমান না করলেও এলাইনার মা একটু সুক্ষ্ণভাবে বুঝাতে চেয়েছিলেন যে তার মেয়ে এমন ফেলনা না যে যাকে তাকে বিয়ে করে ফেলবে ।
আর আজকে !
তন্বীকে কাছে পেলে আজই একটা বড় রকমের গিফট দেওয়া যেত । তবে সেটা তিনি এখন করতে পারছেন না । মেয়েটা আজকে এদিকে আসে নি ।
রাত একটার দিকে ফারিজ তন্বীদের বাসার সামনে গিয়ে হাজির হল । কেন হাজির হল সেটা সে নিজেও জানে না । খাওয়াদাওয়া শেষ করে তার কিছুতেই ঘুম আসছিলো না । বারবার মনে হচ্ছিলো অফিসে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা । মেয়েটার সাহস দেখে সে সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছিলো । এতো সাহস তন্বী কিভাবে পেল ?
আজও মনে আছে সেদিন সেই হোটেলে মেয়েটা কেমন কুকড়ে ছিল । ভয়ে একেবারে কাঠ হয়ে গিয়েছিলো। আর আজ এই মেয়েই কিনা ওর শরীর থেকে জামা খুলে নিল !
ব্যাপারটা সে মোটেই ভাবতে চায় না । তারপরেও দৃশ্যটা বারবার তার চোখের সামনে চলেই আসছে । এলাইনাকে অফিসের বাইরে রেখে এসে তন্বী আবার ফারিজের কেবিনে এসে হাজির হয়েছিলো । কোন কারণ নেই কিন্তু তন্বীর চোখের দিকে তাকিয়ে ফারিজের কেমন যেন ভয় করলো । সামনে দাঁড়ানো মেয়েটি এখন তার স্ত্রী এবং এই মেয়েটি তাকে একটু আগেই অন্য একটা মেয়ের সাথে দেখেছে ।
একটু তো ভয় পাওয়ারই কথা, তাই না ?
তন্বী একভাবে বেশ কিছু সময় কেবল ফারিজের দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর ঠান্ডা গলায় বলল,
-এই শার্টই তো জড়িয়ে ধরেছিলো, তাই না ? এটা খুলো !
-মানে ?
-মানে জামা খুলতে বলেছি ।
-পাগল নাকি !
-খুলবা না?
ফারিজ মনে মনে ঠিক করে ফেলল যে খুলবে না । এই মেয়ে কি করতে পারে ? কিছুই না । এটা তার অফিস । তার নিজের এলাকা ! এইখানে এই মেয়ে কিছুই করতে পারবে না । ফারিজ বলল,
-খুলবো না ।
তবে গলার স্বরে কেন জানি ঠিক বল পেল না । সে নিজেও ঠিক বুঝতে পারছিলো না যে এই মেয়েকে সে ভয় কেন পাচ্ছে ! এই মেয়েকে ভয় পাওয়ার কি কোন কারণ আছে ?
নেই তো!
তবে ফারিজের ভুলটা ভাঙ্গলো একটু পরেই । ফারিজ তন্বীর দিকেই তাকিয়ে ছিল । মনে মনে ভাবছিলো মেয়েটা কি করবে এখন ?
তখনই দেখতে পেল তন্বী এদিক
ওদিক তাকাচ্ছে । একদিকে তাকিয়ে ওর চোখ স্থির হয়ে গেল । ফারিজের টেবিলের ঠিক ডানদিকে একটা বড় ফুলদানি রয়েছে । বেশ দামী সেটা । তন্বী সেটার কাছে গেল এবং ফারিজকে অবাক করে দিয়ে সেটা লাথি মেরে মেঝেতে ফেলে দিল । পড়ার সাথে সাথেই সেটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল । ফারিজ মুখ হা করে কেবল তাকিয়ে রইলো সেদিকে । সে সত্যিই ভাবতেও পারে নি যে তন্বী এই কাজটা করবে । তন্বী ফারিজের দিকে তাকিয়ে বলল,
-খুলবে না ? না ? দাঁড়াও !
তন্বীর চোখ আবার এদিকওদিক নড়তে শুরু করলো । সে নতুন কিছু খুঁজছে ! পেয়ে গেলে সাথে সাথেই । টেবিলের উপরে রাখা পিসির মনিটর ! ফারিজকে আরও অবাক করে দিয়ে তন্বী পিসির মনিটরটা টেনে নামালো । তারপর সর্বশক্তি দিয়ে মেঝেতে আছাড় মারলো । ফারিজ এতোই অবাক হয়ে গেল যে একটা কথা পর্যন্ত বলতে পারলো না । কেউ তার নিজের অফিসে এসে এমন কিছু করতে পারে সেটা ফারিজের ধারণর বাইরে ছিল । অবাক হয়ে একবার মনিটরের দিকে আরেকবার তন্বীর দিকে তাকাতে লাগলো । মনের ভেতরে কু ডেকে উঠলো । বুঝতে কষ্ট হল না যে এই মেয়ে ততক্ষণ পর্যন্ত থামবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না ফারিজ তার কথা শুনবে ।
এইবার তন্বী টেবিলের উপরে রাখা ল্যাপটপটার দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করলো ! সেদিকে এগোতে যাবে এমন সময় ফারিজ বলল,
-দাঁড়াও দাঁড়াও প্লিজ ! ওয়েট ! ওয়েট । ওর ভেতরে দরকার জিনিসপত্র রয়েছে ।
-লাইক আই কেয়ার !
-ওকে ওকে বাবা, ওকে ! আমি শার্ট খুলছি !
ফারিজ নিজের শার্ট খুলে তন্বীর হাতে দিল । তন্বী শার্টটার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । তারপর সেটা পায়ের কাছে ফেলে বেশ কিছু সময় পা দিয়ে চটকালো । ফারিজের দিকে তাকিয়ে বলল,
-এই শার্টে ওই মেয়ের স্পর্শ রয়েছে । এটা এই দুনিয়াতে থাকবে না ! দিয়াশলাই দাও !
-দিয়াশলাই?
-হ্যা । কোথায়?
ফারিজ নিজের পকেট থেকেই একটা লাইটার বের করে দিল । তন্বীর লাইটারটা নিয়ে পা দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে শার্টটা নিয়ে গেল ওয়াশরুমের দিকে । এমন একটা ভাব যেন শার্টটার থেকে ঘৃণ্য বস্তু আর কিছু নেই দুনিয়াতে । এবং সত্যি সত্যিই ওয়াশরুমে গিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল সেটাতে । ওয়াশরুমের দরজাটা খোলাই ছিল সেখান থেকে পোড়া গন্ধ আসতে থাকলো । তন্বী বের হয়ে এল একটু পরে । ফারিজের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো ।
তারপর দরজার পাশে পড়ে থাকা একটা প্যাকেট ছুঁড়ে দিল ফারিজের দিকে । তন্বী যখন প্রথম ঘরে ঢুকেছিলো তখনই হাতে করে এটা এনেছিলো । তন্বী আর দাঁড়ালো না । দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল ।
তন্বী চলে যাওয়ার পর কিছু সময় ফারিজ কেবল বোকার মত দাঁড়িয়ে রইলো । মেয়েটা ওর সাথে কি করলো সেটা এখনও ওর মাথায় ঢুকছে না ঠিকঠাক মত !
তবে প্যাকেটটা বের করে খানিকটা অবাক হল । একটা নীল রংয়ের শার্ট । পুরো ব্যাপারটা বুঝতে কষ্ট হল না । তন্বী ফারিজের জন্য এই শার্টটা কিনে এনেছিলো তাকে দেওয়ার জন্য । কেবিনে ঢুকেই এলাইনাকে দেখতে পায় তারপর ওর মাথা খারাপ হয়ে যায় !
তন্বীদের বাসার সামনে এসে ফারিজ আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করলো । কেন যে এখানে এসেছে সেটা ফারিজ নিজেও জানে না । বেশ কিছু সময় দাঁড়িয়ে থেকে আবারও সামনে রাখা গাড়িটার দিকে পা বাড়ালো । গাড়ির দরজা খুলতে যাবে তখনই ফোন বেজে উঠলো । নাম্বারটা দেখেই চোখ খানিকটা কপালে উঠলো ।
তন্বী ফোন দিয়েছে ।
-হ্যালো !
-কি ব্যাপার, চলে যাচ্ছো কেন ?
-তুমি কোথায় ?
-আমি যেখানেই থাকি । আমার বাড়ির সামনে চলে এসে আবার চলে যাচ্ছো কেন ?
ফারিজ ঘুরে দাঁড়ালো । তন্বীদের ফ্লাটের দিকে তাকালো । সব রুমের আলোই বন্ধ । তন্বী ওকে দেখলো কিভাবে ?
ফারিজ কোন কিছু বলছে না দেখে তন্বী আবারও বলল,
-উপরে আসবা ?
-না ।
-আমি নিচে আসবো ?
ফারিজ কিছু সময় নিল প্রশ্নটার জবাব দিতে । তারপর বলল,
-আসো !
প্রায় সাথে সাথেই বাড়ির গেটটা খুলে গেল । তন্বী যেন গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল । ফারিজ কি বলবে বুঝতে পারলো না । দেখতে পেল তন্বী একটা টিশার্ট পরে আছে । সাথে একটা লেগিংস । ঘরের পোশাক । ল্যাম্পপোস্টের আলোতে তন্বীর এলোমেলো চুল দেখতে বেশ চমৎকার লাগছে !
মেয়েটা এতো জলদি কিভাবে নেমে এল ?
সম্ভবত তন্বী যখন গাড়ি নিয়ে এসেছে তখনই তয়কে দেখতে পেয়েছে । তারপরই নেমে এসেছে । তন্বী কয়েক পা এগিয়ে এল ফারিজের দিকে । তার দিকে তাকিয়ে বলল,
-নীল শার্টে তোমাকে ভাল মানিয়েছে ।
ফারিজ অনেকটা সময় চুপ করে তাকিয়ে রইলো তন্বীর দিকে । তারপর বলল,
-সরি !
-সরি কেন ?
-এলাইনার ব্যাপারটার জন্য ! আমি আসলে বুঝতে পারি নি যে এলাইনা ওভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরবে ! আর কখনই হবে না !
-আচ্ছা ! আবারও হওয়ার সম্ভাবনা আছে নাকি ? শুনো, এবার যদি ঐ মেয়েকে তোমার আশেপাশে দেখি আগে ইট দিয়ে ঐ মেয়ের মাথা ফাটাবো তারপর তোমার মাথা ভেঙ্গে দিবো !
ফারিজ হেসে ফেলল । তন্বী এই কাজটা করতেই পারে । আজকে সে তন্বীর যে রূপ দেখেছে তাতে তন্বী যেকোন কিছু করতে পারে । কিন্তু মেয়েটা যে এতোটা পোজেসিভ হবে সেটা সে মোটেই ভাবতে পারে নি ।
-আচ্ছা আমি যাই!
-আচ্ছা !
ফারিজ গাড়ির দিকে ঘুরতে গিয়েও থেমে গেল । তারপর তন্বীর দিকে তাকিয়ে বলল,
-আমার সাথে যাবে ?
-কোথায় ?
-কোথাও না । কিছু সময় গাড়িতে করে ঘুরি । তারপর তুমি চাইলে এখানে নামিয়ে দিবো ।
-আর না চাইলে !
ফারিজ কি বলবে খুঁজে পেল না । এই মেয়েকে সে সত্যিই বুঝতে পারছে না । ফারিজ বলল,
-আমি আসলে আমার ঐ বেরিবাধের বাড়িতে যাচ্ছিলাম । যাবে তুমি ?
-তারপর ? আমাকে একা পেয়ে কি করবে শুনি ? ঐদিন কি করেছিলে মনে আছে ?
ফারিজ বলল,
-আমি ঐদিন কিছুই করি নি ! তোমার পোশাক বদলেছি কেবল । ভয়ানক অবস্থা ছিল পোশাকের ! বিলিভ মি !
তন্বী বলল,
-কিছু করবে না ? তাহলে আর গিয়ে লাভ কি বল ! বাসায় থাকি !
ফারিজ সত্যিই অবাক হয়ে গেল । এই মেয়েকে সে কোনদিন বুঝতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না । তার বাবা কোনদিন ঠিকঠাক মত তার মাকে বুঝতে পারে নি । এখনও সে দেখে যে মায়ের রাগ ভাঙ্গাতে কিংবা মন পেতে তার বাবাকে কত কিছু করতে হয় । তার তো অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাবে !
ফারিজকে আরও একটু অবাক করে দিয়ে তন্বী নিজেই ফারিজের গাড়িতে উঠে বসলো । ফারিজ এদিকওদিক তাকিয়ে নিজেও গাড়িতে উঠে বসলো । উঠে বসতেই দেখতে পেল তন্বীর হাতে বিয়ারের ক্যান । সিটের পেছনে ছিল । এক ক্রেন নিয়ে যাচ্ছিলো সে তার বাসায়।
ফারিজ বলল,
-আরে আরে কি কর !
-কেন ?
-না মানে তোমার তো সহ্য হয় না ।
তন্বী হাসলো আবার । ক্যানটা খুলতে খুলতে বলল,
-আজকে হুশ না থাকলে খুব একটা সমস্যা নেই ।
বলেই ক্যানে চুমুক দিল ! আজকে বিয়ারের ইফেক্ট নিয়ে ও চিন্তিত নয় ।
ছবি উৎস
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০২১ রাত ২:১৩